নদী সামনে এগোয়, পেছনে যায় না : মুর্তজা বশীর by মোহাম্মদ আসাদ
এবারের প্রদর্শনীর সবই কি নতুন কাজ দিয়ে?
-পুরনো-নতুন কাজ মিলিয়েই আছে। ১৮টি কাজই নতুন, যা আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে এ বছর করেছি। জীবনের কঠিন সময় ফ্রেমে আসতে পারে। তবে আমি এখনও আনিনি।
আমি দেখেছি বয়স হয়ে গেলে সিনিয়ররা কিন্তু এক্সিভিশন করতে চান না। জয়নুল আবেদিন কোনো এক্সিবিশন করতে চাননি। সফিউদ্দিন সাহেব করেছেন মৃত্যুর আগে। সেটা হল খ্যাতি তার আছে, সেটা যেন ড্রপ না করে। ইয়াঙ্গার জেনারেশন অনেক মেধাবী। একটা ছেলের কাজ দেখে তো আমি বিস্মিত হয়েছি। সে হল বিশ্বজিৎ গোস্বামী। সে অফসেটে যে ড্রইং করেছে, নদীর ওপার থেকে। আমি ফেসবুকে দেখে হাসলাম। আমি খুব ভালো ড্রইং করতাম। তারপর আমি তার ওয়াটার কালার দেখলাম। তার কাজ অনেক ওপরে। ফেসবুকে অনেকেই পেইনটিংয়ের ছবি পাঠায়। আমার বিশ্বাস সেগুলোর বেশিরভাগই পিকচার হচ্ছে, পেইনটিং হচ্ছে না। ওয়ান ইজ দ্য, পেইনটিং ওয়ান ইজ দ্য পিকচার। সব সুন্দর কাজ পেইনটিং হয় না। হুবহু কিছু করা চিত্রশিল্পীর কি দরকার আছে? সেটা ফটোগ্রাফার করবে।
যা বলছিলাম, তখন প্রদর্শনী করতে লোকে ভয় পায়। কারণ ইয়াংরা তো খুব মেধাবী। তারা পৃথিবীতে কোথায় কি হচ্ছে দেখছে। হাজারও বই পড়ছে। আমাদের সময় বই পাওয়া যেত না। এদের কাছে টিকে থাকা একটা কঠিন কাজ। আমি এখনও ইতস্তত: করছি, আমার কাজগুলো ইয়াংরা কীভাবে গ্রহণ করবে। তবে আমার কাজগুলো যারা দেখেছে তারা বলেছে আপনার কাজ একজন বাঙালি শিল্পীর কাজ সেটা বোঝা যায়। দ্যাটস এনাফ।
আমি যেটা করতে চেয়েছি, আমার এই প্রদর্শনীতে দুইটি পেইনটিং আর একটি ড্রইং আছে। ওই ড্রইংটা হল একটা প্রোফাইল। সে ড্রইংয়ে কয়েকটা লাল আর সবুজ পুঁতির মালা। চোখ, নাক কিছুই নেই। খালি একটু আউট লাইন আর গলায় মালা। পেইনটিং দুটির মধ্যেও নাক-মুখ কিছুই নেই। আমি যা করতে চেয়েছি তা এখানে আছে। আমি বলতে চেয়েছি এটা একটা মেয়ে।
স্যার এবারের কাজগুলোতে কি নতুনত্ব কিছু পাব?
-এখানে যে ফিগারেটিভ কাজগুলো করেছি তার সঙ্গে পুরনো কাজের একটা ধারাবাহিকতা আছে। যার জন্য এ প্রদর্শনীর নাম দিয়েছি পর্যালোচনা। আগের ফিগারেটিভ থেকে নিয়ে নতুনভাবে করা। আমার ওয়াল সিরিজের কাজের সঙ্গে এপিটাফ সিরিজের কাজের মিল নেই। মিলটা হল মানসিকতা। এই যে দেখা। ওয়ালে যে ডিটেলিংটা করেছি, এপিটাফে সে ডিটেলিংটা আছে। ভিন্ন বিষয় কিন্তু শিল্পীর মেজাজ যেটা, সেটা একই আছে।
স্যার আপনার ফিরে আসা নিয়ে বলেন।
-একজন ৭০-৮০ বছরের মানুষও বাঁচতে চায়। ১০০ বছরের ওপরে হলেও বাঁচতে চায়। কারণ হল পৃথিবীটা সুন্দর। নিজের সন্তান, নাতি-নাতনি ছেড়ে একটা অনিশ্চয়তার জগৎ যে জগৎ থেকে ফিরবে না, সেখানে কেউ যেতে চায় না। আমার একমাত্র পুত্র, আমার কন্যা এদের কারও কথা মনে করে নয়। এই যে পৃথিবী এত সুন্দর, সুন্দর রমণী। আমি তো রমণীই আঁকি। যেহেতু মেয়েদের আঁকতে আমার খুব ভালো লাগে। এদের দেখার জন্য কিন্তু আমার কান্না পায় না। আমার কান্না পায় আমি যে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলাম সেটা ভেবে। জীবিত অবস্থায় তুমি খ্যাতিমান হতে পার। তুমি যদি সেই রকম ওজনদার কিছু না রেখে যাও- মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়া, অমরত্ব পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বললেই হল না, সেরকম কিছু তোমাকে রেখে যেতে হবে। যেমন ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রেখে গেছেন, ওই রকম যদি কিছু রেখে যেতে পার।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার লেখালেখির কাজগুলো পরিকল্পনা হিসেবেই রয়ে গেছে। বাড়িতে এসে দেখি আমি তিনটি পাণ্ডুলিপি করেছিলাম। তার একটি হল ‘পবিত্র কোরআনের প্রতীক ও উপমা’। অন্য দুইটি হল ‘পবিত্র কোরআনে দোজখ-জান্নাত প্রসঙ্গ’ ও ‘বৈদিক সঙ্গীতায় উপমা ও প্রতীক’। এগুলো শেষ করা হয়নি।
আমি ধর্মে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি প্রাকটিসিং মুসলমান না। নামাজ রোজা এসব করি না। আমি জানি আল্লাহ আমাকে দিয়েছে। এই যে আমার এপিটাফ, এ পাথর আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছে। এ প্রজাপ্রতির পাখায় আর্ট হয় এটা আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছে। এর মধ্যে আমার কোনো ক্রেডিট নেই। যার জন্য আমি যখন প্রজাপতি আঁকি তখন ঢাকা কুরিয়ারে বেরিয়েছিল ‘আল্লাহ ইজ দ্য গ্রেটেস্ট আর্টিস্ট’। প্রজাপতির এই যে ভেরিয়েশন ফর্ম এটা তো আল্লাহর কাজ। আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি। এটা আমার বিশ্বাস।
আমার আরেকটি কাজ হল মন্দিরের টেরাকোটা নিয়ে। আমার গবেষণা হল বাংলায় যে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে সেই বিদ্রোহের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে টেরাকোটা আর্ট। সেসব টেরাকোটায় আছে পালকি চড়ে যাচ্ছে, বাইজি নাচছে। আর তার ঘরে দেখে এক মেয়েরা এক খণ্ড কাপড় পরে থাকে। আমার গবেষণা হল মন্দির শুধুই একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ সব কিছুই হয় মন্দিরকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি কৃষকই মন্দিরে গিয়ে টেরাকোটায় দেখে বাইজি নাচছে। আর তার ঘরে ভিন্ন চিত্র।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ ছোট গল্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেখানে আছে একটা পানের খিলির মধ্যে লিফলেট। পানের সঙ্গে সে লিফলেট ডিস্টিবিউট হল। সেটার মতোই মন্দিরের টেরাকোটা দেখেছে। আর ঘরে উলঙ্গ, অভাব-অনটন, নীল চাষের জন্য অত্যাচার সে সব মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। তারপর এ আউটব্রাস্ট হয়।
আপনার কাজ নিয়ে এখন কী ভাবছেন?
-জীবনটা তো সীমিত। আমি সব সময় বলতাম আমি ৯৩ বছর বাঁচতে চাই। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেই আমি এ কথা বলতাম। অনেকেই আমাকে বলত ৯৩ কেন? ৯২ অথবা ৯৪ কেন নয়? ৯৩ ডেডলাইন কেন? আমি বলতাম পিকাসোকে আমি জীবনে দেখতে পাইনি। পিকাসো মারা গেছেন ৯২ বছরে। আমি তার চেয়ে এক বছর বেশি বাঁচতে চাই। এখন ৯৩ বছর বাঁচব কিনা জানি না। ধর আমি কালকেও মরে যেতে পারি। আমি ধরে নিয়েছি সব ঠিক থাকলে আরও ৫ বছর বাঁচব। এই ৫ বছরে আমার সব কাজ সারতে হবে। আমার একটা ওয়ার্নিং হয়ে গেছে। এখন নতুন উপসর্গ আমার অক্সিজেন ড্রপ করছে। এই যে সীমিত জীবন আমার। আমার যেসব লেখালেখি, আমার যে ছবি আঁকা, আমার যে দুইটা নতুন ছবির কথা বলছি, চোখ-মুখ নেই, একটা মেয়ে মনে হলেও আরেকটা মনে হওয়ার কথা নয়। তবে যে কেউ দেখে বলবে এগুলো মেয়ের অবয়ব। হিউম্যান ফিগার একটি অবজেক্ট, বস্তু। বস্তুর সে জিনিসটা আমাকে প্রথম আকর্ষণ করে, সে জিনিস আমি রং করব আর বাকিটা ব্লাংক। সেভাবে আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডাক্তার আমাকে বড় কাজ করার পারমিট করছে না। ছোট ছোট ক্যানভাসে কাজ করছি। আর দুটি কারণে এ কাজ করব। এক হল নিজের তৃপ্তির জন্য। দুই হল জীবিকার জন্য। আমার কোনো পেনশন নেই। তারপর আমি কমার্শিয়াল কাজ করি না। আমি ফরমায়েশি কাজ করি না। আমাকে কালেকটররা বলে, আপনি এপিটাফ আমাদের দেন। আমি বলি নদী সামনে এগোয়, পেছনে যায় না। আমি এপিটাফ কেন আঁকব? পয়সার জন্য? সেটা কেন করব। পয়সার জন্য আঁকা নিজের বউ কারও কাছে তুলে দেয়া, তাই না? আমি সেটা করতে পারি না।
আপনার জীবন অলৌকিকভাবেই ফেরা, জ্ঞান ফেরার পর কি দেখলেন?
-আমার জ্ঞান ফেরার আগের তিন দিনের কথা কিছুই মনে নেই। তারপর মনে হল আমি একটা টানেলের ভেতরে। চারদিকে ভূমিকম্প, সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। সিস্টার আমাকে বলছেন, কোথায় যাচ্ছেন, আপনার হাত-পা তো বাঁধা। সে সময় আমি যেদিকে তাকিয়েছি শুধুই রেড আর অরেঞ্জ কালার দেখেছি। ঘরের পর্দাটাও দেখেছি তেমন কটকটা রঙের। তারপর যখন একটু সুস্থ হলাম। তখন দেখতে পেলাম ফর্ম। হিউম্যান ফর্ম, সাদার মধ্যে সাদা। সাদার মধ্যে সাদা, সেটা আঁকার ইচ্ছা আছে।
-পুরনো-নতুন কাজ মিলিয়েই আছে। ১৮টি কাজই নতুন, যা আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে এ বছর করেছি। জীবনের কঠিন সময় ফ্রেমে আসতে পারে। তবে আমি এখনও আনিনি।
আমি দেখেছি বয়স হয়ে গেলে সিনিয়ররা কিন্তু এক্সিভিশন করতে চান না। জয়নুল আবেদিন কোনো এক্সিবিশন করতে চাননি। সফিউদ্দিন সাহেব করেছেন মৃত্যুর আগে। সেটা হল খ্যাতি তার আছে, সেটা যেন ড্রপ না করে। ইয়াঙ্গার জেনারেশন অনেক মেধাবী। একটা ছেলের কাজ দেখে তো আমি বিস্মিত হয়েছি। সে হল বিশ্বজিৎ গোস্বামী। সে অফসেটে যে ড্রইং করেছে, নদীর ওপার থেকে। আমি ফেসবুকে দেখে হাসলাম। আমি খুব ভালো ড্রইং করতাম। তারপর আমি তার ওয়াটার কালার দেখলাম। তার কাজ অনেক ওপরে। ফেসবুকে অনেকেই পেইনটিংয়ের ছবি পাঠায়। আমার বিশ্বাস সেগুলোর বেশিরভাগই পিকচার হচ্ছে, পেইনটিং হচ্ছে না। ওয়ান ইজ দ্য, পেইনটিং ওয়ান ইজ দ্য পিকচার। সব সুন্দর কাজ পেইনটিং হয় না। হুবহু কিছু করা চিত্রশিল্পীর কি দরকার আছে? সেটা ফটোগ্রাফার করবে।
যা বলছিলাম, তখন প্রদর্শনী করতে লোকে ভয় পায়। কারণ ইয়াংরা তো খুব মেধাবী। তারা পৃথিবীতে কোথায় কি হচ্ছে দেখছে। হাজারও বই পড়ছে। আমাদের সময় বই পাওয়া যেত না। এদের কাছে টিকে থাকা একটা কঠিন কাজ। আমি এখনও ইতস্তত: করছি, আমার কাজগুলো ইয়াংরা কীভাবে গ্রহণ করবে। তবে আমার কাজগুলো যারা দেখেছে তারা বলেছে আপনার কাজ একজন বাঙালি শিল্পীর কাজ সেটা বোঝা যায়। দ্যাটস এনাফ।
আমি যেটা করতে চেয়েছি, আমার এই প্রদর্শনীতে দুইটি পেইনটিং আর একটি ড্রইং আছে। ওই ড্রইংটা হল একটা প্রোফাইল। সে ড্রইংয়ে কয়েকটা লাল আর সবুজ পুঁতির মালা। চোখ, নাক কিছুই নেই। খালি একটু আউট লাইন আর গলায় মালা। পেইনটিং দুটির মধ্যেও নাক-মুখ কিছুই নেই। আমি যা করতে চেয়েছি তা এখানে আছে। আমি বলতে চেয়েছি এটা একটা মেয়ে।
স্যার এবারের কাজগুলোতে কি নতুনত্ব কিছু পাব?
