রাজনীতির পরাজয় হতে পারে না by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে
বাংলাদেশ। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, বুঝে না বুঝে আমরা সবাই দেশটাকে জিম্মি
করছি। অসহনশীল ও অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য,
উৎপাদন ও আমদানি-রফতানি এবং অর্থনীতির চাকা আজ থমকে গেছে। এ পরিস্থিতি
অব্যাহত থাকলে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। দেশ
বিপর্যস্ত হোক তা সাধারণ মানুষ চায় না। বস্তুত ১৬ কোটি মানুষই চায় শান্তি
আর শান্তি নির্ভর করে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ওপর, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন
দলের ওপর। এ মুহূর্তে বড় দুই দলের মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। যুদ্ধাপরাধের
বিচার ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের ইস্যু সমান তালে চলছে। আর এটাই
অশান্তির মূল কারণ। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে
ক্ষমতাসীন দল প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলতে পারে।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হাঁটছে উল্টো পথে, ভোটবিহীন এক তামাশার নির্বাচন তারা করতে যাচ্ছে, যা দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সৃষ্টি করবে এক কলংকজনক অধ্যায়। এর মাধ্যমে মানুষ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, বিশেষ করে যারা নতুন ভোটার হয়েছেন তারাও। এ প্রহসন ও তামাশার নির্বাচন একদিকে গণতন্ত্রের বারোটা বাজাবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাবে। এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভোটবিহীন নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দ্বিতীয় দফায় শুনানি হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স’ (জিএসপি) সুবিধা বহাল রাখা নিয়ে আশংকা দেখা দিয়েছে। এর আগে আমেরিকা জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছে। জাতিসংঘও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। হুমকি আসতে পারে শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশের সদস্যদের ওপর। এসব জটিল ব্যাপার ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। দৃশ্যত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে এবং চলমান রাজনৈতিক সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে বাংলাদেশ আর এক চুলও সামনে অগ্রসর হতে পারবে বলে মনে হয় না; বরং যেটুকু উন্নতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা গভীর খাদে পড়ে যেতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দেশ আজ সর্বগ্রাসী সংকটে নিপতিত। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলার আলামত দেখা যাচ্ছে, দেশের স্থানে স্থানে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে; আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনগণ পরস্পরের শত্র“তে পরিণত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে মানুষের সব স্বপ্ন, ধ্বংস হচ্ছে সম্ভাবনা। সবাইকে এই অপরিণামদর্শী রাজনীতি ত্যাগ করে সহনশীল রাজনীতির আবহ তৈরি করতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বেশকিছু মৌলিক বিষয়ে বিতর্ক ছিল। এ বিতর্ক পেছনে ফেলে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বড় দুটি ইস্যু সহিংসতার কারণ হচ্ছে। একটি যুদ্ধাপরাধের বিচার, অন্যটি নির্বাচনকালীন সরকার। এ দুই ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন টালমাটাল। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে। সব ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে অনিশ্চয়তা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে চলছে বিপজ্জনক খেলা! পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তির তৎপরতা দেখে প্রতীয়মান হয়, কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করার চেষ্টায় আছে। এমনটি হলে দেশের ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটার সমূহ আশংকা আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাজেই যে কোনো মূল্যে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে, জাতিকে বের করে আনতে হবে অন্ধকার গহ্বর থেকে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব।
দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ভোটবিহীন নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা সমুন্নত থাকবে।
