ফিলিস্তিন প্রশ্নে ঐক্য, অনৈক্য by কামাল আহমেদ
ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও পারিবারিক
বৈরিতাকেন্দ্রিক বাংলাদেশি রাজনীতিতে বহুদিন পর একধরনের রাজনৈতিক মতৈক্য
দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন যে রাজনৈতিক
রেষারেষিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, তার পটভূমিতে অন্তত একটি ইস্যুতে
রাজনীতির সব প্রতিদ্বন্দ্বীর এক সুরে কথা বলা অবশ্যই একটি ব্যতিক্রম।
সরকারের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ
আশরাফ, তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম
আলমগীর, আধা সরকারি-আধা বিরোধী জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ এবং বামপন্থী
কমিউনিস্ট পার্টি থেকে শুরু করে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং প্রায় একঘরে হয়ে পড়া
জামায়াতে ইসলামী—সবাই গাজায় ইসরায়েলি সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে
ফিলিস্তিনের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে
কোনো দলই তাদের বিদেশি বন্ধু বা সমর্থক রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ভারত (সামরিক কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে
সম্প্রতি গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়) রুষ্ট বা তুষ্ট হবে কি না,
সেই উদ্বেগের কারণে নিশ্চুপ থাকেনি। ৩২ বছর আগে এই জুলাই মাসের ২২ তারিখে
ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনিদের জন্য লড়াইরত অবস্থায় শহীদ হওয়া বাংলাদেশি
কামাল মোস্তফা আলির আত্মা অন্তত এটুকু জেনে স্বস্তি পাবে যে ফিলিস্তিনিদের
পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে বাংলাদেশে এখনো জাতীয় মতৈক্য বজায় আছে।
সত্তর ও আশির দশকে প্রচুর বাংলাদেশির ফিলিস্তিনে গিয়ে যুদ্ধ করার কথা জানা থাকলেও এই বাংলাদেশি শহীদের কথা অনেকের মতো আমারও জানা ছিল না।সম্প্রতি ফেসবুকের কল্যাণে বৈরুতভিত্তিক ইংরেজি সংবাদপত্র আল-আখবর-এ ফিলিস্তিন যুদ্ধে বাংলাদেশিদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর একটি নিবন্ধ আমার নজরে আসে। পত্রিকাটির ৩ জুলাই সংস্করণে সাংবাদিক ইয়াজান আল সাদি এ বিষয়ে একটি বিশদ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তবে, যথারীতি নিবন্ধটি ফিলিস্তিনিদের ভাষ্যনির্ভর। বাংলাদেশি কর্মকর্তারা কোনো তথ্য-উপাত্ত দিতে পারেননি বা দেননি।নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পাঠকদের অনেকে বেশ কিছু তথ্য পাঠিয়েছেন, যেগুলো অযাচাইকৃত হিসেবে অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে আশি ও নব্বইয়ের দশকে প্রত্যাগত ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ নামে একটি সংগঠন বেশ তৎপর ছিল। ওই সংগঠনটির সদস্যরা কোনো না-কোনো সময়ে ফিলিস্তিনে লড়াই করতে গিয়েছিলেন বলে দাবি করতেন। সরকারিভাবে এসবের বিবরণ বা রেকর্ড কোথাও না-কোথাও থাকার কথা।বিশেষ করে, এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর কিছুটা সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানা যায়। আল-আখবর যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের একটি প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে ১৯৮৭ সালে পিএলও–প্রধান ইয়াসির আরাফাতের ঢাকা সফরের সময়ে বাংলাদেশ জানিয়েছিল যে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি তরুণ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পিএলওর পক্ষে যুদ্ধ করতে গেছেন। ওই প্রতিবেদনে কিছু ফিলিস্তিনি যোদ্ধার বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। প্রধান ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী পিএলওর লেবানন শাখার সম্পাদক, ফাতি আবু আল-আরাদাত আল-আখবর পত্রিকাকে বলেছেন যে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার বাংলাদেশি সেখানে যুদ্ধ করেছেন এমনকি এমন ব্যাটালিয়নও ছিল, যা পুরোপুরি বাংলাদেশিদের। তাঁর বর্ণনায়, ‘বাংলাদেশিরা ছিলেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। তাঁদের মনোবল ছিল অসম্ভব দৃঢ়। ইসরায়েলি আগ্রাসনে আটক হওয়ার পরও তাঁরা নাকি নির্যাতনের মুখে ‘পিএলও, ইসরায়েলি নো’ উচ্চারণ করতেন। তাঁরা সত্যি সত্যিই এই সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন।’
অধিকাংশ বিদেশি যোদ্ধা পিএলওর প্রধান শরিক ফাত্তাহ গ্রুপে যোগ দিলেও লেবাননে সিরিয়া সমর্থিত গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) ছিল শক্তিশালী।এই পিএফএলপির এক কর্মকর্তা লেবাননের শাতিলা শিবিরের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য জিয়াদ হাম্মো বলেছেন যে এসব বাংলাদেশি সামরিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি বলেছেন যে বেক্কা উপত্যকায় কয়েকজন বাঙালি এমন ভালো আরবি বলতেন যে লোকেরা ভুলে যেত যে তাঁরা বাংলাদেশি। তিনি জানান যে ওই সব বাংলাদেশির অনেকেই ১৯৮২-তে লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের পর চলে গেছেন, কেউ কেউ মারা গেছেন আর অনেকে ইসরায়েলিদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন।কামাল মোস্তফা আলি লেবাননের নাবাতিয়েহ প্রশাসনিক এলাকার হাই রক ক্যাসলের যুদ্ধে নিহত হন।২০০৪ সালে জার্মান মধ্যস্থতায় হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে বন্দিবিনিময়ের সময়ে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়। শাতিলা শিবিরের বাইরে ফিলিস্তিনি শহীদ সমাধির তত্ত্বাবধায়ক পত্রিকাটিকে জানান যে তাঁর কঙ্কাল বাংলাদেশে তাঁর পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে।তবে, ওই সমাধিক্ষেত্রে তাঁর স্মারক নামফলক এখনো আছে।
পত্রিকাটিতে নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বাংলাদেশি গবেষক নাঈম মোহাইমেন দাবি করেছেন যে ফিলিস্তিনি যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত। উমর চৌধুরী নামের আরেকজন জানিয়েছেন যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিলিস্তিনিদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে মেজর মোহাম্মদ আফসারউদ্দিন তাঁর একটি বইয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সংখ্যাটি যা-ই হোক না কেন, ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশিদের এই অকুণ্ঠ সমর্থন এখনো যে অব্যাহত আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আর কেউ হয়তো সশরীরে তাঁদের হয়ে যুদ্ধ করতে যেতে পারেন না, কিন্তু মানসিক সমর্থন এখনো অটুট। গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে দলমত-নির্বিশেষে সবার অভিন্ন অবস্থান অন্তত সেটাই প্রমাণ করে।
২.
ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ-এ (১৩ জুলাই, ২০১৪) একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম হচ্ছে ‘ইসরায়েলস রিয়েল পারপাজ ইন গাজা অপারেশন? টু কিল অ্যারাবস’। লেখক অনেকগুলো পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক, গিডিয়ন লেভি। তিনি পত্রিকাটির সম্পাদনা পর্ষদেরও একজন সদস্য।তিনি বলছেন যে ৩০ বছর আগের লেবানন যুদ্ধের সময় থেকে অনুসৃত নীতি অনুসরণ করেই ইসরায়েল এই সাম্প্রতিকতম অভিযানটি চালাচ্ছে। তাঁর মতে, ইসরায়েল বিশ্বাস করে যে শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলেই সেখানে নিস্তব্ধতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে।হামাসের অস্ত্রভান্ডার ধ্বংস করা যে অর্থহীন তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে৷ কেননা, তারা যে পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। (প্রতিরক্ষা সাময়িকী জেন্স ডিফেন্স উইকলি জানিয়েছে যে হামাস ও প্যালেস্টানিয়ান ইসলামিক জিহাদ, পিআইজে দীর্ঘমাত্রার ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করেছে, ফলে তাঁরা আর চোরাই পথে অস্ত্র আমদানির ওপর নির্ভরশীল নয়।) হামাস সরকারের পতন ঘটানোও বাস্তবসম্মত নয়। তা ছাড়া, হামাসের পতন ঘটলে তার চেয়েও বিপজ্জনক অন্য কেউ ক্ষমতায় আসতে পারে। সুতরাং, গিডিয়নের মতে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের লক্ষ্য শুধু একটিই হতে পারে; তা হলো, আরবদের হত্যা করে ইসরায়েলি জনগোষ্ঠীকে খুশি করা।
বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার যুক্তি হিসেবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে তাদের হামলার লক্ষ্যস্থল বিভিন্ন ভবন এমনকি স্কুল-হাসপাতালকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে সেগুলোকে হামাসের ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ বা ‘সম্মেলনকক্ষ’ বলে অভিহিত করছে, তাকে গিডিয়ন যুদ্ধাপরাধ অভিহিত করে বলছেন যে এটা হচ্ছে ‘মাছির বিরুদ্ধে হাতি’র লড়াই। সিরিয়া বা ইরাকের সহিংসতার সঙ্গে তুলনা টেনে তিনি বলছেন, গাজার বাসিন্দারা তো খাঁচায় বন্দী, তাঁদের পালানোর কোনো জায়গা নেই। ইসরায়েলি মেজর জেনারেল ওরেন শ্যাচরকে উদ্ধৃত করে তিনি বলছেন যে ইসরায়েলি বাহিনীর নীতি হচ্ছে ‘ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোয় হত্যাকাণ্ড চালালে তারা ভয় পাবে’। তাঁর মতে, আরবদের জন্ম হয় শুধু ‘হয় হত্যা করো না হয় নিহত হও’ এমন এক বাস্তবতায় আর ইসরায়েল তাদের হত্যা করে।
৩.
গাজার নিরীহ নিরপরাধ শিশু, নারী ও বেসামরিক নাগরিকদের লাশের সারি, মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র বিশ্বব্যাপী জনমতের ওপর যে প্রভাব ফেলেছে, তার গুরুত্ব পাশ্চাত্যের রাজনীতিকেরা কতটা উপলব্ধি করছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে ডানপন্থী রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা এখনো অনেকটা নির্লজ্জভাবে ইসরায়েলের প্রতি শর্তহীন সমর্থন জানিয়ে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী গভর্নর ক্রিস্টি ও কানাডার কনজারভেটিভ সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার সরাসরি ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ওবামা প্রশাসন এবং ক্যামেরন সরকার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বা কোনো ধরনের বয়কটের পথে যেতে নারাজ। যুদ্ধবিরতির জন্য মিসরীয়দের একতরফা চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণও এটি। সৎ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা না নিতে পারার অভিযোগ তুলে হামাস তাই তাদের ভাষায় আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এসব উদ্যোগে আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্যকেই তুলে ধরে। সদ্য সাবেক হওয়া ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ তাঁর পদ হারানোর কয়েক ঘণ্টা আগে (সোমবার বিকেলে) হাউস অব কমন্সে এক বিবৃতিতে বলেন যে ‘হামাসকে এখন চারপক্ষীয় (কোয়ার্টেট-যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাতিসংঘ) নীতিমালা মেনে নিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়ায় যোগ দেবে নাকি সহিংসতা আর সন্ত্রাস অব্যাহত রেখে গাজার জনগণের ওপর ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনা বজায় রাখবে, সেই মৌলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ বহু বছর ধরে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তাদের এড়িয়ে চলা এবং নির্বাচিত সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতির পর হামাসকে শান্তিপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার এই বক্তব্য খুবই ইঙ্গিতবহ। তবে, তাঁর প্রস্থানের পর কনজারভেটিভদের মধ্যে কিছুটা কট্টরপন্থী হিসেবে বিবেচিত ফিলিপ হ্যামন্ড সেই ধারাটি অব্যাহত রাখেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। কেননা, হামাসকে ফিলিস্তিনি রাজনীতি থেকে ছেঁটে ফেলা সম্ভব নয়, সেই উপলব্ধি বোধ হয় এখন খুবই জরুরি।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷
No comments