মোজাম্বিকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম by মশিউল আলম
তাঁর মুখে সব সময় লেগে আছে অমায়িক হাসি৷
শনিবার বিকেলে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’ নামের এক
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অনুষ্ঠানে তিনি যখন গণতান্ত্রিক
সংগ্রামের কষ্টকর যাত্রার কথা বলছিলেন, তখনো তাঁর মুখে লেগে ছিল হাসি৷
হাসিমুখে তিনি বলছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন৷ গণতন্ত্র শুধু
রাজনৈতিক দলের ব্যাপার নয়, শুধু নির্বাচন নয়, শুধু মিছিল, জনসভা,
বিক্ষোভ-প্রতিবাদের অধিকারচর্চা করা নয়৷ গণতন্ত্র আরও অনেক বড় বিষয়৷ যে
সমাজে মানুষের মনে গণতান্ত্রিক বোধ নেই, যেখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে
গণতন্ত্র নেই, যেখানে মেয়েরা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়
না বা নিতে পারে না, সেই সমাজে গণতন্ত্র হয় না৷
>>জোয়াকিম শিজানো, মোজাম্বিকের সাবেক প্রেসিডেন্ট
তিনি
জোয়াকিম শিজানো, ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট
ছিলেন৷ তারও আগে ছিলেন পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে মোজাম্বিককে
মুক্ত করার লড়াই-সংগ্রামের অন্যতম নেতা৷ গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে প্রথম
কৃষ্ণাঙ্গ মোজাম্বিকান হিসেবে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্য গিয়েছিলেন
পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে৷ কিন্তু উপনিবেশবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে
সংশ্লিষ্টতার কারণে পড়াশোনা শেষ না করেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তানজানিয়ায়৷
সেখানে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরই মতো আরও অনেক মোজাম্বিকান তরুণ-যুবক৷
তানজানিয়ার দারুস সালামেই ১৯৬২ সালে তাঁরা গঠন করেন ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অব
মোজাম্বিক (ফ্রেলিমো) নামের একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য ছিল মোজাম্বিক থেকে
পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়নের অবসান ঘটানো, একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র
হিসেবে মোজাম্বিককে গড়ে তোলা, যেখানে মানুষের ওপর মানুষের কোনো
শোষণ-নির্যাতন থাকবে না, থাকবে না দারিদ্র্য, অনাহার, অশিক্ষা, অপুষ্টি৷
এক দশকের বেশি সময় ধরে ফ্রেলিমোর গেরিলারা পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসকদের
বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান৷ একই সময়ে অ্যাঙ্গোলা, গিনি-বিসাউ,
রোডেশিয়া (জিম্বাবুয়ে) দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আশপাশের দেশগুলোয় চলছিল
উপনিবেশবিরোধী, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনবিরোধী মুক্তিসংগ্রাম। ১৯৭৪ সালে
পর্তুগালে এস্তাদো নভোর স্বৈরশাসনের পতন ঘটার পর ১৯৭৫ সালে মোজাম্বিক ও
অ্যাঙ্গোলা থেকে পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিদায় নিতে হয়। একটি স্বাধীন
প্রজাতন্ত্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে মোজাম্বিক রাষ্ট্রের। কিন্তু শুরু হয়
অভ্যন্তরীণ সংকট ও সহিংসতা, তা চলে পরবর্তী দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে।
সদ্য স্বাধীন মোজাম্বিকের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান ঘটে ফ্রেলিমোর। সংগঠনটি ইতিমধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলের রূপ নেয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট সামোরা মাশেলের নেতৃত্বে শুরু হয় দেশগঠন, জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার পালা। রাজনৈতিক আদর্শ ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ফ্রেলিমো বেছে নেয় সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ধারা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবাসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দেশগুলো তাদের প্রতি বাড়িয়ে দেয় সমর্থন-সহযোগিতার হাত। কিন্তু বিরুদ্ধতা ও বৈরিতা শুরু হয় বিতাড়িত ঔপনিবেশিক শাসকেরাসহ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর তরফ থেকে। মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলার সমাজতন্ত্র-অভিমুখী যাত্রায় বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী দক্ষিণপন্থী শাসকেরা। অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের অনুসরণে ওই দেশ দুটিতেও কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠদের শোষণমুক্তির আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে মোজাম্বিকে ফ্রেলিমো জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা ও দেশগঠনের প্রয়োজনে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও ব্যাপক জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। প্রেসিডেন্ট সামোরা মাশেল একদলীয় শাসনব্যবস্থা জারি করেন, পশ্চিমা ধারার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পথ পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার বর্ণবাদী শাসকদের মদদে মোজাম্বিকে ফ্রেলিমো সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রবল প্রতিরোধ। অচিরেই তা সহিংস রূপ ধারণ করে এবং ১৯৭৭ সালে শুরু হয় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। পরবর্তী ১৬ বছর ধরে সহিংসতা ও অনাহারে প্রাণ হারায় ১০ লাখের বেশি মানুষ, বাস্তুচ্যুত হয় ৫০ লাখ। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, বেড়ে যায় দারিদ্র্য, অনাহার, অপুষ্টি। স্বাধীনতার স্বপ্ন পরিণত হয় এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। সুখী-সমৃদ্ধ, শান্তিময় ও সমতাপূর্ণ দেশ গঠনের স্বপ্ন হয়ে যায় সুদূরপরাহত।
সেদিন জোয়াকিম শিজানোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনারা একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্তটি নিয়ে যে ভুল করেছিলেন, তা কি এখন উপলব্ধি করেন?’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে তিনি বললেন, ‘না, ওটা কোনো ভুল ছিল না। ওটা ছিল ওই সময়ের বাস্তবতা। একদলীয় শাসন পশ্চিমা প্রচারযন্ত্রের দেওয়া নাম। আসলে মোজাম্বিকে তখন ফ্রেলিমো ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলই তো ছিল না। ফ্রেলিমোই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন, যা মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলা যায় তখন, যখন অনেকগুলো রাজনৈতিক দল থাকে। মোজাম্বিকে তা ছিল না।’
কিন্তু তাহলে ফ্রেলিমো সরকারের বিরুদ্ধে যারা গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল, তারা কারা? কী চেয়েছিল তারা?
এই প্রশ্নের উত্তরে শিজানো বলেন, ‘ওটা গৃহযুদ্ধ ছিল না। পশ্চিমা প্রচারযন্ত্র ওটাকে গৃহযুদ্ধ বলে। আমরা বলি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ বাধে ঘরের ভেতরে, নিজেরাই যখন পরস্পরকে হত্যা করে। কিন্তু আমাদের দেশে ওটা শুরু করা হয়েছিল বাইরে থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকা আর রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সরকার সেটা করেছিল। তারাই রেনামো (মোজাম্বিকান ন্যাশনাল রেজিস্টেন্স) সৃষ্টি করেছিল, তাদের অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়েছিল, প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েছিল।’
স্নায়ুযুদ্ধের সেই যুগে মোজাম্বিক যে একটা প্রক্সি যুদ্ধের কবলে পড়ে গিয়েছিল, শিজানোর কথায় তা আবারও স্মরণে আসে। তাঁকে বললাম, একইভাবে ফ্রেলিমো পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন-সহযোগিতা। জানতে চাইলাম, মোজাম্বিকের ওই ভ্রাতৃঘাতী ‘গৃহযুদ্ধ’ বা ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যুদ্ধ’ যে আসলে ছিল দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার দুই শিবিরের মধ্যকার লড়াইয়েরই একটা অংশ, সে কথা ভেবে আজ তাঁর কী অনুভূতি হয়। তিনি বললেন, অতীত নিয়ে তাঁর ও তাঁর সহযোদ্ধাদের কোনো আক্ষেপ-অনুশোচনা নেই। ভুলভ্রান্তি নিশ্চয়ই হয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতির ফেরে সেগুলো হয়তো অনিবার্য ছিল। ‘স্বাধীনতার পরে আমরা পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও সমর্থন-সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের সমর্থন দেয়নি। আমাদের মুক্তি আন্দোলন ছিল তাদের স্ট্যাটাস কোর জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির আমাদের সমর্থন-সহযোগিতা দিয়েছিল। কিন্তু সে জন্য আমরা তাদের বশংবদ হয়ে চলিনি। তারা পিরিস্ত্রোইকা শুরু করার আগেই আমরা আমাদের সংস্কার শুরু করেছি। কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে অনেক দুর্বলতা আছে। আমরা বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছি সোভিয়েতদের আগেই।’
জানতে চাইলাম, ‘গৃহযুদ্ধ’ বা ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যুদ্ধ’ শেষ হলো কীভাবে? শিজানো বললেন, ‘সেটা ছিল ভীষণ কঠিন এক কাজ। সহিংসতা চলেছে কত বছর ধরে! হানাহানির মধ্যে যে শিশুর জন্ম হয়েছে, সে এখন তরুণ। হয়তো তার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। এখন তাকে যদি বলি, তোমার বাবাকে যারা মেরে ফেলেছে, তাদের ক্ষমা করে দিতে হবে, তুমি কি রাজি? কে রাজি হয়, বলুন? কেউ মানে না আমাদের কথা। কাউকেই বোঝানো যায় না যে ক্ষমা করতে হবে, আবার মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করতে হবে। নইলে শান্তি আসবে না, ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর হবে না। দু-তিন বছর ধরে আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি এবং শেষ পর্যন্ত সফল হই। মানুষ বুঝতে পারে, ক্ষমা করতে হবে, সন্তানসন্ততিদের জন্য একটা বাসযোগ্য শান্তিময় দেশ গড়তে হলে অতীতের তিক্ত বৈরিতা ভুলে যেতে হবে।’
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৯৯২ সালে মোজাম্বিকের ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির পরিসমাপ্তি ঘটে। তারও দুই বছর আগে ১৯৯০ সালে দেশটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও মোজাম্বিকের ফ্রেলিমো সরকারের সমঝোতা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা রেনামোর গেরিলাদের মদদ দেওয়া বন্ধ করে। ১৯৯৪ সালে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জোয়াকিম শিজানো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ফ্রেলিমো পার্লামেন্টেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
তার পর থেকে মোজাম্বিকে স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। শিজানো ১৯৯৯ সালের নির্বাচনেও দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সংবিধান অনুযায়ী মোজাম্বিকে একই ব্যক্তি পর পর তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন, কিন্তু ২০০৫ সালের নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হননি। নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছেন দলের পরবর্তী পর্যায়ের নেতার কাছে। সে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হন ফ্রেলিমোর আরেক নেতা আরমান্দো গুয়েজুবা। এখনো তিনিই দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। মোজাম্বিক আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটি ৪০ লাখ। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু দারিদ্র্য ব্যাপক। ১৯৭৫ সালে যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন দেশটির প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ ছিল অতিদরিদ্র। নিরক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৯৫ শতাংশ। এখন শিক্ষার হার বেড়েছে অনেক, দারিদ্র্য কমেছে। জলবিদ্যুৎ গেছে গ্রাম পর্যন্ত। শিজানো জানালেন, ৩০ শতাংশের বেশি নারী সদস্য আছেন পার্লামেন্টে। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার কয়েক বছর ধরে ৮ শতাংশের ওপরে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, যে দেশে একদলীয় শাসন চলেছে প্রায় দুই দশক ধরে, যে দেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে লিপ্ত ছিল ১৬ বছর ধরে, সেই দেশে দুই দশক ধরে কার্যকর রয়েছে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। পার্লামেন্ট কাজ করছে, সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে। মোট কথা, একটা সচল রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশ, যেখানে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য নেই। বাংলাদেশে তো গৃহযুদ্ধ হয়নি, বড় দুই দলের কর্মী-সমর্থকেরা তো লাখে লাখে পরস্পরকে হত্যা করেনি। এই দেশে কেন গণতান্ত্রিক রাজনীতি দীর্ঘ আড়াই দশকেও কার্যকর হলো না?
