ইতিহাসের নির্মম পুনরাবৃত্তি by রবার্ট ফিস্ক
একসময় আমরা সংবাদপত্রের কাটিং সংগ্রহ
করতাম। যে বিষয়ে লিখতাম সে বিষয়েরও ওপর সংবাদ ও কলাম কাটিং করে গুছিয়ে
গুছিয়ে রাখতাম: ইসরায়েল, লেবানন, ইরান, গাজা প্রভৃতি। কখনো কখনো আবার বই
পড়তাম। হয়তো ইন্টারনেটের কল্যাণে এমনটা হয়েছে—আমাদের অধিকাংশ প্রতিবেদন
পড়ে মনে হয়, ইতিহাস বুঝি এই গতকাল বা গত সপ্তাহে শুরু হয়েছে।
নাক উঁচু মানুষদের ক্ষেত্রে এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতিবিভ্রম বলে চিহ্নিত করা যায়। আর এই রোগে অন্যদের চেয়ে আমরা সাংবাদিকেরাই বেশি ভুগি। ধারণা করি, আমাদের পাঠকেরা এই রোগে তেমন একটা ভোগেন না। তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি?
কানাডার দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল পোস্ট-এর একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘গাজার সাধারণ জনগণের প্রতি আমরা যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। কয়েক দিন ধরে এই ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট জায়গায় সন্ত্রাসীদের ডেরায় ইসরায়েল ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। এটা নিরীহ মানুষের জন্য সত্যিই খুব কঠোর হয়ে যায়। আর হামাস এই মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, এই হামলা বন্ধ করতে হলে ফিলিস্তিনিদেরও ইসরায়েলিদের ওপর হামলা বন্ধ করতে হবে।’
আর দ্য গার্ডিয়ান-এ বলা হয়েছে: ‘গতকাল সামৌনির তিন সন্তান যখন শিফা হাসপাতালের মেঝেতে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল, তখন তিনি সেখানকার ওপরের তলায় বিছানায় শুয়ে পা ও কাঁধের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। একই সঙ্গে তাঁর আরেক সন্তান পাঁচ বছরের মোহামেদের ভাঙা হাতের চিকিৎসা চলছিল, তাকেও তাঁর সান্ত্বনা দিতে হচ্ছিল।’ সামৌনি বলেন, ‘এটা নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, আমরা শুধু শান্তিতে থাকতে চাই।’
আেরকটি ভালো নজিরের জন্য রয়টার্সকে উদ্ধৃত করছি: ‘ইসরায়েল গতকাল গাজা উপত্যকায় তার সবচেয়ে নৃশংস আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে। ইসরায়েল সেখানে স্থল আক্রমণও করবে। ইসরায়েল হামাসের সশস্ত্র বিভাগের দুজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারের বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে। তাঁরা তখন সেখানে না থাকলেও তাঁদের পরিবারের অনেকেই এই হামলায় মারা গেছেন।
এই তালিকার শেষে কানাডিয়ান পোস্ট-এ লেখক রবার্ট ফুলফোর্ডের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি, তবে গুরুত্বে তিনি মোটেও কম নন: ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত জাতি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তারা এ ক্ষেত্রে সর্বকালের রেকর্ড স্থাপন করেছে। উল্লিখিত সব লেখার সঙ্গে আপনারা পরিচিত, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। গত সপ্তাহ থেকে ইসরায়েল হামাসের রকেট হামলা প্রতিরোধে গাজায় বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের একটু বেশিই ভুগতে হচ্ছে, তবে সেটা হচ্ছে হামাসের দোষেই।
কিন্তু এখানে একটি সমস্যা আছে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রেস অ্যাসোসিয়েশন-এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, আজ থেকে সাড়ে পাঁচ বছর আগে। উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল সে বছরেরই ২ জানুয়ারি। গার্ডিয়ান-এর সংবাদটিও প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি, রয়টার্সের লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল তার আগের বছরের ৩০ ডিসেম্বর। ফুলফোর্ডের নির্বোধ লেখাটি প্রকািশত হয়েছিল ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি।
