সহিংস রাজনীতি বন্ধের একমাত্র পথ গণতন্ত্রে উত্তরণ by মইনুল হোসেন
মনে হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী জোট টার্গেট
হামলার প্রস্তুতি নিয়েই রাস্তায় নেমেছে। কার গুপ্তহত্যার তালিকা কার কাছে
সেটা তারাই ভালো জানে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত তথ্য হচ্ছে,
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর গুলশান এলাকায় মোটরসাইকেল
আরোহী আটজন যুবক হামলা চালায়। তাকে গুলিবিদ্ধ করে। তার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
যারা সন্ত্রাসীদের বিচার দাবি করছেন, তাদের উদ্দেশে আমার বক্তব্য হল,
সন্ত্রাসীদের সাহস জোগানোর রাজনীতিতে কে কার বিচার করবে? যারা জড়িত তারা
নিশ্চয়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এখনও দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য সোচ্চার হতে পারছেন না। মনে করছেন, নিজেরা নীরব থাকলে তারা নিরাপদ থাকবেন। এখনও তাই অন্যায় সুবিধাভোগীরা ভাবছেন তাদেরই বিজয় হবে। জাতি অসহায় ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে সবই মেনে নেবে।
সরকারি নেতৃত্বের একগুঁয়েমির স্বরূপ প্রকট হওয়ার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ভয়াবহ সংকট নিরসনের কোনো সদিচ্ছা যে সরকারের নেই, তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। অবস্থা এসে এমন জায়গায় ঠেকেছে যে, স্বাধীন দেশের জনগণ অবাধ নির্বাচন প্রত্যাশা করতে পারবে না। কিন্তু স্বাধীনতার তাৎপর্য হচ্ছে, সরকার হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। উন্নয়নের কথা শুনিয়ে ক্ষমতা দখলের ন্যায্যতা দাবি করা স্বৈরতন্ত্রের চিন্তাভাবনা। আমরা যখন বলি, পাকিস্তান আমলে আমরা স্বাধীন ছিলাম না, তখন অনির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসনের কথাই বুঝিয়ে থাকি।
প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম আমলা-উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিলেন, নির্বাচন কবে হবে তা সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, নির্বাচন কখন হবে সে ব্যাপারে সরকার শাসনতান্ত্রিক বিধান মানতে বাধ্য। অর্থাৎ বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় হতে পারে না। নির্বাচন না করেই সরকার গঠনের দাবি কেউ করতে পারেন না। সরকারের পক্ষে জনসমর্থন থাকলে অবাধ নির্বাচনে তো কারও ভয়-ভীতি থাকতে পারে না। সরকারের নেতারা বলছেন, সন্ত্রাসীদের নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন না। অন্যরাও তো দাবি করতে পারেন, ভোট হরণকারীদের সঙ্গে তারা বসবেন না। সেজন্য স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে, জনগণের ভোটের অধিকার দলীয় রাজনীতির তর্ক-বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। বিজ্ঞ উপদেষ্টা সাহেব এমনও বলেছেন, প্রয়োজন হলে বিএনপিকে অবৈধ করা হবে। তিনি মনে করছেন, বিএনপিকে শেষ করতে পারলেই জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া যাবে।
এটা বলা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না যে, একশ্রেণীর বিবেকবর্জিত আমলা আছেন, তাদের সংখ্যা যতই কম হোক না কেন, তারা জনগণের অর্থে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন অথচ জনগণের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করেন না। পুলিশি ক্ষমতার অবপব্যবহারই তাদের শক্তি- জনগণ বা জনমত নয়। তারা সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য দিতে জানেন না। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলবেন না।
এখন সরকার তাদের বুদ্ধিদাতাদের পরামর্শে গণতন্ত্রের কথা বেশি না বলে উন্নয়নের রাজনীতির কথা শোনাচ্ছে। দেশের জনগণকে খুব বেশি বোকা হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং নিজেদের খুব বুদ্ধিমান মনে করা হচ্ছে।
এটা সত্য হলে তাদের এও বলতে হবে যে, অতীতে বড় বড় নেতা গণতন্ত্রের নামে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন, তারা জনগণের উন্নয়ন-অগ্রগতি চাননি।
গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয় জনগণের ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য। স্বৈরশাসনেও উন্নয়ন হয়; কিন্তু সে উন্নয়নের সিংহভাগ ভোগ করে দুর্নীতিপরায়ণ লুটেরা শ্রেণী। তাই যারা গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়নের কথা বলছেন, তারা তো লুটেরাদের উন্নয়নের কথা বলছেন। লুটেরাদের নিয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার একটি পাকাপোক্ত গণবিরোধী ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার কথাই ভাবছেন।
সরকারের সুবিধাভোগীরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ের লোকের সম্পৃক্ততা না থাকলে বিএনপির আন্দোলন জনগণের আন্দোলনে রূপ নেবে না। তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ের আন্দোলন দেখতে চাইছেন।
অর্থাৎ সিভিল ওয়ার। দায়িত্বহীনতার একটা সীমা থাকা দরকার।
নির্বাচনী বৈধতার জন্য মাঠ পর্যায়ের লোকদের সমর্থন তো প্রয়োজন হবে সরকারের। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য মাঠ পর্যায়ের কেন, কোনো পর্যায়ের আন্দোলনই তো হওয়ার কথা নয়। জনগণের ভোটের অধিকার স্বাধীনতার অধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্বের অধিকার। এটি কারও সঙ্গে আপস-সমঝোতার বিষয় নয়। জনগণ স্বাধীনতার মাধ্যমে এ ভোটাধিকার অর্জন করেছে- কারও অনুগ্রহের অনুদান হিসেবে পায়নি। এজন্যই আমাকে বারবার বলতে হচ্ছে, দেশে সত্যিকার রাজনীতি নেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বও নেই।
একটি ভুয়া নির্বাচনকে যেসব বুদ্ধিজীবী গণতন্ত্র মনে করেন, তারাই যখন আবার বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চলতে দেখে গণতন্ত্র গেল, গণতন্ত্র গেল বলে হা-হুতাশ করেন, তখন বুঝতে পারি না তারা আসলে নিজেদের কত চালাক-চতুর মনে করেন। অপরদিকে একদল বড় ব্যবসায়ী আছেন, যারা জনসাধারণের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন এবং তাদের ওপর যে কোনো ধরনের অন্যায়-নির্যাতন চালানো হোক না কেন, পুলিশের ব্যবস্থাধীনে নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারলেই তারা খুশি। বলবেন, দেশে শান্তি বিরাজ করছে। অপর একদল আছেন যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির থিওরি দেবেন; কিন্তু নির্বাচনই যে সংকট নিরসনের সহজ ও একমাত্র পথ তা স্পষ্টভাবে বলবেন না। প্রহসনের নির্বাচন করতে গিয়েই যে বর্তমানের ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তাও তারা স্বীকার করবেন না।
অথচ সবাই মিলে যদি কিছুটা দূরদর্শিতা, কিছুটা সৎ সাহসের স্বাক্ষর রাখতে পারতাম, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, জনমতের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়ে শুধু পুলিশি নির্যাতনের ওপর নির্ভর করে কোনো সরকার জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা আনতে পারে না, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে পারে না। লজ্জাজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষিত সচেতন শ্রেণীর লোকজন একটু দূরদর্শী হলে, কম সুবিধাবাদী হলে স্বাধীন বাংলাদেশে জেল-জুলুম-হত্যা-গুমের রাজনীতির কথা ভাবাই অসম্ভব হতো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মিত ক্ষমতা হস্তান্তর হলে দেশব্যাপী সহিংস কর্মকাণ্ডের প্রতিযোগিতা এত উৎকট হতো না। বিএনপির পক্ষে অবাধ নির্বাচনের যে দাবি তোলা হয়েছে, সেটা শুধু দলীয় দাবি নয়। তাই এ বিষয়টির গুরুত্ব অস্বীকার করার মতো নয়। বিষয়টি স্বাধীন জনগণের ভোটাধিকার, অর্থাৎ আমার, আপনার- সবার ভোটের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন করা আমাদের সবার অধিকার ও দায়িত্ব। সরকারকে তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেই হবে।
শিক্ষিত সুবিধাবাদীদের রাজনৈতিক স্ববিরোধিতা ও সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরই সাহায্য করছে, যারা জনগণের ওপর অবৈধ ও অবাঞ্ছিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু এখনই নয়, অতীতেও একই কাজ করা হয়েছে। যে কারণে এখন সরকারের পক্ষে বলা সহজ হচ্ছে, কখন নির্বাচন হবে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার এবং সে নির্বাচনও হবে তাদের সরকারের অধীনেই। অর্থাৎ দেশের মালিক-মোক্তার তারা, আমরা নই, জনগণও নয়। আমাদের কারও কিছু বলার নেই। কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনারও তো কিছু থাকতে পারে না। আরও কঠিন হওয়ার কথাই সরকার বারবার শোনাচ্ছে। এ মুহূর্তে দেশব্যাপী সহিংসতার কারণে যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে, তা থেকে কোর্ট-আদালতের বিচারকরাও নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারছেন না। স্বৈরশাসন সুবিচারের সহায়ক শক্তি হতে পারেনি বলেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানের ওপর। অথচ হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের কাছ থেকে তারা কিছুটা হলেও বিচার পেয়েছে।
যে ভোটাধিকারের জন্য এদেশের জনগণকে পাকিস্তান ভাঙতে হয়েছে, লাখ লাখ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে- সেই ভোটাধিকারের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে ঘুরেফিরে বারবার রক্ত দিতে হচ্ছে। দেশব্যাপী ভয়াবহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় পাচ্ছে।
এটা কে না জানে যে, আমাদের রাজনীতির বিরাট অংশজুড়ে চলছে দুর্নীতি, ভুয়া মামলা আর মিথ্যার খেলা। খুন-খারাবি, হরতাল-অবরোধ বা ঘেরাওয়ের রাজনীতি তো নতুন কিছু নয়। জনগণ রক্ত দেবে আর নেতারা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তারা পুলিশসহ সব রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করবেন। যারা বিরোধী দলে আছেন, তারাও দলীয় পেশিশক্তি প্রয়োগ করবেন। ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের আশ্রয় নেবেন। প্রশ্ন করলে নেতাদের অনুসারী ও সহযোগীরা বলেন, এটাই রাজনীতি।
পুলিশি ক্ষমতা যতই দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে সরকার যে কত অসহায় তার দৃষ্টান্ত দেখা গেল বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের বিজেপি সভাপতির তথাকথিত টেলিফোন কল নিয়ে। বেগম খালেদা জিয়ার ওপর পুলিশ পিপার স্প্রে করার পর তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভারতের বিজেপি সভাপতি টেলিফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন শুনে সরকারকে অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে ভুগতে হয়েছে। অথচ দুটি বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে অপর একজন রাজনৈতিক নেতার সৌজন্যমূলক ফোনালাপ হতেই পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমাদের সরকার এতটা দুশ্চিন্তায় পড়ল যা দেখে মনে হয়েছে, বৈধ সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপর থেকে ভারত তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নইলে এত শংকা ও উদ্বেগের কারণ ছিল না। আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি যে কত বিদেশনির্ভর, এ ঘটনায় তা পরিষ্কার হয়েছে। সরকার ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ হবে না। কিন্তু সরকার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচনা-সমঝোতার চেষ্টা করলে সেটাই হতো সবার জন্য শুভ ও কল্যাণকর। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
এখনও দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য সোচ্চার হতে পারছেন না। মনে করছেন, নিজেরা নীরব থাকলে তারা নিরাপদ থাকবেন। এখনও তাই অন্যায় সুবিধাভোগীরা ভাবছেন তাদেরই বিজয় হবে। জাতি অসহায় ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে সবই মেনে নেবে।
সরকারি নেতৃত্বের একগুঁয়েমির স্বরূপ প্রকট হওয়ার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ভয়াবহ সংকট নিরসনের কোনো সদিচ্ছা যে সরকারের নেই, তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। অবস্থা এসে এমন জায়গায় ঠেকেছে যে, স্বাধীন দেশের জনগণ অবাধ নির্বাচন প্রত্যাশা করতে পারবে না। কিন্তু স্বাধীনতার তাৎপর্য হচ্ছে, সরকার হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। উন্নয়নের কথা শুনিয়ে ক্ষমতা দখলের ন্যায্যতা দাবি করা স্বৈরতন্ত্রের চিন্তাভাবনা। আমরা যখন বলি, পাকিস্তান আমলে আমরা স্বাধীন ছিলাম না, তখন অনির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসনের কথাই বুঝিয়ে থাকি।
প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম আমলা-উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিলেন, নির্বাচন কবে হবে তা সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, নির্বাচন কখন হবে সে ব্যাপারে সরকার শাসনতান্ত্রিক বিধান মানতে বাধ্য। অর্থাৎ বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় হতে পারে না। নির্বাচন না করেই সরকার গঠনের দাবি কেউ করতে পারেন না। সরকারের পক্ষে জনসমর্থন থাকলে অবাধ নির্বাচনে তো কারও ভয়-ভীতি থাকতে পারে না। সরকারের নেতারা বলছেন, সন্ত্রাসীদের নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন না। অন্যরাও তো দাবি করতে পারেন, ভোট হরণকারীদের সঙ্গে তারা বসবেন না। সেজন্য স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে, জনগণের ভোটের অধিকার দলীয় রাজনীতির তর্ক-বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। বিজ্ঞ উপদেষ্টা সাহেব এমনও বলেছেন, প্রয়োজন হলে বিএনপিকে অবৈধ করা হবে। তিনি মনে করছেন, বিএনপিকে শেষ করতে পারলেই জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া যাবে।
এটা বলা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না যে, একশ্রেণীর বিবেকবর্জিত আমলা আছেন, তাদের সংখ্যা যতই কম হোক না কেন, তারা জনগণের অর্থে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন অথচ জনগণের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করেন না। পুলিশি ক্ষমতার অবপব্যবহারই তাদের শক্তি- জনগণ বা জনমত নয়। তারা সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য দিতে জানেন না। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলবেন না।
এখন সরকার তাদের বুদ্ধিদাতাদের পরামর্শে গণতন্ত্রের কথা বেশি না বলে উন্নয়নের রাজনীতির কথা শোনাচ্ছে। দেশের জনগণকে খুব বেশি বোকা হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং নিজেদের খুব বুদ্ধিমান মনে করা হচ্ছে।
এটা সত্য হলে তাদের এও বলতে হবে যে, অতীতে বড় বড় নেতা গণতন্ত্রের নামে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন, তারা জনগণের উন্নয়ন-অগ্রগতি চাননি।
গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয় জনগণের ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য। স্বৈরশাসনেও উন্নয়ন হয়; কিন্তু সে উন্নয়নের সিংহভাগ ভোগ করে দুর্নীতিপরায়ণ লুটেরা শ্রেণী। তাই যারা গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়নের কথা বলছেন, তারা তো লুটেরাদের উন্নয়নের কথা বলছেন। লুটেরাদের নিয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার একটি পাকাপোক্ত গণবিরোধী ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার কথাই ভাবছেন।
সরকারের সুবিধাভোগীরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ের লোকের সম্পৃক্ততা না থাকলে বিএনপির আন্দোলন জনগণের আন্দোলনে রূপ নেবে না। তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ের আন্দোলন দেখতে চাইছেন।
অর্থাৎ সিভিল ওয়ার। দায়িত্বহীনতার একটা সীমা থাকা দরকার।
নির্বাচনী বৈধতার জন্য মাঠ পর্যায়ের লোকদের সমর্থন তো প্রয়োজন হবে সরকারের। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য মাঠ পর্যায়ের কেন, কোনো পর্যায়ের আন্দোলনই তো হওয়ার কথা নয়। জনগণের ভোটের অধিকার স্বাধীনতার অধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্বের অধিকার। এটি কারও সঙ্গে আপস-সমঝোতার বিষয় নয়। জনগণ স্বাধীনতার মাধ্যমে এ ভোটাধিকার অর্জন করেছে- কারও অনুগ্রহের অনুদান হিসেবে পায়নি। এজন্যই আমাকে বারবার বলতে হচ্ছে, দেশে সত্যিকার রাজনীতি নেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বও নেই।
একটি ভুয়া নির্বাচনকে যেসব বুদ্ধিজীবী গণতন্ত্র মনে করেন, তারাই যখন আবার বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চলতে দেখে গণতন্ত্র গেল, গণতন্ত্র গেল বলে হা-হুতাশ করেন, তখন বুঝতে পারি না তারা আসলে নিজেদের কত চালাক-চতুর মনে করেন। অপরদিকে একদল বড় ব্যবসায়ী আছেন, যারা জনসাধারণের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন এবং তাদের ওপর যে কোনো ধরনের অন্যায়-নির্যাতন চালানো হোক না কেন, পুলিশের ব্যবস্থাধীনে নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারলেই তারা খুশি। বলবেন, দেশে শান্তি বিরাজ করছে। অপর একদল আছেন যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির থিওরি দেবেন; কিন্তু নির্বাচনই যে সংকট নিরসনের সহজ ও একমাত্র পথ তা স্পষ্টভাবে বলবেন না। প্রহসনের নির্বাচন করতে গিয়েই যে বর্তমানের ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তাও তারা স্বীকার করবেন না।
