আমগোরে মাফ কইরা দেন! by সাহস রতন
জুন শেষ হয়ে জুলাই চলছে। এভাবে ডিসেম্বর শেষে ২০১৪ সালও ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু শেষ হচ্ছে না আমাদের ভোগান্তি। ভয়াবহ সব অঘটনের জন্ম দিয়ে সবসময় সমালোচনায় ছিল আমার প্রিয় বাংলাদেশ। একটার রেশ কাটতে না কাটতেই আগেরটার চেয়ে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে বছরের পর বছর। ভয়ানক সব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে ধারাবাহিকভাবে, বিরামহীন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশটির জন্মের সাড়ে চার বছরের মাথায় নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু, সপরিবারে। কিছুদিন না যেতেই কারাগারের ভেতরে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে। এরপর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এর বিফল প্রতিরোধের চেষ্টা। জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ। কয়েক বছর না যেতেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে রাতের বেলায় তাকে হত্যা। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখল। নয় বছরের স্বৈরশাসনামলে রাজনৈতিক নেতাদের জেল-জুলুম, হত্যাসহ নানা কাহিনী। নব্বই দশকে এসে এরশাদকে ক্ষমতাচুত করার আন্দোলন। ’৯০-এ প্রথমবারের মতো তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন। সব পূর্বাভাস মিথ্যে প্রমাণ করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি’র সরকার গঠন। ’৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন। ২০০১ সালে বিএনপি আবারও ক্ষমতায়। শুরু হলো দেশব্যাপী বোমাবাজি, আদালত প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা। একই দিনে প্রায় একই সময়ে সারা দেশের ৬৫ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা। বাংলাভাই ও শায়খ রহমানের উত্থান। ঘটে ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। মুহূর্তে ঝরে গেল ২১টি প্রাণ। স্প্লিন্টারের আঘাতে পঙ্গু হলো শতাধিক। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলন। পল্টনে লগি-বৈঠা মিছিল। একাধিক প্রাণহানি। আবার সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ। প্রথমবারের মতো দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষব্যক্তি গ্রেপ্তার। রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীসহ অনেক গ্রেপ্তার। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে ২য় মেয়াদে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন। এর ৫১ দিনের মাথায় ২০০৮ সালে ২৫শে ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহ। প্রাণ হারালেন সেনাবাহিনীর ৫৪ জন অফিসার। ক্ষমতায় আরোহণের তিন বছরের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ। শুরু হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। অনলাইন ব্লগারদের উদ্যোগে শাহবাগ চত্বরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে নানা শ্রেণী-পেশার লাখো মানুষের সমাবেশ। শাহবাগ চত্বরে নতুন করে জয় বাংলা স্লোগান ফিরে এলো সাধারণের মুখে যা কিনা সময়ের বির্বতনে আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। শাহবাগ চত্বরে গড়ে ওঠা আন্দোলনটির বিপরীতে তৈরি হলো হেফাজতে ইসলাম। ৫ই ফেব্রুয়ারি ৫ লক্ষাধিক মানুষের পাল্টা সমাবেশ ঘটলো মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। জ্বললো অফিস, দোকান, ব্যাংক, গাড়ি। বাদ যায়নি সড়ক বিভাজনে বেড়ে ওঠা নিরীহ গাছও। গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশন। মতিঝিল মুক্ত হলেও ঝরে গেল ৩০-এর বেশি প্রাণ। সংখ্যা নিয়ে নানারকম ধোঁয়াশা রয়েই গেল। সর্বশেষ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নারায়ণগঞ্জে সাত জনের প্রাণহানি। এই সময়ের মাঝে আরও অনেক দুর্ঘটনা। লিখলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভর্তি হয়ে যাবে। প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে একাধিক প্রাণহানি ঘটে চলেছে। এই যে এত দুর্ঘটনা, এর কোনটিই যে সাধারণ ঘটনা নয়, তা তো সবাই জানেন। আর এর সব ক’টির পেছনেই রয়েছে ক্ষমতা দখলের লড়াই। বেশ ক’বছর আগে একটা বাংলা সিনেমায় দেখেছিলাম, প্রয়াত অভিনেতা রাজীব প্রায়ই বিশেষ একটা সংলাপ বলেন, তা হলো- ক্ষমতা-রে ক্ষমতা। এই ক্ষমতাই যত নষ্টের গোড়া। ক্ষমতা দখলের লোভেই এতসব ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে যুগ যুগ ধরে। এত অহরহ এগুলো ঘটছে যে, ইদানীং সাধারণ মানুষ এতে মোটেও অবাক হচ্ছে না। কারণ আমরা বুঝে গেছি এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আর মনে হয় এটা সবাই মেনেও নিয়েছি। দুর্ঘটনা যা-ই হোক তার প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ থাকছে টক শো আর প্রেস রিলিজ-এর মধ্যে। বড় জোর কিছুদিন রাজপথে মিছিল, মিটিং, অবরোধ। এরপর আবার তথৈবচ। রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং এর সুবিধাভোগী ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠীটি ছাড়া সর্বস্তরের জনগণ সবাই মোটামুটি এই ধারণায় উপনীত হয়েছেন যে, বর্তমান প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো কখনওই এটি স্বীকার করে না। এভাবে তো আসলে চলতে পারে না। ইদানীং সুশীল সমাজের অনেকে জোর গলায় এটা বলছেনও। যার ফলে ইতিমধ্যে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক বলয় গড়ে ওঠার চেষ্টাও দৃশ্যমান। যদিও এটার ভবিষ্যৎ যে কি তা এখনও বোধগম্য নয়। এই অবস্থায় একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয় যারা নিজেদেরকে সৎ মানুষ কিংবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন তাদের সবার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। সবাই বলছেন, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ী আর সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে রাজনীতি। আসলেই তাই। কারণ সমাজহিতৈষী মানুষজন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নেই প্রায় ৩০ বছরের বেশি কাল ধরে। শূন্যস্থান তো আর শূন্য থাকে না। কেউ না কেউ এসে তা পূরণ করে ফেলে। আমাদের রাজনীতিতেও তা-ই হয়েছে। রাজনীতির বর্তমান অবস্থাকে ঘৃণা করে, এর থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। তারপরও আমি বিশ্বাস করি, এখনও বাংলাদেশে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি। দুষ্ট চক্রটি সব মিলে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশও হবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এই ১৫ শতাংশের হাতেই বাকি ৮৫ শতাংশের জীবন শৃঙ্খলিত। তাই পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সমাজের ভাল মানুষদের, বিশেষ করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরকে, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত, এখনই। তাহলেই আমাদের মুক্তি মিলবে। অন্যথায় বর্তমান রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বলতে হবে- ভাইগো, আমগোরে মাফ কইরা দেন।
No comments