আইনের শাসন সূচকের খুব নিচে by মিজানুর রহমান খান
রাঙামাটির আক্রান্ত ওসি মনু ইমতিয়াজের মন্তব্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শোচনীয় আইনের শাসনের সূচক আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ওসি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি এখনো চিকিৎসাধীন। সুস্থ হয়ে উঠলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এই হলো আইনের নিজস্ব গতি। ওসি যদি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকেন, তাহলে আইন ততটা পিছয়ে পড়বে। কথাটি হয়তো অসতর্ক, তবে আমরা প্রতীকী অর্থেই নিচ্ছি। যত বড় ধরনের ঘটনা বা বিপর্যয়, তত বড় কড়া নির্দেশ আসে। প্রধানমন্ত্রীরা খেয়াল করেন না যে অমুককে ধরতে কড়া নির্দেশের কারণে আইনের শাসনের শর্ত কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়। এ–ও ঠিক, তাঁরা এর মাধ্যমে স্বীকার করেন যে আইনের শাসন নেই, এ ধরেনর নির্দেশনির্ভর শাসনে বাংলদেশ চলছে।
তবে কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিল গেটস ও ডেসমন্ড টুটুদের আশীর্বাদধন্য ওয়াশিংটনভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনটির আদ্যোপান্ত না পড়লে বুঝতেই পারতাম না কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমরা অনেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নেই বুঁদ। কিছু লোক কিছু দেশের সমর্থন পেয়ে এবং বিরোধী দলকে ধরাশায়ী রাখতে পেরেই আনন্দে আটখানা। তাঁরা যত সহজে ক্ষমতাসীন দলের কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির শাসন বোঝেন, তত সহজে কিংবা আদৌ আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশকে বুঝতে চান না। কিন্তু অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।
আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৯টি দেশের মধ্যে ৯২তম অবস্থানে নেমে এসেছে। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলটি প্রায় পুরোটাই মূল্যায়িত হয়েছে। টিআইয়ের মতো এই প্রতিবেদন বাংলাদশে ঘটা করে প্রকাশ করা হয়নি বলেই হয়তো এই সূচক নিয়ে হইচই কিংবা গালাগালি মিডিয়ায় চোখে পড়েনি। ওই সূচকে যে শোচনীয় ফলাফল এসেছে, তা আমাদের মোটেই বিস্মিত করেনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের নিরিখে নয়, ওই সূচক তৈরিতে দেখা হয়েছে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, আইন ও নিয়মকানুনের কার্যকারিতা, দেওয়ানি বিচার এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা।
আইনের শাসনের হৃৎপিণ্ড হচ্ছে আইন ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে। সরকারের ক্ষমতাকে সংসদ, আদালত, অডিট নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত করে। আর বাংলাদেশে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সরকার চলে। আইনকে পর্যুদস্ত করে। ৯৯টি দেশের মধ্যে এই ফ্যাক্টরে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ৮০। তবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়েও এক্ষেত্রে আমরা খারাপ, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে, এটা একটা বড় খটকা। এ–ও ঠিক, বেসিক ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে তো কী হয়েছে, চেয়ারম্যান কি পদত্যাগ করেননি? সাবাস অর্থমন্ত্রী, সাবাস! তিনি ওই ব্যাংকের বোর্ডকে ভেঙেচুরে নতুন করে সাজিয়েছেন।
