হিন্দির আধিপত্য বনাম বহু ভাষাভাষী ভারত by কুলদীপ নায়ার
মোদির ক্ষমতায় আরোহণের প্রথম পক্ষের
মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলোতে একটি পরিপত্র পাঠানো হয়েছে, এতে
বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে হিন্দি ভাষা ব্যবহার করতে হবে। এটা অনেকটা পেছন
দরজা দিয়ে ঢোকার মতো। অহিন্দিভাষী জনগণ এটা ধরতে পেরে এর বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ জানিয়েছে। নতুন দিল্লি বেশ দ্রুতই এ জায়গা থেকে সরে এসে বলেছে, এই
পরিপত্র হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর জন্য প্রযোজ্য।
উপলব্ধিটা হতে একটু দেরিই হয়ে গেল, ফলে সেটা কাউকে তেমন আশ্বস্ত করতে পারেনি। আমার মনে হয়, সরকার হাওয়া বোঝার চেষ্টা করেছে। তারা এটাকে একটা নিরীহ পদক্ষেপ মনে করেছিল, এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ শুরু হওয়ায় সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। কিন্তু এই পরিপত্রটি একটি ক্ষতি করে ফেলেছে। অহিন্দিভাষী জনগণের মধ্যে এটা পুরোনো ভীতির পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে। আগামী দিনে কী ঘটবে, সেটা নিয়ে তারা ভীত হয়ে পড়েছে।
আমি নিশ্চিত, নরেন্দ্র মোদির সরকার হিন্দি জাত্যভিমানীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তবে তিনি হয়তো কোনো তাড়না থেকে এটা করছেন না। ভারতীয় জনতা পার্টিতে বেশ কয়েকজন উদার নেতা আছেন, তাঁরা বোঝেন, হিন্দিতে যেতে হলে খানিকটা সময় নিয়েই যেতে হবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুর খুঁজতে হলে এভাবেই অগ্রসর হওয়া জরুরি। দৃশ্যত, তাঁদের তেমন কিছু বলার নেই।
৫০ বছর আগের ভারত আর আজকের ভারত এক নয়, বর্তমানে প্রতিটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীই নিজেদের আত্মপরিচয়ের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। রাজ্যগুলোর পুনর্গঠনের সময় যে ডামাডোল সৃষ্টি হয়েছিল, সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। জনগণের সংবেদনশীলতার প্রতি উদাসীন হলে ঐক্যের সুতাটাই ছিঁড়ে যেতে পারে। তাড়াহুড়ার কী আছে? জাতির একতা রক্ষা করতে কয়েক দশকের অপেক্ষা কি খুব বেশি কিছু?
১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে ও ১৯৬০-এর দশকের প্রথম ভাগে ভারতে বেশ কিছু ভাষাগত দাঙ্গা হয়েছে। সে সময়ও স্বরাষ্ট্র দপ্তর নির্দেশনা দেয়, প্রতিটি বিভাগকে ইংরেজি থেকে হিন্দিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে—সংবিধানে যেভাবে বলা আছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে দাঙ্গা হয়েছে। তামিলনাড়ুতে এক ব্যক্তি নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে হিন্দি গ্রহণে আপত্তি জানায়। এমনকি ভারতীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পুরোনো স্লোগান নতুন করে শোনা যায়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অখুশি হলেও তিনি এতে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। প্রতিরোধের আগুন ছড়িয়ে পড়লে জওহরলাল নেহরু সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, অহিন্দিভাষী জনগণ ইউনিয়ন প্রশাসনিক কার্যক্রমের একক ভাষা হিসেবে হিন্দি গ্রহণে রাজি না হলে ইংরেজি বাদ দেওয়া হবে না। এই সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হিন্দি গোঁড়াদের একটু হতাশ করলেও ভারত খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হয়, আর পুরো জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আমি আশা করি, এই দ্বিভাষিক সংস্কৃতিতে কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে এটাকে চলতে দেওয়া হবে। কিন্তু মোদির মানুষেরা তাড়াহুড়ার মধ্যেই ছিলেন। তঁারা ইংরেজির ব্যবহার কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তার পরও তঁারা বুঝতে পেরেছেন, তাদের এই তাড়াহুড়া দেশের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারত। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় ইউনিয়নের ভাষা হচ্ছে হিন্দি, অহিন্দিভাষী রাজ্য যেমন তামিলনাড়ু এটা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এটা শিখতে তারা সময় চায়, হিন্দিভাষী রাজ্য যেমন উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানের লোকেরা যেভাবে ভাষাটা ব্যবহার করে, সে পর্যায়ে উন্নীত হতে তারা এ সময় চায়।
সন্দেহ নেই, মোদি হিন্দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় তিনি হিন্দি ব্যবহার করেছেন, এ হিন্দি আবার কিছুটা সংস্কৃত ও উত্তর ভারতঘেঁষা। নির্বাচনে জয়লাভের পেছনে এটাও একটা কারণ। কিন্তু নেহরু ১৯৬৩ সালে ওয়াদা করেছিলেন, হিন্দি ও ইংরেজি উভয়ই প্রশাসনের যোগসূত্র স্থাপনকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মোদির এটা মাথায় রাখা উচিত। নেহরু এককভাবে হিন্দি ব্যবহারের জন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেননি।
ঐতিহ্য ভাষার সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকে। ফলে দেশব্যাপী নেতাদের পন্থা খুঁজে বের করতে হবে, যাতে স্থানীয় ভাষাগুলো এগিয়ে যেতে পারে। সাবেক স্পিকার পুরুষোত্তম দাস ট্যানডন এরূপ এক প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু কেরালার একজন সাংসদ এটা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেছিলেন। তিনি স্পিকারকে সতর্ক করেছিলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে এরূপ দাবি না উঠলে এই কোটা ব্যবস্থার দ্বার খুলে দেওয়া ঠিক হবে না। অহিন্দিভাষী অঞ্চলের সদস্যরা এটা সমর্থন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাবটি বাদ দেওয়া হয়।
সংবিধানে ২২টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এর প্রতিটিরই নিজস্ব লিপি রয়েছে। এটা সত্য, হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে এই ২২টি ভাষা জাতীয় মর্যাদার। ভাষা কমিশনের ওপর গঠিত সংসদীয় কমিটি এটা বিবেচনা করেছিল, যদিও এই কমিটি হিন্দিকে প্রধান ভাষা ও ইংরেজিকে অতিরিক্ত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
এত কিছু বলার কারণ হচ্ছে, নতুন কোনো সূত্রসংক্রান্ত জাতিগত ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় রাখার ব্যাপারে আমার মতামত ব্যক্ত করা। তার মানে, হিন্দির ওপর এই যে নতুন করে জোর দেওয়া হলো, সে ক্ষেত্রে যেন প্রতিটি অঞ্চলের আকাঙ্ক্ষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন না করা হয়। এটাও নিশ্চিত করতে হবে, কোনো ভাষা বা ভাষিক গোষ্ঠী যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। হিন্দিকে যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় মোদির এই হুকুমের কারণে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে, দেশের সব এলাকার মানুষ হিন্দিতে দক্ষ হয়ে ওঠা পর্যন্ত হিন্দি জাত্যভিমানীদের অপেক্ষা করতে হবে। ইতিমধ্যে তামিলনাড়ু ছাড়া সব রাজ্যেই হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের চাকরিপ্রার্থীরাও হিন্দি শেখার ওপর জোর দিয়েছেন। সিনেমার কল্যাণে এই ভাষাটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এখন দক্ষিণের একজন মানুষও হিন্দি বা হিন্দুস্তানিতে কথা বলতে পারেন। আরও কয়েক বছর পর দেখা যাবে, দেশের সব মানুষই হিন্দিতে অনর্গল কথা বলছে।
ভাষা খুবই শক্তিশালী একটা ব্যাপার। বাংলার ওপর উর্দু চাপানোর চেষ্টা হওয়ায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তানে বেলুচ ভাষার প্রতি যে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে, তার ফলেই স্বায়ত্তশাসিত বেলুচিস্তানের দাবি উঠেছে।
বাস্তবে, স্থানীয় ভাষাগুলো কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে শাসকদের চিন্তা করা উচিত। যেমন পাঞ্জাব রাজ্যেই পাঞ্জাবি ভাষায় সেখানকার মানুষেরা ঘরবাড়িতেও কথা বলা একরকম ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষার প্রতি উদাসীন। তারা ইংরেজি শিখতেই বেশি আগ্রহী, এতে তাদের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল হয়, ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচা যায়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
No comments