সিউলের অভিজ্ঞতা, ঢাকা নিয়ে দুর্ভাবনা by এ কে এম জাকারিয়া
আমরা যারা ঢাকায় থাকি তারা জানি ও প্রতিদিন টের পাই কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। প্রসঙ্গটি রাস্তাঘাট, যানবাহন ও চলাচলের। এই শহরে পরিকল্পনা করে চলাচলের উপায় নেই। যে পথ ৩০ মিনিটে যাওয়া যায়, সে পথে যানজট বা এ ধরনের কিছু আশঙ্কায় আপনি কতক্ষণ আগে রওনা হতে পারেন? ঘণ্টা খানেক? বা দেড় ঘণ্টা? কিন্তু ঘণ্টা তিনেকও লেগে যেতে পারে। আপনি কী করে জানবেন কোন দিন কোন পথে প্রধানমন্ত্রী চলাচল করবেন? বা যদি জানেনও যে ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং সেদিন দলটির কর্মসূচি রয়েছে, কিন্তু আপনি কি ধারণা করবেন যে বিকেল চারটায় গুলশান থেকে রওনা হয়ে মোহাম্মদপুর হয়ে বাংলামোটর আসতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে যাবে?
ঢাকা এভাবেই চলছে। আর অনেক ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ দেখছি আর এর ভোগান্তি সহ্য করছি সামনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে। কিন্তু এসব উন্নয়ন হলেই কি পরিস্থিতির খুব উন্নতি হবে? স্থাপনা হবে, রাস্তাঘাট হবে কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার কী হবে? কুড়িল উড়ালসড়ক হয়েছে, যান চলাচল অনেক সহজ হয়েছে, কিন্তু উত্তরা থেকে বনানীর দিকে আসার পথে উড়ালসড়কে ওঠার আগে যে একটি যানজট তৈরি হয়, তা দেখবে কে? ফুটপাতের কিছু দোকান আর বাসগুলোর নিয়ম না মেনে একাধিক লাইনে থামার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। ফলে এত অর্থ ব্যয় করে তৈরি করা উড়ালসড়কের সুফল পুরো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছিল এবং আছে। তারা তাদের কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উড়ালসড়কটিকে কার্যকর করতে ফুটপাতটি দখলমুক্ত ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করবে কে? অথবা মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক দিয়ে দিয়ে যাত্রাবাড়ীর দিক থেকে তরতর করে চলে এসে গুলিস্তানে নামতে গিয়ে যখন আটকে থাকতে হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার দায় নির্দিষ্টভাবে কোন কর্তৃপক্ষের?
কুড়িল বা মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক হয়েছে, সরকারের সাফল্যের তালিকায় সংখ্যা বেড়েছে। মগবাজার উড়ালসেতুর কাজ হচ্ছে, এটি শেষ হলে তালিকাটি আরও বড় হবে। ব্যস, কাজ শেষ! গত সপ্তাহে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বিষয় ঢাকা। এই শহরটি নিয়ে তিনি গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করছেন সেই ষাটের দশক থেকে। সাক্ষাৎকারে তিনি অনেক কিছুই বলেছেন, তবে ঢাকার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থান নিয়ে তাঁর যা উপলব্ধি সেটা সত্যিই ভয়াবহ। ঢাকা নিয়ে নাকি বর্তমান সরকারের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে কী! ঢাকা যেভাবে চলছে তাতেই সরকার খুশি? ঢাকার পরিস্থিতি দিন দিন যেদিকে যাচ্ছে, তা অবশ্য এই মতের পক্ষেই সায় দিচ্ছে।
ঢাকার চেয়ে দেশ বড়। সরকারকে ভাবতে হয় পুরো দেশ নিয়ে, ঢাকা নিয়ে আলাদা মনোযোগ দেওয়ার সময় নাও থাকতে পারে। তা থাকুক, কিন্তু সে ক্ষেত্রে শহরটি পরিচালনার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা কাঠামো গঠন এবং দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই তো যথার্থ। সমস্যা হচ্ছে সেটিও সম্ভবত সরকারের পছন্দ নয়। একটি শহর দেখভাল বা পরিচালনা, এর ব্যবস্থাপনা বা শহর নিয়ে পরিকল্পনা করার নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকলে পরিস্থিতি যতটা বিশৃঙ্খল হতে পারে, ঢাকার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। ঢাকার নানা দিক দেখার জন্য সরকারের অসংখ্য কর্তৃপক্ষ আছে কিন্তু কোনো সমন্বয় করার কেউ নেই, যে যে চলছে যার যার মতো।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, দুটি সিটি করপোরেশন, ট্রাফিক পুলিশ, রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি, ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বা সেতু কর্তৃপক্ষ—এমন অনেক সংস্থার মধ্যে কে কার কথা শোনে! যে যে চলছে যারা যার মতো। নগরের যানবাহন পরিচালনা একটি বিজ্ঞান, আমাদের ট্রাফিক পুলিশের হঠাৎ মনে হলো যে ফার্মগেট থেকে সোনারগাঁওয়ের মোড় ঘুরে ডান দিকে যাওয়া যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে দড়ি টেনে তা বন্ধ করে দিল। মাস খানেক পর দেখবেন তা আর কাজ করছে না। অথবা বিভিন্ন মোড়ে দেখা যাবে কংক্রিটের তৈরি ভারী ব্লকের সঙ্গে বাঁশ বেঁধে যানবাহনের চলাচল এদিক-সেদিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। ঢাকা শহরের ভিআইপি রোডে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হচ্ছে বাঁশ, দড়ি এসব!
ঢাকা বর্তমানে বিশ্বে ১১তম জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, ভবিষ্যতে শহরমুখী মানুষের ঢল আরও বাড়বে। ঢাকার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে না। এই পরিস্থিতিতে যেখানে ঢাকা নিয়ে অতীতের তুলনায় আরও জোরালো ও সামগ্রিকভাবে ভাবনা দরকার, সেখানে ঢাকা নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা কার্যত আগে যাও ছিল এখন বরং আরও কমেছে। একসময় ঢাকায় নির্বাচিত মেয়র ছিলেন, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ছিলেন, এখন নেই, সেবা বাড়ানোর আশা দিয়ে সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করা হয়েছে, সেবা বাড়া তো দূরে থাক, আগে যে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি ছিল, এখন তাও নেই। ঢাকা দেখভালের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগেও ছিল না কিন্তু যেই প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত, সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার অন্তত চেষ্টা ছিল। গত বিএনপি সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় ঢাকাসংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি কাঠামো কার্যকর থাকলেও বর্তমানে তেমন কিছুও কার্যকর নেই।
এক দুর্ভাগা শহরের নাম ঢাকা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সূচকে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন খারাপ করে তখন সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ করে, ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ঢাকা এমনই এক হতভাগা শহর যে এর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলারও কেউ নেই। বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) জরিপে বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ঢাকা সবচেয়ে খারাপ শহর বা এর এক-দুই ধাপ ওঠা–নামা করছে। এ নিয়ে আজ পর্যন্ত সরকার বা কোনো তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি। কেউ আসলে ঢাকার দায়িত্বে নেই, ঢাকা নিয়ে কারও দায়ও নেই।
ইআইইউ শহরগুলোর বাসযোগ্যতা বিবেচনা করে বিদেশিদের চোখ দিয়ে। সম্প্রতি কোরীয় সাংবাদিক সমিতির আয়োজনে ওয়ার্ল্ড জার্নালিস্ট কনফারেন্সে যোগ দিতে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলাম, দিন পাঁচেক রাজধানী সিউলে ছিলাম। সেখানে একজন বিদেশি হিসেবে আমার চাওয়া কী? প্রথমত, বিমানবন্দর থেকে আমার থাকার জায়গা হোটেলে যাওয়ার জন্য নিরাপদ ও যথাযথ যাওয়ার ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, সেখানে অবস্থান করার সময় ঝুট-ঝামেলা ছাড়া চলাফেরার সুযোগ। সিউল অসম্ভব চমৎকারভাবে এই দুটোই নিশ্চিত করতে পেরেছে। ইআইইউ বাসযোগ্যতার সূচকে আরও অনেক কিছুই বিবেচনায় নেয়। সর্বশেষ সূচকে বিশ্বে ১৪০টি শহরের মধ্যে সিউলের অবস্থান ৫৮। ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর সেখান থেকে কোনো হোটেলে যাওয়ার জন্য একজন বিদেশিকে কী ঝক্কি আর কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে, অনুমান করুন। ঢাকার স্থান ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৯তম, নিকৃষ্টতম শহরটির (সিরিয়ার দামেস্ক, যেখানে যুদ্ধ চলছে) চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে।
দিন পাঁচেক কোনো শহরে থেকে এর চলাচলের সুযোগ-সুবিধা টের পাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন। সিউলের দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত মেয়র পার্ক ওন সুন বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য এক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে দৃশ্য-শব্দের উপস্থাপনায় সিউলকে তুলে ধরা হয়েছিল। সিউলকে নিয়ে ভাবার, এর দায়-দায়িত্ব নেওয়ার ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার কেউ আছেন। আছেন একজন নির্বাচিত মেয়র ও তিনজন উপমেয়র, আছে সিউল মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট। সিউলবাসীর নাগরিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, চলাচল, স্বাধীনতা, স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ, বিনোদন ও নানা সেবামূলক সুবিধা দেওয়া এই মেট্রোপলিটন সরকারের দায়িত্ব।
এসব দায়িত্ব এই মেট্রোপলিটন সরকার কতটা পালন করছে, তা সিউলবাসীর বিবেচনার বিষয়। চার বছর পর মেয়রকে আবার ভোটের জন্য নাগরিকদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জবাবদিহির ব্যবস্থা সেখানে পাকা। দিন পাঁচেক অবস্থান করা ঢাকার এই নাগরিকের কাছে সিউল শহরটির নিরাপদ চলাচল ও যানবাহনের সহজলভ্যতার বিষয়টিই মুগ্ধ করেছে। হাঁটার চওড়া ফুটপাত, রাস্তা পারাপারের জেব্রা ক্রসিং, বাস, ট্যাক্সিক্যাব, মেট্রোরেল—এগুলো যেকোনো শহরের জন্যই স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকাবাসীর কাছে এটাই যে স্বপ্নের মতো! ঢাকার রাস্তায় এখন পথচারী পারাপারের জেব্রা ক্রসিংও যে বিরল এক জিনিস!
জানলাম, গণপরিবহন নিয়ে সিউল মেট্রোপলিটন সরকারের অবস্থান হচ্ছে সিউলকে এমন একটি শহরে পরিণত করা, যেখানকার নাগরিকেরা নিজেরা গাড়ি চালানো ছাড়াই আরামে বসবাস করতে পারবে। মানে সরকার এমন গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে চায়, যাতে নিজের গাড়ি না থাকলেও আপনি নিরাপদে ও আরামে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে পারবেন। আর ঢাকা সম্ভবত এর উল্টো পথ ধরেছে, প্রাইভেট গাড়ি বাড়িয়ে একটি অচল শহরে পরিণত হতে চাইছে। এমনটা নিশ্চয় চাওয়ার কথা নয়, কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। কারণ, যাদের ভাবার কথা, তাদের নাকি শহরটি নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। আর এ নিয়ে যত দুর্ভাবনা আমাদের মতো অসহায় নাগরিকদের।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
ঢাকা এভাবেই চলছে। আর অনেক ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ দেখছি আর এর ভোগান্তি সহ্য করছি সামনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে। কিন্তু এসব উন্নয়ন হলেই কি পরিস্থিতির খুব উন্নতি হবে? স্থাপনা হবে, রাস্তাঘাট হবে কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার কী হবে? কুড়িল উড়ালসড়ক হয়েছে, যান চলাচল অনেক সহজ হয়েছে, কিন্তু উত্তরা থেকে বনানীর দিকে আসার পথে উড়ালসড়কে ওঠার আগে যে একটি যানজট তৈরি হয়, তা দেখবে কে? ফুটপাতের কিছু দোকান আর বাসগুলোর নিয়ম না মেনে একাধিক লাইনে থামার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। ফলে এত অর্থ ব্যয় করে তৈরি করা উড়ালসড়কের সুফল পুরো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছিল এবং আছে। তারা তাদের কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উড়ালসড়কটিকে কার্যকর করতে ফুটপাতটি দখলমুক্ত ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করবে কে? অথবা মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক দিয়ে দিয়ে যাত্রাবাড়ীর দিক থেকে তরতর করে চলে এসে গুলিস্তানে নামতে গিয়ে যখন আটকে থাকতে হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার দায় নির্দিষ্টভাবে কোন কর্তৃপক্ষের?
কুড়িল বা মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক হয়েছে, সরকারের সাফল্যের তালিকায় সংখ্যা বেড়েছে। মগবাজার উড়ালসেতুর কাজ হচ্ছে, এটি শেষ হলে তালিকাটি আরও বড় হবে। ব্যস, কাজ শেষ! গত সপ্তাহে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বিষয় ঢাকা। এই শহরটি নিয়ে তিনি গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করছেন সেই ষাটের দশক থেকে। সাক্ষাৎকারে তিনি অনেক কিছুই বলেছেন, তবে ঢাকার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থান নিয়ে তাঁর যা উপলব্ধি সেটা সত্যিই ভয়াবহ। ঢাকা নিয়ে নাকি বর্তমান সরকারের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে কী! ঢাকা যেভাবে চলছে তাতেই সরকার খুশি? ঢাকার পরিস্থিতি দিন দিন যেদিকে যাচ্ছে, তা অবশ্য এই মতের পক্ষেই সায় দিচ্ছে।
ঢাকার চেয়ে দেশ বড়। সরকারকে ভাবতে হয় পুরো দেশ নিয়ে, ঢাকা নিয়ে আলাদা মনোযোগ দেওয়ার সময় নাও থাকতে পারে। তা থাকুক, কিন্তু সে ক্ষেত্রে শহরটি পরিচালনার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা কাঠামো গঠন এবং দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই তো যথার্থ। সমস্যা হচ্ছে সেটিও সম্ভবত সরকারের পছন্দ নয়। একটি শহর দেখভাল বা পরিচালনা, এর ব্যবস্থাপনা বা শহর নিয়ে পরিকল্পনা করার নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকলে পরিস্থিতি যতটা বিশৃঙ্খল হতে পারে, ঢাকার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। ঢাকার নানা দিক দেখার জন্য সরকারের অসংখ্য কর্তৃপক্ষ আছে কিন্তু কোনো সমন্বয় করার কেউ নেই, যে যে চলছে যার যার মতো।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, দুটি সিটি করপোরেশন, ট্রাফিক পুলিশ, রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি, ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বা সেতু কর্তৃপক্ষ—এমন অনেক সংস্থার মধ্যে কে কার কথা শোনে! যে যে চলছে যারা যার মতো। নগরের যানবাহন পরিচালনা একটি বিজ্ঞান, আমাদের ট্রাফিক পুলিশের হঠাৎ মনে হলো যে ফার্মগেট থেকে সোনারগাঁওয়ের মোড় ঘুরে ডান দিকে যাওয়া যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে দড়ি টেনে তা বন্ধ করে দিল। মাস খানেক পর দেখবেন তা আর কাজ করছে না। অথবা বিভিন্ন মোড়ে দেখা যাবে কংক্রিটের তৈরি ভারী ব্লকের সঙ্গে বাঁশ বেঁধে যানবাহনের চলাচল এদিক-সেদিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। ঢাকা শহরের ভিআইপি রোডে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হচ্ছে বাঁশ, দড়ি এসব!
ঢাকা বর্তমানে বিশ্বে ১১তম জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, ভবিষ্যতে শহরমুখী মানুষের ঢল আরও বাড়বে। ঢাকার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে না। এই পরিস্থিতিতে যেখানে ঢাকা নিয়ে অতীতের তুলনায় আরও জোরালো ও সামগ্রিকভাবে ভাবনা দরকার, সেখানে ঢাকা নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা কার্যত আগে যাও ছিল এখন বরং আরও কমেছে। একসময় ঢাকায় নির্বাচিত মেয়র ছিলেন, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ছিলেন, এখন নেই, সেবা বাড়ানোর আশা দিয়ে সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করা হয়েছে, সেবা বাড়া তো দূরে থাক, আগে যে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি ছিল, এখন তাও নেই। ঢাকা দেখভালের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগেও ছিল না কিন্তু যেই প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত, সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার অন্তত চেষ্টা ছিল। গত বিএনপি সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় ঢাকাসংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি কাঠামো কার্যকর থাকলেও বর্তমানে তেমন কিছুও কার্যকর নেই।
এক দুর্ভাগা শহরের নাম ঢাকা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সূচকে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন খারাপ করে তখন সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ করে, ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ঢাকা এমনই এক হতভাগা শহর যে এর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলারও কেউ নেই। বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) জরিপে বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ঢাকা সবচেয়ে খারাপ শহর বা এর এক-দুই ধাপ ওঠা–নামা করছে। এ নিয়ে আজ পর্যন্ত সরকার বা কোনো তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি। কেউ আসলে ঢাকার দায়িত্বে নেই, ঢাকা নিয়ে কারও দায়ও নেই।
ইআইইউ শহরগুলোর বাসযোগ্যতা বিবেচনা করে বিদেশিদের চোখ দিয়ে। সম্প্রতি কোরীয় সাংবাদিক সমিতির আয়োজনে ওয়ার্ল্ড জার্নালিস্ট কনফারেন্সে যোগ দিতে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলাম, দিন পাঁচেক রাজধানী সিউলে ছিলাম। সেখানে একজন বিদেশি হিসেবে আমার চাওয়া কী? প্রথমত, বিমানবন্দর থেকে আমার থাকার জায়গা হোটেলে যাওয়ার জন্য নিরাপদ ও যথাযথ যাওয়ার ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, সেখানে অবস্থান করার সময় ঝুট-ঝামেলা ছাড়া চলাফেরার সুযোগ। সিউল অসম্ভব চমৎকারভাবে এই দুটোই নিশ্চিত করতে পেরেছে। ইআইইউ বাসযোগ্যতার সূচকে আরও অনেক কিছুই বিবেচনায় নেয়। সর্বশেষ সূচকে বিশ্বে ১৪০টি শহরের মধ্যে সিউলের অবস্থান ৫৮। ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর সেখান থেকে কোনো হোটেলে যাওয়ার জন্য একজন বিদেশিকে কী ঝক্কি আর কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে, অনুমান করুন। ঢাকার স্থান ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৯তম, নিকৃষ্টতম শহরটির (সিরিয়ার দামেস্ক, যেখানে যুদ্ধ চলছে) চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে।
দিন পাঁচেক কোনো শহরে থেকে এর চলাচলের সুযোগ-সুবিধা টের পাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন। সিউলের দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত মেয়র পার্ক ওন সুন বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য এক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে দৃশ্য-শব্দের উপস্থাপনায় সিউলকে তুলে ধরা হয়েছিল। সিউলকে নিয়ে ভাবার, এর দায়-দায়িত্ব নেওয়ার ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার কেউ আছেন। আছেন একজন নির্বাচিত মেয়র ও তিনজন উপমেয়র, আছে সিউল মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট। সিউলবাসীর নাগরিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, চলাচল, স্বাধীনতা, স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ, বিনোদন ও নানা সেবামূলক সুবিধা দেওয়া এই মেট্রোপলিটন সরকারের দায়িত্ব।
এসব দায়িত্ব এই মেট্রোপলিটন সরকার কতটা পালন করছে, তা সিউলবাসীর বিবেচনার বিষয়। চার বছর পর মেয়রকে আবার ভোটের জন্য নাগরিকদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জবাবদিহির ব্যবস্থা সেখানে পাকা। দিন পাঁচেক অবস্থান করা ঢাকার এই নাগরিকের কাছে সিউল শহরটির নিরাপদ চলাচল ও যানবাহনের সহজলভ্যতার বিষয়টিই মুগ্ধ করেছে। হাঁটার চওড়া ফুটপাত, রাস্তা পারাপারের জেব্রা ক্রসিং, বাস, ট্যাক্সিক্যাব, মেট্রোরেল—এগুলো যেকোনো শহরের জন্যই স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকাবাসীর কাছে এটাই যে স্বপ্নের মতো! ঢাকার রাস্তায় এখন পথচারী পারাপারের জেব্রা ক্রসিংও যে বিরল এক জিনিস!
জানলাম, গণপরিবহন নিয়ে সিউল মেট্রোপলিটন সরকারের অবস্থান হচ্ছে সিউলকে এমন একটি শহরে পরিণত করা, যেখানকার নাগরিকেরা নিজেরা গাড়ি চালানো ছাড়াই আরামে বসবাস করতে পারবে। মানে সরকার এমন গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে চায়, যাতে নিজের গাড়ি না থাকলেও আপনি নিরাপদে ও আরামে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে পারবেন। আর ঢাকা সম্ভবত এর উল্টো পথ ধরেছে, প্রাইভেট গাড়ি বাড়িয়ে একটি অচল শহরে পরিণত হতে চাইছে। এমনটা নিশ্চয় চাওয়ার কথা নয়, কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। কারণ, যাদের ভাবার কথা, তাদের নাকি শহরটি নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। আর এ নিয়ে যত দুর্ভাবনা আমাদের মতো অসহায় নাগরিকদের।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments