সাঈদীর রায়ে সরকার লাভবান হয়েছে -মনে করে জামায়াত by সেলিম জাহিদ
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ে সরকারই সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতা–কর্মীদের মতে, আমৃত্যু কারাদণ্ড মৃত্যুদণ্ডেরই কাছাকাছি। কিন্তু এ রায়ের পর সরকারের সঙ্গে আঁতাতের রটনা রাজনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে জামায়াতকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দলটির কেন্দ্রীয় ও মধ্যম সারির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জামায়াতের ভেতরকার এ পর্যালোচনার কথা জানান। তবে তাঁদের কেউই উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ে জামায়াতের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ‘অসন্তুষ্ট’ ও ‘ব্যথিত’। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকলে নেতা-কর্মীদের মনে যে ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হতো, এ রায় তাতে অনেকটাই ছেদ ঘটিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে গতকালের হরতালেও।
এই ‘বেদনা’ ও ‘অসন্তুষ্টির’ মধ্যে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন ‘বিব্রত’ রায়ের পর সরকারের সঙ্গে আঁতাতের গুজবে। গত দুদিনে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরছে সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করেছে জামায়াত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আঁতাত করে জামায়াত কাদের মোল্লার ফাঁসি, সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড, শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির আদেশ পেয়েছে। শত-সহস্র নেতা জেলে গেছে, পঙ্গু হয়েছে, নিষিদ্ধ না হয়েও জামায়াতের সব কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। এর চেয়ে নির্মম আঁতাতকারী পৃথিবীতে আর কে আছে!’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি জামায়াতের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতার কথা অস্বীকার করে আসছেন।
জামায়াত মনে করে, সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণা নিয়ে এত দিন বেশ চাপে ও অস্বস্তিতে ছিল সরকার। বিশেষ করে ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর সারা দেশে যে রক্তক্ষয়ী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, একই সাজা আপিল বিভাগে বহাল থাকলে সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে সরকার শঙ্কায় ছিল। এ পরিস্থিতি এড়ানোর কৌশল খুঁজছিল সরকার। এখন আপিল বিভাগের রায়ে সরকার সে সুযোগ পেয়েছে। এ রায়ের ফলে সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের কাছাকাছি সাজা হয়েছে। আবার সরকার রাজনৈতিকভাবে ‘স্বস্তিদায়ক’ অবস্থান পেয়েছে। জামায়াত মনে করে, সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়নি, কিন্তু তাতে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বা ব্যক্তিগতভাবে সাঈদী—কেউই লাভবান হননি। কারণ, আমৃত্যু তাঁকে কারা প্রকোষ্ঠেই থাকতে হবে।
জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বরং আপিল বিভাগের এ রায় জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের ‘সন্দেহ’ এবং ‘প্রশ্নের’ মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে, দলের প্রধান রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির নেতাদের বড় একটি অংশের ভেতর এত দিন ঘুরপাক খাওয়া ‘সন্দেহ’ এখন ভিত্তি পেতে পারে। পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা নিয়ে জামায়াতের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও নানা প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। এতে শেষ বিচারে দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় দলের নীতিনির্ধারকদের মনোবলের ওপর বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। কারণ, দলের নেতা-কর্মীরা মনে করতেন, মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারাধীন বা সাজা পাওয়া দলের নেতাদের মধ্যে সাঈদী ‘একেবারেই নির্দোষ’। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগ, সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্তকে ‘দুর্বল’ বলে মনে করতেন তাঁরা।
এ ছাড়া সারা দেশে ওয়াজ-মাহফিলের কারণে দলের বাইরেও সাঈদীর অনুরাগী ও বড় সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। তাঁর বড় ধরনের সাজা হলে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সব মিলিয়ে দলটির নেতারা আশাবাদী ছিলেন যে সাঈদীর বড় ধরনের কোনো সাজা হবে না। কিন্তু তাঁর আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ নেতাদের হতাশ করেছে। এখন তাঁরা মনে করছেন, বিচারাধীন অন্য নেতাদের সাজা আরও কঠোর হবে।
No comments