চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায় by ফরহাদ মজহার
শ্রদ্ধাভাজন ডক্টর জাফর উল্লাহ্ চৌধুরী একবার আলোচনা সভায় বলেছিলেন, শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছেন। তার সারকথা হচ্ছে : বাংলাদেশে শেখ হাসিনা চাইছেন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শুধু জামায়াতে ইসলামী থাকুক। বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শেখ হাসিনা ভাবছেন, এভাবে রাজনীতি সাজালেই তার সুবিধা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষে বিভক্ত রাখলে শেখ হাসিনার সমালোচনা এখন যারা করছে, তারা মন্দের ভালো বলে আওয়ামী লীগের পতাকাতলেই দাঁড়াবে। বিএনপি যদি এটা না বুঝতে পারে তাহলে এ দলটি আসলেই বিলীন হয়ে যাবে। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে বদল ঘটাবে, তাতে বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে। বিচার ব্যবস্থা এখনই দুর্বল এবং ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক নির্দেশনার বাইরে তাদের যাওয়ার জায়গা সংকুচিত হয়ে রয়েছে, বিচারব্যবস্থার দুর্দশা আরও বাড়বে। বিনিয়োগ, মুদ্রাব্যবস্থা ও সামগ্রিকভাবে ব্যাংক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর দলীয় হস্তক্ষেপ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নগ্ন লুটপাট যেভাবে চলছে তাতে সহনশীল উন্নয়ন সুদূরপরাহত হয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক শৃংখলা বলে কিছুই থাকবে না। আর আইনশৃংখলার অবনতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন ইত্যাদি এখন যা দেখছি তার চেয়েও আরও তীব্র হবে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়তেই থাকবে। সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা আরও কমবে। বাড়া তো দূরের কথা।
এগুলো নতুন কথা নয়। তিনি ঠিক এভাবে বলেছেন, সেই দাবি আমি করব না। সেদিন তার বক্তব্যটি ছিল চমৎকার, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উৎকণ্ঠার জায়গা তার কথায় যেমন ধরা পড়েছিল, একই সঙ্গে তিনি এই পরিস্থিতিতে বিএনপির কর্তব্য সম্পর্কে খুবই গঠনমূলক কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিএনপির নেতৃবৃন্দ সেই সভায় হাজির ছিলেন। সেই পরামর্শ তাদের কেমন লেগেছিল জানি না, কিন্তু তিনি কেন বিএনপি বিলীন হয়ে যাবে বলেছেন, তাতে অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। অথচ জাফর উল্লাহ্ চৌধুরীর বক্তৃতাই ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিএনপিকে সতর্ক করা, বিএনপির অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান মনে রেখে বাংলাদেশে একটি সহনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কিভাবে জারি রাখা যায়, তিনি সেই দিকে নজর রেখেই কথা বলছিলেন।
তার একটি পরামর্শ মনে আছে। বলেছিলেন, সুপ্রিমকোর্টে বিএনপির আইনজীবীরা আছেন। তারা দুর্বল নন। তারা তো নিদেনপক্ষে প্রধান বিচারপতির কাছে এই প্রার্থনা জানাতে পারেন যে, গত নির্বাচনে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, নাগরিকদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতএব প্রধান বিচারপতির উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে একটা ব্যাখ্যা চাওয়া। এটি প্রধান বিচারপতি শুনবেন সেটা আশা করা যায় না। কিন্তু জাফর ভাইয়ের যুক্তি ছিল বিএনপি রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না। তার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলছে। তাহলে তাকে এমন কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে নেতারা বসে নেই। আইনি কাঠামোর মতো যা করা সম্ভব সেটা নেতারা করছেন। নিদেনপক্ষে এই তৎপরতাটুকু জারি রাখা জরুরি। অর্থাৎ কোনোভাবেই আন্দোলনে বিরতি দেয়া ঠিক হবে না। সেটা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু জাফর ভাই বিএনপি বিলীন হয়ে যেতে পারে কেন বলেছেন, তাতেই সেদিন বিএনপির কয়েকজন নেতা রুষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। বিএনপি যদি বিলীন হয় তো দলটির সমালোচনায় নেতাদের রুষ্ট হওয়ার এটাও একটি কারণ। যারা এখনও মনে করে, বিএনপি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের জনগণকে সাময়িক হলেও মুক্তি দিতে পারবে, তাদের পরামর্শ না শোনা।
যে কোনো দলই বিলীন হয়ে যেতে পারে। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। ঐতিহাসিক বাস্তবতা যদি বিচার করি তাহলে আওয়ামী লীগেরই বরং বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কিন্তু আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে গেছে প্রথমত মতাদর্শিক লড়াইকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের লালন-পালন করার প্রতি আওয়ামী লীগের নিষ্ঠার তুলনায় বিএনপি কিছুই না। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটা আসলে কী সেটা বিএনপি তার নিজের কর্মীদেরও বোঝাতে পারেনি। নেতাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা এর ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন কি-না সন্দেহ। আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে যে চারটি স্তম্ভ খাড়া করেছে সেটা সব সময়ই তাদের খুঁটির মতো কাজ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র। এই আদর্শের বিপরীতে বিএনপির আরও অগ্রসর আদর্শ নিয়ে দাঁড়ানো ছিল জরুরি। বাকশালি আমলকে এ দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে মূলত আওয়ামী লীগের মতাদর্শকেই জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা এর বিপরীতে কোনো মতাদর্শ খাড়া করতে পারেনি। ফলে এই দলটির রাজনীতির সারবস্তু হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ এবং দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরোধিতা। এটা দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। বিএনপি গিয়েছিল, কারণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তাদের পক্ষ ছিল। আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রবাদী অর্থনীতির বিপরীতে বিএনপি অবাধ বাজার ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের সবাই নাগরিক, তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি একটি মাত্র জাতি। বাংলাদেশের আরও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। জিয়াউর রহমান এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকতা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তা আলাদা- এ সত্যটা ধরতে পেরেছিলেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার জন্য তা ছিল অগ্র পদক্ষেপ। কিন্তু তিনি নিজে এর গণতান্ত্রিক তাৎপর্য কতটুকু বুঝেছিলেন বলা মুশকিল। জাতি অর্থে বাঙালি ও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী হওয়ার মধ্যে কোনো স্ববিরোধিতা নাই- এটা বিএনপির রাজনীতিতে কখনোই স্পষ্ট ছিল না, এখনও নাই। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে দুটিই হতে পারে এবং এই ধারণাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জাতীয় পরিচয় থেকে বাংলাদেশী কথাটা আলাদা করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কেন জরুরি, এটা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে বোঝাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করার একটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যা একসময় ব্যাকফায়ার করেছে। কারণ বাঙালি জাতিসত্তাকে যারা একই সঙ্গে তাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় গণ্য করে, তারা ভেবেছে এটা বাঙালি হিসেবে তাদের জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত। আশির দশকের পর থেকে তারা জাতীয়তাবাদী চেতনার জায়গা থেকে সংগঠিত হতে পেরেছে। একেই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে দাবি করতে শুরু করে এবং বিএনপির রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রমাণ করতে ধীরে ধীরে তারা সক্ষম হয়ে ওঠে। বুদ্ধিবৃত্তিক বা মতাদর্শিকভাবে একে মোকাবেলা করার কোনো শক্তি বিএনপির ছিল না। এখনও নাই।
জাতি পরিচয় ও নাগরিক পরিচয় যদি বাঙালির ক্ষেত্রে আলাদা হয়, তাহলে সেটা অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বেলাতেও সত্য। কিন্তু বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে বিএনপির অস্পষ্টতার জায়গা সহজে ধরা পড়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতি বিএনপির রাজনীতিতে। বিএনপি একে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা ও সংকট হিসেবে না দেখে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির স্বার্থ রক্ষার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেছে। পক্ষাবলম্বন করেছে বাঙালিদের প্রতি। শেখ মুজিব তাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলোকে বাঙালি হয়ে যেতে বলেছেন, জিয়াউর রহমান ও বিএনপি তাদের বাংলাদেশী হতে বলেছেন- এটাই পার্থক্য, কিন্তু তাদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও সম্পত্তিতে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার মেনে নেননি। ফল হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধ। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে ভারতের যতই হাত থাকুক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা নিপীড়তই হয়েছে। বিএনপি শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী বর্ণবাদকেই চর্চা করেছে। সেটা করেছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নতুন মতাদর্শ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি পরিগঠনের যে সম্ভাবনা ছিল, বিএনপি তা অংকুরেই নষ্ট করেছে। এর পর জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে তার আঁতাতে বিএনপি নিজেকে জামায়াত ঘেঁষা দল হিসেবে ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর কারণ হচ্ছে, একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে বিএনপির নিজের কোনো মূল্যায়ন নেই, জামায়াতে ইসলামীও এই ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির গণতান্ত্রিক বা উদারনৈতিক বিকাশ কিভাবে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় তাকে গুরুত্ব দেয়নি। আজও দেয় না। ইসলামপন্থীদের জন্য এটা এক বিরাট বোঝা।
জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে যতই দৃশ্যমান হয়েছে, সমান তালে ও তার চেয়েও অধিক মাত্রায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সংঘবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের জন্য জামায়াতে ইসলামী নামে জামায়াত নেতৃবৃন্দের রাজনীতি অব্যাহত রাখাই বিশেষভাবে দায়ী। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিএনপির অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব^ও শুরু হয়। এখনও জারি আছে। অবস্থা অনুযায়ী তা প্রকটও হয়।
এরপরও বিএনপি জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি বিনিয়োগ করে চলছিল, খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আপসহীন নেত্রী হিসেবে যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন, সেটাও বিএনপির কাজে লাগে। কিন্তু বিএনপি জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভিযোগের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে। কারণ জিয়াউর রহমান সৈনিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাঘটনের ফলাফলেই জিয়াউর রহমানের উত্থান। তিনি টিকে গিয়েছেন কারণ সাতই নভেম্বরে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে তিনি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ও সাধারণ সৈনিকদের মৈত্রীর প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। জিয়াউর রহমান নিজেও তার এই ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝেননি। যদি বুঝতেন তাহলে তিনি ক্ষমতায় গিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান মেনে নিতেন না। ফেলে দিয়ে নতুন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু করতেন।
দুটি কারণে তার উচিত নতুন সাংবিধানিক সভা ডাকা ও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা। প্রথম কারণ হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান আওয়ামী লীগের দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে রচিত। এতে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন নাই। কারণ এই সংবিধান প্রণয়নের জন্য কোনো সংবিধান প্রণয়নী সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে যারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল, তারাই ডক্টর কামাল হোসেন লিখিত ও ডক্টর আনিসুজ্জামান অনূদিত রচনাকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে। এখনও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধান ডক্টর কামাল হোসেন লিখেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে ব্যক্তির রচনা কিভাবে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের অভিপ্রায় হয়? কিন্তু বাংলাদেশে এটা সম্ভব হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই সংবিধান স্বাধীনতার ঘোষণার মূল যে তিন নীতি তার ভিত্তিতে প্রণীত হয়নি। সেটা আওয়ামী লীগের চার স্তম্ভ নয়। বরং সেই ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ইনসাফ। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করেননি। তিনি বলতে পারতেন, স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই তিনি ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ রক্ত দিয়েছে। এর ভিত্তিতে নতুন সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রণীত হবে। সেটা তিনি করেননি। এটা ছিল তার চরম অনভিজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয়। তার মূল্য তিনি দিয়েছেন।
এই মূল্যায়ন তাহলে অমূলক নয় যে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে এসেছেন বলে সংবিধান স্থগিত রেখে সামরিক শাসন জারি করে শাসন করেছেন। সামরিক শাসনের অধিক কিছু ভাবতে পারেননি। ততটুকুই তিনি সংবিধান সংশোধন করেছেন, যতটুকু তার সামরিক শাসনকে বৈধ করার কাজে দরকার বোধ করেছেন। সামরিক শাসক হিসেবে বাহাত্তরের সংবিধান মেনে নিয়ে তিনি বাহাত্তরের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকেই মেনে নিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে তার আমলের সংবিধান সংশোধন আদালত অবৈধ বলেছে। একেই আমি বলছি অদূরদর্শিতার জন্য মূল্য পরিশোধ। আদালতের রায় তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
বিএনপির দুর্বলতা বোঝার জন্য আমি সাম্প্রতিক রাজনীতির ওপর জোর দিতে চাই না। ফলে গোড়ার কয়েকটি বিষয় নিয়ে বললাম। কারণ গোড়ায় না গেলে বিএনপির পক্ষে কোনো উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্ম দেয়া অসম্ভব। নিজের ইতিহাস পর্যালোচনা করেই বিএনপিকে দাঁড়াতে হবে। যদি সেই পর্যালোচনার সামর্থ্য তার থাকে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে নির্বাচনপন্থী উদার রাজনীতি আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এখন বলাবলি শুরু হয়েছে, গণতন্ত্র দিয়ে কী করব, দরকার ভালো শাসনব্যবস্থা। অন্যদিকে যেসব দেশে ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম, সেসব দেশে জনগণ উদার রাজনীতির ওপর কতদিন ভরসা করে থাকবে, সেটাই সন্দেহ। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশে সাম্প্রতিককালে যা ঘটছে, বাংলাদেশের জনগণের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। বলাবাহুল্য, ইরাকের সাম্প্রতিক ঘটনা এ দেশের জনগণের চিন্তা-চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলবে। ফেলতে বাধ্য।
আমরা দুনিয়াতে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি না। পরিবর্তন ঘটতে কতক্ষণ? হাওয়া বদলায়।
চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়!
৪ জুলাই ২০১৪। ২০ আষাঢ় ১৪২১। শ্যামলী।
এগুলো নতুন কথা নয়। তিনি ঠিক এভাবে বলেছেন, সেই দাবি আমি করব না। সেদিন তার বক্তব্যটি ছিল চমৎকার, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উৎকণ্ঠার জায়গা তার কথায় যেমন ধরা পড়েছিল, একই সঙ্গে তিনি এই পরিস্থিতিতে বিএনপির কর্তব্য সম্পর্কে খুবই গঠনমূলক কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিএনপির নেতৃবৃন্দ সেই সভায় হাজির ছিলেন। সেই পরামর্শ তাদের কেমন লেগেছিল জানি না, কিন্তু তিনি কেন বিএনপি বিলীন হয়ে যাবে বলেছেন, তাতে অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। অথচ জাফর উল্লাহ্ চৌধুরীর বক্তৃতাই ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিএনপিকে সতর্ক করা, বিএনপির অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান মনে রেখে বাংলাদেশে একটি সহনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কিভাবে জারি রাখা যায়, তিনি সেই দিকে নজর রেখেই কথা বলছিলেন।
তার একটি পরামর্শ মনে আছে। বলেছিলেন, সুপ্রিমকোর্টে বিএনপির আইনজীবীরা আছেন। তারা দুর্বল নন। তারা তো নিদেনপক্ষে প্রধান বিচারপতির কাছে এই প্রার্থনা জানাতে পারেন যে, গত নির্বাচনে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, নাগরিকদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতএব প্রধান বিচারপতির উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে একটা ব্যাখ্যা চাওয়া। এটি প্রধান বিচারপতি শুনবেন সেটা আশা করা যায় না। কিন্তু জাফর ভাইয়ের যুক্তি ছিল বিএনপি রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না। তার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলছে। তাহলে তাকে এমন কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে নেতারা বসে নেই। আইনি কাঠামোর মতো যা করা সম্ভব সেটা নেতারা করছেন। নিদেনপক্ষে এই তৎপরতাটুকু জারি রাখা জরুরি। অর্থাৎ কোনোভাবেই আন্দোলনে বিরতি দেয়া ঠিক হবে না। সেটা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু জাফর ভাই বিএনপি বিলীন হয়ে যেতে পারে কেন বলেছেন, তাতেই সেদিন বিএনপির কয়েকজন নেতা রুষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। বিএনপি যদি বিলীন হয় তো দলটির সমালোচনায় নেতাদের রুষ্ট হওয়ার এটাও একটি কারণ। যারা এখনও মনে করে, বিএনপি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের জনগণকে সাময়িক হলেও মুক্তি দিতে পারবে, তাদের পরামর্শ না শোনা।
যে কোনো দলই বিলীন হয়ে যেতে পারে। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। ঐতিহাসিক বাস্তবতা যদি বিচার করি তাহলে আওয়ামী লীগেরই বরং বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কিন্তু আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে গেছে প্রথমত মতাদর্শিক লড়াইকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের লালন-পালন করার প্রতি আওয়ামী লীগের নিষ্ঠার তুলনায় বিএনপি কিছুই না। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটা আসলে কী সেটা বিএনপি তার নিজের কর্মীদেরও বোঝাতে পারেনি। নেতাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা এর ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন কি-না সন্দেহ। আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে যে চারটি স্তম্ভ খাড়া করেছে সেটা সব সময়ই তাদের খুঁটির মতো কাজ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র। এই আদর্শের বিপরীতে বিএনপির আরও অগ্রসর আদর্শ নিয়ে দাঁড়ানো ছিল জরুরি। বাকশালি আমলকে এ দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে মূলত আওয়ামী লীগের মতাদর্শকেই জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা এর বিপরীতে কোনো মতাদর্শ খাড়া করতে পারেনি। ফলে এই দলটির রাজনীতির সারবস্তু হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ এবং দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরোধিতা। এটা দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। বিএনপি গিয়েছিল, কারণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তাদের পক্ষ ছিল। আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রবাদী অর্থনীতির বিপরীতে বিএনপি অবাধ বাজার ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের সবাই নাগরিক, তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি একটি মাত্র জাতি। বাংলাদেশের আরও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। জিয়াউর রহমান এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকতা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তা আলাদা- এ সত্যটা ধরতে পেরেছিলেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার জন্য তা ছিল অগ্র পদক্ষেপ। কিন্তু তিনি নিজে এর গণতান্ত্রিক তাৎপর্য কতটুকু বুঝেছিলেন বলা মুশকিল। জাতি অর্থে বাঙালি ও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী হওয়ার মধ্যে কোনো স্ববিরোধিতা নাই- এটা বিএনপির রাজনীতিতে কখনোই স্পষ্ট ছিল না, এখনও নাই। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে দুটিই হতে পারে এবং এই ধারণাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জাতীয় পরিচয় থেকে বাংলাদেশী কথাটা আলাদা করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কেন জরুরি, এটা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে বোঝাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করার একটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যা একসময় ব্যাকফায়ার করেছে। কারণ বাঙালি জাতিসত্তাকে যারা একই সঙ্গে তাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় গণ্য করে, তারা ভেবেছে এটা বাঙালি হিসেবে তাদের জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত। আশির দশকের পর থেকে তারা জাতীয়তাবাদী চেতনার জায়গা থেকে সংগঠিত হতে পেরেছে। একেই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে দাবি করতে শুরু করে এবং বিএনপির রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রমাণ করতে ধীরে ধীরে তারা সক্ষম হয়ে ওঠে। বুদ্ধিবৃত্তিক বা মতাদর্শিকভাবে একে মোকাবেলা করার কোনো শক্তি বিএনপির ছিল না। এখনও নাই।
জাতি পরিচয় ও নাগরিক পরিচয় যদি বাঙালির ক্ষেত্রে আলাদা হয়, তাহলে সেটা অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বেলাতেও সত্য। কিন্তু বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে বিএনপির অস্পষ্টতার জায়গা সহজে ধরা পড়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতি বিএনপির রাজনীতিতে। বিএনপি একে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা ও সংকট হিসেবে না দেখে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির স্বার্থ রক্ষার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেছে। পক্ষাবলম্বন করেছে বাঙালিদের প্রতি। শেখ মুজিব তাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলোকে বাঙালি হয়ে যেতে বলেছেন, জিয়াউর রহমান ও বিএনপি তাদের বাংলাদেশী হতে বলেছেন- এটাই পার্থক্য, কিন্তু তাদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও সম্পত্তিতে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার মেনে নেননি। ফল হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধ। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে ভারতের যতই হাত থাকুক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা নিপীড়তই হয়েছে। বিএনপি শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী বর্ণবাদকেই চর্চা করেছে। সেটা করেছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নতুন মতাদর্শ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি পরিগঠনের যে সম্ভাবনা ছিল, বিএনপি তা অংকুরেই নষ্ট করেছে। এর পর জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে তার আঁতাতে বিএনপি নিজেকে জামায়াত ঘেঁষা দল হিসেবে ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর কারণ হচ্ছে, একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে বিএনপির নিজের কোনো মূল্যায়ন নেই, জামায়াতে ইসলামীও এই ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির গণতান্ত্রিক বা উদারনৈতিক বিকাশ কিভাবে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় তাকে গুরুত্ব দেয়নি। আজও দেয় না। ইসলামপন্থীদের জন্য এটা এক বিরাট বোঝা।
জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে যতই দৃশ্যমান হয়েছে, সমান তালে ও তার চেয়েও অধিক মাত্রায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সংঘবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের জন্য জামায়াতে ইসলামী নামে জামায়াত নেতৃবৃন্দের রাজনীতি অব্যাহত রাখাই বিশেষভাবে দায়ী। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিএনপির অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব^ও শুরু হয়। এখনও জারি আছে। অবস্থা অনুযায়ী তা প্রকটও হয়।
এরপরও বিএনপি জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি বিনিয়োগ করে চলছিল, খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আপসহীন নেত্রী হিসেবে যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন, সেটাও বিএনপির কাজে লাগে। কিন্তু বিএনপি জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভিযোগের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে। কারণ জিয়াউর রহমান সৈনিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাঘটনের ফলাফলেই জিয়াউর রহমানের উত্থান। তিনি টিকে গিয়েছেন কারণ সাতই নভেম্বরে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে তিনি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ও সাধারণ সৈনিকদের মৈত্রীর প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। জিয়াউর রহমান নিজেও তার এই ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝেননি। যদি বুঝতেন তাহলে তিনি ক্ষমতায় গিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান মেনে নিতেন না। ফেলে দিয়ে নতুন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু করতেন।
দুটি কারণে তার উচিত নতুন সাংবিধানিক সভা ডাকা ও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা। প্রথম কারণ হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান আওয়ামী লীগের দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে রচিত। এতে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন নাই। কারণ এই সংবিধান প্রণয়নের জন্য কোনো সংবিধান প্রণয়নী সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে যারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল, তারাই ডক্টর কামাল হোসেন লিখিত ও ডক্টর আনিসুজ্জামান অনূদিত রচনাকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে। এখনও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধান ডক্টর কামাল হোসেন লিখেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে ব্যক্তির রচনা কিভাবে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের অভিপ্রায় হয়? কিন্তু বাংলাদেশে এটা সম্ভব হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই সংবিধান স্বাধীনতার ঘোষণার মূল যে তিন নীতি তার ভিত্তিতে প্রণীত হয়নি। সেটা আওয়ামী লীগের চার স্তম্ভ নয়। বরং সেই ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ইনসাফ। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করেননি। তিনি বলতে পারতেন, স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই তিনি ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ রক্ত দিয়েছে। এর ভিত্তিতে নতুন সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রণীত হবে। সেটা তিনি করেননি। এটা ছিল তার চরম অনভিজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয়। তার মূল্য তিনি দিয়েছেন।
এই মূল্যায়ন তাহলে অমূলক নয় যে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে এসেছেন বলে সংবিধান স্থগিত রেখে সামরিক শাসন জারি করে শাসন করেছেন। সামরিক শাসনের অধিক কিছু ভাবতে পারেননি। ততটুকুই তিনি সংবিধান সংশোধন করেছেন, যতটুকু তার সামরিক শাসনকে বৈধ করার কাজে দরকার বোধ করেছেন। সামরিক শাসক হিসেবে বাহাত্তরের সংবিধান মেনে নিয়ে তিনি বাহাত্তরের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকেই মেনে নিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে তার আমলের সংবিধান সংশোধন আদালত অবৈধ বলেছে। একেই আমি বলছি অদূরদর্শিতার জন্য মূল্য পরিশোধ। আদালতের রায় তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
বিএনপির দুর্বলতা বোঝার জন্য আমি সাম্প্রতিক রাজনীতির ওপর জোর দিতে চাই না। ফলে গোড়ার কয়েকটি বিষয় নিয়ে বললাম। কারণ গোড়ায় না গেলে বিএনপির পক্ষে কোনো উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্ম দেয়া অসম্ভব। নিজের ইতিহাস পর্যালোচনা করেই বিএনপিকে দাঁড়াতে হবে। যদি সেই পর্যালোচনার সামর্থ্য তার থাকে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে নির্বাচনপন্থী উদার রাজনীতি আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এখন বলাবলি শুরু হয়েছে, গণতন্ত্র দিয়ে কী করব, দরকার ভালো শাসনব্যবস্থা। অন্যদিকে যেসব দেশে ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম, সেসব দেশে জনগণ উদার রাজনীতির ওপর কতদিন ভরসা করে থাকবে, সেটাই সন্দেহ। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশে সাম্প্রতিককালে যা ঘটছে, বাংলাদেশের জনগণের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। বলাবাহুল্য, ইরাকের সাম্প্রতিক ঘটনা এ দেশের জনগণের চিন্তা-চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলবে। ফেলতে বাধ্য।
আমরা দুনিয়াতে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি না। পরিবর্তন ঘটতে কতক্ষণ? হাওয়া বদলায়।
চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়!
৪ জুলাই ২০১৪। ২০ আষাঢ় ১৪২১। শ্যামলী।
No comments