তিনি ছিলেন জনমানুষের নেতা by ড. সুশান্ত দাস
আজ ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স
পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড অমল সেনের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। এ বছরই পালিত
হচ্ছে তার জন্মশতবর্ষ। সেদিক দিয়ে এ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করা
অন্যান্য বছরের চেয়ে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে।
সময় ও ইতিহাস প্রয়োজনে ক্ষণজন্মা মানুষদের তৈরি করে, আবার এরাই ইতিহাস তৈরি করে সময়কে এগিয়ে নেয়ার জন্য- এটাই সভ্যতার শিক্ষা। কমরেড অমল সেনদের আদর্শ ও কর্মকে বুঝতে হলে তাদের সময়কালটা বুঝতে হবে। তিনি জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই, যশোর জেলার আফরা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। মহামতি লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে সফল হয়েছিল রুশ বিপ্লব। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ বিপ্লবের অভিঘাত বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তৈরি করে এক যুগান্তকারী চেতনা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নতুন গতিবেগ আর দিকনির্দেশনা পায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহে বেড়ে ওঠা কমরেড অমল সেনও জড়িয়ে পড়েন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে এদেশেও। তিনি দ্রুতই আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি। তিনি আরাম-আয়েশে গড়ে ওঠা সামন্ত পরিবারের আবহ উপেক্ষা করে জায়গা করে নেন গরিব কৃষকের কুঁড়েঘরে। গড়ে তোলেন যশোর-নড়াইল অঞ্চলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন। এ কৃষক সংগ্রাম তৎকালীন রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। এ আন্দোলন কৃষকের কিছু দাবি নিয়ে গড়ে উঠেছিল ঠিকই; কিন্তু সীমাবদ্ধ থাকেনি তাতে। এ আন্দোলনের দোলাচলে যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর চেতনার এক নবদিগন্ত। কমরেড অমল সেন ছিলেন সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা। যখন নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে এসেছে, তখনও তিনি সামনে দাঁড়িয়েই তা সহ্য করেছেন। পাকিস্তান আমলে তাকে ১৯ বছর কাটাতে হয়েছে জেলে। জেলের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে তাকে ভয়াবহ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তিনি শত নির্যাতনেও দেশত্যাগ করেননি, ত্যাগ করেননি বিপ্লবী জীবন।
ব্যক্তিজীবনে অকৃতদার এ মানুষটির জীবনেও কম টানাপোড়েন আসেনি। তিনি তা মোকাবেলা করেছেন তাত্ত্বিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত লাইনের বাম বিচ্যুতি (‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ স্লোগান) পার্টিকে যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তা তিনি তার কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং এর বিরোধিতা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী চীন-সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত বিতর্ক দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে দ্বন্দ্ব ও ভাঙনের মুখোমুখি করে, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি। তিনি গোটা বিষয়টিকে তাত্ত্বিকভাবে মোকাবেলা করেছেন, যা তার দুটি ঐতিহাসিক দলিলে লিখে গেছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে তিনি তাতে অংশ নিয়েছেন, পাশাপাশি তাদের ঐক্যবদ্ধও করেছেন। তিনি কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন।
রাজনৈতিক কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ছিলেন সন্দেহ নেই; কিন্তু মানুষ হিসেবে ছিলেন সম্ভবত আরও বড়। তার ব্যক্তিত্বের ঔদার্যে আর চরিত্রের মাধুর্যে অনেক মানুষই অভিভূত হয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে একবার তার সংস্পর্শে এসেছে, সে-ই তাকে সারাজীবন মনে রেখেছে। অনেকেই জানেন না তিনি কবি ছিলেন। তার লেখা কবিতায় কৃষক রমণীর দুঃখগাথা থেকে কৃষকের কিশোরীকন্যার স্বপ্ন সবই স্থান পেয়েছে। তিনি ভালো অভিনেতা ছিলেন। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক যখন জেলখানায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়, তাতে অমল সেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। দর্শনে তার ব্যুৎপত্তি ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের। তার লেখা ‘দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে মুখ্যদ্বন্দ্ব’ প্রবন্ধটি মার্কসীয় দর্শনে একটি মৌলিক অবদান।
সবশেষে, যে কথাটি বিশেষভাবে না বললেই না তা হল, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক কৃষকের বন্ধু, কৃষক নেতা। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নেতা হতে চাননি, প্রয়োজনে তাকে সেই পদ নিতে হয়েছিল; কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি কখনও কৃষকের আঙিনা ছাড়তে চাননি। কৃষিপ্রধান এ বাংলাদেশে এখন কৃষকনেতা নেই। কৃষকরা নিজেরাই নীরবে বিপ্লব সাধন করে এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছেন; কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে, সামনে থেকে দুঃখ-বেদনা নিজের করে নেয়ার কেউ নেই। হয়তো অমল সেনরা আজও নিঃশব্দে তাদের হৃদয় কন্দরে নিঃশ্বাস ফেলে তাদের শক্তি জোগায়।
ড. সুশান্ত দাস : প্রাবন্ধিক
সময় ও ইতিহাস প্রয়োজনে ক্ষণজন্মা মানুষদের তৈরি করে, আবার এরাই ইতিহাস তৈরি করে সময়কে এগিয়ে নেয়ার জন্য- এটাই সভ্যতার শিক্ষা। কমরেড অমল সেনদের আদর্শ ও কর্মকে বুঝতে হলে তাদের সময়কালটা বুঝতে হবে। তিনি জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই, যশোর জেলার আফরা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। মহামতি লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে সফল হয়েছিল রুশ বিপ্লব। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ বিপ্লবের অভিঘাত বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তৈরি করে এক যুগান্তকারী চেতনা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নতুন গতিবেগ আর দিকনির্দেশনা পায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহে বেড়ে ওঠা কমরেড অমল সেনও জড়িয়ে পড়েন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে এদেশেও। তিনি দ্রুতই আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি। তিনি আরাম-আয়েশে গড়ে ওঠা সামন্ত পরিবারের আবহ উপেক্ষা করে জায়গা করে নেন গরিব কৃষকের কুঁড়েঘরে। গড়ে তোলেন যশোর-নড়াইল অঞ্চলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন। এ কৃষক সংগ্রাম তৎকালীন রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। এ আন্দোলন কৃষকের কিছু দাবি নিয়ে গড়ে উঠেছিল ঠিকই; কিন্তু সীমাবদ্ধ থাকেনি তাতে। এ আন্দোলনের দোলাচলে যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর চেতনার এক নবদিগন্ত। কমরেড অমল সেন ছিলেন সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা। যখন নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে এসেছে, তখনও তিনি সামনে দাঁড়িয়েই তা সহ্য করেছেন। পাকিস্তান আমলে তাকে ১৯ বছর কাটাতে হয়েছে জেলে। জেলের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে তাকে ভয়াবহ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তিনি শত নির্যাতনেও দেশত্যাগ করেননি, ত্যাগ করেননি বিপ্লবী জীবন।
ব্যক্তিজীবনে অকৃতদার এ মানুষটির জীবনেও কম টানাপোড়েন আসেনি। তিনি তা মোকাবেলা করেছেন তাত্ত্বিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত লাইনের বাম বিচ্যুতি (‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ স্লোগান) পার্টিকে যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তা তিনি তার কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং এর বিরোধিতা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী চীন-সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত বিতর্ক দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে দ্বন্দ্ব ও ভাঙনের মুখোমুখি করে, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি। তিনি গোটা বিষয়টিকে তাত্ত্বিকভাবে মোকাবেলা করেছেন, যা তার দুটি ঐতিহাসিক দলিলে লিখে গেছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে তিনি তাতে অংশ নিয়েছেন, পাশাপাশি তাদের ঐক্যবদ্ধও করেছেন। তিনি কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন।
রাজনৈতিক কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ছিলেন সন্দেহ নেই; কিন্তু মানুষ হিসেবে ছিলেন সম্ভবত আরও বড়। তার ব্যক্তিত্বের ঔদার্যে আর চরিত্রের মাধুর্যে অনেক মানুষই অভিভূত হয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে একবার তার সংস্পর্শে এসেছে, সে-ই তাকে সারাজীবন মনে রেখেছে। অনেকেই জানেন না তিনি কবি ছিলেন। তার লেখা কবিতায় কৃষক রমণীর দুঃখগাথা থেকে কৃষকের কিশোরীকন্যার স্বপ্ন সবই স্থান পেয়েছে। তিনি ভালো অভিনেতা ছিলেন। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক যখন জেলখানায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়, তাতে অমল সেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। দর্শনে তার ব্যুৎপত্তি ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের। তার লেখা ‘দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে মুখ্যদ্বন্দ্ব’ প্রবন্ধটি মার্কসীয় দর্শনে একটি মৌলিক অবদান।
সবশেষে, যে কথাটি বিশেষভাবে না বললেই না তা হল, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক কৃষকের বন্ধু, কৃষক নেতা। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নেতা হতে চাননি, প্রয়োজনে তাকে সেই পদ নিতে হয়েছিল; কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি কখনও কৃষকের আঙিনা ছাড়তে চাননি। কৃষিপ্রধান এ বাংলাদেশে এখন কৃষকনেতা নেই। কৃষকরা নিজেরাই নীরবে বিপ্লব সাধন করে এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছেন; কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে, সামনে থেকে দুঃখ-বেদনা নিজের করে নেয়ার কেউ নেই। হয়তো অমল সেনরা আজও নিঃশব্দে তাদের হৃদয় কন্দরে নিঃশ্বাস ফেলে তাদের শক্তি জোগায়।
ড. সুশান্ত দাস : প্রাবন্ধিক
No comments