দ্বিতীয় সূচক হলো দুর্নীতি। আর এতে আমরা যথারীতি টিআইয়ের মন্দ ঐতিহ্য সূচকের ধারা বজায় রাখতে পেরেছি। বাংলাদেশ নিচ থেকে পঞ্চম হতে পেরেছে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ এবং পার্লামেন্ট কী করে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তা তারা বিবেচনায় নিয়েছে। আলোচ্য সমীক্ষায় দশমিক ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত হলো মার্কিং। যে কম পাবে, তার অবস্থা খারাপ আর যে বেশি পাবে, তার অবস্থা তত উন্নত। উন্মুক্ত সরকার হলো এই সমীক্ষার তৃতীয় ফ্যাক্টর। সরকার কতটা স্বচ্ছ, তথ্য অধিকারকে কেমন মর্যাদা দেয়, তারা সিদ্ধান্ত নিতে কতটা অংশগ্রহণমূলক, সেসবের বিবেচনায় বাংলাদেশ দশমিক ৩৭ পেয়ে ৮৫তম অবস্থানে, মানে একটু উন্নতি করেছে। তাই বলে চীন ও নাইজেরিয়ার চেয়ে নয়। এমনকি নেপালও দশমিক ৪৪ পেয়ে ৬১তম অবস্থানে রয়েছে। ভারত দশমিক ৫৩ পেয়ে ৩০ আর শ্রীলঙ্কা দশমিক ৪৮ পেয়ে ৪১তম অবস্থানে আছে।
চতুর্থ ফ্যাক্টর মৌলিক অধিকার। আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত বিভিন্ন ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতার সুফল মানুষ কীভাবে ভোগ করছে, তার নিরূপণ ঘটেছে এই মূল্যায়নে। বিবেচ্য হয়েছে জীবনের অধিকার, ব্যক্তির নিরাপত্তা, ডিউ প্রসেস, অভিযুক্তের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তির গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ, সমাবেশের স্বাধীনতা ও মৌলিক শ্রম অধিকার সুরক্ষা। এখানে বাংলাদেশ দশমিক ৪৩ পেয়ে ৮৭তম অবস্থানে এসেছে। তার চেয়ে এগিয়ে মালয়েশিয়া, কেনিয়া, ক্যামেরুন, তানজানিয়া, ফিলিপাইন। ভারত দশমিক ৫৪ পেয়ে ৬৩। আর শ্রীলঙ্কা দশমিক ৫৬ পেয়ে ভারতের চেয়ে সাত ধাপ ওপরে।
পঞ্চম ফ্যাক্টর আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। অপহরণ, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাস, রাজনৈিতক অস্থিশীলতাকে একটি বিশেষ বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে। এসবকে কী করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার ক্ষোভ নিরসন বা প্রতিকারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এই সমীক্ষায়। পুলিশ ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানো বাংলাদেশ কী করে সামাল দিচ্ছে, সেটাই এতে ফুটে উঠছে। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন কিংবা সম্পত্তি দখল বা অন্য যেকোনো ধরনের বিরোধ মেটাতে মানুষ পারতপক্ষে পুলিশ বা আদালতে ছোটে না। তারা অন্য বিকল্পগুলো বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ অবশ্য এখানে দশমিক ৬৪ পেয়ে তুলনামূলক উন্নত ৭৬তম অবস্থানে এসেছে; যদিও নেপালের চেয়েও পিছিয়ে। আমরা যদি ভাবি এখানে খুব ভালো আছি, তাহলে মনে রাখব যে মিয়ানমার দশমিক ৭২ পেয়ে ৬০ আর কামড়ে দিয়ে আলোচিত তারকা সুয়ারেজের উরুগুয়েও ৬৪তম, কমিউনিস্ট চীন ২৯তম আর দশমিক ৮৭ পেয়ে মালয়েশিয়া শীর্ষ ১২-তে পৌঁছে গেছে। ক্ষমতাসীনদের মিত্ররা প্রায়ই প্রবৃদ্ধি আর তাগড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গল্প শোনান। কিন্তু তাঁরা তুলনামূলক গল্প বলতে ভুলে গেছেন। আইনের শাসনের এই সূচক সম্পর্কে তাঁরা কিন্তু নীরব রয়েছেন।
ওই সূচকের ষষ্ঠ ফ্যাক্টর হচ্ছে রেগুলেটরি এনফোর্সমেন্ট। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এই আশায় যে জনগণের স্বার্থ ব্যক্তির স্বার্থের কাছে পরাস্ত হবে না। কিন্তু এখন এর জয়জয়কার চলছে। জাতীয় অর্থনীতির বহু খাত রয়েছে, যেখানে ব্যক্তি সমষ্টির স্বার্থকে জিম্মি করে রেখেছে। এই র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়দের দলে। এটা দেখে আমরা তাই অবাক হই না। নিচের দিক থেকে নবম। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও অবশ্য নিম্ন দশে আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আইনের শাসনের আটটি সূচকেই শ্রীলঙ্কা এগিয়ে। অথচ দেশটি এই সেদিন গৃহযুদ্ধ থেকে উঠে দাঁড়াল। বারুদের গন্ধ এখনো বাতাসে মিলিয়ে যায়নি। বিএনপি ও এক-এগারোর লোকেরা আর যা-ই করুক, তারা তো আর বাংলাদেশকে জাফনা বানিয়ে যায়নি। তাহলে এত যে উন্নয়নের নহর ও উন্নয়নের নিনাদ, সেটা এই সমীক্ষায় ফুটে উঠল না কেন?
সপ্তম ফ্যাক্টর হচ্ছে দেওয়ানি বিচার। একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগ কোনো ব্যক্তির, সরকারি কিংবা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে নাগরিককে সুরক্ষা দেবে। আওয়ামী লীগের গত শাসনকালে বিচার বিভাগ এমন ভূমিকা রেখেছে, যাতে তার স্বাধীনতার রূপ দেখে নির্বাহী বিভাগ মুগ্ধ হয়েছে। তার চোখ দেখে আমরা বুঝেছি যে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। অথচ এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। দশমিক ৩৬ নম্বর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটা গুয়াতেমালা ও পাকিস্তানের সমান্তরালে পৌঁছে গেছে। দশমিক ৩৪ পেয়ে ক্যামেরুন, বলিভিয়া ও কম্বোডিয়া একই কাতারে। আর দশমিক ৩৩ পেয়ে ভেনেজুয়েলা ৯৮তম ও দশমিক ২৭ পেয়ে আফগানিস্তান ৯৯তম অবস্থানে রয়েছে।
সমীক্ষার অষ্টম ও সবশেষ ফ্যাক্টর হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা। আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখার সুযোগ এনে দিয়েছে এই সূচক। ডব্লিউজেপির এই প্রতিবেদন বলেছে, একটি কার্যকর ফৌজদারি ব্যবস্থায় পুলিশ, প্রসিকিউটর, আইনজীবী, বিচারক এবং কারা কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য নীতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তঁারা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অপরাধ প্রতিরোধ এবং ফৌজদারি অপরাধ মোকাবিলায় সার্মথ্যবান থাকবে। এর আগে এই ব্যবস্থায় দুর্নীতির কথা জেনেছিলাম। বাংলাদেশের অধঃপতন এখানে চরমে। অথচ এটাই আসল বিচারিক আদালত। এখানে আমাদের অবস্থান ৯৪। শাসনের তুলনা হবে তাহলে কার সঙ্গে, সেটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে তুলনা করেই যদি আমরা আমোদিত হই, তাহলে সে কথা আলাদা। আমরা এই ফ্যাক্টরে বলিভিয়া, মেক্সিকো, আফগানিস্তান ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে আছি। ভারতের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা যে শক্তিশালী, তার প্রতিফলন ঘটেছে এই সূচকে। এমনকি এটাও কি দেখব না যে দক্ষিণ এশিয়ায় ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সূচকে বাংলাদেশ নিকৃষ্টতম। গতকালের (সোমবার) যুগান্তরের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ সরকার উপেক্ষা করছে।
তবে আমরা যে মিডিয়ার স্বাধীনতা ভোগের কথা বলি, এখানে আশাবাদ দেখি, তারও প্রতিফলন আছে এতে। আর সেটা একান্ত বাংলাদেশি নয়, গোটা দক্ষিণ এশীয় প্রবণতা। তবে ডব্লিউজেপির এই প্রতিবেদন স্পষ্টতই বলেছে, ‘আইনের শাসনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ঘাটতি আছে। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার দুর্নীতিতে দেশটির র্যাঙ্কিং ৯৫।’ সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান সবার নিচে। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও তদীয় লোকলস্করের অসদাচরণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের শিথিল মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। তারা আরও বলেছে, প্রশাসনিক এজেন্সিগুলো ও আদালত অদক্ষ এবং তারা দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের দ্বারা প্রভাবিত।
এই সমীক্ষায় বাংলাদেশ যেখানে সবচেয়ে ভালো করেছে, সেটা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায়। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ৭৬ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান তৃতীয়। তবে সেখানেও সুশাসনের কৃতিত্ব দাবি কতটা করা যাবে, তা তর্কসাপেক্ষ। কারণ, সংখ্যাগত দিক থেকে অপরাধের ঘটনা কম হওয়ায় এই র্যাঙ্কিংয়ে তার উন্নতি ঘটেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হলো ব্যক্তিগত সমস্যা মেটাতে সহিংসতার ব্যবহার। অন্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তুলনায় সম্পদের অধিকার সুরক্ষা শক্তিশালী থাকার কথা উল্লেখ করে এতে বাংলাদেশের প্রশংসাও আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
এই হলো আইনের নিজস্ব গতি। ওসি যদি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকেন, তাহলে আইন ততটা পিছয়ে পড়বে। কথাটি হয়তো অসতর্ক, তবে আমরা প্রতীকী অর্থেই নিচ্ছি। যত বড় ধরনের ঘটনা বা বিপর্যয়, তত বড় কড়া নির্দেশ আসে। প্রধানমন্ত্রীরা খেয়াল করেন না যে অমুককে ধরতে কড়া নির্দেশের কারণে আইনের শাসনের শর্ত কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়। এ–ও ঠিক, তাঁরা এর মাধ্যমে স্বীকার করেন যে আইনের শাসন নেই, এ ধরেনর নির্দেশনির্ভর শাসনে বাংলদেশ চলছে।
তবে কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিল গেটস ও ডেসমন্ড টুটুদের আশীর্বাদধন্য ওয়াশিংটনভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনটির আদ্যোপান্ত না পড়লে বুঝতেই পারতাম না কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমরা অনেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নেই বুঁদ। কিছু লোক কিছু দেশের সমর্থন পেয়ে এবং বিরোধী দলকে ধরাশায়ী রাখতে পেরেই আনন্দে আটখানা। তাঁরা যত সহজে ক্ষমতাসীন দলের কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির শাসন বোঝেন, তত সহজে কিংবা আদৌ আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশকে বুঝতে চান না। কিন্তু অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।
আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৯টি দেশের মধ্যে ৯২তম অবস্থানে নেমে এসেছে। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলটি প্রায় পুরোটাই মূল্যায়িত হয়েছে। টিআইয়ের মতো এই প্রতিবেদন বাংলাদশে ঘটা করে প্রকাশ করা হয়নি বলেই হয়তো এই সূচক নিয়ে হইচই কিংবা গালাগালি মিডিয়ায় চোখে পড়েনি। ওই সূচকে যে শোচনীয় ফলাফল এসেছে, তা আমাদের মোটেই বিস্মিত করেনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের নিরিখে নয়, ওই সূচক তৈরিতে দেখা হয়েছে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, আইন ও নিয়মকানুনের কার্যকারিতা, দেওয়ানি বিচার এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা।
আইনের শাসনের হৃৎপিণ্ড হচ্ছে আইন ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে। সরকারের ক্ষমতাকে সংসদ, আদালত, অডিট নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত করে। আর বাংলাদেশে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সরকার চলে। আইনকে পর্যুদস্ত করে। ৯৯টি দেশের মধ্যে এই ফ্যাক্টরে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ৮০। তবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়েও এক্ষেত্রে আমরা খারাপ, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে, এটা একটা বড় খটকা। এ–ও ঠিক, বেসিক ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে তো কী হয়েছে, চেয়ারম্যান কি পদত্যাগ করেননি? সাবাস অর্থমন্ত্রী, সাবাস! তিনি ওই ব্যাংকের বোর্ডকে ভেঙেচুরে নতুন করে সাজিয়েছেন।
দ্বিতীয় সূচক হলো দুর্নীতি। আর এতে আমরা যথারীতি টিআইয়ের মন্দ ঐতিহ্য সূচকের ধারা বজায় রাখতে পেরেছি। বাংলাদেশ নিচ থেকে পঞ্চম হতে পেরেছে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ এবং পার্লামেন্ট কী করে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তা তারা বিবেচনায় নিয়েছে। আলোচ্য সমীক্ষায় দশমিক ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত হলো মার্কিং। যে কম পাবে, তার অবস্থা খারাপ আর যে বেশি পাবে, তার অবস্থা তত উন্নত। উন্মুক্ত সরকার হলো এই সমীক্ষার তৃতীয় ফ্যাক্টর। সরকার কতটা স্বচ্ছ, তথ্য অধিকারকে কেমন মর্যাদা দেয়, তারা সিদ্ধান্ত নিতে কতটা অংশগ্রহণমূলক, সেসবের বিবেচনায় বাংলাদেশ দশমিক ৩৭ পেয়ে ৮৫তম অবস্থানে, মানে একটু উন্নতি করেছে। তাই বলে চীন ও নাইজেরিয়ার চেয়ে নয়। এমনকি নেপালও দশমিক ৪৪ পেয়ে ৬১তম অবস্থানে রয়েছে। ভারত দশমিক ৫৩ পেয়ে ৩০ আর শ্রীলঙ্কা দশমিক ৪৮ পেয়ে ৪১তম অবস্থানে আছে।
চতুর্থ ফ্যাক্টর মৌলিক অধিকার। আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত বিভিন্ন ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতার সুফল মানুষ কীভাবে ভোগ করছে, তার নিরূপণ ঘটেছে এই মূল্যায়নে। বিবেচ্য হয়েছে জীবনের অধিকার, ব্যক্তির নিরাপত্তা, ডিউ প্রসেস, অভিযুক্তের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তির গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ, সমাবেশের স্বাধীনতা ও মৌলিক শ্রম অধিকার সুরক্ষা। এখানে বাংলাদেশ দশমিক ৪৩ পেয়ে ৮৭তম অবস্থানে এসেছে। তার চেয়ে এগিয়ে মালয়েশিয়া, কেনিয়া, ক্যামেরুন, তানজানিয়া, ফিলিপাইন। ভারত দশমিক ৫৪ পেয়ে ৬৩। আর শ্রীলঙ্কা দশমিক ৫৬ পেয়ে ভারতের চেয়ে সাত ধাপ ওপরে।
পঞ্চম ফ্যাক্টর আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। অপহরণ, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাস, রাজনৈিতক অস্থিশীলতাকে একটি বিশেষ বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে। এসবকে কী করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার ক্ষোভ নিরসন বা প্রতিকারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এই সমীক্ষায়। পুলিশ ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানো বাংলাদেশ কী করে সামাল দিচ্ছে, সেটাই এতে ফুটে উঠছে। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন কিংবা সম্পত্তি দখল বা অন্য যেকোনো ধরনের বিরোধ মেটাতে মানুষ পারতপক্ষে পুলিশ বা আদালতে ছোটে না। তারা অন্য বিকল্পগুলো বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ অবশ্য এখানে দশমিক ৬৪ পেয়ে তুলনামূলক উন্নত ৭৬তম অবস্থানে এসেছে; যদিও নেপালের চেয়েও পিছিয়ে। আমরা যদি ভাবি এখানে খুব ভালো আছি, তাহলে মনে রাখব যে মিয়ানমার দশমিক ৭২ পেয়ে ৬০ আর কামড়ে দিয়ে আলোচিত তারকা সুয়ারেজের উরুগুয়েও ৬৪তম, কমিউনিস্ট চীন ২৯তম আর দশমিক ৮৭ পেয়ে মালয়েশিয়া শীর্ষ ১২-তে পৌঁছে গেছে। ক্ষমতাসীনদের মিত্ররা প্রায়ই প্রবৃদ্ধি আর তাগড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গল্প শোনান। কিন্তু তাঁরা তুলনামূলক গল্প বলতে ভুলে গেছেন। আইনের শাসনের এই সূচক সম্পর্কে তাঁরা কিন্তু নীরব রয়েছেন।
ওই সূচকের ষষ্ঠ ফ্যাক্টর হচ্ছে রেগুলেটরি এনফোর্সমেন্ট। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এই আশায় যে জনগণের স্বার্থ ব্যক্তির স্বার্থের কাছে পরাস্ত হবে না। কিন্তু এখন এর জয়জয়কার চলছে। জাতীয় অর্থনীতির বহু খাত রয়েছে, যেখানে ব্যক্তি সমষ্টির স্বার্থকে জিম্মি করে রেখেছে। এই র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়দের দলে। এটা দেখে আমরা তাই অবাক হই না। নিচের দিক থেকে নবম। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও অবশ্য নিম্ন দশে আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আইনের শাসনের আটটি সূচকেই শ্রীলঙ্কা এগিয়ে। অথচ দেশটি এই সেদিন গৃহযুদ্ধ থেকে উঠে দাঁড়াল। বারুদের গন্ধ এখনো বাতাসে মিলিয়ে যায়নি। বিএনপি ও এক-এগারোর লোকেরা আর যা-ই করুক, তারা তো আর বাংলাদেশকে জাফনা বানিয়ে যায়নি। তাহলে এত যে উন্নয়নের নহর ও উন্নয়নের নিনাদ, সেটা এই সমীক্ষায় ফুটে উঠল না কেন?
সপ্তম ফ্যাক্টর হচ্ছে দেওয়ানি বিচার। একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগ কোনো ব্যক্তির, সরকারি কিংবা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে নাগরিককে সুরক্ষা দেবে। আওয়ামী লীগের গত শাসনকালে বিচার বিভাগ এমন ভূমিকা রেখেছে, যাতে তার স্বাধীনতার রূপ দেখে নির্বাহী বিভাগ মুগ্ধ হয়েছে। তার চোখ দেখে আমরা বুঝেছি যে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। অথচ এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। দশমিক ৩৬ নম্বর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটা গুয়াতেমালা ও পাকিস্তানের সমান্তরালে পৌঁছে গেছে। দশমিক ৩৪ পেয়ে ক্যামেরুন, বলিভিয়া ও কম্বোডিয়া একই কাতারে। আর দশমিক ৩৩ পেয়ে ভেনেজুয়েলা ৯৮তম ও দশমিক ২৭ পেয়ে আফগানিস্তান ৯৯তম অবস্থানে রয়েছে।
সমীক্ষার অষ্টম ও সবশেষ ফ্যাক্টর হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা। আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখার সুযোগ এনে দিয়েছে এই সূচক। ডব্লিউজেপির এই প্রতিবেদন বলেছে, একটি কার্যকর ফৌজদারি ব্যবস্থায় পুলিশ, প্রসিকিউটর, আইনজীবী, বিচারক এবং কারা কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য নীতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তঁারা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অপরাধ প্রতিরোধ এবং ফৌজদারি অপরাধ মোকাবিলায় সার্মথ্যবান থাকবে। এর আগে এই ব্যবস্থায় দুর্নীতির কথা জেনেছিলাম। বাংলাদেশের অধঃপতন এখানে চরমে। অথচ এটাই আসল বিচারিক আদালত। এখানে আমাদের অবস্থান ৯৪। শাসনের তুলনা হবে তাহলে কার সঙ্গে, সেটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে তুলনা করেই যদি আমরা আমোদিত হই, তাহলে সে কথা আলাদা। আমরা এই ফ্যাক্টরে বলিভিয়া, মেক্সিকো, আফগানিস্তান ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে আছি। ভারতের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা যে শক্তিশালী, তার প্রতিফলন ঘটেছে এই সূচকে। এমনকি এটাও কি দেখব না যে দক্ষিণ এশিয়ায় ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সূচকে বাংলাদেশ নিকৃষ্টতম। গতকালের (সোমবার) যুগান্তরের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ সরকার উপেক্ষা করছে।
তবে আমরা যে মিডিয়ার স্বাধীনতা ভোগের কথা বলি, এখানে আশাবাদ দেখি, তারও প্রতিফলন আছে এতে। আর সেটা একান্ত বাংলাদেশি নয়, গোটা দক্ষিণ এশীয় প্রবণতা। তবে ডব্লিউজেপির এই প্রতিবেদন স্পষ্টতই বলেছে, ‘আইনের শাসনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ঘাটতি আছে। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার দুর্নীতিতে দেশটির র্যাঙ্কিং ৯৫।’ সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান সবার নিচে। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও তদীয় লোকলস্করের অসদাচরণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের শিথিল মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। তারা আরও বলেছে, প্রশাসনিক এজেন্সিগুলো ও আদালত অদক্ষ এবং তারা দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের দ্বারা প্রভাবিত।
এই সমীক্ষায় বাংলাদেশ যেখানে সবচেয়ে ভালো করেছে, সেটা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায়। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ৭৬ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান তৃতীয়। তবে সেখানেও সুশাসনের কৃতিত্ব দাবি কতটা করা যাবে, তা তর্কসাপেক্ষ। কারণ, সংখ্যাগত দিক থেকে অপরাধের ঘটনা কম হওয়ায় এই র্যাঙ্কিংয়ে তার উন্নতি ঘটেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হলো ব্যক্তিগত সমস্যা মেটাতে সহিংসতার ব্যবহার। অন্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তুলনায় সম্পদের অধিকার সুরক্ষা শক্তিশালী থাকার কথা উল্লেখ করে এতে বাংলাদেশের প্রশংসাও আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments