ড. সুমিত গাঙ্গুলির বিশ্লেষণ- সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণে অনাগ্রহী
প্রখ্যাত ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর
ড. সুমিত গাঙ্গুলি মনে করেন দুই নেত্রীর মধ্যকার বিরোধ যতটা না আদর্শগত তার
চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশটির সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণে অনাগ্রহী। কারণ
তাহলে তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণে বেশ আন্তর্জাতিক বাধার
মুখে পড়তে পারে। জাতিসংঘে তাদের আকর্ষণীয় চাকরি হারানোরও শঙ্কা আছে।
সুমিত গাঙ্গুলি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমিংটনের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়ান কালচার্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনস-এর রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি অধ্যাপনা করেন।
গত ৬ই ডিসেম্বর ভারতের দি নিউ এশিয়ান এজ পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে অধ্যাপক গাঙ্গুলি বলেন, সম্ভবত বাংলাদেশী রাষ্ট্রব্যবস্থার কতিপয় ভাল দিকের অন্যতম হচ্ছে সামরিক বাহিনী যদিও তাদের নিজেদের বিশেষ অধিকারের প্রতি সতর্ক চোখ রেখে চলেছে কিন্তু তারা আর একটি অভ্যুত্থান সংঘটনে সামান্য আগ্রহ দেখিয়েছে।
তার মতে এই অনাগ্রহের পেছনে আরও একটা আংশিক কারণ আছে। প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপে তাদের অনাগ্রহের কারণ হলো এই বিবেচনা থেকে যে, তারা যদি দেশের ভঙ্গুর নির্বাচনী গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করে তাহলে তা যথেষ্ট আন্তর্জাতিক অননুমোদনের কবলে পড়তে পারে। এমনকি সেটা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের আকর্ষণীয় চাকরি হারানোর ঘটনায় রূপ নিতে পারে।
তিনি বলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ সম্ভবত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য দেশগুলো মতপার্থক্য নিরসনে দুই নেতার প্রতি আহ্বান জানাতে পারে যাতে তাদের জনগণ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে যোগ দিতে পারে। এখন গণতন্ত্রের জন্য আশাবাদের একটাই জায়গা আছে যদি তারা একটা সমঝোতায় পৌঁছান।
তার কথায়, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছে সেটা দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক নাটকের অংশ কি অংশ নয়, তার চেয়েও বড় হলো এটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মৌলিক সমস্যার নির্দেশক। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেছিল। সেই থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সূচকসমূহে (এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ) বিরাট অগ্রগতি এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক সংহতি সাধন এখনও অধরা রয়ে গেছে। বরং সকল বাস্তব অর্থে বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী গণতন্ত্রের পর্যায়ের আছে। গণতন্ত্রের অন্যান্য উপাদান, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে বড় ভূমিকা রেখে থাকে সেখানে ঘাটতি চলছে। দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন শক্তিশালী হতে পারলো না, তার উত্তর জটিল। এবং এর শেকড় ইতিহাসে নিহিত।
এটা স্মরণ করা দরকার যে, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের কোন গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা ছিল না। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম যখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলো- তখন ইসলামাবাদের বেসামরিক কর্তৃপক্ষগুলো যারা সামরিক বাহিনীর যোগসাজশ করেছিল, তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে। এই একটি ঘটনাই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রায় অবশ্যম্ভাবী অবস্থায় ঠেলে দেয়।
সুমিত গাঙ্গুলি আরও লিখেছেন, বিশাল জনপ্রিয়তা ও ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিতে সফল হননি। বিশেষ করে তিনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি এবং ক্রমাগতভাবে তিনি তার কর্তৃত্বপরায়ণ স্টাইলে দেশ শাসনের পটভূমিতে ১৫ই আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নিহত হন। এর পরে বাংলাদেশে যে সব সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে তাতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণে সামান্য অথবা কোন চেষ্টাই চালানো হয়নি। বরং বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে তারা খাটো করেছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সামান্য শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পরে সাবেক শাসনামলের অনেক কিছুরই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। বেগম খালেদা জিয়া সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে যথেষ্টভাবে খর্ব করতে উদ্যোগী হননি এবং তিনি সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় কোন ব্যাকুলতা দেখাননি এবং অবশ্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সততার উন্নয়ন নিশ্চিত করেননি। সম্ভবত মাত্র একটি ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে একটা অগ্রগতি দেখা যায়। সেটা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। যদিও কিছু সংখ্যক সংবাদপত্র নির্লজ্জভাবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে।
ড. সুমিত গাঙ্গুলি আরও লিখেছেন, বেগম খালেদা জিয়া ভারতের প্রতি কঠিন বৈরিতা ও পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণ করা ছাড়াও তিনি নিহত বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদের প্রতি অবিশ্রান্ত বৈরিতা দেখিয়ে চলেছেন। শেখ হাসিনা তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, শেখ হাসিনা ওয়াজেদ একটি অনুগত বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন। সুতরাং রাজনৈতিক পরাজয় উদারচিত্তে গ্রহণ করার ব্যর্থতা বাংলাদেশ গণতন্ত্রে রয়েছে। জাতীয় সংসদেও গঠনমূলক বিরোধিতা অনুপস্থিত। অথচ এসবই একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা না থাকার কারণে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতন্ত্র শিকড় গাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ এর পরিবর্তে গণবিক্ষোভ ও হরতালের মতো সংসদীয় রীতি-নীতি বহির্ভূত সব ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল।
গাঙ্গুলি লিখেছেন ১৯৯৬ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতা থেকে সরে যায় তখন পরাজিত বিএনপি’র বিরুদ্ধে তিনি ও তার সমর্থকরা বিএনপি সরকারে থাকতে তাদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছিল সেটাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের ক্ষোভের মুখ্য কারণ। যদিও এই দু’টি দলের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ রয়েছে কিন্তু তাদের মধ্যকার মুখ্য রাজনৈতিক বিরোধের উৎস হচ্ছে ক্রমবর্ধমানভাবে দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত তিক্ততা। সেই সব ব্যক্তির প্রতি আওয়ামী লীগের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ রয়েছে যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের একটি অংশ এখন বিএনপি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। রাজনৈতিক পেশিশক্তি প্রদর্শনে বিএনপি পিছিয়ে নেই। তারাও সংসদ বহির্ভূত কলাকৌশল অবলম্বন করে।
ইতিমধ্যে উভয় দলের সকল পর্যায়ের নেতৃত্বকে রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতায় উন্মত্ত করেছে। যে দল যখনই ক্ষমতায় থাকে তখন তারা ও তাদের সমর্থকরা সব ধরনের উৎপীড়ন চালিয়ে থাকে। আর সে কারণেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের বৃহত্তর আস্থায় ফাটল ধরেছে এবং সেটা যথেষ্ট রাজনৈতিক নৈরাশ্যবাদের জন্ম দিচ্ছে।
No comments