সবকিছুই সম্ভব, সবাই যখন এক হয় by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
রাজনীতিকদের
কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি মোক্ষম সময় বেছে নিতে
হয়। কেননা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত
হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে এমনই একটি যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিরোধী দলবিহীন
নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
বাংলাদেশ। এই সংকট শেষ পর্যন্ত সর্বগ্রাসী সংকটে রূপ নেবে- এতে কোনো সন্দেহ
নেই। যে দেশটির সম্ভাবনা বিশ্বের খ্যাতনামা মানুষের মুখে মুখে প্রকাশ
পাচ্ছে; বিশ্বের নামকরা পত্রিকাগুলো যে দেশকে উদীয়মান দেশ হিসেবে আখ্যায়িত
করছে- সে দেশটি এখন উদ্বেগ ও আতংকের দেশ। নিরীহ মানুষের মৃত্যু, গাড়ি-বাড়ি ও
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও আক্রমণ হচ্ছে। বিশ্ব মিডিয়ায় শিরোনাম
হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান অগ্নিগর্ভ ও সহিংস পরিস্থিতি। বাংলাদেশকে নিয়ে
উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী, উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। জাতিসংঘ যখন
বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তখন আর বুঝতে বাকি নেই- বহির্বিশ্বে
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক বিভাজন প্রত্যেক
দেশেই আছে, আছে আদর্শগত বিরোধও, কিন্তু দেশের স্বার্থে সবাই এক; কেননা দেশ
বাঁচলে রাজনীতি, দেশই যদি না থাকে তাহলে রাজনীতি কার জন্য? কাজেই দেশের
স্বার্থে রাজনীতিকদের এক হতে হবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটি
সমঝোতায় পৌঁছতে হবে; সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে,
যাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।
ধ্বংসের রাজনীতি সহজ কিন্তু গড়ার রাজনীতি কঠিন। এ দেশটির জন্ম দিয়েছে সাধারণ মানুষ এবং দেশটি গড়ার পেছনেও ভূমিকা সাধারণ মানুষেরই। আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে এক সময় বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি।’ এ দেশের মানুষ নিরন্তর পরিশ্রম করে এই বদনাম থেকে এটিকে বের করে এনেছে। তারপর বাংলাদেশকে বলা হল জঙ্গি রাষ্ট্র। আমরা প্রমাণ করলাম বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র; এরপর এ দেশকে অপবাদ দেয়া হল দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এই অপবাদও আমরা ঘোচানোর চেষ্টা করছি। এখন বাকি আছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তকমা। রাজনৈতিক খেলা দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের সেদিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শেরেবাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে হরহামেশাই তার সমালোচনা করত ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা। একদিন তার এক ভক্ত এসে বললেন, ‘স্যার আজকে আনন্দবাজার পত্রিকা আপনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে।’ শেরেবাংলা বললেন- তাই নাকি? তাহলে তো ভাবতে হবে আমি সঠিক পথে নেই; আমি মনে হয় ভুল করছি।’ যাই বলুন না কেন, যেভাবেই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন না কেন- বাংলাদেশ সঠিক পথে নেই। রাজনীতির ভুল খেলার কারণে চোখের সামনে বাংলাদেশ অতলে তলিয়ে যাচ্ছে আর বাংলাদেশের এ পরিস্থিতির প্রশংসা করছে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু মিডিয়া। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল, আইন-শৃংখলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করান হচ্ছে আর আইন-শৃংখলা বাহিনী ও জনগণ মুখোমুখি হওয়া মানে রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়া। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; কাজেই আইন-শৃংখলা বাহিনী ও জনগণের মুখোমুখি অবস্থান কোনোভাবেই কাম্য নয়, কাক্সিক্ষতও নয়। এই বিপজ্জনক খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সবাইকে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বিবৃত করেছেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মহাবিশ্ব, তাতে রেখেছি সুস্পষ্ট ভারসাম্য; যাতে ভারসাম্য লঙ্ঘিত না হয়।’ কেননা ভারসাম্য যেখানে থাকে না, সেখানে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরের ক্ষেত্রে ভারসাম্য। এর একটি বাদ দিয়ে অন্যটি চলতে পারে না। রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী ভালোই খেলছিলেন। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক খেলার চালে তিনি এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের খেলায় তিনি এগিয়ে থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না, শেষ পর্যন্ত সবকিছু দ্রুত তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তিনি নিজে, তার দল এবং দেশও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। সুতরাং সময় আছে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার এবং পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার।
গত কয়েক দিনে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়েছে শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ সর্বত্র। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, প্রায় ৩০ জেলার জেলা প্রশাসকরা নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। অনেক উপজেলা কার্যত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পুলিশ, বিজিবি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে; সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি উঠছে। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় অনেক নিরীহ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এবং এই মৃত্যুর মিছিল দিন দিন বাড়ছে, অনেক সম্পদও ধ্বংস হয়েছে এবং হচ্ছে। এভাবে একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না- বিশেষ করে একটি রফতানিমুখী রাষ্ট্র। বিভক্তি ও বিভাজন নিয়ে কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। দেশের রাজনীতিতে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিভক্তি থেকে জাতিকে বের করে আনার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় মানুষ চোখে শর্ষে ফুল দেখছে। কোথাও কোনো আশার বাণী তারা শুনতে পাচ্ছেন না, কেউ তাদের আশ্বস্ত করছে না; হরতালের পর হরতাল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। সড়ক অবরোধ, বন্দর বন্ধ থাকায় রফতানি খাতে দেখা দেবে বিপর্যয়। এর প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। ব্যাংকের লেনদেন দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেয়ার বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সূচক দ্রুত নিচের দিকে নামছে। নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। সরকার ও বিরোধী দল নির্বিকার। মানুষ যাবে কোথায়, কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল একটা দেশ। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে টাকা না এলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে যাবে। বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে যেভাবে নেতিবাচক প্রচারণা হচ্ছে- ভবিষ্যতে রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তখন এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ কীভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবে- এই চিন্তাটা কোনো রাজনীতিক করেন বলে মনে হয় না।
দেশের আবাসন ব্যবসা আজ ধ্বংসের পথে, ধ্বংসের পথে জনশক্তি রফতানি খাত; তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থাটাও ভালো নয়, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার আসা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। পর্যটন খাত মুখ থুবড়ে পড়ছে। এভাবে একের পর এক বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে; মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হবে, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। দেশের আইন-শৃংখলার অবনতি ঘটবে। এসব কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন? ভাবলে রাজনীতিতে এত বিভেদ-বিভক্তি ও বিভাজন কি তৈরি হতো?
দেশে নির্বিচারে সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, রেল লাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে, ট্রেন ও রেল স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, হাইওয়ের বেইলি ব্রিজ ভেঙে ফেলা হচ্ছে, রাস্তা কেটে দেয়া হচ্ছে, বিদ্যুৎ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, একে অপরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, ব্যাংক, যানবাহন, শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর হচ্ছে ও আগুন দেয়া হচ্ছে। এক কথায় মানুষ জানমাল ও ইজ্জত নিয়ে এক মহাআতঙ্কে আছেন। কিন্তু সরকারের ভাবখানা এমন যে, দেশে কিছুই হয়নি; সব ঠিক আছে।
রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করবে এটা স্বাভাবিক। তবে সেই কৌশল হতে হবে গণতন্ত্রসম্মত। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার অভিপ্রায়ে যে কৌশল অবলম্বন করছে, তা অবশ্যই বিপজ্জনক; এই কৌশল কোনোভাবেই ভালো ফল বয়ে আনবে না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের জিম্মি করে রাজনীতি হতে পারে না। নির্বিচারে হত্যাও সমস্যা সমাধানের পথ নয়। নিরীহ মানুষ হত্যা করে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে; বাংলাদেশও তাদের পথ অনুসরণ করছে। এই ভয়াবহ পথ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদরা হারিয়ে ফেলছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এখনও যে সময় ও সুযোগটুকু হাতে আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ যারা আছেন, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না; এর মাধ্যমে গঠিত সরকার দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং এ সরকারের মেয়াদও হবে ক্ষণস্থায়ী, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও এ সরকার সম্পাদন করতে পারবে না। উপরন্তু বদনামটা নিতে হবে পুরোপুরি সরকারি দলকেই।
অন্যদিকে বিরোধী দলকেও শান্তির পথে আসতে হবে, জনগণের ভোগান্তি হয় এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহার করতে হবে। জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায়ের কৌশল নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা কোনো উদ্যান বা খোলা জায়গায় টানা অবস্থান নিয়ে তাদের দাবির ব্যাপারে জনমত সংগঠিত করতে পারেন। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সচল থাকবে এবং সরকারের ওপর নৈতিক চাপও বৃদ্ধি পাবে। বিরোধী দলকে স্মরণে রাখতে হবে, তাদের নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিটি নিরেট গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন দাবি। এ দাবির প্রতি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে এ দাবি আদায়ের পথে হাঁটলে, ধীরে ধীরে দাবিটি জনগণের কাছে পানসে হয়ে যাবে; তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কাজেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায়ের চিন্তা করতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ এটিকে কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে না পারে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা উপলব্ধিতে আনাই দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে প্রতিবাদের অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে এবং এই প্রতিবাদ জরুরি; কারণ তা সরকারকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করে। এটিই গণতন্ত্রের রীতি। গণতন্ত্রকে পরিপক্ব করতে হলে এ ভাষার প্রতি শাসকদের অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। দেশ যাতে কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকটের কবলে না পড়ে, এর জন্য শাসকদলকেই পালন করতে হবে মুখ্য ভূমিকা। মনে রাখতে হবে, দেশ যদি সংকটে পড়ে সবাইকেই এর ফল ভোগ করতে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ধ্বংসের রাজনীতি সহজ কিন্তু গড়ার রাজনীতি কঠিন। এ দেশটির জন্ম দিয়েছে সাধারণ মানুষ এবং দেশটি গড়ার পেছনেও ভূমিকা সাধারণ মানুষেরই। আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে এক সময় বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি।’ এ দেশের মানুষ নিরন্তর পরিশ্রম করে এই বদনাম থেকে এটিকে বের করে এনেছে। তারপর বাংলাদেশকে বলা হল জঙ্গি রাষ্ট্র। আমরা প্রমাণ করলাম বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র; এরপর এ দেশকে অপবাদ দেয়া হল দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এই অপবাদও আমরা ঘোচানোর চেষ্টা করছি। এখন বাকি আছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তকমা। রাজনৈতিক খেলা দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের সেদিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শেরেবাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে হরহামেশাই তার সমালোচনা করত ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা। একদিন তার এক ভক্ত এসে বললেন, ‘স্যার আজকে আনন্দবাজার পত্রিকা আপনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে।’ শেরেবাংলা বললেন- তাই নাকি? তাহলে তো ভাবতে হবে আমি সঠিক পথে নেই; আমি মনে হয় ভুল করছি।’ যাই বলুন না কেন, যেভাবেই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন না কেন- বাংলাদেশ সঠিক পথে নেই। রাজনীতির ভুল খেলার কারণে চোখের সামনে বাংলাদেশ অতলে তলিয়ে যাচ্ছে আর বাংলাদেশের এ পরিস্থিতির প্রশংসা করছে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু মিডিয়া। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল, আইন-শৃংখলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করান হচ্ছে আর আইন-শৃংখলা বাহিনী ও জনগণ মুখোমুখি হওয়া মানে রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়া। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; কাজেই আইন-শৃংখলা বাহিনী ও জনগণের মুখোমুখি অবস্থান কোনোভাবেই কাম্য নয়, কাক্সিক্ষতও নয়। এই বিপজ্জনক খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সবাইকে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বিবৃত করেছেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মহাবিশ্ব, তাতে রেখেছি সুস্পষ্ট ভারসাম্য; যাতে ভারসাম্য লঙ্ঘিত না হয়।’ কেননা ভারসাম্য যেখানে থাকে না, সেখানে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরের ক্ষেত্রে ভারসাম্য। এর একটি বাদ দিয়ে অন্যটি চলতে পারে না। রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী ভালোই খেলছিলেন। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক খেলার চালে তিনি এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের খেলায় তিনি এগিয়ে থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না, শেষ পর্যন্ত সবকিছু দ্রুত তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তিনি নিজে, তার দল এবং দেশও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। সুতরাং সময় আছে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার এবং পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার।
গত কয়েক দিনে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়েছে শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ সর্বত্র। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, প্রায় ৩০ জেলার জেলা প্রশাসকরা নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। অনেক উপজেলা কার্যত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পুলিশ, বিজিবি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে; সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি উঠছে। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় অনেক নিরীহ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এবং এই মৃত্যুর মিছিল দিন দিন বাড়ছে, অনেক সম্পদও ধ্বংস হয়েছে এবং হচ্ছে। এভাবে একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না- বিশেষ করে একটি রফতানিমুখী রাষ্ট্র। বিভক্তি ও বিভাজন নিয়ে কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। দেশের রাজনীতিতে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিভক্তি থেকে জাতিকে বের করে আনার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় মানুষ চোখে শর্ষে ফুল দেখছে। কোথাও কোনো আশার বাণী তারা শুনতে পাচ্ছেন না, কেউ তাদের আশ্বস্ত করছে না; হরতালের পর হরতাল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। সড়ক অবরোধ, বন্দর বন্ধ থাকায় রফতানি খাতে দেখা দেবে বিপর্যয়। এর প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। ব্যাংকের লেনদেন দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেয়ার বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সূচক দ্রুত নিচের দিকে নামছে। নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। সরকার ও বিরোধী দল নির্বিকার। মানুষ যাবে কোথায়, কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল একটা দেশ। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে টাকা না এলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে যাবে। বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে যেভাবে নেতিবাচক প্রচারণা হচ্ছে- ভবিষ্যতে রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তখন এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ কীভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবে- এই চিন্তাটা কোনো রাজনীতিক করেন বলে মনে হয় না।
দেশের আবাসন ব্যবসা আজ ধ্বংসের পথে, ধ্বংসের পথে জনশক্তি রফতানি খাত; তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থাটাও ভালো নয়, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার আসা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। পর্যটন খাত মুখ থুবড়ে পড়ছে। এভাবে একের পর এক বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে; মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হবে, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। দেশের আইন-শৃংখলার অবনতি ঘটবে। এসব কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন? ভাবলে রাজনীতিতে এত বিভেদ-বিভক্তি ও বিভাজন কি তৈরি হতো?
দেশে নির্বিচারে সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, রেল লাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে, ট্রেন ও রেল স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, হাইওয়ের বেইলি ব্রিজ ভেঙে ফেলা হচ্ছে, রাস্তা কেটে দেয়া হচ্ছে, বিদ্যুৎ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, একে অপরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, ব্যাংক, যানবাহন, শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর হচ্ছে ও আগুন দেয়া হচ্ছে। এক কথায় মানুষ জানমাল ও ইজ্জত নিয়ে এক মহাআতঙ্কে আছেন। কিন্তু সরকারের ভাবখানা এমন যে, দেশে কিছুই হয়নি; সব ঠিক আছে।
রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করবে এটা স্বাভাবিক। তবে সেই কৌশল হতে হবে গণতন্ত্রসম্মত। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার অভিপ্রায়ে যে কৌশল অবলম্বন করছে, তা অবশ্যই বিপজ্জনক; এই কৌশল কোনোভাবেই ভালো ফল বয়ে আনবে না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের জিম্মি করে রাজনীতি হতে পারে না। নির্বিচারে হত্যাও সমস্যা সমাধানের পথ নয়। নিরীহ মানুষ হত্যা করে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে; বাংলাদেশও তাদের পথ অনুসরণ করছে। এই ভয়াবহ পথ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদরা হারিয়ে ফেলছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এখনও যে সময় ও সুযোগটুকু হাতে আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ যারা আছেন, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না; এর মাধ্যমে গঠিত সরকার দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং এ সরকারের মেয়াদও হবে ক্ষণস্থায়ী, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও এ সরকার সম্পাদন করতে পারবে না। উপরন্তু বদনামটা নিতে হবে পুরোপুরি সরকারি দলকেই।
অন্যদিকে বিরোধী দলকেও শান্তির পথে আসতে হবে, জনগণের ভোগান্তি হয় এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহার করতে হবে। জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায়ের কৌশল নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা কোনো উদ্যান বা খোলা জায়গায় টানা অবস্থান নিয়ে তাদের দাবির ব্যাপারে জনমত সংগঠিত করতে পারেন। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সচল থাকবে এবং সরকারের ওপর নৈতিক চাপও বৃদ্ধি পাবে। বিরোধী দলকে স্মরণে রাখতে হবে, তাদের নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিটি নিরেট গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন দাবি। এ দাবির প্রতি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে এ দাবি আদায়ের পথে হাঁটলে, ধীরে ধীরে দাবিটি জনগণের কাছে পানসে হয়ে যাবে; তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কাজেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায়ের চিন্তা করতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ এটিকে কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে না পারে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা উপলব্ধিতে আনাই দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে প্রতিবাদের অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে এবং এই প্রতিবাদ জরুরি; কারণ তা সরকারকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করে। এটিই গণতন্ত্রের রীতি। গণতন্ত্রকে পরিপক্ব করতে হলে এ ভাষার প্রতি শাসকদের অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। দেশ যাতে কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকটের কবলে না পড়ে, এর জন্য শাসকদলকেই পালন করতে হবে মুখ্য ভূমিকা। মনে রাখতে হবে, দেশ যদি সংকটে পড়ে সবাইকেই এর ফল ভোগ করতে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments