বদ্ধচিন্তার খাপ থেকে মুক্তি দরকার by ফরহাদ মজহার
এ
লেখাটি লিখছি শহরে, গ্রামে ও প্রবাসে সেসব বাংলাদেশের নাগরিকের জন্য যারা
বয়সে তরুণ। যারা ‘তরুণ প্রজন্ম’ অবশ্যই, কিন্তু শুধু ঢাকা শহরের নয়। মফস্বল
ও গ্রামেরও। গ্রামে আছে তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটি অংশ, যারা কৃষিসহ
বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কাজে জড়িত। কলকারখানায় মেহনত দিয়ে অর্থনীতির চাকা যারা
সচল রাখছেন; প্রায় পুরনো দাস ব্যবস্থার মতো ‘তরুণ প্রজন্ম’ তরতাজা
শ্রমশক্তি হয়ে চালান হয়ে যাচ্ছে বিদেশে, বিশাল একটি অংশ চলে যাচ্ছে নিজের
দেশ থেকেই, অথচ মন পড়ে থাকে দেশে মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য;
মাসে মাসে ঘামে-রক্তে কামাই করা আয় দেশে পাঠান, দেশের অর্থনীতি প্রবাসীদের
সেই আয়ের ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় আয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় তরুণ প্রজন্মের
আরেক অংশের জন্য, যারা মূলত কনজিউমার বা ভোগী, দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনে
যাদের বিশেষ কোনো অবদান নেই। কিন্তু দেখা যায় তারাই সমাজ সংস্কৃতি ও
রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সরব। খুব কম তরুণই ভাবেন, তারা যে কম্পিউটারটি
ব্যবহার করেন, যে প্রাইভেট গাড়িটি চালান, যে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে খান,
কিংবা যে টেলিফোন ব্যবহার করেন- সেই প্রতিটি ভোগের জিনিস বিদেশ থেকে
আমদানি করতে হয়েছে। আর এ আমদানির অর্থ জুগিয়েছে কারখানার শ্রমিকরা, বিশেষত
পোশাক কারখানার কিশোর-কিশোরীরা। যারা পুড়ে মরে, ভবন ধসে মাটির নিচে চাপা
পড়ে কিংবা ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিরন্তর প্রাণ দেয়।
অথবা এর অর্থ জোগাচ্ছে সেই সব শ্রমিক, যারা দাসের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে মরুভূমিতে পুড়ে মরছে। কিংবা মালয়েশিয়ায় বিপদসংকুল রাবার বাগানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে, সাপের কামড় খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। কেউ ট্যাক্সি চালাচ্ছে নিউইয়র্কে, টরেন্টোতে; কেউ হোটেলের বাসন মাজছে বিলাতে। আবার কেউ রোমে, মাদ্রিদে, গ্রিসে কোনো রকমে টিকে আছে নিত্যদিনের অসম্ভব যুদ্ধে।
এই অসাম্য কুৎসিত। তরুণদের মধ্যে যারা এ অসম সম্পর্ক সম্বন্ধে ভাবতে সক্ষম, তারা অন্যদের তুলনায় সুবিধাভোগী হলেও কখনোই অহংকারী নন। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক, তাদের ভাবনার দিগন্ত প্রসারিত থাকারই কথা, এটা অনায়াসেই অনুমান করা যায়। অন্যদিকে যারা জীবিতভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার প্রায় পুরো সময়টাই প্রাণ ধারণের জন্য লড়ে যাচ্ছেন, সেসব মেহনতি মানুষ অন্যদের প্রতি ক্রোধ আর হিংসা দ্বারা তাড়িত হয়ে থাকেন, এটা ভাবাও ঠিক নয়। যারা সমাজ ও ইতিহাসকে আর দশটা বিজ্ঞানের মতো নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তারাও এই অসাম্যকে নিছকই নৈতিক অন্যায় বলে নিন্দা করে নিজেদের বিবেকের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন না। ইতিহাস বলে, আধুনিক যুগে আসলে শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশের সচেতনতাই একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাদের চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতিই সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির নির্ধারক শক্তি হয়ে ওঠে।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এমন কোনো চিন্তা, মতাদর্শ ও সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে পেরেছি কিনা, যা ১৬ কোটি মানুষকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। যদি সে মতাদর্শকে ‘জাতীয়’ হতে হয় তাহলে তার কেন্দ্রে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের স্বার্থের কথা থাকবে। শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, লোকায়ত চিন্তা, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের নিজেদের মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধ ও সংবেদনা- অর্থাৎ তাদের সজীব জীবনের সব বিষয়ই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে বাধ্য। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা কতটা ‘মুক্ত’ চিন্তার অধিকারী? কতটা সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকে তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণী আমলে নিতে রাজি? সাধারণ মানুষের ভাবনা-চিন্তার বিপরীতে কতটা নিজেদের চিন্তা ও আদর্শ সম্পর্কে আত্মপ্রত্যয়ী? আমার মনে হয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া দূরে থাকুক, তারা কী বলে বা কী বলছে সে সম্পর্কে তাদের নিজেদের কোনো হুঁশ আছে বলে মনে হয় না।
আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে কেন? এই অর্থে আত্মপ্রত্যয়ী যে, জনগণ যদি ভুল চিন্তা করে বা মতাদর্শিক বিচারে পশ্চাৎপদ থাকে, নিজের চিন্তার জায়গা থেকেই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও সঠিকভাবে অবশ্যই বোঝানো সম্ভব। কিংবা নিজে শিক্ষিত হয়ে ওঠারও সুবিধা। জনগণের চেয়ে ভালো শিক্ষক আর কেউই হতে পারে না। যদি আমরা নিজেদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম গণ্য করি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে চিন্তার পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ নিজেদের যদি একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করি, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করা কঠিন হতে পারে না। কিন্তু যারা নিজেরা চিন্তার গোঁড়ামিতে ভোগে, নিজেরা চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়েছে, যাদের বুদ্ধির জগৎ মরুভূমিতে পরিণতি হয়েছে, বালু ছড়ানো ছাড়া তাদের আর বিশেষ কোনো প্রতিভাব অবশিষ্ট নেই। তারা আত্মপ্রত্যয়ী হতে পারে না। তারা যে রাজনীতি সামনে নিয়ে আসে, তাকে বলা যায় আতংকবাদ। আবারও বলি, সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ভুল ও পশ্চাৎপদ চিন্তা থাকতেই পারে, কিন্তু কারবারটা মানুষের সঙ্গেই হতে হবে, মানুষের সঙ্গেই করতে হবে, কোনো বিমূর্ত মতাদর্শের সঙ্গে নয়। যারা জীবন্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের লড়াই সংগ্রাম থেকে জাত চিন্তা মোকাবেলা করতে অক্ষম, তারাই নানা মতাদর্শিক জুজুর ভয় দেখায়। একসময় এটা ছিল কমিউনিজম। আজ ইতিহাসের কী প্রহসন, সেটা হয়েছে ইসলামী জঙ্গিবাদ। সোজা কথায় ইসলাম। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যে অংশ নিজেদের খামাখা প্রগতিশীল ভাবে, তারা ইসলামের ভয়ে ভীত! এই ভীতি রীতিমতো কৌতুককর।
আজ আমরা কথায় কথায় জাতি এই চায়, জাতি ওই চায়, অনায়াসে ‘জাতি’ নিয়ে হাজার প্রকার চাওয়ার কাহিনী ফেরি করি, বাগাড়ম্বর করি। জাতিকে দিয়ে বহু কিছু চাওয়াই, নিজে যা চাই তা জাতির নামে বলি। ‘জাতি’ বিমূর্ত কিছু নয়, জীবন্ত মানুষ নিয়েই জাতি। আর জাতির চিন্তা অনড় বা অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। জাতি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান চেয়েছিল, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ, আগামী দিনে কী চাইবে জানি না, কিন্তু কোনো জাতীয়তাবাদ চাইবে বলে মনে হয় না। জাতিকে অখণ্ড ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলতে পারে, কিংবা বিপরীতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টাও কোনো অংশে কম তীব্র হবে না। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে আন্তর্জাতিকতাবাদের আবেদন থাকবে। সেটা ইসলাম হোক, কিংবা হোক কমিউনিজম।
রাজনৈতিক মতাদর্শ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার বড় কারণ হয়ে উঠেছে। একটু যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখব সমাজে যে বিভক্তি, বিভাজন, রক্তপাত, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্বিচারে গুলি, হরতাল, অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, লাশের উৎসব- সবকিছুর হোতা হচ্ছে সেই শ্রেণী, যারা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী। রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি করে, লুটপাট করে, এগুলো আমাদের জানা। কিন্তু যে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কথা বলে আজ দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিতর্ক। এই বিতর্কের কোনো গুরুত্ব নেই, সেটা আমার দাবি নয়। কিন্তু এত রক্ত ও এত লাশের পরও এমন কোনো মতাদর্শিক বয়ান গড়ে ওঠেনি, যা বিভক্তি ও বিভাজনের বাইরে একটা ঐক্যের জায়গা শনাক্ত করতে পারে। আমাদের নিশ্চয়ই চোখ নষ্ট হয়নি। যদি না হয়, আমরা অনায়াসেই দেখব রাজনীতির পক্ষাপক্ষ যেভাবে স্থির হয়েছে, তার কোনো পক্ষেই কৃষক বা শ্রমিক দৃশ্যমানভাবে হাজির নেই। তাদের কোনো পক্ষে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিণতি কী হবে জানি না, কিন্তু এই অনুপস্থিতি ইঙ্গিত করে যে আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি না। আমরা ঠিকই একটি খাদের কিনারে এসে পড়েছি। এজন্য নয় যে, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা সংলাপ করছেন না। এই জন্য যে, আমরা এমন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কবলে পড়েছি, যে শ্রেণী চিন্তার দিক থেকে প্রাচীন ও অন্তঃসারশূন্য। নতুনভাবে চিন্তার ক্ষমতা তার নেই। বাংলাদেশে এখনকার যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে আস্থা রাখা দুঃসাধ্য। এটা একটি জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি, কিন্তু বাস্তবতা এটাই। যারা রাজনীতি করেন, তারা প্রধানত কোনো না কোনো দল করেন। সেটা দোষের নয়। কিন্তু সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ যখন বিবেক ও চিন্তার ক্ষমতাকে রুদ্ধ করে দেয়, তখন সেটা একটি জনগোষ্ঠীর অধঃপতনের কারণ হয়ে ওঠে।
এই দ্রুত অধঃপতন আমরা দ্রুত রুদ্ধ করতে পারব কিনা? আমি মনে করি, সেটা সম্ভব যদি আমরা চিন্তার পদ্ধতি হিসেবে খাঁজকাটা পাথুরে মতাদর্শ থেকে শুরু না করে সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়ার দিকে আন্তরিকভাবে কান পাততে শিখি। শুধু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার কথা বলছি না। পুরনো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের দাবি থাকুক, কিন্তু এগুলো অর্থনৈতিক দাবি। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দাবি সমান গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত এ সময় অনেক বেশি নির্ধারক। এ বিবেচনা থেকেই আমি সব সময় বলছি, ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার যে পাথুরে বিভাজন আগাম অনুমান করে রাজনীতির নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের পুরনো পদ্ধতি নিয়ে আমরা চলি, তা নতুন করে পর্যালোচনা করা দরকার। কেউ চাক বা না চাক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে ইসলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে হাজির রয়েছে। এর বেগ বাংলাদেশে রুদ্ধ করা কঠিন। কিন্তু তা আমাদের এগিয়ে নেবে নাকি পিছিয়ে দেবে তা নির্ভর করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ও ইহলৌকিক লড়াই-সংগ্রামে তাকে আত্মস্থ করার ওপর। ‘ইসলাম’ কোনো একাট্টা একরকম ব্যাপার নয়। যারা ইসলামপন্থী তারা তাদের জায়গা থেকে কথা বলবেন, সে অধিকার তাদের আছে। কিন্তু চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা থেকে যে কাজ দরকার সেটা হচ্ছে, কী ধরনের চিন্তা সমাজকে পিছিয়ে দেয় আর কী চিন্তা এগিয়ে নিয়ে যায়, খোলা মনে সেই তর্ক করা। আলোচনাকে ইসলামী মৌলবাদ বনাম প্রগতিশীলতা নামক বদ্ধ খাপের মধ্যে পুরে ফেলা নয়। ওতে আমরা বদ্ধ জায়গাতেই বন্দি হয়ে থাকব।
আগামী দিনে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তরুণরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন; দর্শন, বুদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞান, সংস্কৃতিসহ সবকিছুতেই। প্রধানত রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, কারণ সব ক্ষেত্রে একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও চৈতন্যের সারসত্তা রাজনৈতিকতার মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হয়। রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্দশা ঘটেছে, তার কারণে রাজনীতির পক্ষে গলা ফুলিয়ে কিছু বলা কঠিন। কিন্তু ইতিহাস শিক্ষা দেয়, রাজনৈতিকভাবেই একটি জনগোষ্ঠী পরাধীন চিন্তা ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে; নিজেদের পথ নিজেদের নির্ণয় করার আর কোনো শর্টকাট পথ আছে বলে আমার জানা নেই।
অথবা এর অর্থ জোগাচ্ছে সেই সব শ্রমিক, যারা দাসের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে মরুভূমিতে পুড়ে মরছে। কিংবা মালয়েশিয়ায় বিপদসংকুল রাবার বাগানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে, সাপের কামড় খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। কেউ ট্যাক্সি চালাচ্ছে নিউইয়র্কে, টরেন্টোতে; কেউ হোটেলের বাসন মাজছে বিলাতে। আবার কেউ রোমে, মাদ্রিদে, গ্রিসে কোনো রকমে টিকে আছে নিত্যদিনের অসম্ভব যুদ্ধে।
এই অসাম্য কুৎসিত। তরুণদের মধ্যে যারা এ অসম সম্পর্ক সম্বন্ধে ভাবতে সক্ষম, তারা অন্যদের তুলনায় সুবিধাভোগী হলেও কখনোই অহংকারী নন। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক, তাদের ভাবনার দিগন্ত প্রসারিত থাকারই কথা, এটা অনায়াসেই অনুমান করা যায়। অন্যদিকে যারা জীবিতভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার প্রায় পুরো সময়টাই প্রাণ ধারণের জন্য লড়ে যাচ্ছেন, সেসব মেহনতি মানুষ অন্যদের প্রতি ক্রোধ আর হিংসা দ্বারা তাড়িত হয়ে থাকেন, এটা ভাবাও ঠিক নয়। যারা সমাজ ও ইতিহাসকে আর দশটা বিজ্ঞানের মতো নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তারাও এই অসাম্যকে নিছকই নৈতিক অন্যায় বলে নিন্দা করে নিজেদের বিবেকের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন না। ইতিহাস বলে, আধুনিক যুগে আসলে শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশের সচেতনতাই একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাদের চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতিই সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির নির্ধারক শক্তি হয়ে ওঠে।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এমন কোনো চিন্তা, মতাদর্শ ও সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে পেরেছি কিনা, যা ১৬ কোটি মানুষকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। যদি সে মতাদর্শকে ‘জাতীয়’ হতে হয় তাহলে তার কেন্দ্রে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের স্বার্থের কথা থাকবে। শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, লোকায়ত চিন্তা, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের নিজেদের মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধ ও সংবেদনা- অর্থাৎ তাদের সজীব জীবনের সব বিষয়ই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে বাধ্য। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা কতটা ‘মুক্ত’ চিন্তার অধিকারী? কতটা সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকে তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণী আমলে নিতে রাজি? সাধারণ মানুষের ভাবনা-চিন্তার বিপরীতে কতটা নিজেদের চিন্তা ও আদর্শ সম্পর্কে আত্মপ্রত্যয়ী? আমার মনে হয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া দূরে থাকুক, তারা কী বলে বা কী বলছে সে সম্পর্কে তাদের নিজেদের কোনো হুঁশ আছে বলে মনে হয় না।
আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে কেন? এই অর্থে আত্মপ্রত্যয়ী যে, জনগণ যদি ভুল চিন্তা করে বা মতাদর্শিক বিচারে পশ্চাৎপদ থাকে, নিজের চিন্তার জায়গা থেকেই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও সঠিকভাবে অবশ্যই বোঝানো সম্ভব। কিংবা নিজে শিক্ষিত হয়ে ওঠারও সুবিধা। জনগণের চেয়ে ভালো শিক্ষক আর কেউই হতে পারে না। যদি আমরা নিজেদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম গণ্য করি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে চিন্তার পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ নিজেদের যদি একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করি, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করা কঠিন হতে পারে না। কিন্তু যারা নিজেরা চিন্তার গোঁড়ামিতে ভোগে, নিজেরা চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়েছে, যাদের বুদ্ধির জগৎ মরুভূমিতে পরিণতি হয়েছে, বালু ছড়ানো ছাড়া তাদের আর বিশেষ কোনো প্রতিভাব অবশিষ্ট নেই। তারা আত্মপ্রত্যয়ী হতে পারে না। তারা যে রাজনীতি সামনে নিয়ে আসে, তাকে বলা যায় আতংকবাদ। আবারও বলি, সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ভুল ও পশ্চাৎপদ চিন্তা থাকতেই পারে, কিন্তু কারবারটা মানুষের সঙ্গেই হতে হবে, মানুষের সঙ্গেই করতে হবে, কোনো বিমূর্ত মতাদর্শের সঙ্গে নয়। যারা জীবন্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের লড়াই সংগ্রাম থেকে জাত চিন্তা মোকাবেলা করতে অক্ষম, তারাই নানা মতাদর্শিক জুজুর ভয় দেখায়। একসময় এটা ছিল কমিউনিজম। আজ ইতিহাসের কী প্রহসন, সেটা হয়েছে ইসলামী জঙ্গিবাদ। সোজা কথায় ইসলাম। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যে অংশ নিজেদের খামাখা প্রগতিশীল ভাবে, তারা ইসলামের ভয়ে ভীত! এই ভীতি রীতিমতো কৌতুককর।
আজ আমরা কথায় কথায় জাতি এই চায়, জাতি ওই চায়, অনায়াসে ‘জাতি’ নিয়ে হাজার প্রকার চাওয়ার কাহিনী ফেরি করি, বাগাড়ম্বর করি। জাতিকে দিয়ে বহু কিছু চাওয়াই, নিজে যা চাই তা জাতির নামে বলি। ‘জাতি’ বিমূর্ত কিছু নয়, জীবন্ত মানুষ নিয়েই জাতি। আর জাতির চিন্তা অনড় বা অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। জাতি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান চেয়েছিল, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ, আগামী দিনে কী চাইবে জানি না, কিন্তু কোনো জাতীয়তাবাদ চাইবে বলে মনে হয় না। জাতিকে অখণ্ড ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলতে পারে, কিংবা বিপরীতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টাও কোনো অংশে কম তীব্র হবে না। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে আন্তর্জাতিকতাবাদের আবেদন থাকবে। সেটা ইসলাম হোক, কিংবা হোক কমিউনিজম।
রাজনৈতিক মতাদর্শ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার বড় কারণ হয়ে উঠেছে। একটু যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখব সমাজে যে বিভক্তি, বিভাজন, রক্তপাত, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্বিচারে গুলি, হরতাল, অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, লাশের উৎসব- সবকিছুর হোতা হচ্ছে সেই শ্রেণী, যারা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী। রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি করে, লুটপাট করে, এগুলো আমাদের জানা। কিন্তু যে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কথা বলে আজ দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিতর্ক। এই বিতর্কের কোনো গুরুত্ব নেই, সেটা আমার দাবি নয়। কিন্তু এত রক্ত ও এত লাশের পরও এমন কোনো মতাদর্শিক বয়ান গড়ে ওঠেনি, যা বিভক্তি ও বিভাজনের বাইরে একটা ঐক্যের জায়গা শনাক্ত করতে পারে। আমাদের নিশ্চয়ই চোখ নষ্ট হয়নি। যদি না হয়, আমরা অনায়াসেই দেখব রাজনীতির পক্ষাপক্ষ যেভাবে স্থির হয়েছে, তার কোনো পক্ষেই কৃষক বা শ্রমিক দৃশ্যমানভাবে হাজির নেই। তাদের কোনো পক্ষে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিণতি কী হবে জানি না, কিন্তু এই অনুপস্থিতি ইঙ্গিত করে যে আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি না। আমরা ঠিকই একটি খাদের কিনারে এসে পড়েছি। এজন্য নয় যে, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা সংলাপ করছেন না। এই জন্য যে, আমরা এমন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কবলে পড়েছি, যে শ্রেণী চিন্তার দিক থেকে প্রাচীন ও অন্তঃসারশূন্য। নতুনভাবে চিন্তার ক্ষমতা তার নেই। বাংলাদেশে এখনকার যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে আস্থা রাখা দুঃসাধ্য। এটা একটি জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি, কিন্তু বাস্তবতা এটাই। যারা রাজনীতি করেন, তারা প্রধানত কোনো না কোনো দল করেন। সেটা দোষের নয়। কিন্তু সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ যখন বিবেক ও চিন্তার ক্ষমতাকে রুদ্ধ করে দেয়, তখন সেটা একটি জনগোষ্ঠীর অধঃপতনের কারণ হয়ে ওঠে।
এই দ্রুত অধঃপতন আমরা দ্রুত রুদ্ধ করতে পারব কিনা? আমি মনে করি, সেটা সম্ভব যদি আমরা চিন্তার পদ্ধতি হিসেবে খাঁজকাটা পাথুরে মতাদর্শ থেকে শুরু না করে সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়ার দিকে আন্তরিকভাবে কান পাততে শিখি। শুধু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার কথা বলছি না। পুরনো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের দাবি থাকুক, কিন্তু এগুলো অর্থনৈতিক দাবি। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দাবি সমান গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত এ সময় অনেক বেশি নির্ধারক। এ বিবেচনা থেকেই আমি সব সময় বলছি, ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার যে পাথুরে বিভাজন আগাম অনুমান করে রাজনীতির নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের পুরনো পদ্ধতি নিয়ে আমরা চলি, তা নতুন করে পর্যালোচনা করা দরকার। কেউ চাক বা না চাক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে ইসলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে হাজির রয়েছে। এর বেগ বাংলাদেশে রুদ্ধ করা কঠিন। কিন্তু তা আমাদের এগিয়ে নেবে নাকি পিছিয়ে দেবে তা নির্ভর করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ও ইহলৌকিক লড়াই-সংগ্রামে তাকে আত্মস্থ করার ওপর। ‘ইসলাম’ কোনো একাট্টা একরকম ব্যাপার নয়। যারা ইসলামপন্থী তারা তাদের জায়গা থেকে কথা বলবেন, সে অধিকার তাদের আছে। কিন্তু চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা থেকে যে কাজ দরকার সেটা হচ্ছে, কী ধরনের চিন্তা সমাজকে পিছিয়ে দেয় আর কী চিন্তা এগিয়ে নিয়ে যায়, খোলা মনে সেই তর্ক করা। আলোচনাকে ইসলামী মৌলবাদ বনাম প্রগতিশীলতা নামক বদ্ধ খাপের মধ্যে পুরে ফেলা নয়। ওতে আমরা বদ্ধ জায়গাতেই বন্দি হয়ে থাকব।
আগামী দিনে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তরুণরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন; দর্শন, বুদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞান, সংস্কৃতিসহ সবকিছুতেই। প্রধানত রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, কারণ সব ক্ষেত্রে একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও চৈতন্যের সারসত্তা রাজনৈতিকতার মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হয়। রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্দশা ঘটেছে, তার কারণে রাজনীতির পক্ষে গলা ফুলিয়ে কিছু বলা কঠিন। কিন্তু ইতিহাস শিক্ষা দেয়, রাজনৈতিকভাবেই একটি জনগোষ্ঠী পরাধীন চিন্তা ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে; নিজেদের পথ নিজেদের নির্ণয় করার আর কোনো শর্টকাট পথ আছে বলে আমার জানা নেই।
No comments