অথচ সবাই মিলে যদি কিছুটা দূরদর্শিতা, কিছুটা সৎ সাহসের স্বাক্ষর রাখতে পারতাম, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, জনমতের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়ে শুধু পুলিশি নির্যাতনের ওপর নির্ভর করে কোনো সরকার জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা আনতে পারে না, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে পারে না। লজ্জাজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষিত সচেতন শ্রেণীর লোকজন একটু দূরদর্শী হলে, কম সুবিধাবাদী হলে স্বাধীন বাংলাদেশে জেল-জুলুম-হত্যা-গুমের রাজনীতির কথা ভাবাই অসম্ভব হতো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মিত ক্ষমতা হস্তান্তর হলে দেশব্যাপী সহিংস কর্মকাণ্ডের প্রতিযোগিতা এত উৎকট হতো না। বিএনপির পক্ষে অবাধ নির্বাচনের যে দাবি তোলা হয়েছে, সেটা শুধু দলীয় দাবি নয়। তাই এ বিষয়টির গুরুত্ব অস্বীকার করার মতো নয়। বিষয়টি স্বাধীন জনগণের ভোটাধিকার, অর্থাৎ আমার, আপনার- সবার ভোটের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন করা আমাদের সবার অধিকার ও দায়িত্ব। সরকারকে তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেই হবে।
শিক্ষিত সুবিধাবাদীদের রাজনৈতিক স্ববিরোধিতা ও সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরই সাহায্য করছে, যারা জনগণের ওপর অবৈধ ও অবাঞ্ছিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু এখনই নয়, অতীতেও একই কাজ করা হয়েছে। যে কারণে এখন সরকারের পক্ষে বলা সহজ হচ্ছে, কখন নির্বাচন হবে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার এবং সে নির্বাচনও হবে তাদের সরকারের অধীনেই। অর্থাৎ দেশের মালিক-মোক্তার তারা, আমরা নই, জনগণও নয়। আমাদের কারও কিছু বলার নেই। কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনারও তো কিছু থাকতে পারে না। আরও কঠিন হওয়ার কথাই সরকার বারবার শোনাচ্ছে। এ মুহূর্তে দেশব্যাপী সহিংসতার কারণে যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে, তা থেকে কোর্ট-আদালতের বিচারকরাও নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারছেন না। স্বৈরশাসন সুবিচারের সহায়ক শক্তি হতে পারেনি বলেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানের ওপর। অথচ হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের কাছ থেকে তারা কিছুটা হলেও বিচার পেয়েছে।
যে ভোটাধিকারের জন্য এদেশের জনগণকে পাকিস্তান ভাঙতে হয়েছে, লাখ লাখ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে- সেই ভোটাধিকারের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে ঘুরেফিরে বারবার রক্ত দিতে হচ্ছে। দেশব্যাপী ভয়াবহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় পাচ্ছে।
এটা কে না জানে যে, আমাদের রাজনীতির বিরাট অংশজুড়ে চলছে দুর্নীতি, ভুয়া মামলা আর মিথ্যার খেলা। খুন-খারাবি, হরতাল-অবরোধ বা ঘেরাওয়ের রাজনীতি তো নতুন কিছু নয়। জনগণ রক্ত দেবে আর নেতারা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তারা পুলিশসহ সব রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করবেন। যারা বিরোধী দলে আছেন, তারাও দলীয় পেশিশক্তি প্রয়োগ করবেন। ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের আশ্রয় নেবেন। প্রশ্ন করলে নেতাদের অনুসারী ও সহযোগীরা বলেন, এটাই রাজনীতি।
পুলিশি ক্ষমতা যতই দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে সরকার যে কত অসহায় তার দৃষ্টান্ত দেখা গেল বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের বিজেপি সভাপতির তথাকথিত টেলিফোন কল নিয়ে। বেগম খালেদা জিয়ার ওপর পুলিশ পিপার স্প্রে করার পর তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভারতের বিজেপি সভাপতি টেলিফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন শুনে সরকারকে অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে ভুগতে হয়েছে। অথচ দুটি বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে অপর একজন রাজনৈতিক নেতার সৌজন্যমূলক ফোনালাপ হতেই পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমাদের সরকার এতটা দুশ্চিন্তায় পড়ল যা দেখে মনে হয়েছে, বৈধ সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপর থেকে ভারত তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নইলে এত শংকা ও উদ্বেগের কারণ ছিল না। আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি যে কত বিদেশনির্ভর, এ ঘটনায় তা পরিষ্কার হয়েছে। সরকার ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ হবে না। কিন্তু সরকার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচনা-সমঝোতার চেষ্টা করলে সেটাই হতো সবার জন্য শুভ ও কল্যাণকর। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments