বেহাল সড়ক মহাসড়ক by আহমেদ জামাল

বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত সকল সড়ক-মহাসড়কে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন অসহায় যাত্রীরা। প্রয়োজনীয় সংস্কার, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, যত্রতত্র দখলসহ নানা কারণে প্রতিনিয়ত অন্তঃহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। রাজধানী থেকে বাইরে যেতে কিংবা রাজধানীতে ঢুকতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে থাকতে হচ্ছে রাস্তায়। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময়, ক্ষয় হচ্ছে শারীরিক শক্তি। অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু এবং বয়স্করা। রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মহাসড়কের কয়েকশ’ কিলোমিটার এলাকায় এই দুঃসহ অবস্থা বিরাজ করছে। যোগাযোগমন্ত্রীর নিত্য  দৌড়ঝাঁপেও উন্নতি হচ্ছে না। ফলে ঈদে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছে ভুক্তভোগীরা। সড়ক পথের দুর্গতি নিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন ফোরামে আলোচনার ঝড় উঠে। সড়ক পথের এই ঝক্কি এড়াতে কিছু অবস্থা সম্পন্ন ব্যবসায়ী,শিল্পপতি,রাজনীতিক হেলিকপ্টার ভাড়া করে গ্রামে যাতায়াত শুরু করেছেন। কিন্তু এই সামর্থ্য যাদের নেই তারাই আছেন বিপাকে। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে চার লেন সড়ক নির্মাণের কাজে ধীরগতি, অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি এবং দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে সড়কের এ দূরবস্থা। খানাখন্দে ভরা এসব সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে। প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজটের। এতে করে ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যেতে কিংবা ঢাকায় আসার ক্ষেত্রে যাত্রীদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। বিশেষ করে দীর্ঘ যানজটে যাত্রীদের অধিকাংশ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। পরিস্থতি এতটাই  শোচনীয় যে, দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা কোন কোন ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় লেগে যায়। প্রায়শই এমন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন স্বয়ং যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। গত শনিবার চট্টগ্রামে যানজট নিরসনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের কাজে চীনা কোম্পানি সিনো হাইড্রোর গাফিলতি তুলে ধরে তিনি বলেন, চার লেন প্রকল্পের কাজের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়ক সংস্কারের বিষয়টি চুক্তিতে থাকলেও সিনো হাইড্রো চুক্তি অনুযায়ী কাজ করছে না। অথচ কন্ট্রাক্টে নতুন রাস্তা বানানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক  মেরামতের কথা ছিল। তিনি বর্ষা এবং রমজানের মধ্যে মহাসড়কে ভয়াবহ দুর্ভোগ থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করার আহ্বান জানান। এদিকে, পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগেই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য তাগিদ দিয়েছে পরিবহন মালিক সমিতি। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও মহাসড়ক সংস্কারে জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, একদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন নির্মাণ কাজ ধীরগতিতে চলছে। অন্যদিকে অনেকদিন ধরে এ সড়কের সংস্কার হচ্ছে না। যে কারণে এ সড়কটি এখন খানাখন্দে এতোটাই বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে যে, ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রতিদিন হতাহতের ঘটনা ঘটছে। দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট এখন নিত্যদিনের চিত্র। মহাসড়কের গৌরীপুর, চান্দিনা, কুমিল্লা পদুয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, বারইয়ারহাট, মিরসরাই সদর, নিজামপুর ও বড় দারোগারহাট অংশের প্রায় ১০০ কিলোমিটারের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এর মধ্যে  ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে। বৃষ্টির কারণে মহাসড়কের ওই অংশে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেছে বলে পরিবহন চালকেরা জানিয়েছেন। বারইয়ারহাটের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকার রাস্তার পুরোটাই এবড়োখেবড়ো। কয়েক দিন আগে সড়কের বড় গর্তগুলো দায়সারাভাবে ভরাট করা হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই আগের রূপে ফিরে গেছে সড়কটি। অভিযোগ উঠেছে, সড়ক সংস্কারের নামে গর্তের মধ্যে বড় বড় পাথর ঢেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। ট্রাকচালক আমির হোসেন বলেন, লোড গাড়ি নিয়ে সড়ক পার হতে গিয়ে মনে হয়, পুলসিরাত পার হচ্ছি। ভয় হয়, কখন জানি এক্সেলেটর ভেঙে যায়। সওজের আওতাধীন আরও একটি ব্যস্ততম সড়ক হচ্ছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। এই সড়কের অন্তত ৫০টি পয়েন্টে রাস্তার অবস্থা বেহাল। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও কলকারখানার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম জলাবদ্ধতার। ডুবছে রাস্তা। কোথাও কোথাও মহাসড়ক ধারণ করেছে ডোবা ও খালের আকৃতি। বাড়ছে দুর্ঘটনা। সংস্কার নেই ১০ বছরেও। নেই ড্রেনেজ সিস্টেম। রাস্তায় রাস্তায় অবৈধ টার্মিনাল, বাজার। নষ্ট হচ্ছে জোড়াতালির সংস্কার। নিম্নমানের ইট দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে গর্ত। সব মিলিয়ে এই রুটে ৫০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা যান চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। দেশের বেশ কয়েকটি সড়ক-মহাসড়কেই এমন বেহাল পরিস্থিতি বিরাজমান। খুলনা-ঢাকা মহাসড়কের যশোর সদর উপজেলার জামতলা এলাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই কাদা হয়ে যায়। সড়কটির বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ছোট-বড় গর্ত। এতে ধীরে ধীরে যান চলায় সৃষ্টি হয় যানজটের। এই সড়কের নওয়াপাড়া ভাঙা গেট, গোপালপুর গেট, রূপদিয়া, রাজারহাট, মুড়ুলী মোড়সহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় গর্ত। বিভিন্ন স্থানে ইট ফেলে গর্ত ভরাট করেছে সওজ। কিন্তু বৃষ্টি হলে এই ইটের ওপর দিয়ে গাড়ি দ্রুত গতিতে চলতে পারে না। দ্রুত এসব গর্ত ভরাট করা না হলে ঈদে ঘরমুখী মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়বে। চার লেনে উন্নীত করার কাজের জন্য যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কে। সড়কের ওপর নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণযন্ত্র রাখার ফলে মাঝে-মধ্যেই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। যানবাহন শ্রমিকেরা জানান, ঈদের আগে উন্নয়নকাজ বন্ধ না রাখলে এ সমস্যা আরও প্রকট হবে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফুটপাত ও সড়কের ওপর বাজার বসিয়ে যান চলাচল বিঘ্নিত করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ওই এলাকায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার যানজট লেগে থাকে। দীর্ঘদিনেও সংস্কার না হওয়ায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক। খানাখন্দে ভরা এ সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। ইট, সুরকি, বালু আর পিচ-খোয়া উঠে ৩৭ কিলোমিটার এই সড়কের বিভিন্ন অংশে অনেক খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় বরিশালের বাকেরগঞ্জ-চান্দখালী-বরগুনা সড়কের এখন করুণ অবস্থা। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কাদা-পানিতে চারদিক সয়লাব। চাঁদপুর ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ মতলব-গৌরীপুর (বাবুরহাট-মতলব-পেন্নাই) সড়কটির করুণ অবস্থা। সড়কের ঢাকিরগাঁও, নবকলস, বরদিয়া, ভাঙ্গারপাড়, ধনারপাড়, নাগদা, আশ্বিনপুর, নায়েরগাঁও, নৈয়াইরবাজার, নারায়ণপুর অংশের রাস্তার কার্পেটিং উঠে গেছে। সরে গেছে ইট, বালু ও খোয়া। সড়কটির কমপক্ষে ৩০টি স্থান দেবে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ৬২ হাজার কিলোমিটার সড়কের অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন ১২ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক এবং এলজিইডি-নিয়ন্ত্রিত ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এসব পাকা সড়কের বেশ কিছু অংশ এতটাই খারাপ যে নতুন করে নির্মাণ না করলে যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। এসব রাস্তা ভাঙাচোরা, বিপজ্জনক খানাখন্দে ভরপুর। অনেক জায়গায় সংস্কারের বালাই নেই। এলজিইডি’র আওতায় জেলা সংযোগসহ উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামীণ পর্যায়ে পাকা সড়ক রয়েছে ৮০ হাজার ৪৪৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। ভুক্তভোগীদের মতে, নির্মাণের পর থেকে এসব সড়কে সামান্য বিটুমিনের প্রলেপও পড়েনি। চলমান বর্ষায় এসব সড়কের অবস্থা দিন দিন আরও করুণ হচ্ছে। এতে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষ মারাত্মক সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে ।

No comments

Powered by Blogger.