অবরোধে মজনু মিয়াদের ভাগ্যবিপর্যয়
মজনু মিয়া। গায়ে ছেঁড়া-ফাটা জামা। বসে আছেন জুরাইনের আলম মার্কেটের সামনে। অপেক্ষা কখন কেউ কিনে নেবে তার শ্রম। ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত তার নিষ্পল অপেক্ষা। মজনু মিয়া যখন তার ভাগ্যবিপর্যয়ের গল্প বলছিলেন, তখন তার চোখে ছিল জলটলমল। হৃদয়বিদারক এমন গল্পের নায়ক মজনু মিয়া একা নন। বিরোধী জোটের টানা অবরোধে কর্মহারা অনেক শ্রমিকই। জুরাইন, মালিবাগ রেললাইন, যাত্রাবাড়ী গোলচত্বর গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র। টানা অবরোধে বেকার হয়েছে কয়েক হাজার দিনমজুর। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে শ্রম বিক্রি করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা দিনহীন মানুষগুলো বর্তমানে চরম অর্থাভাবে রয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাদের কেউ কাজে নিতে চায় না। চলমান অবরোধের প্রথম দশ দিনে কেউ কাজ পেয়েছেন একদিন, কেউ দুই দিন; আবার কেউ একদিনও পাননি। এর মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে রোমহর্ষক ঘটনাও। ঘরভাড়া দিতে না পারা, স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাতে হিমশিম খাওয়াতো অহরহ ঘটছে। রোমহর্ষক ঘটনাটি মিলেছে শনির আখড়ার হাটে। আবদুল জলিল। তিনি কাজ করতেন গাজীপুরের হানিফ সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরিটি ৫ মাস ধরে বন্ধ। দিশাহারা হয়ে জলিল নেমে আসেন রাস্তায়। শনির আখড়ার হাটে নিজের শ্রম বিক্রির জন্য পুরনো রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে শরিক হন তিনি। প্রথম কয়েক দিন চললেও টানা অবরোধে কোন কাজ মিলছে না। চরম অর্থসঙ্কটে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে একদিন তার রান্নাঘরে আগুন জ্বলেনি। ছিলেন পুরোদিন উপোস। কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগে কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে তার। অনেকটাই কাছাকাছি জুরাইনের দুলালের ঘটনাও। তিনি প্রথমে কাজ করতেন শ্যামপুরের কে আলী সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। বন্ধ হয়ে যায় ফ্যাক্টরিটি। ছুটে যান পার্শ্ববর্তী ইউনি স্টার ফ্যাক্টরিতে। এটিও বন্ধ হয়ে যায় কিছুদিন পর। নিরুপায় হয়ে নাম লেখান দিনমজুরের খাতায়। রাজনৈতিক হাঙ্গামা সে খাতাও বন্ধ করে দেয়। দুলাল বলেন, পৃথিবীর সব খাতা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষায় আছি, মৃত্যুর খাতায় নাম লেখাবো। তিনি বলেন, অপরাধ একটাই জীবনে লেখাপড়া করতে পারিনি। নিম্নমানের কাজ করে জীবন চালিয়েছি। রাজনীতিবিদরা অবোধ-নির্বোধদের ব্যবহার করেছে। কিন্তু কিছুই দেয়নি। শনির আখড়ার কাঠমিস্ত্রি নজরুল ইসলাম প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দিনমজুরের পক্ষ থেকে বয়কট ও ঘৃণা করছি। তিনি নিজেকে গোপালগঞ্জের লোক পরিচয় দিয়ে বলেন, আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ হলেও আওয়ামী লীগকে অনেক বেশি ঘৃণা করি। একই সঙ্গে বিএনপিকেও। দুটো দল দিনমজুরের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তিনি বলেন, অবরোধ শুরুর পর থেকে চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা। কেউ দিনমজুর নিচ্ছে না। গত ১০ দিনে মাত্র একদিন কাজ পেয়েছি বলে জানান তিনি। মোহাম্মদ আলী যাত্রাবাড়ী হাটের মানবপণ্য। নিজের কর্মঘণ্টা বিক্রির জন্য তিনি প্রতিদিন খুব ভোরে আসেন। অবরোধে মাত্র দু’দিন কাজ পেয়েছেন। তিনি মাটির কাজ করেন। প্রথম দিন পেয়েছেন মাত্র ৫০ টাকা। দ্বিতীয় দিন ৩০০। বাকি ৮ দিন-ই কাজশূন্য। আবু সিদ্দিক রংমিস্ত্রির কাজ করেন। অবরোধে ৫ দিন কাজ পেয়েছেন। এর মধ্যে তার ক্ষতি হয়েছে ৩০০০ টাকা। কাঠমিস্ত্রি মনির হোসেন ৪ দিন কাজ পেয়েছেন। বাকি দিন কাজশূন্য। লোকসান প্রায় ৫০০০ টাকা। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ বাবর আলীর। ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ বলেন, সামান্য দিনমজুরের কাজ করে খেয়ে মরার নিশ্চিয়তা এ দেশে নেই। দু’দলের ব্যর্থতার মাশুল দিনমজুরের ঘাড়ে। জুরাইনের জসিমউদ্দিন জানান, অবরোধের ১০ দিনে একদিনও কাজ পাইনি। কোথায় ঘরভাড়ার টাকা, কোথায় পাবো ভাত; কিছুই জানি না। মালিবাগ মানবহাটের শুক্কুর মিয়া ও লালন মিস্ত্রি জানান, গত ৮ দিনে কোন কাজ পায়নি। মাসের অর্ধেক। এখনও ঘরভাড়া দিতে পারিনি। এবার বাড়িওয়ালা ঘরছাড়া করতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
No comments