চাল আমদানি নিয়ে লুকোচুরি কেন? by আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ২৫ জুন রাজধানীর একটি হোটেলে ন্যাশনাল ফুড পলিসি প্লান অব অ্যাকশন অ্যান্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্লান মনিটরিং রিপোর্ট-২০১৪ প্রকাশ অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ভারত থেকে আমদানি করা নিুমানের চাল গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ভারত চালের গুদাম খালি করতে কম দামে এসব চাল বিক্রি করে। ব্যবসায়ীরা এসব চাল কম দামে নিয়ে আসেন। সরকারিভাবে কোনো চাল আমদানি করা হচ্ছে না (বণিক বার্তা, ২৬ জুন)। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ; বছরে চাল উৎপাদন প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। এর কয়েক দিন আগে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অনুরূপ বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতের খাদ্যগুদামগুলোতে চালের মেয়াদ তিন বছর পার হলে তারা তা রফতানি করে দেয়? বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা গো-খাদ্য হিসেবে তা আমদানি করছেন। দেশে চালের কোনো সংকট নেই।

তবে মজার ব্যাপার হল, চাল আমদানিকারকরা মন্ত্রীদের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা বলেছেন, বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে এবং তারা মানুষের খাবার হিসেবে চাল আমদানি করেছেন। একাধিক চাল আমদানিকারকের বরাত দিয়ে ২৬ জুন দ্য ডেইলি স্টারে এ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১০ হাজার টন চাল আমদানি করেছেন এমন একজন আমদানিকারক বলেছেন, So far, I know no rice was imported as cattle feed, because the import price of rice is too high to be used as cattle feed. অর্থাৎ গো-খাদ্য হিসেবে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি, কারণ এত উচ্চমূল্যে আমদানি করা চাল গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে ১০ হাজার টন মোটা চাল আমদানি করেছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেছেন, তারা মানুষের খাওয়ার জন্যই চাল আমদানি করেছেন। এর আগে অন্য একটি দৈনিকে (প্রথম আলো, ৭ জুন) একই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশ চাল আমদানিকারক সমিতির একজন সাবেক সভাপতির বক্তব্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে। তাই আমদানি বেড়ে গেছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যে তিন হাজার টন চাল আমদানি করেছেন এবং আগামী অর্থবছরের (২০১৪-১৫) জুলাইয়ে ভারত থেকে আরও ২০ হাজার টন চাল আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বাজারে চালের সংকট হতে পারে এ আশংকায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী চাল আমদানি শুরু করেছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ২৯ জুন পর্যন্ত দেশে আমদানিকৃত চালের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬ টন। এর পুরোটাই বেসরকারি খাতে আমদানিকৃত। অন্যদিকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আমদানিকৃত চালের মোট পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ হাজার ৯৩০ টন। বেসরকারি খাতে আমদানি করা হয় ২৫ হাজার ২৭০ টন এবং সরকার আমদানি করে ৩ হাজার ৬৬০ টন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষের খাওয়ার জন্য চাল আমদানি নিয়ে সরকারের এই লুকোচুরি কেন? এর মূল কারণ হল, সরকার খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে বলে যে দাবি করে আসছে, মানুষের খাবার জন্য সরকারি বা বেসরকারি খাতে চাল আমদানির স্বীকৃতি সে দাবির অসারতা প্রমাণ করে। দুই. খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের স্লোগানের মধ্য দিয়ে সরকার এতদিন এ ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের, বিশেষ করে বিএনপির ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছে। মানুষের খাওয়ার জন্য চাল আমদানির স্বীকৃতি সরকার কর্তৃক তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।
এখন দেখা যাক, খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে সরকারের দাবি কতটা যৌক্তিক। প্রথমত, সরকারের নীতিনির্ধারকরা খাদ্য ও চালের মধ্যকার পার্থক্য বোঝেন না অথবা বুঝতে চান না। চালে স্বনির্ভরতা অর্জনকে তারা সার্বিক খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে চাল সার্বিক খাদ্যের একটি উপাদান মাত্র। অন্য গুরুত্বৎপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে (ক) গম ও ভুট্টা, (খ) আলু, (গ) ডাল, (ঘ) মাছ-মাংস ও ডিম, (ঙ) শাকসবজি, (চ) দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার, (ছ) তেল এবং (জ) ফলমূল। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হলে এসব উপাদানের সব উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতার পথে অনেকটা এগিয়ে গেলেও অন্য উপাদনগুলোর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, দেশে খাদ্যশস্য হিসেবে চালের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গমের বর্তমান চাহিদা ৪০ লাখ টনের বেশি। উৎপাদন হয় কমবেশি ১০ লাখ টন। অর্থাৎ ৩০ লাখ টনের বেশি গম বছরে আমদানি করতে হচ্ছে। এ ছাড়া আমিষজাতীয় খাদ্যপণ্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডালে রয়েছে ঘাটতি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) বলা হয়েছে, দেশে প্রাণিজ খাদ্য যথা- দুধ, মাংস ও ডিমের চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। ঘাটতি রয়েছে ফলমূলের। চাহিদা মেটাতে এসব পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে চাল থেকে রূপান্তরিত ভাত। স্বাধীনতার সময়ের তুলনায় আমাদের চালের উৎপাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। চালের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা এখন পর্যন্ত চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। তাই চাহিদা মেটাতে আমাদের চাল আমদানি করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) একমাত্র ২০১২-১৩ অর্থবছর (এ বছর মাত্র ২৮ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়) বাদে অন্যসব বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চাল আমদানি করতে হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট চাল আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার টনে। এর মধ্যে সরকারি খাতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৬৪ হাজার টন। বেসরকারি খাত বাকি ২ লাখ ৯০ হাজার টন চাল আমদানি করে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৩ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। সরকার আমদানি করে ৪ লাখ ৫৪ হাজার টন এবং বেসরকারি খাত আমদানি করে ৫৯ হাজার টন।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রণীত দীর্ঘমেয়াদি, পঞ্চবার্ষিক, দ্বিবার্ষিক প্রভৃতি পরিকল্পনায় খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সব সরকারই খাদ্যে, বিশেষ করে চালে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে। ফলে চাল উৎপাদনে আমরা স্বনির্ভরতার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। তাছাড়া আমাদের চাল উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতি নির্ভরশীল। আমরা ২০০৭ সালে দেখেছি, একাধিক প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোন, সিডর কীভাবে আমন ফসলের ক্ষতি করেছিল। আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৩০ লাখ টনের বিপরীতে উৎপাদিত আমনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ কোটি টনের নিচে। ২০০৭-৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং চাল উৎপাদনকারী অনেক দেশ চাল রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় চাহিদা মেটাতে চাল আমদানি করতে বাংলাদেশ সরকারকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাই চাহিদা ও উৎপাদনের ফাঁক পূরণে আমাদের আরও কিছুদিন চাল আমদানি করতে হতে পারে। এজন্য সরকারের লুকোচুরির আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন নেই। বরং সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে যেন চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ না কমে যায়। কারণ খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য ও সরবরাহে স্বল্পতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধা ও সরকার পতনের উদাহরণ আছে।
একজন সাবেক খাদ্যসচিব হিসেবে সরকারকে অনুরোধ করব চাল নিয়ে রাজনীতি না করতে। কারণ চাল আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য এবং এ পণ্যটির সরবরাহ স্বল্পতা ও উচ্চমূল্য জনগণের, বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী সাড়ে চার কোটি মানুষের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে চরম দুর্ভোগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক জাতীয়ভাবে একটি পরিবারে মাসিক যে ব্যয় হয় তার ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। এর মধ্যে চালে খরচ হয় ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অবশ্য গ্রামাঞ্চলে চালে খরচের হার ৩৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী সাড়ে চার কোটি মানুষ ক্রয়ক্ষমতার অভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এদের মধ্যে চরম দরিদ্র প্রায় ৮ শতাংশ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করে। এরা ভাতের সঙ্গে লবণ, কাঁচামরিচ ও সামান্য শাকসবজি খেয়ে বেঁচে থাকে। চালের দাম বাড়লে এরা প্রয়োজনীয় চালটুকু সংগ্রহ করতে পারে না। এদের আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। বিঘ্নিত হয় তাদের খাদ্য নিরাপত্তা।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের অবিচল থাকতে হবে। বিশেষ করে প্রধান খাদ্যশস্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জনে অগ্রাধিকার প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। যেভাবেই হোক, চাহিদা মোতাবেক চালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। চাল নিয়ে দলীয় রাজনীতি করা চলবে না।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.