-এখানে যে ফিগারেটিভ কাজগুলো করেছি তার সঙ্গে পুরনো কাজের একটা ধারাবাহিকতা আছে। যার জন্য এ প্রদর্শনীর নাম দিয়েছি পর্যালোচনা। আগের ফিগারেটিভ থেকে নিয়ে নতুনভাবে করা। আমার ওয়াল সিরিজের কাজের সঙ্গে এপিটাফ সিরিজের কাজের মিল নেই। মিলটা হল মানসিকতা। এই যে দেখা। ওয়ালে যে ডিটেলিংটা করেছি, এপিটাফে সে ডিটেলিংটা আছে। ভিন্ন বিষয় কিন্তু শিল্পীর মেজাজ যেটা, সেটা একই আছে।
স্যার আপনার ফিরে আসা নিয়ে বলেন।
-একজন ৭০-৮০ বছরের মানুষও বাঁচতে চায়। ১০০ বছরের ওপরে হলেও বাঁচতে চায়। কারণ হল পৃথিবীটা সুন্দর। নিজের সন্তান, নাতি-নাতনি ছেড়ে একটা অনিশ্চয়তার জগৎ যে জগৎ থেকে ফিরবে না, সেখানে কেউ যেতে চায় না। আমার একমাত্র পুত্র, আমার কন্যা এদের কারও কথা মনে করে নয়। এই যে পৃথিবী এত সুন্দর, সুন্দর রমণী। আমি তো রমণীই আঁকি। যেহেতু মেয়েদের আঁকতে আমার খুব ভালো লাগে। এদের দেখার জন্য কিন্তু আমার কান্না পায় না। আমার কান্না পায় আমি যে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলাম সেটা ভেবে। জীবিত অবস্থায় তুমি খ্যাতিমান হতে পার। তুমি যদি সেই রকম ওজনদার কিছু না রেখে যাও- মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়া, অমরত্ব পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বললেই হল না, সেরকম কিছু তোমাকে রেখে যেতে হবে। যেমন ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রেখে গেছেন, ওই রকম যদি কিছু রেখে যেতে পার।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার লেখালেখির কাজগুলো পরিকল্পনা হিসেবেই রয়ে গেছে। বাড়িতে এসে দেখি আমি তিনটি পাণ্ডুলিপি করেছিলাম। তার একটি হল ‘পবিত্র কোরআনের প্রতীক ও উপমা’। অন্য দুইটি হল ‘পবিত্র কোরআনে দোজখ-জান্নাত প্রসঙ্গ’ ও ‘বৈদিক সঙ্গীতায় উপমা ও প্রতীক’। এগুলো শেষ করা হয়নি।
আমি ধর্মে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি প্রাকটিসিং মুসলমান না। নামাজ রোজা এসব করি না। আমি জানি আল্লাহ আমাকে দিয়েছে। এই যে আমার এপিটাফ, এ পাথর আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছে। এ প্রজাপ্রতির পাখায় আর্ট হয় এটা আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছে। এর মধ্যে আমার কোনো ক্রেডিট নেই। যার জন্য আমি যখন প্রজাপতি আঁকি তখন ঢাকা কুরিয়ারে বেরিয়েছিল ‘আল্লাহ ইজ দ্য গ্রেটেস্ট আর্টিস্ট’। প্রজাপতির এই যে ভেরিয়েশন ফর্ম এটা তো আল্লাহর কাজ। আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি। এটা আমার বিশ্বাস।
আমার আরেকটি কাজ হল মন্দিরের টেরাকোটা নিয়ে। আমার গবেষণা হল বাংলায় যে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে সেই বিদ্রোহের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে টেরাকোটা আর্ট। সেসব টেরাকোটায় আছে পালকি চড়ে যাচ্ছে, বাইজি নাচছে। আর তার ঘরে দেখে এক মেয়েরা এক খণ্ড কাপড় পরে থাকে। আমার গবেষণা হল মন্দির শুধুই একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ সব কিছুই হয় মন্দিরকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি কৃষকই মন্দিরে গিয়ে টেরাকোটায় দেখে বাইজি নাচছে। আর তার ঘরে ভিন্ন চিত্র।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ ছোট গল্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেখানে আছে একটা পানের খিলির মধ্যে লিফলেট। পানের সঙ্গে সে লিফলেট ডিস্টিবিউট হল। সেটার মতোই মন্দিরের টেরাকোটা দেখেছে। আর ঘরে উলঙ্গ, অভাব-অনটন, নীল চাষের জন্য অত্যাচার সে সব মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। তারপর এ আউটব্রাস্ট হয়।
আপনার কাজ নিয়ে এখন কী ভাবছেন?
-জীবনটা তো সীমিত। আমি সব সময় বলতাম আমি ৯৩ বছর বাঁচতে চাই। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেই আমি এ কথা বলতাম। অনেকেই আমাকে বলত ৯৩ কেন? ৯২ অথবা ৯৪ কেন নয়? ৯৩ ডেডলাইন কেন? আমি বলতাম পিকাসোকে আমি জীবনে দেখতে পাইনি। পিকাসো মারা গেছেন ৯২ বছরে। আমি তার চেয়ে এক বছর বেশি বাঁচতে চাই। এখন ৯৩ বছর বাঁচব কিনা জানি না। ধর আমি কালকেও মরে যেতে পারি। আমি ধরে নিয়েছি সব ঠিক থাকলে আরও ৫ বছর বাঁচব। এই ৫ বছরে আমার সব কাজ সারতে হবে। আমার একটা ওয়ার্নিং হয়ে গেছে। এখন নতুন উপসর্গ আমার অক্সিজেন ড্রপ করছে। এই যে সীমিত জীবন আমার। আমার যেসব লেখালেখি, আমার যে ছবি আঁকা, আমার যে দুইটা নতুন ছবির কথা বলছি, চোখ-মুখ নেই, একটা মেয়ে মনে হলেও আরেকটা মনে হওয়ার কথা নয়। তবে যে কেউ দেখে বলবে এগুলো মেয়ের অবয়ব। হিউম্যান ফিগার একটি অবজেক্ট, বস্তু। বস্তুর সে জিনিসটা আমাকে প্রথম আকর্ষণ করে, সে জিনিস আমি রং করব আর বাকিটা ব্লাংক। সেভাবে আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডাক্তার আমাকে বড় কাজ করার পারমিট করছে না। ছোট ছোট ক্যানভাসে কাজ করছি। আর দুটি কারণে এ কাজ করব। এক হল নিজের তৃপ্তির জন্য। দুই হল জীবিকার জন্য। আমার কোনো পেনশন নেই। তারপর আমি কমার্শিয়াল কাজ করি না। আমি ফরমায়েশি কাজ করি না। আমাকে কালেকটররা বলে, আপনি এপিটাফ আমাদের দেন। আমি বলি নদী সামনে এগোয়, পেছনে যায় না। আমি এপিটাফ কেন আঁকব? পয়সার জন্য? সেটা কেন করব। পয়সার জন্য আঁকা নিজের বউ কারও কাছে তুলে দেয়া, তাই না? আমি সেটা করতে পারি না।
আপনার জীবন অলৌকিকভাবেই ফেরা, জ্ঞান ফেরার পর কি দেখলেন?
-আমার জ্ঞান ফেরার আগের তিন দিনের কথা কিছুই মনে নেই। তারপর মনে হল আমি একটা টানেলের ভেতরে। চারদিকে ভূমিকম্প, সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। সিস্টার আমাকে বলছেন, কোথায় যাচ্ছেন, আপনার হাত-পা তো বাঁধা। সে সময় আমি যেদিকে তাকিয়েছি শুধুই রেড আর অরেঞ্জ কালার দেখেছি। ঘরের পর্দাটাও দেখেছি তেমন কটকটা রঙের। তারপর যখন একটু সুস্থ হলাম। তখন দেখতে পেলাম ফর্ম। হিউম্যান ফর্ম, সাদার মধ্যে সাদা। সাদার মধ্যে সাদা, সেটা আঁকার ইচ্ছা আছে।
No comments