অপরাধ ও আইন প্রয়োগ- ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কেন বন্ধ হচ্ছে না? by মশিউল আলম
গত তিন দিনে ঢাকা, যশোর ও ঝিনাইদহে চারটি
‘বন্দুকযুদ্ধে’ চারজন মানুষের মৃত্যুর খবরে প্রশ্ন জাগছে, হঠাৎ করে এই
ধারার ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বেড়ে গেল কেন? অবশ্য যদি এ ঘটনাগুলো
বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, যদি আগামী কয়েক দিন এমন ঘটনা আর একটিও না ঘটে, তাহলে
প্রশ্নটা অমূলক হবে। তখন স্বস্তির সঙ্গে ভাবা যাবে, আইন প্রয়োগকারী
সংস্থাগুলোকে হঠাৎ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নেশায় পেয়ে বসেনি। অথবা
ধরে নেওয়া যাবে, সরকার আকস্মিকভাবে অপরাধ দমনের অভিযান শুরু করেনি। অবশ্য
খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, ডাকাতিসহ গুরুতর অপরাধবৃত্তি এত বেড়েছে যে এগুলোর রাশ
টেনে ধরার লক্ষ্যে দেশজুড়ে সত্যিকারের এক দমন অভিযান শুরু করা হলে তা
অস্বাভাবিক ঠেকত না। কিন্তু সরকার সম্ভবত সে রকম প্রয়োজন বোধ করে না।
কারণ, তাদের বিবেচনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন কোনো অবনতি ঘটেনি,
যা দূর করতে বিশেষ অভিযান শুরু করতে হয়।
এই চারটি বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে বিশেষ লক্ষণীয় একটি বিষয় হলো, এগুলোর কোনোটিতেই র্যাব নেই। চারটি বন্দুকযুদ্ধই ঘটেছে পুলিশের সঙ্গে। এর মানে কী? মাত্র তিন দিন আর চারটি ঘটনা দিয়ে এ ব্যাপারটার আলাদা মানে আবিষ্কার করা সম্ভবত সমীচীন হবে না। হয়তো এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে র্যাব হাত গুটিয়ে নিয়েছে এবং ওই কাজে এখন তৎপর হয়েছে পুলিশ বাহিনী, বিশেষত এর গোয়েন্দা বিভাগ বা ডিবি।
অল্প সময়ের মধ্যে পর পর চারটি বন্দুকযুদ্ধ এবং সেগুলোতে র্যাবের বদলে পুলিশের হাত—এ দুটি প্রশ্নজাগানিয়া বিষয় ছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে আর সবকিছু আগের মতোই অপরিবর্তিত আছে। বন্দুকযুদ্ধের বিবরণ হিসেবে সেই একই ছকবাঁধা গল্পের উপস্থাপন। তবে বিবরণটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াসে যুক্ত করা হয়েছে যে বন্দুকযুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দু-একজন সদস্যও আহত হয়েছেন।
কোনো পরিবর্তন আসেনি সেই আদি দৃষ্টিভঙ্গিতেও, যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নামের এক ক্ষিপ্র ‘এলিট ফোর্স’ এবং তার সদস্যদের দেওয়া হয়েছিল ‘ক্রসফায়ার’ ঘটানোর ক্ষমতা। সেই দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা ছিল এমন: দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ বাহিনী ও দীর্ঘসূত্রতা-কণ্টকিত বিচারব্যবস্থায় গুরুতর অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন ক্রসফায়ার। র্যাবের শুরুর দিকে ক্রসফায়ারে কেউ মারা গেলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো আর নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা বাদে অন্য প্রায় সবাই স্বস্তি প্রকাশ করত। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেত, র্যাব সদস্যদের সঙ্গে ক্রসফায়ারে যাঁর মৃত্যু ঘটেছে, তিনি ছিলেন সন্ত্রাসী, ডাকাত, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী কিংবা এমন দুর্ধর্ষ অপরাধী; যাঁর উপদ্রবে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের অপরাধীদের সম্পর্কে মানুষের অভিজ্ঞতা এমন যে দেশের প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থায় তাদের দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের উপদ্রব থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় করা। এ সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল র্যাবের ক্রসফায়ারের জনপ্রিয়তার মূল কারণ।
২০০৪ সালে, যখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে সামনে রেখে গঠন করা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নামের একটি এলিট ফোর্স। সে বছরের জুনে কাজ শুরু করার পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ৭৯টি ক্রসফায়ার ঘটিয়ে র্যাব দেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, তাদের ক্রসফায়ারে মারা পড়ছিল তথাকথিত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’সহ গুরুতর অপরাধীরা, অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যাদের কোনোভাবেই দমন করতে পারছিল না; যারা খুন, ধর্ষণসহ নানা গুরুতর অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা ডজন ডজন মামলা মাথায় নিয়েও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং নতুন নতুন অপরাধ করে যাচ্ছিল। এমন ঘটনার খবরও সে সময় সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে, কোনো এলাকার দুর্ধর্ষ কোনো অপরাধী র্যাবের ক্রসফায়ারে মারা পড়লে সেই এলাকার সাধারণ মানুষ আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে মিষ্টি বিতরণ করেছে। কিন্তু ক্রসফায়ারের সেই জনপ্রিয়তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ, র্যাবের সদস্যদের ক্রসফায়ার শুধু গুরুতর অপরাধীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অনেক নিরপরাধ সাধারণ মানুষও তাদের হাতে নিহত হয়েছে বলে জনগণ জানতে পেরেছে।
ফলে ক্রসফায়ারের সমালোচনা শুরু হয়েছে, সমালোচনা ক্রমেই বেড়েছে ও তীব্র হয়েছে এবং একপর্যায়ে র্যাব ক্রসফায়ার শব্দটির ব্যবহার বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, বন্দুকযুদ্ধ এবং এ পদ্ধতির বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আজ শুধু র্যাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, পুলিশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এটা যত বড় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত, ততটা কোনো মহলেই লক্ষ করা যাচ্ছে না। আহাজারি করছেন শুধু ভুক্তভোগীরা, যাঁরা স্বজনদের হারাচ্ছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন যে কে কখন স্বজন হারাবেন, তার আর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে শুধু র্যাব গঠনকারী সাবেক সরকারের নীতিনির্ধারকদের দায়ী করলে ভুল করা হবে। পরবর্তী সরকারও র্যাবকে একইভাবে চলতে দিয়েছে। এমনকি, আইনবহির্ভূত পন্থায় অপরাধ দমনসহ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে তারা সম্ভবত আগের সরকারের তুলনায় বেশি মাত্রায় ব্যবহার করেছে র্যাবকে। একই ধরনের বিচারবহির্ভূত পন্থা সংক্রমিত হয়েছে পুলিশের মধ্যেও। এর দায়ও সরকারের ওপর বর্তায়। কিন্তু আগের বা বর্তমানের কোনো সরকারই এসব ব্যাপারে নিজেদের দায় স্বীকার করতে চায় না। ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধ’—যে শব্দই ব্যবহার করা হোক না কেন, এ ধরনের প্রাণহানির বিবরণে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা সরকার—কারোরই দায় স্বীকারের কোনো ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। সংবাদমাধ্যমে প্রবল প্রতিবাদ হলে র্যাব-পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে শুধু এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা চলে যে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তি সন্ত্রাসী, ডাকাত, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী ইত্যাদি ছিল। জনমনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলে যে যাকে মেরে ফেলা হয়েছে, সে আর যা-ই হোক, নিরপরাধ ভালো মানুষ ছিল না। গত তিন দিনের চারটি বন্দুকযুদ্ধে যে চার ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাঁদেরও পুলিশ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছে। ঢাকার মুগদায় নিহত তরুণ তারেককে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী বলা হয়েছে, কিন্তু এলাকাবাসী বলেছেন, তারেক ভালো ছেলে ছিলেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে জরুরি প্রয়োজন বলে বিবেচনা করার এই আদি দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যে সরকার, র্যাব ও পুলিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা বলা যাবে না। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, নৃশংস ডাকাত, মানুষের জীবন অতিষ্ঠকারী খুনি-ধর্ষকদের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেললে র্যাব-পুলিশকে বাহবা দেয়, বা অন্তত মনে মনে খুশি হয়—এমন মানুষ এই সমাজে বিস্তর আছে। র্যাবের শুরুর দিনগুলোতে ক্রসফায়ারের প্রতি এই জন-অনুমোদন সুপ্রত্যক্ষ ছিল। র্যাবের সদস্যরা সেটা দেখতে পেতেন। এ কারণে তাঁরা নিজেদের একটি জনপ্রিয় বাহিনীর সদস্য ভাবার সুযোগ পেয়েছিলেন; তাঁরা গর্ব বোধ করতেন। আজও র্যাব কিংবা পুলিশ যদি শুধু অপরাধীদের ধরে ধরে নিকেশ করে, তাহলে এই সমাজের অনেকেই কোনো আপত্তি করবে না। জনগণ আপত্তি করবে, প্রতিবাদ জানাবে, এমনকি বিক্ষুব্ধ হবে যদি তাঁদের বন্দুকযুদ্ধে কোনো নিরপরাধ ‘ভালো লোক’ মারা যায়।
এ কারণেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিকে অপরাধী প্রমাণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রাণপণ চেষ্টা করে। অপরাধীকে মেরে ফেলা জায়েজ—এই দৃষ্টিভঙ্গি এ সমাজে কত প্রবল, তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত র্যাবের এক সদস্যের হাতে ঝালকাঠির কিশোর লিমনের গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানোর ঘটনা। ওই নিরীহ দরিদ্র কিশোরকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে র্যাব কর্তৃপক্ষ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা বলেছিলেন, শুধু লিমন নয়, তার পুরো পরিবারই সন্ত্রাসী। অর্থাৎ র্যাব ও সরকার ধরে নিয়েছিল, লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে পারলে জনসাধারণের কাছে এটা মনে হবে না যে তাকে গুলি করে র্যাব সদস্যটি কোনো অন্যায় করেছে।
অপরাধী বা নিরপরাধ কোনো ব্যক্তিকে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হত্যা করা দূরে থাক, শারীরিকভাবে আঘাত করারও যে অধিকার রাখে না—এ কথা আমরা সম্ভবত ভুলে গেছি। কেউ দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলার হলেও যে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া যায় না, দিলে ওই বাহিনী এবং তার দেখাদেখি অন্য বাহিনীগুলোও একসময় ভয়ংকর বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে—সরকার, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যত দিন পর্যন্ত এই উপলব্ধি না আসবে, তত দিন ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি নামে নির্জলা খুন বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments