কাদের কাদের কাদের হত্যা করেছিল? সবাই আমাদেরই স্বজন by মাহবুব কামাল
এক
অর্থে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের প্রতিটি দিনই বাংলাদেশের জন্য একেকটি রেড
লেটার ডে। বিশেষত ১৯৭১ সালের নয় মাসের প্রতিদিনই এমন কিছু মর্মান্তিক ঘটনা
ঘটেছে যে, সেই দিনগুলো স্মরণে রাখার মতো। তবে ১৪ ডিসেম্বরের একটি বিশেষ
তাৎপর্য রয়েছে। এ দিনটি এলেই একটা বিষয় ভাবি আমি। মুক্তিযুদ্ধটা যদি আর
কিছুদিন দীর্ঘায়িত হতো, তাহলে কি এ দেশে বুদ্ধিজীবী কেউ বেঁচে থাকত?
পাকিস্তানি সেনা ও বঙ্গভাষী তাদের দোসররা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা করেছিল
ডিসেম্বরের প্রথম দিকে। এ সময় তাদের চিন্তাটা সম্ভবত এমন ছিল যে, যুদ্ধে
তো হেরেই যাচ্ছি, আনুষ্ঠানিক পরাজয় স্বীকার করার আগে বাঙালিকে মেধাশূন্য
করে যেতে হবে, যাতে তারা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে দাঁড়াতে না পেরে আবারও
পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। এখন এটাকে ভাগ্যই বলতে হবে যে, তাদের
নীলনকশার পর স্বাধীনতার জন্য আমাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এ প্রসঙ্গে
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আরেকবার ধন্যবাদ। তবে
বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার যতটুকুই বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তাতে আমাদের যে
ক্ষতি হয়েছে তা অসামান্য। বুদ্ধিজীবী হত্যা কিংবা যদি বলি গণহত্যা- কেন
মেতে উঠেছিল পাকিস্তানিরা? কারণ একটাই- পাঞ্জাবের শাসকগোষ্ঠী মনে করত, তারা
পাকিস্তানের রাজন্যবর্গ আর বাঙালিরা হচ্ছে বিদ্রোহী প্রজা। প্রজার এত বড়
সাহস, তারা স্বাধীনতা চায়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি শাসক
হিটলার ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের কেন নির্বিচারে হত্যা করেছিল, তার ব্যাখ্যা
তিনি তার বক্তৃতায় দিয়েছিলেন। সেসব ব্যাখ্যা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও
কোন কোন মহল সেটাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা চালিয়েছে,
তার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্বের কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি, হবেও না। প্রথমত,
পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটিই ছিল কিম্ভূতকিমাকার। হাজার-বারোশ’ মাইলের
ভৌগোলিক দূরত্বেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ অর্থাৎ স্বাধীনতা-পূর্ব পূর্ব
পাকিস্তান। এমন একটি অবাস্তব কাঠামো তার অন্তর্গত ছটফটানির কারণেই ভেঙে
পড়তে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙালির একমাত্র ধর্মীয় মিল
ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সাদৃশ্য নেই। ঐতিহ্য, ভাষা,
সংস্কৃতি-কৃষ্টি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বেড়ে ওঠার সংগ্রাম পর্যন্ত
সবক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আলাদা এই দুই সত্তা। এই পারস্পরিক বিরোধিতা নিয়ে
পাকিস্তান যে ২৪ বছর টিকে ছিল, সেটাই বরং আশ্চর্যের বিষয়। বঙ্গবন্ধুর
কৃতিত্ব এই যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব (Contradiction)
বিরাজ করছিল, সেটাকে শার্প বা তীক্ষ্ণ করেছেন তিনি। আমরা বিজ্ঞানের নিয়মেই
জানি, দুই পরস্পরবিরোধী সত্তা যখন পরস্পরের সঙ্গে চরম দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়,
তখন সেখান থেকে একটা নতুন কিছু বেরিয়ে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশ যেমন নতুন এক
সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান
দ্বন্দ্বের মীমাংসা হতে আরও দীর্ঘ সময় লাগত।
তদানীন্তন পাকিস্তানিরা ছিল এতই অসভ্য জাতি যে, তারা বিজ্ঞান বুঝত না, সোশ্যাল ডিনামিক্স বা সামাজিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। অসভ্যরা সাধারণত কী প্রদর্শন করে থাকে? শক্তি। এটা পেশির শক্তি হতে পারে, আবার অস্ত্রের শক্তিও। পাকিস্তানি শাসকদের হাতে অস্ত্র ছিল বলে তারা সেটাই প্রয়োগ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, অস্ত্র পাকিস্তানিদের পরিণত করেছিল এক যুক্তিহীন (Irrational) জাতিতে। হত্যা এবং একমাত্র হত্যাই হয়ে উঠল তাদের রাজনৈতিক দর্শন। কিন্তু হত্যা কিংবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যে সোশ্যাল ডিনামিক্সের স্বাভাবিক অগ্রসরমানতা রোধ করা যায় না, সেটা তাদের বুদ্ধিতে কুলোয়নি। তারা আসলে হেরে গেছে সমাজের গতিসূত্রের কাছে, বিজ্ঞানের কাছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানিরা না হয় একটা ভিন্ন জাতিকে নির্মূল করার ব্রত নিয়েছিল; বাঙালিদের মধ্য থেকে কেন একশ্রেণীর মানুষ তাদের সহযোগিতায় মাঠে নামল? বস্তুত বাঙালির মধ্য থেকেই কিছু সংখ্যক সহযোগীর কারণে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞটা সর্বব্যাপী হতে পেরেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, বিশেষত যারা মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে এখানে এসেছিল, তাদের এ দেশ সম্পর্কে সম্যক কোনো ধারণা ছিল না। তাদের এক ধরনের এলিয়েন বলা যেতে পারে। বাঙালির সঙ্গে তাদের ভাষাগত অমিল তো ছিলই, এছাড়া বাংলাদেশের ভূগোল সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল সীমিত। বাঙালি নরাধমরাই তাদের এই শূন্যস্থান পূরণ করেছে। চিনিয়েছে কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে হিন্দু। বুঝিয়েছে কোথায় আগুন দিতে হবে। স্বজাতির প্রতি এমন বিশ্বাসঘাতকতা খুঁজে পেতে হলে ইতিহাসকে বিস্তর ঘাঁটতে হবে। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মানুষের সহজাত (Inharent); এমনকি একটি শিশুও বাবা-মার শাসন অমান্য করে স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। অথচ কিছু বাঙালি স্বাধীনতার এই স্পৃহাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানিদের অধীন থাকতে চেয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা তাদের পরাধীনতাকে আরও গৌরবময় করতে চেয়েছে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করে। কী বিচিত্র মানুষ! কী বিচিত্র তাদের স্বভাব! কী অদ্ভুত তাদের চিন্তা পদ্ধতি!
১৪ ডিসেম্বর যে আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করি, তার মানে এই নয় যে, শুধু এ দিবসটিতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। এটি একটি প্রতীকী দিবস। বস্তুত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের প্রতিটি দিনই একেকটি শহীদ দিবস। আর বধ্যভূমি? সারা বাংলাদেশই যেন এক বিশাল বধ্যভূমি। নাটোর জেলায় একটি বধ্যভূমি আছে, যেখানে এক বিকালেই ৬৯ জনের লাশ কবর দেয়া হয়েছে। সেখানে একটি টিনের ফলকে ৬৯ জন শহীদের নাম লেখা রয়েছে। বাকি সবাই অজ্ঞাত। এমন বধ্যভূমি ছড়িয়ে আছে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায়। আমরা কয়টি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করব, কয়টা নির্মাণ করব শহীদ মিনার? অথবা বলা যায়, ১৯৭১ সালে গোটা বাংলাদেশটাই যে বধ্যভূমি ছিল, সেটা কি অভয়ারণ্য হতে পেরেছে, নাকি তা এখনও বধ্যভূমিই?
এই ১৪ ডিসেম্বরে একটি অন্যরকম ভাবনা আমাকে আলোড়িত করছে। আজ থেকে একশ’ কি দুইশ’ বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাসটি কেমন হয়ে ধরা দেবে তখনকার প্রজন্মের কাছে। এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রজন্মের মানুষ বেঁচে থাকতেই যেভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার উদ্যোগ ও চেষ্টা চলছে, তাতে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক- মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যখন আর থাকবে না, তখন কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হয়ে যাবে? এমন একটা সময় কি আসবে, যখন রাজাকার-আলবদররাই হয়ে উঠবে দেশপ্রেমিক আর মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রদ্রোহী? বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতক আর জিয়াউর রহমান প্রকৃত নেতা? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে চিরকালের জন্য অবিকৃত ও অবিকল রাখার স্বার্থে আমাদের করণীয় আছে অনেক কিছুই। সমাজবিজ্ঞানী, গবেষক থেকে শুরু করে আমাদের সবাইকে সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক প্রমাণাদি। বেশি বেশি করে লিখতে হবে প্রকৃত ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এমন সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম ভুল তথ্য দ্বারা পরিচালিত হতে না পারে। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করে তার প্রসিডিংসকেও করতে হবে ইতিহাসের বিষয়বস্তু। এসব কাজ করা না গেলে একদিন হয়তো সিরাজউদ্দৌলাহ হয়ে উঠবে দেশদ্রোহী আর মীরজাফর-ক্লাইভ দেশপ্রেমিক।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের রক্ত আপাতত বৃথাই রয়েছে। আমরা যারা জীবিত, তাদের যে কেউই ১৯৭১ সালে নিহত হতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আজকের যে স্লোগান- শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না- সেই শহীদের তালিকায় আমি, আপনি যে কেউই অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাম। যে কোনো কারণেই হোক, আমরা যেহেতু বেঁচে রয়েছি, সেহেতু শহীদের রক্ত সফল করতে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
পুনশ্চ : এ লেখাটির শিরোনাম অন্যরকম ছিল। লেখাটি শেষ করার পরপরই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এই সেই কাদের, যিনি নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন আমাদেরই স্বজনদের। অর্বাচীনের ধর্ম এই যে, সে পরিণাম ভেবে কাজ করে না। কাদের শুধু একজন নিষ্ঠুর ঘাতকই নন, তিনি একজন অর্বাচীনও বটে। এ ধরনের ব্যক্তির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে এমন একজনের ফাঁসি কার্যকর করে আমরা জাতি হিসেবে সভ্যতার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছি।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
তদানীন্তন পাকিস্তানিরা ছিল এতই অসভ্য জাতি যে, তারা বিজ্ঞান বুঝত না, সোশ্যাল ডিনামিক্স বা সামাজিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। অসভ্যরা সাধারণত কী প্রদর্শন করে থাকে? শক্তি। এটা পেশির শক্তি হতে পারে, আবার অস্ত্রের শক্তিও। পাকিস্তানি শাসকদের হাতে অস্ত্র ছিল বলে তারা সেটাই প্রয়োগ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, অস্ত্র পাকিস্তানিদের পরিণত করেছিল এক যুক্তিহীন (Irrational) জাতিতে। হত্যা এবং একমাত্র হত্যাই হয়ে উঠল তাদের রাজনৈতিক দর্শন। কিন্তু হত্যা কিংবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যে সোশ্যাল ডিনামিক্সের স্বাভাবিক অগ্রসরমানতা রোধ করা যায় না, সেটা তাদের বুদ্ধিতে কুলোয়নি। তারা আসলে হেরে গেছে সমাজের গতিসূত্রের কাছে, বিজ্ঞানের কাছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানিরা না হয় একটা ভিন্ন জাতিকে নির্মূল করার ব্রত নিয়েছিল; বাঙালিদের মধ্য থেকে কেন একশ্রেণীর মানুষ তাদের সহযোগিতায় মাঠে নামল? বস্তুত বাঙালির মধ্য থেকেই কিছু সংখ্যক সহযোগীর কারণে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞটা সর্বব্যাপী হতে পেরেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, বিশেষত যারা মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে এখানে এসেছিল, তাদের এ দেশ সম্পর্কে সম্যক কোনো ধারণা ছিল না। তাদের এক ধরনের এলিয়েন বলা যেতে পারে। বাঙালির সঙ্গে তাদের ভাষাগত অমিল তো ছিলই, এছাড়া বাংলাদেশের ভূগোল সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল সীমিত। বাঙালি নরাধমরাই তাদের এই শূন্যস্থান পূরণ করেছে। চিনিয়েছে কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে হিন্দু। বুঝিয়েছে কোথায় আগুন দিতে হবে। স্বজাতির প্রতি এমন বিশ্বাসঘাতকতা খুঁজে পেতে হলে ইতিহাসকে বিস্তর ঘাঁটতে হবে। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মানুষের সহজাত (Inharent); এমনকি একটি শিশুও বাবা-মার শাসন অমান্য করে স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। অথচ কিছু বাঙালি স্বাধীনতার এই স্পৃহাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানিদের অধীন থাকতে চেয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা তাদের পরাধীনতাকে আরও গৌরবময় করতে চেয়েছে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করে। কী বিচিত্র মানুষ! কী বিচিত্র তাদের স্বভাব! কী অদ্ভুত তাদের চিন্তা পদ্ধতি!
