পাকিস্তানের ঘরের যুদ্ধ by শহীদ জাভেদ বারকি
বিগত কয়েক বছরের সিদ্ধান্তহীনতার পর, এই গত সপ্তাহে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশটির উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সন্ত্রাসীদের ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অপারেশন শুরু করেছে। বিভিন্ন বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠী সেখানে ঘাঁটি গেড়ে পুরো মুসলিম দুনিয়ায় জিহাদ করার লক্ষ্যে নেমেছে, এই অভিযান এদের তাড়ানোর উদ্দেশ্যেই চালানো হচ্ছে। কিন্তু এতে আবারও শরণার্থী-সংকট সৃষ্টি হতে পারে। সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো সেখান থেকে উৎখাত হয়ে পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়তে পারে; দেশটির বড় শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র করাচিও তাদের সম্ভাব্য গন্তব্য।
আদিবাসী এলাকাগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে এই সন্ত্রাসী দলগুলো পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশটির চারটি প্রতিবেশী দেশেও হামলা চালিয়েছে—আফগানিস্তান, চীন, ভারত ও ইরান। উজবেকিস্তানের ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান গত ৮ থেকে ৯ জুন করাচি বিমানবন্দরে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এই ঘটনায় ১০ জন জঙ্গিসহ ৩০ জন নিহত হয়; এরাই এখন সবচেয়ে খতরনাক হয়ে উঠেছে।
এই উত্তর ওয়াজিরিস্তান অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তথাকথিত ‘খারাপ’ ও ‘ভালো’ তালেবানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করবে না বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহেল শরিফ। কিন্তু কথা হচ্ছে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী এই তালেবান ও হাক্কানিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এই ইন্টার-সার্ভিসেস অব ইনটেলিজেন্স (আইএসআই)—পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আগ্রাসন করলে এই হাক্কানিরা উত্তর ওয়াজিরিস্তানের আদিবাসী এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসে। কিন্তু আইএসআই এদের সমর্থন দিয়েছে এই চিন্তায় যে আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের শেষের দিকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে পশতু গ্রুপগুলো আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হাক্কানিরা সে রকম কোনো দর-কষাকষিতে সায় দেয়নি; বরং তারা এই উজবেক জঙ্গিদের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে আশ্রয় দিয়ে করাচি বিমানবন্দরে হামলার সুযোগ করে দিয়েছে।
এই বিবাদ শিগগিরই মিটবে না। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের উভয় পার্শ্বে পশতুরাই প্রধান জাতিসত্তা। তারা যেসব দাবি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈধ মনে করে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশেই তারা তুমুল লড়াইয়ে নেমেছে। কথা হচ্ছে, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে যে সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে, তার আগুন থেকে শত মাইল দূরের করাচি শহরও রক্ষা পাবে না।
সেনাবাহিনী প্রথমে বিমান আক্রমণ চালিয়ে পরে সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে, সে লক্ষ্যে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের আগেভাগেই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ইতিমধ্যে সে এলাকা ছেড়ে গেছে। সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে সোয়াতে তালেবানদের ডেরা গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, এবারও সেরূপ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এত বিপুলসংখ্যক মানুষের গৃহত্যাগ পাকিস্তান দেশটির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই হামলার পাঁচ দিন পরই জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৩ সালের শেষে সারা বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৫১ দশমিক ২ মিলিয়ন, আগের বছরের তুলনায় যা ছয় মিলিয়ন বেশি। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সর্বোচ্চ।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী মানুষের বসবাস হচ্ছে এই পাকিস্তানে। সেখানে দেড় মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী তালিকাভুক্ত। এর সঙ্গে দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষ তো আছেই।
আগের মতোই উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বাস্তুচ্যুত মানুষ পার্শ্ববর্তী জেলায় তাদের জন্য স্থাপিত শিবিরে থাকবে না, তারা করাচির মতো বড় শহরগুলোর দিকে চলে যাবে। করাচি শহরের দুই কোটি মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে ৬০ লাখ পশতু আছে। কাবুল ও পেশোয়ার শহরের সম্মিলিত পশতু জনসংখ্যার চেয়েও এটা বেশি।
সে কারণেই করাচি কখনো কখনো ‘তাৎক্ষণিক শহর’ হিসেবে অভিিহত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর এই শহরটি বেশ কয়েকবার অভিবাসনের ধাক্কায় ৫০ গুণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম ধাক্কায় ভারত থেকে আট মিলিয়ন মুসলমান পাকিস্তানে আসে, এর মধ্যে দুই মিলিয়ন করাচিকে বেছে নেয়।দ্বিতীয় ধাক্কায় পশতু নির্মাণশ্রমিকেরা এই শহরে আসে, যারা মূলত এই বাণিজ্যিক শহরের নির্মাণকাজে অংশ নেয়।আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তৃতীয় ধাক্কায় আরও পশতু এই শহরে আসে। চতুর্থ দফায় আসে ২০০০ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের সময়, সে সময় পশতুরা সীমান্তের উভয় পার্শ্বেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে, আদিবাসী এলাকাগুলোতে ইসলামি চরমপন্থার সৃষ্টি হয়।
উত্তর ওয়াজিরিস্তান থেকে বর্তমান এই বাস্তুচ্যুতি আসলে উল্লিখিত চতুর্থ ধাক্কারই অংশ। সেনাবাহিনী এ এলাকা থেকে জঙ্গিদের বের করে দিতে সক্ষম হলেও বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ হৃদয়ে যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে শেষ পর্যন্ত করাচিতে এসে ভিড় করবে। সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এই জাতিগত সংখ্যালঘুদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে তারা শিগগিরই অস্ত্র ত্যাগ করবে, এমনটা মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের এই সামরিক অভিযানের পরিণতি ভালো হবে না, পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে—সেটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শহীদ জাভেদ বারকি: পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী।
আদিবাসী এলাকাগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে এই সন্ত্রাসী দলগুলো পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশটির চারটি প্রতিবেশী দেশেও হামলা চালিয়েছে—আফগানিস্তান, চীন, ভারত ও ইরান। উজবেকিস্তানের ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান গত ৮ থেকে ৯ জুন করাচি বিমানবন্দরে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এই ঘটনায় ১০ জন জঙ্গিসহ ৩০ জন নিহত হয়; এরাই এখন সবচেয়ে খতরনাক হয়ে উঠেছে।
এই উত্তর ওয়াজিরিস্তান অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তথাকথিত ‘খারাপ’ ও ‘ভালো’ তালেবানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করবে না বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহেল শরিফ। কিন্তু কথা হচ্ছে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী এই তালেবান ও হাক্কানিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এই ইন্টার-সার্ভিসেস অব ইনটেলিজেন্স (আইএসআই)—পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আগ্রাসন করলে এই হাক্কানিরা উত্তর ওয়াজিরিস্তানের আদিবাসী এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসে। কিন্তু আইএসআই এদের সমর্থন দিয়েছে এই চিন্তায় যে আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের শেষের দিকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে পশতু গ্রুপগুলো আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হাক্কানিরা সে রকম কোনো দর-কষাকষিতে সায় দেয়নি; বরং তারা এই উজবেক জঙ্গিদের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে আশ্রয় দিয়ে করাচি বিমানবন্দরে হামলার সুযোগ করে দিয়েছে।
এই বিবাদ শিগগিরই মিটবে না। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের উভয় পার্শ্বে পশতুরাই প্রধান জাতিসত্তা। তারা যেসব দাবি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈধ মনে করে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশেই তারা তুমুল লড়াইয়ে নেমেছে। কথা হচ্ছে, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে যে সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে, তার আগুন থেকে শত মাইল দূরের করাচি শহরও রক্ষা পাবে না।
সেনাবাহিনী প্রথমে বিমান আক্রমণ চালিয়ে পরে সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে, সে লক্ষ্যে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের আগেভাগেই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ইতিমধ্যে সে এলাকা ছেড়ে গেছে। সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে সোয়াতে তালেবানদের ডেরা গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, এবারও সেরূপ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এত বিপুলসংখ্যক মানুষের গৃহত্যাগ পাকিস্তান দেশটির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই হামলার পাঁচ দিন পরই জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৩ সালের শেষে সারা বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৫১ দশমিক ২ মিলিয়ন, আগের বছরের তুলনায় যা ছয় মিলিয়ন বেশি। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সর্বোচ্চ।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী মানুষের বসবাস হচ্ছে এই পাকিস্তানে। সেখানে দেড় মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী তালিকাভুক্ত। এর সঙ্গে দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষ তো আছেই।
আগের মতোই উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বাস্তুচ্যুত মানুষ পার্শ্ববর্তী জেলায় তাদের জন্য স্থাপিত শিবিরে থাকবে না, তারা করাচির মতো বড় শহরগুলোর দিকে চলে যাবে। করাচি শহরের দুই কোটি মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে ৬০ লাখ পশতু আছে। কাবুল ও পেশোয়ার শহরের সম্মিলিত পশতু জনসংখ্যার চেয়েও এটা বেশি।
সে কারণেই করাচি কখনো কখনো ‘তাৎক্ষণিক শহর’ হিসেবে অভিিহত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর এই শহরটি বেশ কয়েকবার অভিবাসনের ধাক্কায় ৫০ গুণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম ধাক্কায় ভারত থেকে আট মিলিয়ন মুসলমান পাকিস্তানে আসে, এর মধ্যে দুই মিলিয়ন করাচিকে বেছে নেয়।দ্বিতীয় ধাক্কায় পশতু নির্মাণশ্রমিকেরা এই শহরে আসে, যারা মূলত এই বাণিজ্যিক শহরের নির্মাণকাজে অংশ নেয়।আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তৃতীয় ধাক্কায় আরও পশতু এই শহরে আসে। চতুর্থ দফায় আসে ২০০০ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের সময়, সে সময় পশতুরা সীমান্তের উভয় পার্শ্বেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে, আদিবাসী এলাকাগুলোতে ইসলামি চরমপন্থার সৃষ্টি হয়।
উত্তর ওয়াজিরিস্তান থেকে বর্তমান এই বাস্তুচ্যুতি আসলে উল্লিখিত চতুর্থ ধাক্কারই অংশ। সেনাবাহিনী এ এলাকা থেকে জঙ্গিদের বের করে দিতে সক্ষম হলেও বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ হৃদয়ে যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে শেষ পর্যন্ত করাচিতে এসে ভিড় করবে। সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এই জাতিগত সংখ্যালঘুদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে তারা শিগগিরই অস্ত্র ত্যাগ করবে, এমনটা মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের এই সামরিক অভিযানের পরিণতি ভালো হবে না, পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে—সেটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শহীদ জাভেদ বারকি: পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী।
No comments