কেন সংলাপ-সমঝোতা চাই by সিরাজুর রহমান
বাংলাদেশের রাজনীতি বিগত ছয় বছরে কত অমানবিক হয়ে গেছে, ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়। এমন দিন ছিল, যখন আলোচনার মাধ্যমে মতানৈক্য দূর করার রীতি আমাদের দেশেও চালু ছিল। রাজনীতির ময়দানে কিংবা সংসদে তীব্র মতানৈক্য সত্ত্বেও সামাজিকভাবে রাজনীতিকদের মধ্যে সখ্য ও সৌজন্যবোধ দেখা যেত। বিয়ে-শাদিতে বিভিন্ন দলের নেতারা গল্পগুজারি করতেন, কুশল বিনিময় করতেন। কেউ অসুস্থ হয়েছেন খবর পেলে সম্ভব হলে নিজে গিয়ে তত্ত্বতালাশ করে আসতেন, নিদেন টেলিফোন করে খবর নিতেন তিনি কেমন আছেন। আমার বয়স হয়েছে। কিছুকাল ধরেই স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না। পাড়ার লোকেরা (এদের কেউ বাংলাদেশী নন, বিভিন্ন দেশী) এসে খোঁজখবর নিয়ে যান, জিজ্ঞেস করে যান কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কি না। দূরে দূরে থাকা বিভিন্ন দেশীয় পরিচিতরাও টেলিফোন করে খোঁজ নেন। কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কি না, এরাও খোঁজ নেন। অবশ্যই আমার ভালো লাগে। সবিনয়ে বলে দিই কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। তাদেরও কোনো খরচ কিংবা লোকসান হচ্ছে না। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে মনজয়ী একটা মানবিক বিবেচনা আছে। গত ছয় বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে কী দেখি? কারো সাথে মতবিরোধ হলে তাকে খুন কিংবা গুম করার কথাই প্রথমে ভাবেন অনেকে। এই সময়ের মধ্যে ইলিয়াস আলী আর চৌধুরী আলমসহ কয়েক শ’ রাজনৈতিক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন, খুন হয়েছেন। তথাকথিত ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন কয়েক শ’ সরকারবিরোধী। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের বেসামাল ক্যাডারেরা খুন করেছে হাজারের অঙ্কে। আমার প্রায়ই মনে হয়, এখানেও শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতিশোধবাসনার কোনো ব্যাপার আছে কি না। আমার সৌভাগ্য, ছোটবেলা থেকে অনেক নেতা দেখেছি- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান। আরো বড় হয়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক এবং বিশ্বনেতাকেও দেখেছি। ব্যক্তিগত অসৌজন্যের কথা তাদের কারো প্রসঙ্গে ভাবতে পারি না। কারো কারো সাথে পরিচয়ও হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সেদিন বলেছেন, ভাষা মার্জিত নয় বলেই বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। মার্জিত ভাষাই যদি মাপকাঠি হয়, তাহলে সরকারের এবং শাসক দলের নেতাদের কোন বিচারে সভা-সমাবেশ করতে, এমনকি প্রকাশ্য উক্তি করতে দেয়া হচ্ছে, ভেবে পাচ্ছি না। অগ্রণযোগ্য দুর্ব্যবহার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে অনেক আন্দোলন হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। গান্ধী-নেহরু থেকে শুরু করে বহু নেতা জেল খেটেছেন। কিন্তু শাসকেরা, এমনকি পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী শাসকেরাও নেতাদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করেছেন। কারাগারে তাদের উচ্চ শ্রেণী দেয়া হয়েছে, আইয়ুবি স্বৈরতন্ত্র গৃহবন্দী শেরেবাংলাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিল, জেলে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো অযত্ম হয়েছে বলে শুনিনি, ফখরউদ্দীন-মইন ইউ বর্ণচোরা সামরিক স্বৈরতন্ত্র গৃহবন্দী শেখ হাসিনাকে বিশ্বভ্রমণের স্বাধীনতা দিয়েছিল। কিন্তু তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের জনতার অবিসংবাদিত নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি বর্তমানে যে ধরনের দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে, মানবিকতার কোন বিচারে সেটা গ্রহণযোগ্য? আগের বারে, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর, তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সৎ ও সাধু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ডেকেছিলেন। বাকশালী স্বৈরতন্ত্র ভয়ে আতঙ্কিত ছিল। জাতির ও জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখার সুযোগ খালেদা জিয়াকে দেয়া হয়নি। তিনি যাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সমাবেশে যেতে না পারেন, সে জন্যে বালি আর ইটের ট্রাক দিয়ে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এবারের ৫ জানুয়ারি বিএনপিসহ ২০ দল গণতন্ত্র হত্যা দিবস উপলক্ষে