কতদূর যেতে পারবেন সিরিসেনা? by তারেক শামসুর রেহমান
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
অপ্রত্যাশিতভাবে মিথ্রিপাল সিরিসেনার বিজয়ের পর একটি প্রশ্ন ইতিমধ্যেই
উঠেছে- তিনি কতদূর যেতে পারবেন? কতগুলো সিদ্ধান্তের কথা তিনি নির্বাচনের
আগে ও পরে জানিয়েছেন। এগুলোর সব কি তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন? শ্রীলংকার
মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছে। আর সেই পরিবর্তনটি সম্পন্ন হয়েছে। ছ’বছরের
জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানিয়েছেন, তা শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক. তার এক ঘনিষ্ঠ সহচর জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আগামী মাসে নয়াদিল্লি সফর করবেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং শ্রীলংকার বৈদেশিক নীতির সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কারণ সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এমনকি তার শাসনামলে এ অঞ্চলে চীন-পাকিস্তান-শ্রীলংকা একটি অক্ষ তৈরি হয়েছিল। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, চীন শ্রীলংকার উন্নয়নে একটি বড় অবদান রেখেছে। রাজাপাকসের নিজস্ব এলাকা হচ্ছে হামবানতোতা। একসময় এ অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ও অনুন্নত। রাজাপাকসে চীনের সহায়তায় এ অঞ্চলে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছেন। একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করে দিয়েছে চীন। এখন সিরিসেনা চীনের ওপর এ নির্ভরতা কমিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন। তবে এটাও সত্য, শ্রীলংকার মানুষ কিছুটা স্বাধীনচেতা। ভারতীয় ‘আধিপত্যকে’ তারা কখনও স্বীকার করে নেয়নি। তামিল বিদ্রোহ ঠেকাতে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় সৈন্য জাফনায় প্রবেশ করেছিল। ওই ‘যুদ্ধে’ প্রায় ১২শ’ ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারায়। ফলে ১৯৯০ সালে ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করার কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু সংসদে রাজাপাকসের সমর্থকের সংখ্যা বেশি। সিরিসেনা শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির সবার সমর্থন পাবেন, এটা মনে করার কারণ নেই। তৃতীয়ত, তিনি প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন এবং সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী পুনঃস্থাপনের (রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বাতিল) কথাও বলেছেন। এ ক্ষেত্রে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন তিনি নাও পেতে পারেন। চতুর্থত, শিরানি বন্দরনায়েকে অর্থাৎ সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তিনি ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছেন। এটিও খুব সহজ হবে না। স্বাধীন বিচার বিভাগ, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কাজটিও খুব সহজ হবে না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, শ্রীলংকায় গণতন্ত্রেরই বিজয় হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ রাজাপাকসে হেরে গেছেন। উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষা, যেখানে ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জনরায়ে হেরে যান। হেরে যাওয়ার আগেই তিনি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং কোনো রকম আপত্তির কথা তার সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা যায়নি। কোনো ধরনের ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ কথাও আমরা শুনিনি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যায়। আবার জনসমর্থন না থাকলে ‘জোর করে’ সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করেও ক্ষমতায় থাকা যায় না। রাজাপাকসের বিদায় এটাই প্রমাণ করল আবার। অথচ রাজাপাকসে একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। শ্রীলংকাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে তিনি রক্ষা করেছেন। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিজয় নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, রাজাপাকসে যদি ওই সময় টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা না করতেন, তাহলে সম্ভবত শ্রীলংকা তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারত না।
এখানে বলা ভালো, রাজাপাকসে ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সেখানে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল, তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করে তিনি সিংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল পারিবারিকীকরণের। তার দু’ভাই, ছেলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে তারা প্রভাব খাটাতেন। এ পারিবারিকীকরণ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। তামিল টাইগারদের পরাজিত করার মাধ্যমে অর্জিত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তার দ্বিতীয় টার্ম শেষ হওয়ার কথা আরও দু’বছর পর। তৃতীয় টার্মে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না- এ ক্ষেত্রে সংবিধান অন্যতম বাধা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী রাজাপাকসে সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিজের জন্য তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ প্রশস্ত করেন। তার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পাবে না বিরোধী দল। কিন্তু তার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিথ্রিপাল সিরিসেনা যে খোদ তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। একসময় সিরিসেনা তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সিরিসেনা অক্টোবরে (২০১৪) মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে রাজাপাকসেকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি কোনো প্রার্থী দেয়নি। বরং তারা একত্রিত হয়ে সিরিসেনাকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে এবং নির্বাচনে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। নির্বাচনের আগে সিরিসেনার সঙ্গে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির যে সমঝোতা হয়েছিল, তার আলোকেই বিরোধীদলীয় নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহ ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছেন।
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয় এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ জয়ের সুবাদে এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও রাজাপাকসে হেরে গেলেন কেন, এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করেন। রাজাপাকসে জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্ষমতা মানুষকে যে ‘অন্ধ’ করে দেয়, রাজাপাকসে ছিলেন তার বড় প্রমাণ। তিনি শ্রীলংকার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এক ধরনের একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। তার নিজের কথাই ছিল আইন। প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষিতের দেশ শ্রীলংকার মানুষ এটা গ্রহণ করে নেয়নি। তার এই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে মানুষ তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যা শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ সমর্থন করেনি। তিনি পরিবারতন্ত্র চালু করেছিলেন, এটাও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। যদিও শ্রীলংকায় এক ধরনের পরিবারতন্ত্র চালু আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কিংবা তার মা প্রয়াত শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। বন্দরনায়েকে ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী (১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হয়) শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্রীমাভো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে মেয়ে চন্দ্রিকাও প্রেসিডেন্ট হন। মেয়ে চন্দ্রিকা যখন প্রেসিডেন্ট, তখন মা শ্রীমাভো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তাকে ঘিরে একটি বড় ধরনের ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশ হলে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নিজেদের প্রার্থী দিত। কিন্তু দলটি তা করেনি। বরং সিরিসেনাকে সমর্থন দিয়ে শ্রীলংকায় একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই অনেক প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। এক. যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আদৌ থাকবে কি-না? সিরিসেনা ইতিমধ্যেই ইউএনপি নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী করলেও প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিসেনার নিজের দল শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি এই ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করবে কি-না? সাধারণত যিনি হেরে যান, তিনি আর রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় থাকেন না (যেমন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা)। এখন দেখার বিষয়, রাজাপাকসে আদৌ শ্রীলংকার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন কি-না। তবে শ্রীলংকার ইতিহাস বলে, ফ্রিডম পার্টিকে এখন নতুন একজন নেতা খুঁজতে হবে।
দ্বিতীয়ত, তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে রাজাপাকসে শ্রীলংকার অখণ্ডতা রক্ষা করেছেন সত্য, কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তিনি শ্রীলংকার তামিলদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এটা ছিল তার বড় ব্যর্থতা। সাধারণ তামিলরা তাকে বরাবর ঘৃণা করে আসছে। এবং নির্বাচনে তারা এককভাবে সিরিসেনাকে ভোট দিয়েছে। এখন সিরিসেনার প্রধান কাজ হবে তামিলদের আস্থা অর্জন করা। সেই কাজটি করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সিংহলিদের একটা অংশ এখনও তামিলবিরোধী। শ্রীলংকার জাতিগত দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বেশ পুরনো। ৬৫ হাজার ৬০৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এ দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৩ লাখ। ভারত মহাসাগর ঘেঁষা এ দেশটি বিভিন্ন সময়ে পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা দেশটির পশ্চিমে ও দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে। পনেরো শতকের মাঝামাঝি ডাচরা (হল্যান্ড) দেশটি দখল করে নেয়। ১৮০২ সালে শ্রীলংকা পৃথক ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচয় ছিল সিংহল হিসেবে।
তৃতীয়ত, তামিলদের আস্থা অর্জন করার কাজটি হবে কঠিন। জনগোষ্ঠীর ১১ দশমিক ২ ভাগ তামিল। তামিল টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ‘হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা সাধারণ তামিলরা মেনে নিতে পারেননি আজও। প্রবাসী তামিলদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা এখনও আছে। শ্রীলংকার মূলধারার রাজনীতিতে এদের নিয়ে আসার কাজটি হবে কঠিন। তামিল অধ্যুষিত দুটি প্রদেশ (মোট প্রদেশ ৯টি) পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলকে ২০০৬ সালে একত্রিত করা হয়। কিন্তু প্রাদেশিক নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব বেশি। সত্যিকার অর্থে প্রাদেশিক সরকার কোনো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। ফলে তামিলরা এখনও নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। সিরিসেনাকে এখন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বলা ভালো, ইংরেজরা শ্রীলংকায় ব্রিটিশ শাসন কায়েম করার আগে থেকেই সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তামিলরা বসতি স্থাপন করে। তামিলরা আসে মূলত ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে। ব্রিটিশরা তাদের এ অঞ্চলে চায়ের বাগান ও রাবার বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে এসেছিল। তবে দীর্ঘদিন তাদের শ্রীলংকার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এ বৈষম্যমূলক আচরণের ফলেই তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। তবে তামিল টাইগারদের (তারা প্রতীক হিসেবে বাঘের মুখ ব্যবহার করত বলে তামিল টাইগার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল) কথা প্রথম জানা যায় ১৯৭৫ সালে যখন জাফনার মেয়র দুরায়াপ্পাকে টাইগাররা হত্যা করে।
