সুশাসন তথা ত্বরান্বিত বিচার by আলী ইদরিস
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান যেমন মানুষের বাঁচার জন্য অপরিহার্য, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ত্বরান্বিত বিচার অপরিহার্য। অন্যায়, নির্যাতন, নিপীড়নের প্রতিকার হিসেবে বিচার পাওয়াও জনগণের মৌলিক অধিকার। দু’চার দিন কিছু না খেয়েও মানুষ বাঁচতে পারে, পরে খাদ্য পেলে উপোসের কষ্ট ভুলে যায়। কিন্তু অমানুষিক, বর্বর, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের বিচার না পেলে সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই যুগে যুগে সমাজ ও রাষ্ট্র অপরাধের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে কাজী, পঞ্চায়েত, আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে বিচারের ব্যবস্থা করেছে। আজ ঘরে-বাইরে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, রাষ্ট্রে অহরহ অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে। চুরি, চামারি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, ডাকাতি, ঘুষ, দুর্নীতি, খুন-গুম, এসব অন্যায় যেন আজ ডালভাত। পরিবারে দেখা যায়, অর্থবিত্তের লোভে ভাই ভাইকে, ছেলে বাবাকে হত্যা করে, যৌতুকের জন্য স্বামী- দেবর, শ্বশুর, শাশুড়ি মিলে বউকে হত্যা করে, অর্থের লোভে ছিনতাইকারী, পকেটমার, অজ্ঞান পার্টি, ডাকাত দল, রাস্তা-ঘাটে, ট্রেনে, স্টিমারে তৎপর, অর্থবিত্তের লোভে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা/কর্মচারী ঘুষ দাবি করে, দুর্নীতিতে মত্ত হয়, অর্থের লোভে ব্যবসায়ী খাদ্য পণ্যে, ওষুধে বিষ ও ভেজাল মেশায়, অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার প্রলোভনে, আধিপত্য বিস্তার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি জনগণের প্রাপ্য লুটে খায় এবং স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অর্থের লোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাঁদাবাজি, ক্ষমতার বাণিজ্য, এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়। সমস্ত অপরাধের নেপথ্যে অবৈধ অর্থ, প্রতিপত্তি, আধিপত্য ও ক্ষমতার লোভ কাজ করছে এবং অপরাধের মাত্রা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে কাজ করছে বিলম্বিত বিচার অথবা আদৌ বিচার না হওয়া। এদেশে বিচার পাওয়ার পথ ইনডেমনিটি দিয়ে রুদ্ধ করে দেয়ার ইতিহাসও রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু খুনের বিচার সম্পন্ন ও শাস্তি বাস্তবায়িত করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা সেই খারাপ ইতিহাস মুছে ফেলেছেনে এবং বিচার হওয়ার এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। কিন্তু এখনও অনেক অপরাধের বিচার হয়নি, কিবরিয়া হত্যার বিচার হয়নি, ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার হয়নি, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা, জিয়া হত্যার বিচার হয়নি, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম গুমের বিচার হয়নি, সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি, আরও অসংখ্য খুন-গুমের বিচার হয়নি, শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট, সোনালী ব্যাংকের টাকা লুট, ডেসটিনি কর্তৃক জনগণের টাকা আত্মসাৎ, রানা প্লাজা ধসে প্রায় ১২০০ লোকের প্রাণহানি, এ রকম অনেক অপরাধের বিচার হয়নি, কোন কোনটার বিচার চলছে। যে মায়ের বুক খালি হয় অথবা যে বোন বিধবা হলো বিলম্বিত বিচার কি পারবে তাদের বুকের দীর্ঘ রক্তক্ষরণ বা অতি শোকে মৃত্যুবরণ করাকে ফিরিয়ে দিতে? হাজার হাজার অপরাধের মামলা বছরের পর বছর পড়ে আছে, অপরাধীরা একই অন্যায় করে বেড়াচ্ছে, বাদীরা আতঙ্কে নির্ঘুম রাতযাপন করছে, এ অশান্তির পরিবেশ সব সরকারের আমলেই চলে আসছে। বিচার প্রার্থী আরও মর্মাহত হয় যখন দলীয় হীনস্বার্থে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়। অপরাধকে রাজনৈতিক রঙ্গে রাঙ্গিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার অর্থ বিচার ব্যবস্থাকে, মানবতাকে পদদলিত করা, বিচার প্রার্থীর দীর্ঘলালিত বিচার পাওয়ার স্বপ্নকে পদপিষ্ট করা, অপরাধীকে আরও অপরাধ করার সাহস যোগান দেয়া। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হলো সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা। সে সময় যদি ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রী কাউকে দোষারোপ করেন, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বভাবতই চাকরি বাঁচাতে ক্ষমতাসীন দলের ইঙ্গিতে এগোবে। আইন তার নিজস্ব গতি-পরিধি অতিক্রম করে সংকেতপ্রাপ্ত রাস্তায় ধাবিত হতে পারে। ফলে প্রকৃত অপরাধীর বিচার না-ও হতে পারে। এ দেশে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে। তারা যদি প্রতিযোগিতার সঙ্গে নিজেদের শাসনকালে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতো তাহলে এ দেশ সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যেতো। এই হতভাগ্য দেশে বিচার বিভাগ কর্তৃক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মৃত্যুদণ্ডও কোন কোন ক্ষেত্রে মহামান্য প্রেসিডেন্ট মওকুফ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এই মহান ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের মহিমা, মর্যাদা বাড়ায় বটে, কিন্তু খুনের অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ক্ষমা করে দিলে সন্তান-হারা মায়ের অথবা ভাই-হারা বোনের ও তার সহোদরগণের বুকের রক্তক্ষরণ সেই ক্ষমতা বা মর্যাদা থামাতে পারে কি? আজ অপরাধ বেড়েই চলছে। এসব অপরাধ বন্ধ করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, অর্থাৎ সময়মতো অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক বা অধিষ্ঠিত থাকুক, আইনের শাসন ছাড়া দুর্নীতি, সস্ত্রাস, খুন-খারাবি দমন করা সম্ভব হবে না। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেন সুশাসন পেতে পারি সে কামনায় সরকারের কাছে নিবেদন থাকবে অপরাধের বিচার পদ্ধতি আরও ত্বরান্বিত করুন, তাহলে অপরাধ নির্মূল না হোক, অন্তত নিয়ন্ত্রিত হবে।
No comments