প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিল। সতর্কতা হিসেবে খালেদা জিয়া এবারে বাসার পরিবর্তে অফিস থেকে সভায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার বাসা ও অফিস এক ডজনেরও বেশি বালি ও ইটের ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাতেও নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। অফিস ভবনে খালেদাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, তালা বন্ধ করা ও খোলার নাটক দেখানো হয়েছে মিডিয়াকে। মরিচের গুঁড়া স্প্রে করে খালেদা জিয়া ও আরো এক ডজন মহিলা রাজনীতিককে গুরুতর অসুস্থ করা হয়েছে। পুলিশপ্রধান এ কে শহিদুল হক বলেছেন, অবরোধ সংবিধানের পরিপন্থী। সুযোগ পেলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম সরকারের বিরোধীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার অস্বীকার করার বিধান কোন সংবিধানে আছে? তা ছাড়া সমাবেশের অনুমতির জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হতে গিয়ে বিএনপির নেতাদের যেভাবে হতমান হতে হয়েছে, সেটা রীতিমতো কেলেঙ্কারি। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কাউকে নিজ নিজ অফিসে পাওয়া যায়নি। পত্রিকায় পড়ছিলাম বটে যে, পুলিশপ্রধান মন্ত্রিত্ব কিংবা মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজনীতিকের মতো গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন মিডিয়াকে জানান দিয়ে। খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করতে না দেয়ার অছিলায় ৪ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু ছাত্রলীগ-যুবলীগ ৫ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা মান্য করেনি। পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে? আওয়ামী লীগকে ১২ জানুয়ারি সমাবেশ করার সুযোগ দিতে চটজলদি ১৪৪ ধারাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের পুলিশকে নিরপেক্ষ বলবে কোন আহাম্মকে? অমানবিকতার মরুতে সান্ত্বনার মরূদ্যান এই অমানবিক পরিবেশে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রধান অমিত শাহ অবরুদ্ধ, নির্যাতিত ও অসুস্থ খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে খোঁজখবর নিয়েছেন, সমবেদনা জানিয়েছেনÑ এ ব্যাপারটা আমার সাহারা মরুভূমির মধ্যিখানে একটা সুজলা-সুফলা মরূদ্যানের মতোই মনে হয়েছেÑ যেমন করে পরিচিত, এমনকি অপরিচিত ব্যক্তিরাও স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিলে আমার ভালো লাগে। তাতে আরো প্রমাণ হয় যে, বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে মানবিক মূল্যবোধ অদৃশ্য হলেও অন্যত্র মানবিকতায় শ্মশান সৃষ্টি হয়নি। বিজেপি দীর্ঘকাল বিরোধী দলে ছিল। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের মতো অমানবিক নির্যাতন তাদের সহ্য করতে হয়নি। তা সত্ত্বেও দীর্ঘকাল বিরোধী অবস্থানে থাকার অনেক বিড়ম্বনা আছে। এমতাবস্থায় বিজেপি নেতার খালেদা জিয়ার খোঁজখবর নেয়া ও তার প্রতি সমবেদনা জানানো একটি স্বাভাবিক এবং মানবিক সদগুণের পরিচয় বহন করেছে। অন্য দিকে, এই একটি অনানুষ্ঠানিক টেলিফোন কলকে নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি মহলের লেজে বাটা মরিচ লেপে দেয়ার মতো প্রতিক্রিয়া একযোগে হাসি ও করুণার উদ্রেক করতে বাধ্য। সংশ্লিষ্ট টেলিফোন কলে কী বলা হয়েছিল, কী হয়নি সেটা নয়, বরং একটি টেলিফোন করা হয়েছিল বলে স্বীকার করা ও না করার ওপর যেন সরকারের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। অমিত শাহ আদৌ টেলিফোন করেননি প্রমাণ করার জন্য গোয়েবলসীয় প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে। কোনো কোনো সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেল টেলিফোন সংলাপের কথা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য অমিত শাহের উক্তি বলে কথিত কিছু কথা সম্প্রচার করেছে। কিন্তু যারা জানেন ও বোঝেন তারা বলছেন, উপরোল্লিখিত কথাগুলোর শব্দগত গুণে প্রায়ই তারতম্য দেখা গেছে। অর্থাৎ সন্দেহ দেখা দিচ্ছে যে, সব উক্তি একই ব্যক্তির কণ্ঠনিঃসৃত নয় এবং তার ফলে এ সন্দেহ দেখা দিতে বাধ্য যে, বক্তব্যগুলো আদৌ অমিত শাহের কি না। এ বিষয়ে সরকারের ও কোনো কোনো মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া থেকে তাদের অসহায় ও বেপরোয়া আতঙ্কের প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে যায়। সরকারের গদি ও মন্ত্রীদের চাকরি দীর্ঘ দিন ধরে নির্ভর করেছে দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের আশ্রয়ের ওপর। দিল্লি জানতে চায়নি বাংলাদেশের কোনো মানুষ এ সরকারকে সমর্থন করে কি না, অথবা এ সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন মানবতাবিরোধী কি না। দিল্লির বিগত সরকারের বিবেচনা ছিল একদেশদর্শী। শেখ হাসিনা ২০১০ সালে দিল্লিতে গিয়ে অজ্ঞাতসংখ্যক চুক্তিতে সই করে ভারতকে অজ্ঞাত সুযোগ-সুবিধাদানের অঙ্গীকার দিয়ে এসেছিলেন। সেসব চুক্তির বিবরণ, এমনকি সংখ্যাও বাংলাদেশের মানুষকে দূরের কথা, সংসদকেও জানতে দেয়া হয়নি। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, একে একে তাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক সম্পদগুলো ভারতকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে এ-ও বলা হয়েছে, বিনিময়ে ভারতের কাছে অর্থনৈতিক প্রতিদান প্রত্যাশা করা বাংলাদেশের জন্য অসভ্যতা হবে। ভিখারীর দানবিলাস জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের সম্পদ এমনিতেই খুব সীমিত। তার ওপর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে সেসব সম্পদের সদ্ব্যবহার কিংবা উপযুক্ত বিবর্তন হয়নি। দেশে অসমাপ্ত ও বিধ্বস্ত সেতুর সংখ্যা অগণিত। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সড়কগুলো প্রায়ই ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে ৬৭ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়েও বাংলাদেশের রেলপদ্ধতির উন্নতি হয়নি, ব্রিটিশ আমলের মতোই রয়ে গেছে। সংরক্ষণ ও মেরামতের অভাবে রেলপদ্ধতির মরণোন্মুখ দশা। এমন দিন কমই যায় যেদিন কোথাও-না-কোথাও ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে না। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারেনি। দেশের দুটো সমুদ্রবন্দরও সুপরিচালনার অভাবে ক্ষমতাসীমার অনেক নিচে কাজ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতির পশ্চাৎপদতার এগুলো কিছু কারণ। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতের দুই অংশের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য আমাদের সড়ক, রেল ও নদীপথগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, আমাদের নদী ও খালে বাঁধ দিয়ে অস্বাভাবিক ভারী ও প্রশস্ত যন্ত্রপাতি বহনের সুব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে ভারতকে, পরিবেশ ও কৃষির ক্ষতির জন্য আমাদের কৃষক ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। আমাদের দুটো সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা যে ক্ষেত্রে আমাদের বহির্বাণিজ্য দ্রুত নির্বাহ করতে সক্ষম হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে ভারতকে বহির্বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্যও আমাদের সমুদ্রবন্দরগুলো অবাধে ব্যবহার করতে খুলে দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে, বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও ভারত পরিশোধ করেনি। ছিটমহল বিনিময়সংক্রান্ত ১৯৭৪ সালের চুক্তি, ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন সংক্রান্ত ১৯৯৬ সালের হাসিনা-দেবগৌড়া চুক্তি ইত্যাদি ভারত কার্যকর করেনি, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করেনি কংগ্রেস সরকার। আরো পীড়াদায়ক ছিল কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকারের আমলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেকোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনার সরকারকে ভারত সুরক্ষা দিয়ে যাবেÑ বারবার এ কথা শুনে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ অপমানিত বোধ করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের অবাধ হস্তক্ষেপ, হাসিনার নির্বাচনী বিজয়ের জন্য ভারত কত হাজার কোটি রুপি ব্যয় করবে, এ-জাতীয় সংবাদ উদারভাবে ফাঁস করা ইত্যাদি বাংলাদেশে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এ দেশের মানুষ ভয় করছে যে, ভারত বাংলাদেশকে সিকিম ও কাশ্মিরের মতোই গ্রাস করে নিতে চায় কি না। বিগত বছরের মে মাসে ভারতের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ খুবই শঙ্কিত ছিল। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে বসেছিল, সে নির্বাচনে বিজেপির বিজয় হবে। সে আশা বৃথা যায়নি। বিজেপি যে শুধু বিজয়ী হয়েছে, তা নয়। তাদের বিজয় এত ব্যাপক হয়েছে যে, নির্ভাবনায় দীর্ঘকাল দেশ শাসন করার উপযোগী স্থিতিশীলতা পেয়েছে নতুন সরকার। কিঞ্চিত আশার আলো বাংলাদেশের মানুষ তাতে কিছু আশার আলো দেখছে। প্রথমত, দিল্লির নতুন সরকার এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন ও সংরক্ষণ দেয়ার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ মনে হতে পারে এমন কোনো উক্তি নতুন সরকারের নেতাদের কাছ থেকে শোনা যায়নি। বরঞ্চ সাউথ ব্লকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন মাত্র গত সোমবার স্পষ্ট করে বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই ভারতের সাথে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রত্যাশা করেছে। তার কারণ শুধু এই নয় যে, ১৯৭১ সালের ঘনঘটার দিনগুলোতে ভারত আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে নয় মাস আশ্রয় দিয়েছে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে সাহায্য দিয়েছে। কারণ এই যে, দুই দেশের সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণে পরিপূরক। দিল্লির বিগত সরকার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল। সে অসম বন্ধুত্বও এ দেশের মানুষের অবিরাম গাত্রদাহের কারণ ঘটিয়েছে। তারা দেখেছে, বন্ধুত্বের নামে দিল্লি বাংলাদেশের ওপর প্রভুত্ব করতে চেয়েছে ও শেখ হাসিনার নতজানু সরকার তাতে উল্লাসে আপ্লুত হয়েছে। অমিত শাহ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো উক্তি করেননি। সে এখতিয়ার তার নয়, দিল্লির মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের। তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের ক্রুদ্ধ হুঙ্কার অসহায় আর্তনাদের মতোই মনে হবে। দিল্লির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার চিন্তাতেই তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। আন্তর্জাতিকভাবেই এই ব্যাখ্যা করা হবে একটি টেলিফোন কলের অস্তিত্ব নিয়ে মন্ত্রীদের কৃত্রিম রোষের। দেশের মানুষের আপত্তি এবং বিশ্বসমাজের পরামর্শ উপেক্ষা করে তারা নির্বাচন দিতে চেয়েছিল। ভোটের তারিখের আগেই তারা গরিষ্ঠতা দাবি করেছে। ৫ জানুয়ারি কোনো ভোটদাতা ভোটকেন্দ্রে যাননি। কিন্তু সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন কাল্পনিক ভোটে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। রজ্জুতে সর্পভ্রম যে কারণে তখন থেকেই বিশ্বসমাজ বলে এসেছে যে, তথাকথিত সে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য নয়। সংলাপের মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করার তাগিদ তারা সরকারকে দিয়ে এসেছে। সে তাগিদ এখন রীতিমতো কূটনৈতিক চাপে পরিণত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বন্ধু দেশ ও সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে গায়ের ঝাল ঝাড়তে গিয়ে সরকার তাদের আরো বিষিয়ে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন ‘দুই আনার মন্ত্রী’, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন বাসার চাকর। এক মন্ত্রী সেদিন বলেছেন মানবাধিকার সংস্থাগুলো (লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং নিউ ইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ) বিএনপির দালাল। সারা বিশ্বকেই এই অবৈধ সরকার শত্রুর কাতারে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান বিতর্কিত সরকার এখন পর্যন্ত সবার পরামর্শ ও চাপ ঠেকিয়ে আসছে এ আশায় যে, দিল্লির বিজেপি সরকারও কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকারের পথেই যাবে, যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনার সরকারকে গদিতে আসীন রাখবে। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি মহলের একাংশ কোনো অজ্ঞাত কারণে এ যাবৎ একগুঁয়ে সরকারকে সব ধরনের সাহায্য-সমর্থন দিয়ে আসছিল। কিন্তু এখন তাদেরও বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয়। বিগত কয়েক দিনে গার্মেন্ট মালিক সমিতি ও এফবিসিসিআইও সংলাপ ও সমঝোতার পথ ধরতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। সুজন বলেছে, সংলাপ ছাড়া দেশের বর্তমান সঙ্কট নিরসনের অন্য পথ নেই। অর্থাৎ দেশে-বিদেশে কেউ আর এই সরকারের পক্ষে নেই। বিশেষ করে দেশের মানুষ অমিত শাহের টেলিফোন কলকে ভারত সরকারের নীতি পরিবর্তন ভাবতে পারে সে ভয়ে সে কলকে এয়ারব্রাশ করে উড়িয়ে দিতে চাইছে সরকার। কিন্তু দেশের মানুষ জানে ‘পাগলা কুকুরে কামড়ালে পানি দেখে আতঙ্ক হয়, মস্তিষ্কের অশান্তি ঘটলে রজ্জুতেও সর্পভ্রম ঘটে।’
লন্ডন, ১৩.০১.১৫
সিরাজুর রহমান: বিবিসিখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক
serajurrahman34@gmail.com
No comments