আমরা আর মামুরা by কাজল ঘোষ
বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। কংগ্রেস জামানার শেষদিকে একটি ঘটনা খুব তাক লাগিয়েছিল। লোকসভার অধিবেশনে মরিচের গুঁড়ো নিক্ষেপ। স্পিকার আহত হয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি হলো। দোষীদের খোঁজার কাজ চললো। আমাদের স্পিকার শিরিন শারমিন সে সময় দিল্লিতে। রাষ্ট্রীয় সফরের ফাঁকে তিনি এই ঘটনাটি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ফিরি নিজ দেশে। এখানে স্পিকারের মরিচ গুঁড়োর টেনশন নেই। কারণ শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। ধরে নিই, টিআইবি অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে এমন একটি বিরোধী দল নিয়ে তথ্য না জানালে আমাদের বুঝতে কি বাকি থাকতো। সরকারি টেলিভিশনের কল্যাণে সংসদের হাস্যরস মোটামুটি সকলেরই জানা। সবশেষ অধিবেশনের সমাপনীতে দেখা গেছে, একে অন্যের পিঠ চুলকিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটছে। তবে, লক্ষণীয় বিষয় পার্লামেন্টের বর্তমান বিরোধী দল বা সরকারি দলের পক্ষের চেয়ে সমালোচনা বেশি হচ্ছে প্রাক্তন বিরোধী দল নিয়ে। অর্থাৎ যারা এই পার্লামেন্টে নেই সেই বিএনপি-জামায়াত নিয়েই আলোচনা বেশি। টিআইবি’র গবেষণায় দেখা গেছে, দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে বিএনপি-জামায়াত নিয়ে সমালোচনা হয়েছে ৫৩১ বার। যেখানে নবম সংসদে একটি অধিবেশনে সংসদে থাকা বিরোধী দলের সমালোচনা হয়েছে ৩৪২ বার। নির্বাচিত বিরোধী দলের চেয়ে যারা প্রাক্তন হয়ে গেছেন তারাই কি অনেক বেশি শক্তিশালী এই প্রশ্নটি কেউ করলে নিশ্চয়ই অবান্তর হবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ নেতার উপস্থিতি ছিল ৮৮.৮৮% এবং বিরোধীদলীয় নেতার উপস্থিতি ছিল ৩৮.৮৮%। বিস্ময় লেগেছে শক্তিশালী বিরোধী নেতার ভূমিকায় যারা অভিনয় করছেন সেই নেত্রীর উপস্থিতি সংসদ নেতার চেয়ে অনেক কম। যেদিন এরশাদকে বাইপাস করে রওশন এরশাদ সংসদে বিরাধী নেত্রীর ভূমিকায় বসেছিলেন তখন ভেবেছিলাম এটি আর যাই হোক অলঙ্কারিক ফার্স্ট লেডির তকমা থেকে বেরিয়ে আসার চমৎকার সুযোগ। আর গণতান্ত্রিক সংসদে তো ছায়া সরকারের মাধ্যমে বিরোধী দলই সরকারের ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করে থাকে। বিএনপি যখন নির্বাচনে অংশ নেয়নি তখন সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে জাতীয় পার্টি ও রওশন জাতির ইতিহাসের নতুন দিগন্ত রচনা করবে। প্রচ-ভাবে হতাশ হয়েছে দেশের মানুষ। কি এক তামাশার বিরোধী দল! একে অন্যের দিকে খেয়াল রেখেই এগিয়ে চলেছে সংসদ ও সরকার। কারণ, অদ্ভুত এই জমানায় বিরোধী দল সরকারেরও অংশ আবার বিরোধী দল হিসেবেতো আছেই। যদিও এই সংসদে ফরমালিন নিয়ে বিরোধী দলের সমালোচনার জায়গাটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তাছাড়া, হাই অফিসিয়াল ডিপ্লোম্যাটরা, বিদেশী মন্ত্রীরা বিরোধী নেতার সঙ্গে কথা বলছেন দেশ, সরকার, রাজনীতি নিয়ে। এটাইতো অনেক পাওনা। অথচ বাহাত্তর পরবর্তীতে গুটিকয় সংসদ সদস্য বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আলোচনার ঝড় তুলেছিল। যা এখনও ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে। আজকের আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সে সময় বিরোধী দলে থেকে সরকারের কর্মকা- সমালোচনা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। আজকের এই সংসদের মাধ্যমে অচেনা এই গণতন্ত্র বাঁচাতে বর্তমান সংসদের সদস্যদের ভোটার ছাড়াই জয় নিয়ে আসতে হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির একটি ব্যালটবিহীন নির্বাচন অদ্ভুত কিসিমের একটি পার্লামেন্ট এবং একই সঙ্গে একটি সরকার উপহার দেয়ার কাজটি করেছে। আর এতে আমাদের মান্যবর নির্বাচন কমিশন গৌরবের ঢেঁকুর তোলার সুযোগটি পেয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে ৫ তারিখের নির্বাচন কি ধরনের জগাখিচুড়ি হয়েছে তার একটি নজির। এতে দেখা যায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বাইরে যে ক’টিতে ভোট হয়েছে তার ৯০টিতে ভোটের হিসেবে গরমিল। প্রতিটি এলাকা থেকে পাঠানো রিটার্নিং অফিসার আর প্রিজাইডিং অফিসারের পাঠানো তালিকায় মিল নেই। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে একই কমিশনের কর্মকর্তাদের ভোটের হিসাবে দুই রকম হওয়ার কারণ কি থাকতে পারে। এতে কি কেবলই যোগের ভুল। নাকি ভোটের হার বাড়াতে এই টুকুতো করতেই হবে। যা হোক, মিডিয়াতে রিপোর্ট প্রকাশের পর তোলপাড় চলছে ইসিতে। একদিকে ভোট ছাড়াই সংসদে বসার অধিকার অন্যদিকে ভোটের গরমিলে যে গোঁজামিলের গণতন্ত্র তা কতটা শক্তিশালী রাষ্ট্র উপহার দেবে তা বিবেকবান নাগরিক মাত্রেরই জিজ্ঞাসা। সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে আর যাই হোক নৈতিকভাবে একটি রাষ্ট্র তার নীতির প্রশ্নে, সামজিক মূল্যবোধ প্রশ্নে, ন্যায়বিচার প্রশ্নে যোগ্য সরকার দাবি করতে পারে না। অমন ভঙ্গুর গণতন্ত্রের বড়াই নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। ক’দিন আগে টিআইবির আরেকটি রিপোর্ট নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেই দপ্তরের মন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন। প্রয়োজন এই রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করে শিক্ষার মান বাঁচাতে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়। কোন তদন্ত বা অনুসন্ধান ছাড়াই শিক্ষামন্ত্রী ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ নেয়ায় সত্যানুসন্ধানের পথ রুদ্ধ হলো। বরং টিআইবির রিপোর্ট আমলে নিয়েই সামনে এগোনো যেতে পারে। এতে মন্দের কিছু নেই। ভুল কিছু হলে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও যুগোপযোগী হতে পারে। একইভাবে সংসদের রিপোর্ট নিয়েও। বর্তমান বিরোধী দলের এটাই সুযোগ, নিজেদের যোগ্য বিরোধী দলের স্থানে নিয়ে যাওয়া। এরকমন সুযোগ কালেভদ্রে মিলে।
No comments