পারিলার চাষিরা পারলেন- বাজারের ব্যাগে তাজা মাছ, ফরমালিনের সন্দেহও নেই by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
(বড় মাছ তাজা রেখে সেগুলো প্রতিদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন রাজশাহীর পারিলা গ্রামের মাছচাষিরা l ছবি: শহীদুল ইসলাম) রুই,
কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প—যত বড় হবে তত কদর বেশি, দামও। আর এ মাছ যদি
জীবিত বা তাজা হয়, তাহলে তো দাম আরও বেশি। কিন্তু পানি থেকে ওঠানোর পর
মাছ বেশিক্ষণ বাঁচানো কঠিন। ভাবতে ভাবতে উপায়ও একটা বের করলেন সোহরাব
হোসেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা গ্রামের মাছচাষি তিনি।
একসময়ের দরিদ্র চাষি সোহরাব হোসেনের হাত ধরে এখন মাছ চাষ ও তাজা মাছ বাজারজাত করার ব্যবসায় নেমে পড়েছেন পারিলার ২০০ চাষি। ভোক্তার কাছে তাজা মাছ পৌঁছে দিতে এবং এর মাধ্যমে ফরমালিন আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে এই চাষিরা গড়ে তুলেছেন এক সফল আন্দোলনও।
পদ্ধতিটি সহজ, তবে এতে বাড়তি শ্রম লাগে। বড় মাছ বিক্রির ক্ষেত্রে সোহরাব মূলত পোনা মাছ বাজারজাত করার পদ্ধতিটিকেই কাজে লাগিয়েছেন। পুকুর থেকে ধরার পর মাছ পানিভর্তি ড্রামে নেওয়া হয়। সেই পানিসুদ্ধ ড্রামই যায় স্থানীয় বাজারে। ক্রেতা সেখান থেকে কিনে নেন জেতা মাছ। আর ঢাকাসহ দূরের বাজারে মাছ নেওয়া হয় ট্রাকে।
ট্রাকের ভেতর মোটা পলিথিন বা নিশ্ছিদ্র ত্রিপল বিছিয়ে পানি ভরা হয়। তাতেই ‘খেলা করতে করতে’ মাছ যায় বাজারে। যাত্রার এ সময় অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে পাতিলে পা ঢুকিয়ে পানিতে অনবরত ঢেউ তোলা হয়।
কয়েক বছরে এই প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন পারিলার জেতা মাছ যাচ্ছে ঢাকার নিউ মার্কেট, যাত্রাবাড়ী ও রামপুরা (মধ্যবাড্ডা), সাভারের ফুলবাড়ী বাজার, গাজীপুরের কালিয়াকৈর বাজারে। একইভাবে যায় রংপুর পৌরসভা, বগুড়া চেলোপাড়া, টাঙ্গাইলের পার্কবাজার, সিরাজগঞ্জের গোলচত্বর ও নরসিংদীর পাঁচদানা বাজারে। রাজশাহীতে শুধু সাহেব বাজারে এই মাছ পাওয়া যায়।
ট্রাকে থাকা অবস্থায় মাছের দাম করা হয়। প্রথমে পানিসহ ট্রে আলাদা করে ওজন করা হয়। পরে মাছসহ ট্রে ওজন করে মাছের ওজন নির্ধারণ করা হয়। পাঁচ কেজি ওজনের একটি মাছ পাইকারি বাজারে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন চাষিরা।
বড় মাছ চাষ ও সেগুলো বেশি মুনাফায় বাজারজাত করার এই উদ্যোগ ভাগ্য বদলে দিয়েছে পারিলার মানুষদের। একসময় যে গ্রামের মানুষের বাইসাইকেল কেনার পয়সা ছিল না তাঁদের ঘরে এখন মোটরসাইকেল। বড় মাছ চাষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গড়ে উঠেছে বহুমুখী ব্যবসা।
গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ পরিবারই এখন কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে মাছ ব্যবসায়। নিজেদের চাষ করা মাছ পরিবহন করতে গ্রামবাসী কিনেছেন ছোট-বড় অন্তত ৮০টি ট্রাক। খাটছে ভাড়ার ট্রাকও। প্রতি রাতে এসব ট্রাকে করে গ্রাম থেকে তাজা বড় মাছ যাচ্ছে বিভিন্ন বাজারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষক আখতার হোসেন বলেন, পারিলার মাছচাষিরা বাজারে তাজা মাছ সরবরাহ করতে গিয়ে মাছে ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি ওই গ্রামের ১০ জন চাষিকে নিয়ে কাজও করেছেন।
যেভাবে শুরু: ১৯৯৮ সালের কথা। পারিলা গ্রামের যুবক সোহরাব হোসেন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারেননি। চাকরিও হয়নি। কাজ খুঁজে হয়রান। একসময় খেয়াল করলেন গ্রামের সস্তা জমি ইজারা নিয়ে বাইরের মাছ ব্যবসায়ীরা পোনা মাছ চাষ করছেন। ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বড় মাছ চাষের পরিকল্পনা করেন তিনি। সফলও হন। ১০-১২ কেজি ওজনের মাছও উৎপাদন হয় তাঁর পুকুরে। কিন্তু এত বড় মাছ নিয়ে বাজারে গেলেই শুনতে হয়—বিদেশ থেকে আমদানি করা মাছ। তার ওপর মরা। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না, এটা পারিলার পুকুরের মাছ। মাছ বড় করেও ভালো দাম পান না সোহরাব। ভাবেন, জেতা মাছ নিয়ে বাজারে যেতে পারলে কেউ আর বলতে পারবে না আমদানির মাছ।
সোহরাব বলেন, পানিভর্তি ড্রামে করে রাজশাহীর বাজারে নিয়ে যান তাজা মাছ। এবার ক্রেতাদের চোখ তাঁর মাছের দিকে। আগের তুলনায় কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দাম পাওয়া গেল। আস্তে আস্তে বগুড়া ও ঢাকায় ভালো বাজার খুঁজে পান। গত চার বছর ঢাকার নিউ মার্কেটসহ অন্যান্য বাজারে যাচ্ছে পারিলার তাজা বড় মাছ।
সোহরাব বলেন, ‘বলতে গেলে আমার কিছুই ছিল না। এখন ৩০০ বিঘা জমির পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছি। তিনটা ট্রাক কিনেছি মাছ পরিবহনের জন্য। মনের মতো বাড়িও করেছি একটা। বিঘা দশ জমিও কিনেছি।’ সোহরাব জানান, সিড (SEED) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ওয়েবসাইটেও এ গ্রামের মাছ চাষের কাহিনি স্থান পেয়েছে।
সোহরাব জানান, ধরার পর মাছ দ্রুত পানিভর্তি ড্রামে তোলা হয়। স্থানীয় বাজারে পৌঁছা পর্যন্ত পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে অনবরত হাত দিয়ে ঢেউ তোলা হয়। আর একসঙ্গে বেশি মাছ ঢাকাসহ দূরের জেলায় পাঠাতে ট্রাকের ভেতর মোটা পলিথিন বা নিশ্ছিদ্র ত্রিপল বিছিয়ে পানি ভরা হয়। অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে একটা খালি পাতিলের ভেতর পা ঢুকিয়ে ট্রাকের ওপর বসে সেটার সাহায্যে অনবরত ঢেউ দিতে হয়। রাজশাহী থেকে ঢাকার মতো দূরত্বে নেওয়ার জন্য পথে একবার পানি বদল করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় একটি ট্রাকে ১২ থেকে ১৪ মণ মাছ পরিবহন করা হয়।
বদলে গেছে গ্রাম: পারিলার এক বিঘা জমি আগে পাঁচ হাজার টাকায় এক বছর মেয়াদে ইজারা পাওয়া যেত। এখন ইজারা নিতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাগে। গ্রামে প্রায় ২ হাজার বিঘা জমির পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। গ্রাম ছাপিয়ে এখন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাট, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে যেখানেই পুকুর সেখানেই আছেন পারিলার চাষিরা। স্থানীয়দের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় মাছ চাষ করছেন তাঁরা।
তাজা মাছের এই ব্যবসায় জড়িয়ে গ্রামের কেউ এখন জাল বোনেন, কেউ পুকুরে জাল টানেন, কেউ পুকুর পাহারা দেন, কেউ ট্রাকে পানি ভরেন, কেউ ট্রাক চালান, কেউ পানিতে ঢেউ দেন, কেউ মাছের খাবারের ব্যবসা করেন, আর কেউবা বিদেশ থেকে খৈল আমদানি করেন। গ্রামের কোনো সামর্থ্যবান নারী-পুরুষ বেকার নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পুকুরে দুই-এক ঘণ্টা জাল টেনে নিজেই নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করেন।
গ্রামের চাষি ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শফিকুল আলম বলেন, এই মাছ চাষ গ্রামের মানুষের ভেদাভেদও ভুলিয়ে দিয়েছে। নেই কোনো রকম রাজনৈতিক বৈরিতা। আছে কেবল ভালো মাছ চাষ ও নতুন বাজার ধরার প্রতিযোগিতা।
শফিকুল আলমের দাবি, মাছের খাবার হিসেবে কোনো ধরনের বিষ্টা বা অখাদ্য কিছু ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মাছের খাবার হিসেবে রেডি ফিড, খৈল ও গমের ভুসি ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে পানিতে শেওলা তৈরির জন্য মাসে একবার হালকা টিএসপি সার ব্যবহার করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের পিএইচডি গবেষক আরিফুল ইসলাম বলেন, পারিলার মাছচাষিরা যে তৈরি খাবার ব্যবহার করেন, তা সরকার অনুমোদিত। এর মধ্যে কোনো ধরনের ‘গ্রোথ হরমোন’ ব্যবহার করা হয় না।
আর সোহরাব জানান, সাধারণত রুই মাছ ২২ মাসে, কাতলা ও সিলভার কার্প মাছ ১৮ মাসে পাঁচ কেজি ওজনের হয়।
সম্প্রতি একদিন সন্ধ্যায় গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাক। ট্রাকে রাখা মোটা পলিথিনের আধারে পাম্পের সাহায্যে পানি ভরা হচ্ছে। পুকুর পাড়ে রাখা সারি সারি ভ্যান। ভ্যানের ওপর পানিভর্তি ড্রাম। মাছ ধরে তোলা হচ্ছে ড্রামে। পরে ভ্যানগুলো যাচ্ছে ট্রাকের কাছে। ট্রাকে মাছ ওঠানোর পর একজন পানিতে অনবরত ঢেউ দিচ্ছেন। পুকুরগুলোর ধার দিয়ে কলা আর শাক-সবজির চাষ চোখে লাগার মতো।
গ্রামের এই মাছচাষিদের একটি অনুযোগ আছে। ট্রাকে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই কি না—তা যাচাইয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় অন্যান্য ট্রাকের সঙ্গে তাঁদের মাছবাহী ট্রাকও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। মাঝেমধ্যেই এত দেরি হয় যে বাজারের সময় চলে যায়। মাছও মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে কম দামে মাছ বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁদের।
চাষিরা বলেন, তাঁদের ট্রাকে শুধু পানি ভর্তি থাকে। আর থাকে কিছু মাছ। পানি দিয়ে তো কখনোই ট্রাক অতিরিক্ত বোঝাই করা সম্ভব নয়। তাই এই ট্রাকগুলোকে স্কেলিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড় না করিয়ে যেন দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রধান রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, তাজা মাছের ট্রাক আলাদা সারিতে নিয়ে আগে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে স্থানীয়ভাবে তাঁরা কিছু করতে পারবেন না। এ জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত লাগবে।
একসময়ের দরিদ্র চাষি সোহরাব হোসেনের হাত ধরে এখন মাছ চাষ ও তাজা মাছ বাজারজাত করার ব্যবসায় নেমে পড়েছেন পারিলার ২০০ চাষি। ভোক্তার কাছে তাজা মাছ পৌঁছে দিতে এবং এর মাধ্যমে ফরমালিন আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে এই চাষিরা গড়ে তুলেছেন এক সফল আন্দোলনও।
পদ্ধতিটি সহজ, তবে এতে বাড়তি শ্রম লাগে। বড় মাছ বিক্রির ক্ষেত্রে সোহরাব মূলত পোনা মাছ বাজারজাত করার পদ্ধতিটিকেই কাজে লাগিয়েছেন। পুকুর থেকে ধরার পর মাছ পানিভর্তি ড্রামে নেওয়া হয়। সেই পানিসুদ্ধ ড্রামই যায় স্থানীয় বাজারে। ক্রেতা সেখান থেকে কিনে নেন জেতা মাছ। আর ঢাকাসহ দূরের বাজারে মাছ নেওয়া হয় ট্রাকে।
ট্রাকের ভেতর মোটা পলিথিন বা নিশ্ছিদ্র ত্রিপল বিছিয়ে পানি ভরা হয়। তাতেই ‘খেলা করতে করতে’ মাছ যায় বাজারে। যাত্রার এ সময় অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে পাতিলে পা ঢুকিয়ে পানিতে অনবরত ঢেউ তোলা হয়।
কয়েক বছরে এই প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন পারিলার জেতা মাছ যাচ্ছে ঢাকার নিউ মার্কেট, যাত্রাবাড়ী ও রামপুরা (মধ্যবাড্ডা), সাভারের ফুলবাড়ী বাজার, গাজীপুরের কালিয়াকৈর বাজারে। একইভাবে যায় রংপুর পৌরসভা, বগুড়া চেলোপাড়া, টাঙ্গাইলের পার্কবাজার, সিরাজগঞ্জের গোলচত্বর ও নরসিংদীর পাঁচদানা বাজারে। রাজশাহীতে শুধু সাহেব বাজারে এই মাছ পাওয়া যায়।
ট্রাকে থাকা অবস্থায় মাছের দাম করা হয়। প্রথমে পানিসহ ট্রে আলাদা করে ওজন করা হয়। পরে মাছসহ ট্রে ওজন করে মাছের ওজন নির্ধারণ করা হয়। পাঁচ কেজি ওজনের একটি মাছ পাইকারি বাজারে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন চাষিরা।
বড় মাছ চাষ ও সেগুলো বেশি মুনাফায় বাজারজাত করার এই উদ্যোগ ভাগ্য বদলে দিয়েছে পারিলার মানুষদের। একসময় যে গ্রামের মানুষের বাইসাইকেল কেনার পয়সা ছিল না তাঁদের ঘরে এখন মোটরসাইকেল। বড় মাছ চাষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গড়ে উঠেছে বহুমুখী ব্যবসা।
গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ পরিবারই এখন কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে মাছ ব্যবসায়। নিজেদের চাষ করা মাছ পরিবহন করতে গ্রামবাসী কিনেছেন ছোট-বড় অন্তত ৮০টি ট্রাক। খাটছে ভাড়ার ট্রাকও। প্রতি রাতে এসব ট্রাকে করে গ্রাম থেকে তাজা বড় মাছ যাচ্ছে বিভিন্ন বাজারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষক আখতার হোসেন বলেন, পারিলার মাছচাষিরা বাজারে তাজা মাছ সরবরাহ করতে গিয়ে মাছে ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি ওই গ্রামের ১০ জন চাষিকে নিয়ে কাজও করেছেন।
যেভাবে শুরু: ১৯৯৮ সালের কথা। পারিলা গ্রামের যুবক সোহরাব হোসেন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারেননি। চাকরিও হয়নি। কাজ খুঁজে হয়রান। একসময় খেয়াল করলেন গ্রামের সস্তা জমি ইজারা নিয়ে বাইরের মাছ ব্যবসায়ীরা পোনা মাছ চাষ করছেন। ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বড় মাছ চাষের পরিকল্পনা করেন তিনি। সফলও হন। ১০-১২ কেজি ওজনের মাছও উৎপাদন হয় তাঁর পুকুরে। কিন্তু এত বড় মাছ নিয়ে বাজারে গেলেই শুনতে হয়—বিদেশ থেকে আমদানি করা মাছ। তার ওপর মরা। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না, এটা পারিলার পুকুরের মাছ। মাছ বড় করেও ভালো দাম পান না সোহরাব। ভাবেন, জেতা মাছ নিয়ে বাজারে যেতে পারলে কেউ আর বলতে পারবে না আমদানির মাছ।
সোহরাব বলেন, পানিভর্তি ড্রামে করে রাজশাহীর বাজারে নিয়ে যান তাজা মাছ। এবার ক্রেতাদের চোখ তাঁর মাছের দিকে। আগের তুলনায় কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দাম পাওয়া গেল। আস্তে আস্তে বগুড়া ও ঢাকায় ভালো বাজার খুঁজে পান। গত চার বছর ঢাকার নিউ মার্কেটসহ অন্যান্য বাজারে যাচ্ছে পারিলার তাজা বড় মাছ।
সোহরাব বলেন, ‘বলতে গেলে আমার কিছুই ছিল না। এখন ৩০০ বিঘা জমির পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছি। তিনটা ট্রাক কিনেছি মাছ পরিবহনের জন্য। মনের মতো বাড়িও করেছি একটা। বিঘা দশ জমিও কিনেছি।’ সোহরাব জানান, সিড (SEED) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ওয়েবসাইটেও এ গ্রামের মাছ চাষের কাহিনি স্থান পেয়েছে।
সোহরাব জানান, ধরার পর মাছ দ্রুত পানিভর্তি ড্রামে তোলা হয়। স্থানীয় বাজারে পৌঁছা পর্যন্ত পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে অনবরত হাত দিয়ে ঢেউ তোলা হয়। আর একসঙ্গে বেশি মাছ ঢাকাসহ দূরের জেলায় পাঠাতে ট্রাকের ভেতর মোটা পলিথিন বা নিশ্ছিদ্র ত্রিপল বিছিয়ে পানি ভরা হয়। অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে একটা খালি পাতিলের ভেতর পা ঢুকিয়ে ট্রাকের ওপর বসে সেটার সাহায্যে অনবরত ঢেউ দিতে হয়। রাজশাহী থেকে ঢাকার মতো দূরত্বে নেওয়ার জন্য পথে একবার পানি বদল করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় একটি ট্রাকে ১২ থেকে ১৪ মণ মাছ পরিবহন করা হয়।
বদলে গেছে গ্রাম: পারিলার এক বিঘা জমি আগে পাঁচ হাজার টাকায় এক বছর মেয়াদে ইজারা পাওয়া যেত। এখন ইজারা নিতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাগে। গ্রামে প্রায় ২ হাজার বিঘা জমির পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। গ্রাম ছাপিয়ে এখন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাট, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে যেখানেই পুকুর সেখানেই আছেন পারিলার চাষিরা। স্থানীয়দের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় মাছ চাষ করছেন তাঁরা।
তাজা মাছের এই ব্যবসায় জড়িয়ে গ্রামের কেউ এখন জাল বোনেন, কেউ পুকুরে জাল টানেন, কেউ পুকুর পাহারা দেন, কেউ ট্রাকে পানি ভরেন, কেউ ট্রাক চালান, কেউ পানিতে ঢেউ দেন, কেউ মাছের খাবারের ব্যবসা করেন, আর কেউবা বিদেশ থেকে খৈল আমদানি করেন। গ্রামের কোনো সামর্থ্যবান নারী-পুরুষ বেকার নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পুকুরে দুই-এক ঘণ্টা জাল টেনে নিজেই নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করেন।
গ্রামের চাষি ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শফিকুল আলম বলেন, এই মাছ চাষ গ্রামের মানুষের ভেদাভেদও ভুলিয়ে দিয়েছে। নেই কোনো রকম রাজনৈতিক বৈরিতা। আছে কেবল ভালো মাছ চাষ ও নতুন বাজার ধরার প্রতিযোগিতা।
শফিকুল আলমের দাবি, মাছের খাবার হিসেবে কোনো ধরনের বিষ্টা বা অখাদ্য কিছু ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মাছের খাবার হিসেবে রেডি ফিড, খৈল ও গমের ভুসি ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে পানিতে শেওলা তৈরির জন্য মাসে একবার হালকা টিএসপি সার ব্যবহার করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের পিএইচডি গবেষক আরিফুল ইসলাম বলেন, পারিলার মাছচাষিরা যে তৈরি খাবার ব্যবহার করেন, তা সরকার অনুমোদিত। এর মধ্যে কোনো ধরনের ‘গ্রোথ হরমোন’ ব্যবহার করা হয় না।
আর সোহরাব জানান, সাধারণত রুই মাছ ২২ মাসে, কাতলা ও সিলভার কার্প মাছ ১৮ মাসে পাঁচ কেজি ওজনের হয়।
সম্প্রতি একদিন সন্ধ্যায় গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাক। ট্রাকে রাখা মোটা পলিথিনের আধারে পাম্পের সাহায্যে পানি ভরা হচ্ছে। পুকুর পাড়ে রাখা সারি সারি ভ্যান। ভ্যানের ওপর পানিভর্তি ড্রাম। মাছ ধরে তোলা হচ্ছে ড্রামে। পরে ভ্যানগুলো যাচ্ছে ট্রাকের কাছে। ট্রাকে মাছ ওঠানোর পর একজন পানিতে অনবরত ঢেউ দিচ্ছেন। পুকুরগুলোর ধার দিয়ে কলা আর শাক-সবজির চাষ চোখে লাগার মতো।
গ্রামের এই মাছচাষিদের একটি অনুযোগ আছে। ট্রাকে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই কি না—তা যাচাইয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় অন্যান্য ট্রাকের সঙ্গে তাঁদের মাছবাহী ট্রাকও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। মাঝেমধ্যেই এত দেরি হয় যে বাজারের সময় চলে যায়। মাছও মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে কম দামে মাছ বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁদের।
চাষিরা বলেন, তাঁদের ট্রাকে শুধু পানি ভর্তি থাকে। আর থাকে কিছু মাছ। পানি দিয়ে তো কখনোই ট্রাক অতিরিক্ত বোঝাই করা সম্ভব নয়। তাই এই ট্রাকগুলোকে স্কেলিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড় না করিয়ে যেন দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রধান রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, তাজা মাছের ট্রাক আলাদা সারিতে নিয়ে আগে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে স্থানীয়ভাবে তাঁরা কিছু করতে পারবেন না। এ জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত লাগবে।
No comments