চতুর্থত, শ্রীলংকার জনসংখ্যার ১০ ভাগ হচ্ছে মুসলমান (জনসংখ্যার ৭৪ দশমিক ৮৮ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী)। সাম্প্রতিককালে সেখানে মুসলমান-বৌদ্ধ দাঙ্গার খবর আমরা জানি। বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রান্ত হওয়ার খবরও রয়েছে। একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জঙ্গিগোষ্ঠী ‘বদু পালা সেনা’র অপতৎপরতা এবং শ্রীলংকাকে একটি পরিপূর্ণ বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণার খবরও আমরা জানি। রাজাপাকসে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয় সিরিসেনা এদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেন।
পঞ্চমত, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকায় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় সোচ্চার। জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে এবং শ্রীলংকার বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকাকে দেয়া জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। এখন সিরিসেনাকে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আস্থা অর্জন করতে হবে। কাজটি খুব সহজ হবে না নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার জন্য একটা খারাপ খবর হল সংসদের স্পিকার হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের ভাই চামাল রাজাপাকসে। ২২৫ আসনবিশিষ্ট সংসদে রাজাপাকসের সমর্থকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার দলের সদস্য সংখ্যা ১৪৪। আর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের (যিনি এর আগেও দু’বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপাকসের কাছে হেরে যান) দলের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৬০। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হবে। বিক্রমাসিংহ সংসদের আস্থা নাও পেতে পারেন। ২০১৬ সালে সেখানে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এটা সত্য, সিরিসেনা একটি ভালো নির্বাচন দেয়ার জন্য রাজাপাকসেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে এ প্রশ্নও উঠেছিল- নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশংকায় রাজাপাকসে সেনা নামাতে চেয়েছিলেন। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রীলংকায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। একটি ভালো নির্বাচন সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবেই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানিয়েছেন, তা শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক. তার এক ঘনিষ্ঠ সহচর জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আগামী মাসে নয়াদিল্লি সফর করবেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং শ্রীলংকার বৈদেশিক নীতির সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কারণ সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এমনকি তার শাসনামলে এ অঞ্চলে চীন-পাকিস্তান-শ্রীলংকা একটি অক্ষ তৈরি হয়েছিল। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, চীন শ্রীলংকার উন্নয়নে একটি বড় অবদান রেখেছে। রাজাপাকসের নিজস্ব এলাকা হচ্ছে হামবানতোতা। একসময় এ অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ও অনুন্নত। রাজাপাকসে চীনের সহায়তায় এ অঞ্চলে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছেন। একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করে দিয়েছে চীন। এখন সিরিসেনা চীনের ওপর এ নির্ভরতা কমিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন। তবে এটাও সত্য, শ্রীলংকার মানুষ কিছুটা স্বাধীনচেতা। ভারতীয় ‘আধিপত্যকে’ তারা কখনও স্বীকার করে নেয়নি। তামিল বিদ্রোহ ঠেকাতে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় সৈন্য জাফনায় প্রবেশ করেছিল। ওই ‘যুদ্ধে’ প্রায় ১২শ’ ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারায়। ফলে ১৯৯০ সালে ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করার কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু সংসদে রাজাপাকসের সমর্থকের সংখ্যা বেশি। সিরিসেনা শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির সবার সমর্থন পাবেন, এটা মনে করার কারণ নেই। তৃতীয়ত, তিনি প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন এবং সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী পুনঃস্থাপনের (রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বাতিল) কথাও বলেছেন। এ ক্ষেত্রে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন তিনি নাও পেতে পারেন। চতুর্থত, শিরানি বন্দরনায়েকে অর্থাৎ সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তিনি ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছেন। এটিও খুব সহজ হবে না। স্বাধীন বিচার বিভাগ, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কাজটিও খুব সহজ হবে না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, শ্রীলংকায় গণতন্ত্রেরই বিজয় হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ রাজাপাকসে হেরে গেছেন। উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষা, যেখানে ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জনরায়ে হেরে যান। হেরে যাওয়ার আগেই তিনি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং কোনো রকম আপত্তির কথা তার সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা যায়নি। কোনো ধরনের ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ কথাও আমরা শুনিনি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যায়। আবার জনসমর্থন না থাকলে ‘জোর করে’ সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করেও ক্ষমতায় থাকা যায় না। রাজাপাকসের বিদায় এটাই প্রমাণ করল আবার। অথচ রাজাপাকসে একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। শ্রীলংকাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে তিনি রক্ষা করেছেন। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিজয় নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, রাজাপাকসে যদি ওই সময় টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা না করতেন, তাহলে সম্ভবত শ্রীলংকা তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারত না।
এখানে বলা ভালো, রাজাপাকসে ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সেখানে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল, তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করে তিনি সিংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল পারিবারিকীকরণের। তার দু’ভাই, ছেলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে তারা প্রভাব খাটাতেন। এ পারিবারিকীকরণ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। তামিল টাইগারদের পরাজিত করার মাধ্যমে অর্জিত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তার দ্বিতীয় টার্ম শেষ হওয়ার কথা আরও দু’বছর পর। তৃতীয় টার্মে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না- এ ক্ষেত্রে সংবিধান অন্যতম বাধা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী রাজাপাকসে সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিজের জন্য তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ প্রশস্ত করেন। তার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পাবে না বিরোধী দল। কিন্তু তার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিথ্রিপাল সিরিসেনা যে খোদ তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। একসময় সিরিসেনা তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সিরিসেনা অক্টোবরে (২০১৪) মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে রাজাপাকসেকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি কোনো প্রার্থী দেয়নি। বরং তারা একত্রিত হয়ে সিরিসেনাকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে এবং নির্বাচনে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। নির্বাচনের আগে সিরিসেনার সঙ্গে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির যে সমঝোতা হয়েছিল, তার আলোকেই বিরোধীদলীয় নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহ ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছেন।
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয় এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ জয়ের সুবাদে এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও রাজাপাকসে হেরে গেলেন কেন, এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করেন। রাজাপাকসে জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্ষমতা মানুষকে যে ‘অন্ধ’ করে দেয়, রাজাপাকসে ছিলেন তার বড় প্রমাণ। তিনি শ্রীলংকার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এক ধরনের একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। তার নিজের কথাই ছিল আইন। প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষিতের দেশ শ্রীলংকার মানুষ এটা গ্রহণ করে নেয়নি। তার এই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে মানুষ তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যা শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ সমর্থন করেনি। তিনি পরিবারতন্ত্র চালু করেছিলেন, এটাও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। যদিও শ্রীলংকায় এক ধরনের পরিবারতন্ত্র চালু আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কিংবা তার মা প্রয়াত শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। বন্দরনায়েকে ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী (১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হয়) শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্রীমাভো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে মেয়ে চন্দ্রিকাও প্রেসিডেন্ট হন। মেয়ে চন্দ্রিকা যখন প্রেসিডেন্ট, তখন মা শ্রীমাভো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তাকে ঘিরে একটি বড় ধরনের ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশ হলে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নিজেদের প্রার্থী দিত। কিন্তু দলটি তা করেনি। বরং সিরিসেনাকে সমর্থন দিয়ে শ্রীলংকায় একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই অনেক প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। এক. যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আদৌ থাকবে কি-না? সিরিসেনা ইতিমধ্যেই ইউএনপি নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী করলেও প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিসেনার নিজের দল শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি এই ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করবে কি-না? সাধারণত যিনি হেরে যান, তিনি আর রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় থাকেন না (যেমন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা)। এখন দেখার বিষয়, রাজাপাকসে আদৌ শ্রীলংকার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন কি-না। তবে শ্রীলংকার ইতিহাস বলে, ফ্রিডম পার্টিকে এখন নতুন একজন নেতা খুঁজতে হবে।
দ্বিতীয়ত, তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে রাজাপাকসে শ্রীলংকার অখণ্ডতা রক্ষা করেছেন সত্য, কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তিনি শ্রীলংকার তামিলদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এটা ছিল তার বড় ব্যর্থতা। সাধারণ তামিলরা তাকে বরাবর ঘৃণা করে আসছে। এবং নির্বাচনে তারা এককভাবে সিরিসেনাকে ভোট দিয়েছে। এখন সিরিসেনার প্রধান কাজ হবে তামিলদের আস্থা অর্জন করা। সেই কাজটি করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সিংহলিদের একটা অংশ এখনও তামিলবিরোধী। শ্রীলংকার জাতিগত দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বেশ পুরনো। ৬৫ হাজার ৬০৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এ দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৩ লাখ। ভারত মহাসাগর ঘেঁষা এ দেশটি বিভিন্ন সময়ে পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা দেশটির পশ্চিমে ও দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে। পনেরো শতকের মাঝামাঝি ডাচরা (হল্যান্ড) দেশটি দখল করে নেয়। ১৮০২ সালে শ্রীলংকা পৃথক ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচয় ছিল সিংহল হিসেবে।
তৃতীয়ত, তামিলদের আস্থা অর্জন করার কাজটি হবে কঠিন। জনগোষ্ঠীর ১১ দশমিক ২ ভাগ তামিল। তামিল টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ‘হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা সাধারণ তামিলরা মেনে নিতে পারেননি আজও। প্রবাসী তামিলদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা এখনও আছে। শ্রীলংকার মূলধারার রাজনীতিতে এদের নিয়ে আসার কাজটি হবে কঠিন। তামিল অধ্যুষিত দুটি প্রদেশ (মোট প্রদেশ ৯টি) পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলকে ২০০৬ সালে একত্রিত করা হয়। কিন্তু প্রাদেশিক নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব বেশি। সত্যিকার অর্থে প্রাদেশিক সরকার কোনো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। ফলে তামিলরা এখনও নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। সিরিসেনাকে এখন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বলা ভালো, ইংরেজরা শ্রীলংকায় ব্রিটিশ শাসন কায়েম করার আগে থেকেই সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তামিলরা বসতি স্থাপন করে। তামিলরা আসে মূলত ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে। ব্রিটিশরা তাদের এ অঞ্চলে চায়ের বাগান ও রাবার বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে এসেছিল। তবে দীর্ঘদিন তাদের শ্রীলংকার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এ বৈষম্যমূলক আচরণের ফলেই তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। তবে তামিল টাইগারদের (তারা প্রতীক হিসেবে বাঘের মুখ ব্যবহার করত বলে তামিল টাইগার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল) কথা প্রথম জানা যায় ১৯৭৫ সালে যখন জাফনার মেয়র দুরায়াপ্পাকে টাইগাররা হত্যা করে।
চতুর্থত, শ্রীলংকার জনসংখ্যার ১০ ভাগ হচ্ছে মুসলমান (জনসংখ্যার ৭৪ দশমিক ৮৮ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী)। সাম্প্রতিককালে সেখানে মুসলমান-বৌদ্ধ দাঙ্গার খবর আমরা জানি। বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রান্ত হওয়ার খবরও রয়েছে। একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জঙ্গিগোষ্ঠী ‘বদু পালা সেনা’র অপতৎপরতা এবং শ্রীলংকাকে একটি পরিপূর্ণ বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণার খবরও আমরা জানি। রাজাপাকসে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয় সিরিসেনা এদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেন।
পঞ্চমত, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকায় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় সোচ্চার। জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে এবং শ্রীলংকার বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকাকে দেয়া জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। এখন সিরিসেনাকে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আস্থা অর্জন করতে হবে। কাজটি খুব সহজ হবে না নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার জন্য একটা খারাপ খবর হল সংসদের স্পিকার হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের ভাই চামাল রাজাপাকসে। ২২৫ আসনবিশিষ্ট সংসদে রাজাপাকসের সমর্থকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার দলের সদস্য সংখ্যা ১৪৪। আর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের (যিনি এর আগেও দু’বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপাকসের কাছে হেরে যান) দলের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৬০। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হবে। বিক্রমাসিংহ সংসদের আস্থা নাও পেতে পারেন। ২০১৬ সালে সেখানে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এটা সত্য, সিরিসেনা একটি ভালো নির্বাচন দেয়ার জন্য রাজাপাকসেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে এ প্রশ্নও উঠেছিল- নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশংকায় রাজাপাকসে সেনা নামাতে চেয়েছিলেন। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রীলংকায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। একটি ভালো নির্বাচন সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবেই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments