মওদুদ সামরিক শাসন নয়, এক–এগারোবিরোধী? by মিজানুর রহমান খান
মওদুদ আহমদের নতুন বই সব সামরিক
শাসনবিরোধী, নাকি শুধু এক-এগারোর সামরিক শাসনবিরোধী, তা স্পষ্ট নয়। সদ্য
প্রকাশিত তাঁর ১৩তম বইয়ের (বাংলাদেশ ইমারজেন্সি অ্যান্ড দি আফটারম্যাথ)
পরতে পরতে দুঃখবোধ ও আক্ষেপ, জেনারেল মইন কেন খালেদা জিয়ার না হয়ে শেখ
হাসিনার অনুগত হলেন। মওদুদ আহমদ যেকোনো অবস্থাতেই সেনা হস্তক্ষেপের
বিরোধী, বেসামরিক শাসন যত বড় দুঃশাসনই হোক না কেন, তাতে কোনো অবস্থাতেই
তিনি সামরিক বাহিনীর ভূমিকা মেনে নেবেন না—তাঁর বইয়ে এমন অঙ্গীকার নেই।
তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে পরের বইয়ে এটা পাওয়ার আশা রাখি। কারণ, এরশাদের
‘জুনিয়র পার্টনার’ হওয়াকে ইদানীং তিনি দুর্ভাগ্যজনক মনে করেন, তাঁর বই পড়ে
তা মনে হয় না। বরং তিনি সেনাশাসকের গুণকীর্তন করেছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে
সামরিক বাহিনীর সমঝোতা পরিচ্ছেদটি পড়লে কারও মনে হতে পারে, তাঁর মূল
আক্ষেপ হচ্ছে, ইশ্, এই সমঝোতাটা তাঁর নিজের নেত্রীর সঙ্গে কেন হলো না!
তিনি সামরিক বাহিনী এবং ‘কতিপয় বিপথগামীর’ মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। এর মানে হলো, তাঁর চোখে যা গর্হিত ও বেআইনি, তা ‘বিপথগামীরা’ করেছে। আর ফটো আইডির মতো সাফল্যসমূহের মূল্যায়ন করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। ওঁর যুক্তি হলো, ‘এটা বলার কী আছে? তাদের বৈধতাই তো প্রশ্নবিদ্ধ।’ এটি যেন তাঁর একটি পরিষ্কার বুদ্ধিবৃত্তিক পলায়ন। খালেদা জিয়া এবং তাঁর বাহিনী, যার মধ্যে মওদুদ নিজেই একজন, এখন বলছেন, তিনি আইনমন্ত্রী থাকতে বিচারকের বয়সসীমা বৃদ্ধি কীভাবে ঘটল, তা তিনি লিখছেন। কিন্তু এক-এগারোর জরুরি অবস্থার আফটারমাথ বা পরিণাম যিনি লিখলেন, তাঁর হাত থেকেই আমরা পেতে চাইব জরুরি অবস্থার পূর্বাপর। কারণ, তাঁর বর্ণিত অনুমাননির্ভর ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের’ সঙ্গে আমরা খালেদা জিয়া ও তাঁর সহযোগীদের সত্যিকারের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইব।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শীর্ষক একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচ্ছেদে চারটি পৃষ্ঠা খরচ করে মওদুদ এক-এগারোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। মওদুদের সন্দেহ যা আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে, তা হলো, প্রায় ১০০ রাজনীতিকের চরিত্র হনন করে দেশটাকে আফগানিস্তান বানানোর একটা পরীক্ষা চলেছিল। ব্যর্থ রাষ্ট্র, তালেবানি রাষ্ট্র দেখতে তাঁর কথায় বন্ধু ‘যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত’ চেয়েছে। তবে তাঁর সরাসরি প্রশ্ন: ‘ভারত এটা দেখতে কী করে খুশি হতে পারে, যখন তার নিজেরই অনেক সমস্যা?’ এই যদি মওদুদের মূল্যায়ন হয়, তাহলে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বয়কট করল কেন? আফগানিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র ঠেকাতেই কি? মওদুদ জাতির অসামান্য উপকার করবেন, যদি তিনি এক-এগারোর পূর্বকালের খালেদা-ইয়াজউদ্দিন জুটির প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পর্দা উন্মোচন করেন। তাহলে পরিষ্কার হবে যে, তাঁদের সংবিধান তছনছটা বিদেশি শক্তির ইন্ধনে ঘটেছিল কি না? বিচারপতি হাসান-বিতর্কের পরে সংবিধান ভাঙার খেলাটা ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে কে খেলিয়ে নিল? লেবাসটা বেসামরিক থাকলেই সাত খুন মাফ?
বাংলাদেশি রাজনীতিকেরা আর কতকাল নিজেদের ক্ষমতার লোভ, অযোগ্যতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অদূরদর্শিতাকে ‘বিদেশি শক্তির’ অদৃশ্য কলকাঠির কলরব বলে আড়ালে রাখবেন? মওদুদ অ্যাংলো আমেরিকান টমাস পেইনের মতো জাতির বন্দী বিবেক হতে চাইলে আমরা তাঁকে স্বাগত জানাব। তাঁর ক্রোধ আছড়ে পড়েছে যে ‘বিদেশি শক্তির’ ওপর, তারা কি কেবল এক-এগারোতে জেনারেলদের দিয়ে খেলিয়েছে, বেসামরিক লেবাসধারীদের দ্বারা খেলাতে চায় না, নাকি পারে না? বিএনপি-জামায়াত আমাদের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্ধতিগতভাবে কী করে ধ্বংস করেছে, তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর এজেন্টদের কারা তখন দুধকলা দিয়ে পুষেছে, সেই বিবরণী তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদের কাছ থেকে বিস্তারিত আশা করি। আর তাহলেই আমরা সম্ভবত লড়াইয়ের উপযুক্ত কৌশল রপ্ত করতে পারব।
পাকিস্তানি মনোভঙ্গি মওদুদের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। এই তুলনাকে তিনি ইতিহাসের জায়গা থেকে দেখবেন, সভয়ে সেই ভরসা রাখি। বাঙালিকে চুপ রাখতে বিদেশি শক্তির এজেন্ট বলে গালি দেওয়া তারা অভ্যাসে পরিণত করেছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এসব করতে তারা কারও পরামর্শের অপেক্ষায় থাকে? রাজনীতিবিদেরা ইতিহাসের কোন পর্বে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন? বারংবার পেছন পথে গণতন্ত্রে উত্তরণের সৈনিক হওয়া কি তাঁর ব্যক্তিগত নিয়তি? মওদুদ সম্প্রতি জেল থেকে বেরিয়ে খালেদা জিয়াকে বলেছেন, কেবল অবৈধতা আর নতুন নির্বাচনী গান গাইলে চলবে না, শাসনের নতুন প্যাকেজ দিতে হবে। সেটা কোথায়? বরং এটাই সত্য যে তিনি এখন ‘বই লিখে বাড়ি রক্ষা’ তত্ত্বে জেরবার।
পাকিস্তান প্রসঙ্গে ফিরি। মওদুদ নিরঙ্কুশভাবে এই অভিমত দিয়েছেন, যা পড়ে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর কথা মনে পড়ে। তিনি ১৯৫৬ সালেই বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা যা কিছু করে, তা সব ভারতের হিন্দুরা শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয়। এসবই পাকিস্তানের অখণ্ডতা নস্যাতের হুমকি।’ ৫৮ বছর পরেও মওদুদ ও মওদুদীর মূলসুর কাকতালীয় হলেও অভিন্ন। আমাদের রাজনীতিকেরা উত্তরাধিকার সূত্রে এই রোগে আক্রান্ত। মওদুদের নিরঙ্কুশ মূল্যায়ন: ‘বিদেশি শক্তি, যারা দেশটা রসাতলে নিতে চায়, তাদের হয়ে জেনারেল মইন মাঠে নেমেছিলেন।’ তিনি এক-এগারোর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিচারের যে দাবি তুলেছেন, তা যে-কেউ সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ফেলে দিতে আগামী নির্বাচনে জেতা বা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচারণা হিসেবে তাকে ব্যবহারের যেকোনো চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। বিদেশি শক্তির প্রতিভূ হিসেবে মইনকে শনাক্ত করতে গিয়ে মওদুদ স্ববিরোধিতা বা দ্ব্যর্থকতা থেকে মুক্ত নন। মওদুদ একবার লিখেছেন: বিদেশি শক্তি মইনকে শুরুতেই তাঁর ‘নিজস্ব খেলা’ খেলতে দেয়। কিন্তু তিনি ‘শিক্ষানবিশ’। ‘তাঁর নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা ছিল না।’ আবার লিখেছেন, ‘তাঁর কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।’ তাঁর আক্ষেপ কি এ কারণে যে, মইন কেন এরশাদ হতে পারলেন না?
কোনো সন্দেহ নেই, বিএনপির সঙ্গে এক-এগারোতে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে। তবে এও ঠিক যে, বিএনপি-জামায়াতের সরকার ২০০৬ সালে বিদায় নিয়েছিল কেবল দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসতে। ইয়াজউদ্দিনকে ব্যবহার করে তারা ৫ জানুয়ারি ধরনের একটি একতরফা নির্বাচন করাতে পারলে বর্তে যেত। সংবিধান ভাঙার অপরাধে অধ্যাপক উদ্দিনের প্রতি অনুরাগ ও জেনারেল উদ্দিনের প্রতি মওদুদের বিরাগ স্পষ্ট। অনেকের মতে, মওদুদ ছিলেন সামরিক বাহিনীর জুনিয়র পার্টনার। এই ভাবমূর্তি ভাঙতে মওদুদ তাঁর বই নামের আগ্নেয়াস্ত্রকে ব্যবহার করবেন, সেটাই মনেপ্রাণে চাইব। সব অবস্থায় রাজনীতিবিদেরাই হাল ধরবেন, এই হোক ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের উভয়ের মন্ত্র। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ভেঙে চলতে চাইলে তা স্লোগান হয়েই থাকবে। কেউ দণ্ডিত হলে তাঁকে প্রার্থী হতে দেওয়া যাবে না। ভোটের নিক্তিতে রাজনীতিকের দোষ-নির্দোষ শনাক্ত হয় না। এরশাদ ও তাঁর মতো দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচার করতে পারলে তাঁদের তো নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের তথাকথিত দুর্নীতির মামলার সঙ্গে এরশাদের দুর্নীতির মামলার তুলনা সব থেকে আপত্তিকর। মওদুদ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানিরা দুর্নীতি মামলায় জড়ানোর পরে মুজিব জাতির জনক হয়েছেন। আর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদকে জনগণ নির্বাচিত করে চলেছে।’ মুজিবের মতো এরশাদও একজন ত্যাগী নেতা, এমন ধারণা ছড়ালে কি করে রাজনীতিকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটে?
মওদুদের চোখে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ই নিষ্কলুষ। এক-এগারোর কুশীলবদের সব কাজকর্মে মওদুদের অনাস্থা ভয়ংকর। কিন্তু আস্থাবান তখন, যখন তিনি লিখেছেন, ‘পইপই করে তদন্ত করেও তারা দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে কোনো উল্লেখযোগ্য অভিযোগ আনতে পারেনি। অথচ জনগণের চোখে তাঁদের চরিত্র হননে আষাঢ়ে গল্প প্রচার করা হয়েছে।’ তাঁর দুঃখ, ‘কোনো সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করা হলো না।’ এটা ঠিক বুঝলাম না। তবে মওদুদের দুই নেত্রী-বন্দনায় শেখ হাসিনা সন্তুষ্ট হবেন কি? টাকাপয়সা তছরুপ না করে কোনো রাজনীতিক যদি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী না করে তাকে ধ্বংস করেন, দলে গণতন্ত্রের চর্চার পথ রুদ্ধ করেন, তাকে কি আমরা দুর্নীতিগ্রস্ততা বলব না? মওদুদের বয়ানে হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত, কিন্তু তাঁর কথায়, ‘সামরিক ক্রীড়নক মইনের ব্যর্থতায় হতাশ বিদেশি শক্তি হাসিনার নেতৃত্বাধীন একটি বশ্য ও অনুগত সরকারের অধিষ্ঠানকে অধিকতর পছন্দ করল।’
মওদুদ লিখেছেন, ‘ঘৃণার কারণে শেখ হাসিনা খালেদাকে ক্ষমতায় দেখতে চাননি। প্রয়োজনে মইনের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার চেয়েছেন, ৮২-তে আওয়ামী লীগ তাই করেছিল।’ মওদুদ সাহেব আশা করি তাঁর দুর্নীতি ও বিরাজনৈতিকীকরণের সংজ্ঞাটা বদলাবেন। মইনের বিরাজনৈতিকীকরণ ছিল দুই বছরের, আর দুই দলের বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া চলেছে দুই দশক ধরে। উপরন্তু গত পাঁচ বছরে যা চলেছে, তা বিরাজনৈতিকীকরণের চূড়ান্ত। তবে ভয় হয়, রাজনীতিকদের দুর্নীতির অভিযোগকে তিনি যেভাবে কেবল ভোটের দ্বারা বিচার করার ওপর ছেড়েছেন, তাতে দেশের আদালত থেকে রাজনীতিকদের বিচার-আচার তুলে দেওয়ার আবদার উঠতে পারে।
মওদুদের বইয়ের পাতায় পাতায় কান্না। ভয়ানক স্ববিরোধিতা। ‘ডাকাতদের বউদের কি কেউ মামলায় জড়ায়?’ এক-এগারোর অভিযুক্তদের স্ত্রীদের তালিকা বইয়ে ছাপিয়ে মওদুদ আলোচনা সভায় প্রশ্ন রেখেছেন। সচেতন নারীরা মওদুদের মনভোলানো কথায় ভুলবেন না। আয়ের সঙ্গে স্বামীদের অসংগতিপূর্ণ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।
মওদুদ দুই বছর আগে লেখা আরেকটি বইয়ে তথ্য দিয়েছেন যে, তাঁরা যখন ১৪তম সংশোধনী আনেন, তখন বিচারক অপসারণে বাহাত্তরের অভিশংসনপ্রথায় যেতে বিএনপি গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করেছিল। বিচার বিভাগ পৃথক্করণকালে এটা করা উপযুক্ত হবে বলে তারা তুলে রেখেছিল।
তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাকে জানান, বিচারপতি খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দেওয়ার পর বিএনপি বাহাত্তরে ফিরতে চেয়েছিল। সে ক্ষেত্রে দুই দলের মানসিকতায় কোনো তফাৎ নেই। ভবিষ্যতে ‘বিদেশি শক্তির’ ক্রীড়নক হওয়ার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে চাইলে রাজনীতিকদেরই যোগ্যতা ও মেধার ছাপ রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে। অন্যথায় কান্নাকাটি বৃথা। অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পেতে চাইলে মওদুদকে সেনাশাসনের জন্য মইনের পাশাপাশি এরশাদদেরও বিচার চাইতে হবে। সব পরিস্থিতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ (ছদ্মেবশীসহ) অবৈধ। এ রকম নীতিগত বিরোধিতার শক্ত বাতাবরণ তৈরি করতে না পারলে রাষ্ট্রব্যবস্থার পাকিস্তানীকরণ ঠেকানো যাবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments