একদলীয় রাষ্ট্রে বাঙালিরা সমরাজনৈতিক অধিকার হারাবেন by উইলিয়াম বি মাইলাম
সম রাজনৈতিক অধিকারের প্রবল আকাঙক্ষা থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বাঙালিরা। কিন্তু গত জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশে উত্থান ঘটেছে একদলীয় সরকারের। এর মাধ্যমে তাদের সেই সম রাজনৈতিক অধিকার ফের হারিয়ে গেছে। যদি এই একদলীয় সরকার ব্যবস্থা একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে বাঙালিরা সেই অধিকার হারাতে পারেন স্থায়ীভাবে। অনেক দেশের মধ্যে যারা কর্তৃত্বপরায়ণতায় ফিরে গিয়েছে, তাদের খুব কম সংখ্যকই ফিরে যেতে পেরেছে একেবারে শুরুর অবস্থায়। সম্প্রতি আমি লিখেছি ইতিহাসের জট সম্পর্কে। সেখানে আমি পরামর্শ দিয়েছি যে, (তৎকালীন) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সাংস্কৃতিক দ্বি-বিভাজনই রক্তাক্ত যুদ্ধের ভিত্তি রচনা করেছিল। পাকিস্তানের তখনকার এ দু’ অংশের মধ্যে এ লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগের বছরগুলোতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে প্রকাশিত মিডিয়ার দিকে যদি তাকানো হয় তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বাঙালিদের মধ্যে যে গুরুতর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল তার কারণ কি। তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। তাই বাঙালিদের তাৎক্ষণিকভাবে যে ইস্যুতে জাতীয় স্বার্থে একত্রিত করেছিল তা সাংস্কৃতিক ছিল না। তা ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। এর অর্থ এই নয় যে, সাংস্কৃতিক ব্যবধান কোন ভূমিকা রাখে নি। তবে ওই সময়ে বাঙালি বোদ্ধা মহলে এ ইস্যুটি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় নি। এটা পরিষ্কার। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশার আগেই এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক মতপার্থক্য একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছিল বলেই আমার কাছে মনে হয়। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধ এগিয়ে চলতে থাকলো এবং বাঙালিদের ওপর নির্যাতন বেড়ে গেল বহু বহু গুণে। দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, সাংস্কৃতিক মতপার্থক্য অধিকতর ব্যবধান হিসেবে দেখা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকারের মুখপাত্র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) এ আর সিদ্দিকী। তিনি ২০০৬ সালে একটি ডায়েরি প্রকাশ করেছেন।
বাঙালিরা হিন্দু ভাবধারার ও সংস্কৃতে লেখা হস্তলিপি ধারণ করে, হিন্দুদের লেখা কবিতা ও গানের প্রতি তাদের রয়েছে ভালবাসা। এমন অভিযোগ তুলে পাকিস্তানি সেনা নেতৃত্ব বাঙালিদের উপহাস করতেন বলে লিখেছেন ফুকুইয়ামা। বাঙালিদের এসব কারণে দমন করা সহজ হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান ও তার সহযোগীরা। বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযানের এটি অন্যতম একটি কারণ। এ মতপার্থক্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক দিক থেকে, এমনটা ধরে নেয়া হয়।
ইতিহাস এমন নিষ্ঠুরতায়ই পরিপূর্ণ। ফ্রাঁসিস ফুকুইয়ামা’র ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরি’ শীর্ষক বিতর্কিত রচনার ২৫ বছর পূর্তি উদযাপিত হয় সম্প্রতি। একই সঙ্গে এ রচনার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। এ রচনার বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। ১৯৮৯ সালের পূর্বাপর দিনগুলোতে গণতন্ত্র (কমপক্ষে নির্বাচিত গণতন্ত্রে) দৃশ্যত এগিয়ে যাচ্ছিল। এমনভাবে ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান, ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপ, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ, ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে যায় গণতন্ত্রের পথে । দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফ্রিকার অন্যান্য রাষ্ট্রে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করা হয়েছিল। সেখানে গণতন্ত্র, উদারতা ও বাজার ভিত্তিক অর্থনীতিকে স্বাগত জানানো হয়। তাই সহজেই বলা যায় যে, কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীকে একপেশে করে ফেলতে অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাবে গণতন্ত্র ।
কিন্তু এমন স্বপ্নের গণতন্ত্রের যাত্রাপথে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। গণতন্ত্রায়ণের তৃতীয় দফার যাত্রা শুরুর ত্রিশ বছর পরে এটা শুধু ধোঁয়াশায় পরিণত হয় নি। একই সঙ্গে এর যে জোয়ার ছিল তা অপসৃত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে নির্বাচনের মাধ্যমে যে গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটেছিল এখন তা নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। নির্যাস ছাড়া গণতন্ত্রে রয়েছে কিছু প্রতীকী বিষয়। রয়েছে সরকার ও তার কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহি।
আমাদের যারা ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে উদযাপন করেছি তারা ভুলে গিয়েছি যে, স্থিতিশীল গণতন্ত্রে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু থাকতে হয়। কোন ইতিহাসের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও সবার অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠান। মুক্তমনের সংস্কৃতি ও সহনশীলতা, যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় দেয়া ও নেয়ার সংস্কৃতি। এতে অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে থাকতেই হবে একটি বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ, যারা ব্যাপকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করবে। লালন করবে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যার সারকথা অবশ্যই ফাঁকা হবে না। থাকবে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি। সামাজিক প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে যারা সুশীল সমাজের কথা সরকারের কাছে ও রাজনীতিতে অনাগ্রহী সেনাবাহিনীর কাছে তুলে ধরবে।
ইতিহাস এখনও শেষ হয়ে যায় নি। নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কোটি কোটি মানুষের উচ্চাশার গণতান্ত্রিক অবস্থান হতে পারে না। ফুকুইয়ামা উল্লেখ করেছেন, উদার গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম কোন মডেল যদি থাকতো তাহলে উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অভিবাসীর স্রোত এতটা প্রবল হতো না। এক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দেশ হলো চীন। সেখানে একই সঙ্গে আছে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘটনা। পাশাপাশি আছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু এই মডেল আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। তিনি ওয়াশিংটনের উড্র উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তানি সংস্করণ দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।
বাঙালিরা হিন্দু ভাবধারার ও সংস্কৃতে লেখা হস্তলিপি ধারণ করে, হিন্দুদের লেখা কবিতা ও গানের প্রতি তাদের রয়েছে ভালবাসা। এমন অভিযোগ তুলে পাকিস্তানি সেনা নেতৃত্ব বাঙালিদের উপহাস করতেন বলে লিখেছেন ফুকুইয়ামা। বাঙালিদের এসব কারণে দমন করা সহজ হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান ও তার সহযোগীরা। বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযানের এটি অন্যতম একটি কারণ। এ মতপার্থক্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক দিক থেকে, এমনটা ধরে নেয়া হয়।
ইতিহাস এমন নিষ্ঠুরতায়ই পরিপূর্ণ। ফ্রাঁসিস ফুকুইয়ামা’র ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরি’ শীর্ষক বিতর্কিত রচনার ২৫ বছর পূর্তি উদযাপিত হয় সম্প্রতি। একই সঙ্গে এ রচনার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। এ রচনার বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। ১৯৮৯ সালের পূর্বাপর দিনগুলোতে গণতন্ত্র (কমপক্ষে নির্বাচিত গণতন্ত্রে) দৃশ্যত এগিয়ে যাচ্ছিল। এমনভাবে ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান, ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপ, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ, ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে যায় গণতন্ত্রের পথে । দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফ্রিকার অন্যান্য রাষ্ট্রে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করা হয়েছিল। সেখানে গণতন্ত্র, উদারতা ও বাজার ভিত্তিক অর্থনীতিকে স্বাগত জানানো হয়। তাই সহজেই বলা যায় যে, কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীকে একপেশে করে ফেলতে অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাবে গণতন্ত্র ।
কিন্তু এমন স্বপ্নের গণতন্ত্রের যাত্রাপথে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। গণতন্ত্রায়ণের তৃতীয় দফার যাত্রা শুরুর ত্রিশ বছর পরে এটা শুধু ধোঁয়াশায় পরিণত হয় নি। একই সঙ্গে এর যে জোয়ার ছিল তা অপসৃত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে নির্বাচনের মাধ্যমে যে গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটেছিল এখন তা নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। নির্যাস ছাড়া গণতন্ত্রে রয়েছে কিছু প্রতীকী বিষয়। রয়েছে সরকার ও তার কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহি।
আমাদের যারা ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে উদযাপন করেছি তারা ভুলে গিয়েছি যে, স্থিতিশীল গণতন্ত্রে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু থাকতে হয়। কোন ইতিহাসের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও সবার অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠান। মুক্তমনের সংস্কৃতি ও সহনশীলতা, যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় দেয়া ও নেয়ার সংস্কৃতি। এতে অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে থাকতেই হবে একটি বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ, যারা ব্যাপকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করবে। লালন করবে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যার সারকথা অবশ্যই ফাঁকা হবে না। থাকবে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি। সামাজিক প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে যারা সুশীল সমাজের কথা সরকারের কাছে ও রাজনীতিতে অনাগ্রহী সেনাবাহিনীর কাছে তুলে ধরবে।
ইতিহাস এখনও শেষ হয়ে যায় নি। নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কোটি কোটি মানুষের উচ্চাশার গণতান্ত্রিক অবস্থান হতে পারে না। ফুকুইয়ামা উল্লেখ করেছেন, উদার গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম কোন মডেল যদি থাকতো তাহলে উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অভিবাসীর স্রোত এতটা প্রবল হতো না। এক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দেশ হলো চীন। সেখানে একই সঙ্গে আছে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘটনা। পাশাপাশি আছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু এই মডেল আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। তিনি ওয়াশিংটনের উড্র উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তানি সংস্করণ দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।
No comments