রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক by রোজিনা আক্তার
‘কী দেখার কথা, কী দেখছি? কী শোনার কথা, কী শুনছি? কী ভাবার কথা, কী ভাবছি? কী বলার কথা, কী বলছি? তিরিশ বছর (৪২ বছর) পরও আমি স্বাধীনতাকে খুঁজছি।’ এই গানের কথাগুলোই আমাদের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্বের দরবারে স্বাধীন ও সাহসী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাস। এই ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য জানা আমাদের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। স্বাধীনতার অনেক বছর পর আমার জন্ম। তাই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত। এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা প্রথম শুনি আমার পরিবার থেকে, তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি-নাটক দেখে, বই পড়ে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও একাত্তরে শারীরিকভাবে নির্যাতিত নারীর সঙ্গে কথা বলে, তাদের মুখ থেকে সেই আগুনঝরা দিনগুলোর কথা জেনেছি। এসব ঘটনা আমাকে অনেক বেশি আলোড়িত করে। যখন একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন—‘এই হাতে অস্ত্র ধরেছি, শত্রুসেনা খতম করেছি; তখন নিজের অজান্তেই চলে যাই সেই সময়ের কাছে। যখন একজন মুক্তিযোদ্ধা নারী তার ত্যাগের কথা ও নির্যাতনের কথা করুণ কণ্ঠে বর্ণনা করেন, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস না জানলে কারও মধ্যেই দেশপ্রেম বা দেশাত্মবোধ তৈরি হবে না। জাগবে না দেশের প্রতি প্রকৃত সম্মান। একজন বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা বা বীরাঙ্গনা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজেদের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন, দেশপ্রেমের জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয়-বরণীয় হয়েছেন। তারা তখনও সংগ্রাম করেছেন, এখনও করছেন। তাই পরিবারের পাশাপাশি চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, এরপর মিডিয়ার ভূমিকা। প্রযুক্তির যুগে মিডিয়াই পারে সঠিক ইতিহাস জাতির কাছে তুলে ধরতে।
কষ্ট হয় যখন দেখি একজন মুক্তিযোদ্ধা দীনহীন অবস্থায় চরম আর্থিক সঙ্কটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা নারী তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হন। অন্যদিকে একজন ঘাতক দালাল দেশের প্রশাসনে সম্মানিত পদে বসে দেশের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। আসলে দেশপ্রেম বা দেশের প্রতি ভালোবাসা কখনও জোর করে তৈরি হয় না, এটা নিজের ভেতর জন্ম নেয়, যেমনি নিয়েছিল ’৭১-এ। নিজের অস্তিত্বের জন্য মানুষ তখনও অশুভ শক্তির কাছে হার মানেনি, এখনও মানবে না। আজকে লড়াই করে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে আমরা নিজেদের জন্য শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারছি। সে হিসেবে আমাদেরও উচিত দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ সঠিকভাবে পালন করা। দেশ আমাকে কী দিয়েছে এটা না ভেবে, নিজের স্বার্থকে বড় করে না দেখে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া প্রতিটি সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আজ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাজনীতিবিদদের উচিত ক্ষমতার লোভ ও নিজের স্বার্থকে বড় করে না দেখে দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে কাজ করা। আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদরা যতদিন না দেশের মানুষের সবার আগে না ভেবে নিজেদের ক্ষমতালোভী করে প্রকাশ করবে, ততদিন দেশের মানুষকে নতুন করে বারবার স্বাধীনতা খুঁজতে হবে। মহান বিজয় দিবস সামনে রেখে রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, দেশে শান্তি ফিরে আসুক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments