সার্টিফিকেটের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীরা কি করবেন? by শামীমুল হক
মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কি করছে- এ প্রশ্ন আজ যে কেউ করতেই পারেন। টিআইবি অনুসন্ধান করে জানান দিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ হাজার টাকা দিলেই সার্টিফিকেট মেলে। অর্থাৎ লেখাপড়া না করেও যে কেউ হতে পারছেন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। হতে পারছেন বিজ্ঞানীও। টাকা দিলেই এসব সার্টিফিকেটের মালিক হতে পারছেন যে কেউ। তাহলে আর লেখাপড়ার কি দরকার? টাকা হলেই হলো। মন্ত্রণালয়ই করবে কি? যেখানে এসএসসি আর এইচএসসিতে পরীক্ষকদের বলে দেয়া হচ্ছে কাউকে ফেল করানো যাবে না। পাস করাতে হবে। লিখলেই দিতে হবে নাম্বার। ওই লেখা সঠিক হোক আর বেঠিক হোক। তা-ই করা হচ্ছে। এর ফল পাচ্ছি আমরা। এসএসসি আর এইচএসসির রেজাল্টে দেখা যায় ৯২ ভাগ পাস করছে। কিন্তু গত ক’বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে দেখা গেছে জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাননি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আর এ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এই যে গণহারে পাস করে দেয়ার যে কুফল তা ভবিষ্যতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এর ফল জাতিকেই বহন করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে অনেকে ভর্তি হয়েছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে আগাগোড়া টাকা আর টাকা। ভর্তি হওয়ার পর অনেকে টাকা দিতে না পেরে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে এমন নজিরও আছে ভূরিভূরি। আবার দিনের পর দিন ক্লাস না করে, পরীক্ষা না দিয়ে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট অর্জন করার ঘটনাও ঘটছে। যার ইতিবৃত্ত টিআইবির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো, টিআইবিকে এ অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়া হলো কেন? এর আগেই মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এসব বিষয় অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে তা বন্ধ হয়ে যেতো। ভিসি, প্রো-ভিসি, এমনকি ট্রেজারার নিয়োগেও টাকা দেয়া হচ্ছে। এখানে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দিতে গিয়েও লাগে টাকা। যেখানে গোড়াতেই গলদ, যেখানে ভিসি নিয়োগে টাকা লেনদেন হয়, সেখানে সার্টিফিকেট বিক্রি তো হবেই। ছোটবেলায় পড়েছি, পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন। ঠিক এমনটাই হয়েছে এ ক্ষেত্রে। পরের হাতে ধন থাকলে নিজের প্রয়োজনের সময় তা পাওয়া যাবে না। কাজেই ধন সব সময় নিজের হাতেই রাখতে হবে। লেখাপড়া না করে যদি সার্টিফিকেট অর্জন করি তাহলে এ সার্টিফিকেটে কি কাজে আসবে? একজন ইঞ্জিনিয়ার হাতে কলমে শিখে ইঞ্জিনিয়ার হবেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু যিনি হাতে কলমে না শিখে, লেখাপড়া না করে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট নিয়ে নিজের ওজন বাড়ান তাদের কথা ভিন্ন। তারা টাকা দিয়ে সবকিছুই কিনতে চান। ভালবাসা থেকে শুরু করে সবকিছুই তারা টাকার অঙ্কে মাপেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশে মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কেন রয়েছে? রাজধানী ঢাকায় একেকটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চালানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। চালানো হচ্ছে কলেজ। সম্প্রতি একটি কলেজে গিয়ে দেখা গেছে। এর একটি ভবন এখানে তো অন্য ভবন আরও ২-৩টা বাড়ি দূরে। ভাড়া নেয়া বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে ২০ থেকে ২২ জন বসতে পারছে। তাদের নিয়েই ক্লাস করানো হচ্ছে। আর বাইরে বিলবোর্ড টাঙিয়ে বলা হচ্ছে আমরা স্বল্প সংখ্যক ছাত্র/ছাত্রীকে নিয়ে ক্লাস করছি। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে এগিয়ে আসেন। কিন্তু কলেজ দেখে কেউ ফিরে যান, কেউবা মনের ইচ্ছার বাইরেও দিয়ে যান। কারণ তারা অসহায়। প্রশ্ন, দেশের শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? শিক্ষার মূল লক্ষ্য কি এখন শুধুমাত্র বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে? পৃথিবী যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় সেখানে আমরা বিজ্ঞান থেকে দূরে কেন? আমরা বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারছি না কেন? আমাদের দেশে বিজ্ঞানের ব্যবহার থেকে অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি। কাজ থেকে অকাজে লাগাচ্ছি বেশি। এ কারণেই বিজ্ঞান অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে সব শ্রেণীর শ্রমই পাওয়া যায়। একেবারে নিচু লেভেলের শ্রমিক থেকে শুরু করে মধ্য লেভেল এমনকি উচ্চ পর্যায়ের শ্রমও পাওয়া যায় সস্তায়। পৃথিবীর যে কোন দেশ থেকে এ শ্রম অনেক সস্তা। তারপরও আমরা এগোতে পারছি না। কারণ, আমরা সব সময় ফাঁকি দিতে পছন্দ করি। ফাঁকি দেয়াই আমাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, শ্রমের মর্যাদা দিতে আমরা শিখিনি। কাউকে শ্রমের মর্যাদা দিতে দেখলে তাকে পাগল বলে আখ্যা দিই। তাকে নিয়ে কৌতুক করি। আমরা দিন রাত মেধা খাটাই কিভাবে কি করলে দুর্নীতি করা যাবে। কিভাবে ব্যাংকের ভল্ট থেকে সিঁদ কেটে টাকা লুট করা যাবে। কিভাবে অন্যকে ঠকিয়ে নিজে এগিয়ে যেতে পারবো। কিভাবে শ্রমিককে ঠকিয়ে নিজে লাভবান হতে পারবো- এসব দিন-রাতের ভাবনা আমাদের। তারপরও এদেশের সাধারণ নারী সেলিনা জাহান আইডিবি পুরস্কার পান। কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো এ নারী বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উঁচুতে তুলে ধরেন। সম্প্রতি তিনি সৌদি আরবের জেদ্দায় এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে সৌদি বাদশাহ’র কাছ থেকে পুরস্কার নেন। পান সম্মননা আর ২৫ হাজার ডলার পুরস্কার। অসামান্য এ নারী বিজ্ঞান থেকে দূরে থেকেই এগিয়ে গেছেন অনেক দূর। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে ব্যবহার করেন না রাসায়নিক সার, পোকা মারার বিষ। তিনি মান্ধাতা আমলের গোবর ও ছাই অবলম্বন করে এগিয়ে গেছেন অনেক দূর। জয় হোক নরসিংদীর সেলিনা জাহানের। মাথা নিচু হয়ে আসে ওই নারীর কাজে। উচ্চ শিক্ষার কারিগর যারা ৫০ হাজার টাকায় তুলে দেন সার্টিফিকেট সেলিনা জাহানের কাছ থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তাই রাজধানীর অট্টালিকা থেকে ছুটে যান নরসিংদীতে। সেলিনা জাহানকে দেখুন। দেখবেন বিশ্ব দেখছেন। আর শিখছেন অনেক কিছু।
No comments