দৃষ্টিকটুভাবে, আজ এটা কেউই মনে করছেন না যে এই চলমান ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ অতীতের এক অশ্লীল রেকর্ড নতুন করে বাজানো ছাড়া কিছু নয়। উভয়ের তরফ থেকেই এটা করা হয়েছে—আগে যেটা করা হয়েছে বা তারও আগে যা করা হয়েছে, তারই পুনরাবৃত্তি। ইসরায়েলের বামপন্থী ইতিহাসবিদ ইলান পাপে দেখিয়েছেন, ইসরায়েলের মানবাধিকার সংগঠন বি সেলেম ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর বলেছিল, সে বছরই ৬৬০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে, এর বেশির ভাগই ঘটেছে গাজায়। এদের মধ্যে ১৪১ জনই শিশু। আর ২০০০ সাল থেকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হাতে চার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ২০ হাজার জখম হয়েছে। কিন্তু গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের ওপর প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদনেই এসব হত্যাকাণ্ডের উল্লেখমাত্র নেই।
আমরা পাঠক হিসেবেই বা কেন এ রকম সামষ্টিক স্মৃতিবিভ্রমের খপ্পরে পড়ি? সাংবাদিকদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। কারণ, আমরা খুব অলস, আমরা কোনো কিছুই গায়ে লাগাই না। নাকি আমরা ভিতু? গাজায় এই চলমান হত্যাযজ্ঞের হেতু খুঁজতে গিয়ে আমরা পাঠকদের চিন্তাশীলতাকে উসকে দিয়ে তাঁদের মধ্যে এই প্রত্যয় জন্মাতে সহায়তা করতে পারি যে হামাস নয়, ইসরায়েলই এই নির্দয়, চূড়ান্ত রকম নীতিবিগর্হিত ও অশ্লীল হত্যাযজ্ঞের প্রধান আসামি। এসব তথাকথিত এজেন্সি-মার্কা আকর্ষণহীন প্রতিবেদনে এর কোনো আঁচ পাওয়া যায় না। এতে ইসরায়েলের বিদেশি বন্ধুরা সাংবাদিকদের ওপর নাখোশ হতে পারেন।
এই স্মৃতিনাশ কোনো নতুন ব্যাপার নয়। ইনডিপেনডেন্ট-এ প্রকাশিত লেবাননের গৃহযুদ্ধের সতর্কবার্তাই এর প্রকৃষ্ট নজির: ‘লেবাননের জন্য এটা কঠিন সময়ই বটে। সিরিয়ার কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক শক্তি আলাওয়াইট সম্প্রদায় শিয়া আর সিরিয়ার অধিকাংশ জনগণ সুন্নি। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের ভবিষ্যৎ যে তমসাচ্ছন্ন, সেটা বোঝা খুব কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। ইরাকিরা তাদের এই গৃহবিবাদ মেটানোর জন্য যদি শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের দ্বারস্থ হয়, তাহলে বাগদাদ থেকে লেবানন পর্যন্ত এক ধর্মীয় বিবাদের পথ প্রশস্ত হবে... পুরো আরব দুনিয়ার জন্যই তা হবে ভয়ংকর।’
হায় রবার্ট ফিস্ক নামক এ ভদ্রলোক ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, মানে আজ থেকে আট বছর আগে এটা বলেছিলেন।
শেষ করতে গিয়ে মসুল থেকে প্রকাশিত রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে ধরছি, গত সপ্তাহের পাঠকদের কাছে তা হয়তো নতুন ঠেকবে না: ‘বিদ্রোহীরা থানায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, অস্ত্র লুট করেছে। তারা মসুলের সড়কে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই শহরটিও ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে... হ্যাঁ, ছোট একটা সমস্যা।’ রয়টার্সের এই সংবাদটি ১০ বছর আগে ২০০৪ সালে পাঠানো হয়েছিল। সে সময় মার্কিন সামরিক বাহিনীকেই বিদ্রোহীদের কাছ থেকে এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে হয়েছিল, যদিও দ্বিতীয়বারের মতো।
আমি শঙ্কিত, এই স্মৃতিনাশের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। সরকার ও সেনাবাহিনী এভাবেই তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের কিছু গলাধঃকরণ করাতে চায় আর কিছু ভোলাতে চায়। সংবাদ পরিবেশনের এই ঢং ইতিহাস-আশ্রিত নয়।
আমাদের একটি প্রশ্ন তুলতে হবে, যে প্রশ্নটি টেলিভিশনের দর্শক ও অন্য পাঠকেরা ইতিমধ্যে তুলতে শুরু করেছেন, সেটা হচ্ছে—এ রকম অবস্থায় আমরা আগে কি পতিত হইনি? যদি তা-ই হয়, তাহলে অতীতের পুনরাবৃত্তি কেন?
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক।
No comments