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
সদ্য স্বাধীন মোজাম্বিকের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান ঘটে ফ্রেলিমোর। সংগঠনটি ইতিমধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলের রূপ নেয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট সামোরা মাশেলের নেতৃত্বে শুরু হয় দেশগঠন, জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার পালা। রাজনৈতিক আদর্শ ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ফ্রেলিমো বেছে নেয় সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ধারা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবাসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দেশগুলো তাদের প্রতি বাড়িয়ে দেয় সমর্থন-সহযোগিতার হাত। কিন্তু বিরুদ্ধতা ও বৈরিতা শুরু হয় বিতাড়িত ঔপনিবেশিক শাসকেরাসহ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর তরফ থেকে। মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলার সমাজতন্ত্র-অভিমুখী যাত্রায় বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী দক্ষিণপন্থী শাসকেরা। অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের অনুসরণে ওই দেশ দুটিতেও কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠদের শোষণমুক্তির আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে মোজাম্বিকে ফ্রেলিমো জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা ও দেশগঠনের প্রয়োজনে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও ব্যাপক জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। প্রেসিডেন্ট সামোরা মাশেল একদলীয় শাসনব্যবস্থা জারি করেন, পশ্চিমা ধারার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পথ পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার বর্ণবাদী শাসকদের মদদে মোজাম্বিকে ফ্রেলিমো সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রবল প্রতিরোধ। অচিরেই তা সহিংস রূপ ধারণ করে এবং ১৯৭৭ সালে শুরু হয় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। পরবর্তী ১৬ বছর ধরে সহিংসতা ও অনাহারে প্রাণ হারায় ১০ লাখের বেশি মানুষ, বাস্তুচ্যুত হয় ৫০ লাখ। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, বেড়ে যায় দারিদ্র্য, অনাহার, অপুষ্টি। স্বাধীনতার স্বপ্ন পরিণত হয় এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। সুখী-সমৃদ্ধ, শান্তিময় ও সমতাপূর্ণ দেশ গঠনের স্বপ্ন হয়ে যায় সুদূরপরাহত।
সেদিন জোয়াকিম শিজানোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনারা একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্তটি নিয়ে যে ভুল করেছিলেন, তা কি এখন উপলব্ধি করেন?’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে তিনি বললেন, ‘না, ওটা কোনো ভুল ছিল না। ওটা ছিল ওই সময়ের বাস্তবতা। একদলীয় শাসন পশ্চিমা প্রচারযন্ত্রের দেওয়া নাম। আসলে মোজাম্বিকে তখন ফ্রেলিমো ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলই তো ছিল না। ফ্রেলিমোই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন, যা মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলা যায় তখন, যখন অনেকগুলো রাজনৈতিক দল থাকে। মোজাম্বিকে তা ছিল না।’
কিন্তু তাহলে ফ্রেলিমো সরকারের বিরুদ্ধে যারা গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল, তারা কারা? কী চেয়েছিল তারা?
এই প্রশ্নের উত্তরে শিজানো বলেন, ‘ওটা গৃহযুদ্ধ ছিল না। পশ্চিমা প্রচারযন্ত্র ওটাকে গৃহযুদ্ধ বলে। আমরা বলি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ বাধে ঘরের ভেতরে, নিজেরাই যখন পরস্পরকে হত্যা করে। কিন্তু আমাদের দেশে ওটা শুরু করা হয়েছিল বাইরে থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকা আর রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সরকার সেটা করেছিল। তারাই রেনামো (মোজাম্বিকান ন্যাশনাল রেজিস্টেন্স) সৃষ্টি করেছিল, তাদের অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়েছিল, প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েছিল।’
স্নায়ুযুদ্ধের সেই যুগে মোজাম্বিক যে একটা প্রক্সি যুদ্ধের কবলে পড়ে গিয়েছিল, শিজানোর কথায় তা আবারও স্মরণে আসে। তাঁকে বললাম, একইভাবে ফ্রেলিমো পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন-সহযোগিতা। জানতে চাইলাম, মোজাম্বিকের ওই ভ্রাতৃঘাতী ‘গৃহযুদ্ধ’ বা ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যুদ্ধ’ যে আসলে ছিল দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার দুই শিবিরের মধ্যকার লড়াইয়েরই একটা অংশ, সে কথা ভেবে আজ তাঁর কী অনুভূতি হয়। তিনি বললেন, অতীত নিয়ে তাঁর ও তাঁর সহযোদ্ধাদের কোনো আক্ষেপ-অনুশোচনা নেই। ভুলভ্রান্তি নিশ্চয়ই হয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতির ফেরে সেগুলো হয়তো অনিবার্য ছিল। ‘স্বাধীনতার পরে আমরা পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও সমর্থন-সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের সমর্থন দেয়নি। আমাদের মুক্তি আন্দোলন ছিল তাদের স্ট্যাটাস কোর জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির আমাদের সমর্থন-সহযোগিতা দিয়েছিল। কিন্তু সে জন্য আমরা তাদের বশংবদ হয়ে চলিনি। তারা পিরিস্ত্রোইকা শুরু করার আগেই আমরা আমাদের সংস্কার শুরু করেছি। কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে অনেক দুর্বলতা আছে। আমরা বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছি সোভিয়েতদের আগেই।’
জানতে চাইলাম, ‘গৃহযুদ্ধ’ বা ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যুদ্ধ’ শেষ হলো কীভাবে? শিজানো বললেন, ‘সেটা ছিল ভীষণ কঠিন এক কাজ। সহিংসতা চলেছে কত বছর ধরে! হানাহানির মধ্যে যে শিশুর জন্ম হয়েছে, সে এখন তরুণ। হয়তো তার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। এখন তাকে যদি বলি, তোমার বাবাকে যারা মেরে ফেলেছে, তাদের ক্ষমা করে দিতে হবে, তুমি কি রাজি? কে রাজি হয়, বলুন? কেউ মানে না আমাদের কথা। কাউকেই বোঝানো যায় না যে ক্ষমা করতে হবে, আবার মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করতে হবে। নইলে শান্তি আসবে না, ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর হবে না। দু-তিন বছর ধরে আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি এবং শেষ পর্যন্ত সফল হই। মানুষ বুঝতে পারে, ক্ষমা করতে হবে, সন্তানসন্ততিদের জন্য একটা বাসযোগ্য শান্তিময় দেশ গড়তে হলে অতীতের তিক্ত বৈরিতা ভুলে যেতে হবে।’
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৯৯২ সালে মোজাম্বিকের ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির পরিসমাপ্তি ঘটে। তারও দুই বছর আগে ১৯৯০ সালে দেশটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও মোজাম্বিকের ফ্রেলিমো সরকারের সমঝোতা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা রেনামোর গেরিলাদের মদদ দেওয়া বন্ধ করে। ১৯৯৪ সালে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জোয়াকিম শিজানো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ফ্রেলিমো পার্লামেন্টেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
তার পর থেকে মোজাম্বিকে স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। শিজানো ১৯৯৯ সালের নির্বাচনেও দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সংবিধান অনুযায়ী মোজাম্বিকে একই ব্যক্তি পর পর তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন, কিন্তু ২০০৫ সালের নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হননি। নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছেন দলের পরবর্তী পর্যায়ের নেতার কাছে। সে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হন ফ্রেলিমোর আরেক নেতা আরমান্দো গুয়েজুবা। এখনো তিনিই দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। মোজাম্বিক আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটি ৪০ লাখ। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু দারিদ্র্য ব্যাপক। ১৯৭৫ সালে যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন দেশটির প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ ছিল অতিদরিদ্র। নিরক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৯৫ শতাংশ। এখন শিক্ষার হার বেড়েছে অনেক, দারিদ্র্য কমেছে। জলবিদ্যুৎ গেছে গ্রাম পর্যন্ত। শিজানো জানালেন, ৩০ শতাংশের বেশি নারী সদস্য আছেন পার্লামেন্টে। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার কয়েক বছর ধরে ৮ শতাংশের ওপরে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, যে দেশে একদলীয় শাসন চলেছে প্রায় দুই দশক ধরে, যে দেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে লিপ্ত ছিল ১৬ বছর ধরে, সেই দেশে দুই দশক ধরে কার্যকর রয়েছে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। পার্লামেন্ট কাজ করছে, সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে। মোট কথা, একটা সচল রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশ, যেখানে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য নেই। বাংলাদেশে তো গৃহযুদ্ধ হয়নি, বড় দুই দলের কর্মী-সমর্থকেরা তো লাখে লাখে পরস্পরকে হত্যা করেনি। এই দেশে কেন গণতান্ত্রিক রাজনীতি দীর্ঘ আড়াই দশকেও কার্যকর হলো না?
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
No comments