১৪ ডিসেম্বর যে আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করি, তার মানে এই নয় যে, শুধু এ দিবসটিতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। এটি একটি প্রতীকী দিবস। বস্তুত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের প্রতিটি দিনই একেকটি শহীদ দিবস। আর বধ্যভূমি? সারা বাংলাদেশই যেন এক বিশাল বধ্যভূমি। নাটোর জেলায় একটি বধ্যভূমি আছে, যেখানে এক বিকালেই ৬৯ জনের লাশ কবর দেয়া হয়েছে। সেখানে একটি টিনের ফলকে ৬৯ জন শহীদের নাম লেখা রয়েছে। বাকি সবাই অজ্ঞাত। এমন বধ্যভূমি ছড়িয়ে আছে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায়। আমরা কয়টি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করব, কয়টা নির্মাণ করব শহীদ মিনার? অথবা বলা যায়, ১৯৭১ সালে গোটা বাংলাদেশটাই যে বধ্যভূমি ছিল, সেটা কি অভয়ারণ্য হতে পেরেছে, নাকি তা এখনও বধ্যভূমিই?
এই ১৪ ডিসেম্বরে একটি অন্যরকম ভাবনা আমাকে আলোড়িত করছে। আজ থেকে একশ’ কি দুইশ’ বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাসটি কেমন হয়ে ধরা দেবে তখনকার প্রজন্মের কাছে। এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রজন্মের মানুষ বেঁচে থাকতেই যেভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার উদ্যোগ ও চেষ্টা চলছে, তাতে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক- মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যখন আর থাকবে না, তখন কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হয়ে যাবে? এমন একটা সময় কি আসবে, যখন রাজাকার-আলবদররাই হয়ে উঠবে দেশপ্রেমিক আর মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রদ্রোহী? বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতক আর জিয়াউর রহমান প্রকৃত নেতা? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে চিরকালের জন্য অবিকৃত ও অবিকল রাখার স্বার্থে আমাদের করণীয় আছে অনেক কিছুই। সমাজবিজ্ঞানী, গবেষক থেকে শুরু করে আমাদের সবাইকে সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক প্রমাণাদি। বেশি বেশি করে লিখতে হবে প্রকৃত ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এমন সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম ভুল তথ্য দ্বারা পরিচালিত হতে না পারে। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করে তার প্রসিডিংসকেও করতে হবে ইতিহাসের বিষয়বস্তু। এসব কাজ করা না গেলে একদিন হয়তো সিরাজউদ্দৌলাহ হয়ে উঠবে দেশদ্রোহী আর মীরজাফর-ক্লাইভ দেশপ্রেমিক।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের রক্ত আপাতত বৃথাই রয়েছে। আমরা যারা জীবিত, তাদের যে কেউই ১৯৭১ সালে নিহত হতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আজকের যে স্লোগান- শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না- সেই শহীদের তালিকায় আমি, আপনি যে কেউই অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাম। যে কোনো কারণেই হোক, আমরা যেহেতু বেঁচে রয়েছি, সেহেতু শহীদের রক্ত সফল করতে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
পুনশ্চ : এ লেখাটির শিরোনাম অন্যরকম ছিল। লেখাটি শেষ করার পরপরই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এই সেই কাদের, যিনি নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন আমাদেরই স্বজনদের। অর্বাচীনের ধর্ম এই যে, সে পরিণাম ভেবে কাজ করে না। কাদের শুধু একজন নিষ্ঠুর ঘাতকই নন, তিনি একজন অর্বাচীনও বটে। এ ধরনের ব্যক্তির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে এমন একজনের ফাঁসি কার্যকর করে আমরা জাতি হিসেবে সভ্যতার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছি।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
No comments