ক্ষমতার রাজনীতি দেশের মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করছে। এ থেকে আরও অসংখ্য বিভক্তি তৈরি হচ্ছে সমাজে। এমনটি অব্যাহত থাকলে এখানে বাইরের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে। বিদেশী সেনা মোতায়েনের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হবে। সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হবে। তখন রাজনীতি বলতে কিছু থাকবে না, যেমন নেই ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, আইভরিকোস্ট, সুদান, সোমালিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে। তারা আজ অন্যের ওপর নির্ভরশীল। অন্য দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তাদের শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখতে হচ্ছে।
কোনো রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার মনোবৃত্তি নিয়ে রাজনীতি হয় না এবং দেশও সঠিকভাবে চালানো যায় না। আওয়ামী লীগের কোনো ভুল বা অদূরদর্শী রাজনীতির কারণে দেশে যদি কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তাতে আওয়ামী লীগই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনীতিতে দিনবদলের স্লোগান ছিল আওয়ামী লীগের। এটা তাদের নির্বাচনী ওয়াদাও ছিল। তারা জাতির কাছে ওয়াদা করেছিল রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এমন একটি উদ্যোগও সরকার নেয়নি যাতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। উল্টো শাসকদের অসহিষ্ণু আচরণে রাজনীতি ফিরে যাচ্ছে সেই অন্ধকার যুগে। গ্রাম্য রাজনীতি এবং চর দখলের মতো সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে অরাজনীতিসুলভ সব বাক্য, যা কোনোভাবেই জাতীয় রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। এতে অপরাজনীতি উৎসাহিত হচ্ছে, রাজনীতি চলে যাচ্ছে বিপজ্জনক পর্যায়ে। বিরোধী দলের অনেক শীর্ষ নেতা মিথ্যা মামলায় জেলে। তাদের প্রধান কার্যালয় অবরুদ্ধ। তারা মিছিল করতে পারে না, সভা করতে পারে না, এমনকি করতে পারে না শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনও! এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এ পরিস্থিতিতে কিভাবে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা হতে পারে? কাজেই রাজনীতিতে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, মুক্তি দিতে হবে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। সংবিধানের দোহাই দিয়ে ভোটবিহীন নির্বাচন রাজনৈতিক দলের জন্য মানানসই নয়। কেননা সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া নেতৃত্বের জন্য অশোভনীয়। ভোটবিহীন নির্বাচনের কারণে দেশের প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। আর যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের দুঃখের শেষ নেই। তাদের মধ্যে রীতিমত ক্ষোভ বিরাজ করছে। বস্তুত এ ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক দলের রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। তারা কোনো দলকেই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে সমর্থ হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো প্রার্থীও তারা খুঁজে পায়নি। এটি বিরোধী দলের জন্য এক বিরাট সাফল্য। তাদের এখানে নৈতিক বিজয় হয়েছে, কিন্তু সার্বিক অর্থে রাজনীতির পরাজয় হয়েছে। পরাজিত হচ্ছেন রাজনীতিকরাও। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে বলেছেন, ‘দেশের জন্য যে কোনো ত্যাগ আমি স্বীকার করব।’ এর কিছুদিন পর ইমামদের এক সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমি দেশে শান্তি চাই, মানুষের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না, প্রধানমন্ত্রীর পদ আমার দরকার নেই’ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো চলমান সময়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তার সুন্দর সুন্দর এসব কথা বাস্তবে পরিণত হলে দেশে অশান্তি থাকার কথা নয়। ভোটবিহীন নির্বাচন বাতিল করে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, মুক্তি দিতে পারেন মানুষকে কষ্ট থেকে। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর কথা শুধু কথাই থাকবে না, তা বাস্তবে রূপ পাবে। রাজনীতির জয় হবে। ব্যর্থ নয়, সফল হবেন রাজনীতিকরা।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হাঁটছে উল্টো পথে, ভোটবিহীন এক তামাশার নির্বাচন তারা করতে যাচ্ছে, যা দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সৃষ্টি করবে এক কলংকজনক অধ্যায়। এর মাধ্যমে মানুষ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, বিশেষ করে যারা নতুন ভোটার হয়েছেন তারাও। এ প্রহসন ও তামাশার নির্বাচন একদিকে গণতন্ত্রের বারোটা বাজাবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাবে। এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভোটবিহীন নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দ্বিতীয় দফায় শুনানি হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স’ (জিএসপি) সুবিধা বহাল রাখা নিয়ে আশংকা দেখা দিয়েছে। এর আগে আমেরিকা জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছে। জাতিসংঘও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। হুমকি আসতে পারে শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশের সদস্যদের ওপর। এসব জটিল ব্যাপার ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। দৃশ্যত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে এবং চলমান রাজনৈতিক সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে বাংলাদেশ আর এক চুলও সামনে অগ্রসর হতে পারবে বলে মনে হয় না; বরং যেটুকু উন্নতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা গভীর খাদে পড়ে যেতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দেশ আজ সর্বগ্রাসী সংকটে নিপতিত। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলার আলামত দেখা যাচ্ছে, দেশের স্থানে স্থানে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে; আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনগণ পরস্পরের শত্র“তে পরিণত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে মানুষের সব স্বপ্ন, ধ্বংস হচ্ছে সম্ভাবনা। সবাইকে এই অপরিণামদর্শী রাজনীতি ত্যাগ করে সহনশীল রাজনীতির আবহ তৈরি করতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বেশকিছু মৌলিক বিষয়ে বিতর্ক ছিল। এ বিতর্ক পেছনে ফেলে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বড় দুটি ইস্যু সহিংসতার কারণ হচ্ছে। একটি যুদ্ধাপরাধের বিচার, অন্যটি নির্বাচনকালীন সরকার। এ দুই ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন টালমাটাল। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে। সব ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে অনিশ্চয়তা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে চলছে বিপজ্জনক খেলা! পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তির তৎপরতা দেখে প্রতীয়মান হয়, কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করার চেষ্টায় আছে। এমনটি হলে দেশের ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটার সমূহ আশংকা আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাজেই যে কোনো মূল্যে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে, জাতিকে বের করে আনতে হবে অন্ধকার গহ্বর থেকে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব।
দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ভোটবিহীন নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা সমুন্নত থাকবে।
ক্ষমতার রাজনীতি দেশের মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করছে। এ থেকে আরও অসংখ্য বিভক্তি তৈরি হচ্ছে সমাজে। এমনটি অব্যাহত থাকলে এখানে বাইরের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে। বিদেশী সেনা মোতায়েনের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হবে। সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হবে। তখন রাজনীতি বলতে কিছু থাকবে না, যেমন নেই ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, আইভরিকোস্ট, সুদান, সোমালিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে। তারা আজ অন্যের ওপর নির্ভরশীল। অন্য দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তাদের শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখতে হচ্ছে।
কোনো রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার মনোবৃত্তি নিয়ে রাজনীতি হয় না এবং দেশও সঠিকভাবে চালানো যায় না। আওয়ামী লীগের কোনো ভুল বা অদূরদর্শী রাজনীতির কারণে দেশে যদি কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তাতে আওয়ামী লীগই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনীতিতে দিনবদলের স্লোগান ছিল আওয়ামী লীগের। এটা তাদের নির্বাচনী ওয়াদাও ছিল। তারা জাতির কাছে ওয়াদা করেছিল রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এমন একটি উদ্যোগও সরকার নেয়নি যাতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। উল্টো শাসকদের অসহিষ্ণু আচরণে রাজনীতি ফিরে যাচ্ছে সেই অন্ধকার যুগে। গ্রাম্য রাজনীতি এবং চর দখলের মতো সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে অরাজনীতিসুলভ সব বাক্য, যা কোনোভাবেই জাতীয় রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। এতে অপরাজনীতি উৎসাহিত হচ্ছে, রাজনীতি চলে যাচ্ছে বিপজ্জনক পর্যায়ে। বিরোধী দলের অনেক শীর্ষ নেতা মিথ্যা মামলায় জেলে। তাদের প্রধান কার্যালয় অবরুদ্ধ। তারা মিছিল করতে পারে না, সভা করতে পারে না, এমনকি করতে পারে না শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনও! এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এ পরিস্থিতিতে কিভাবে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা হতে পারে? কাজেই রাজনীতিতে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, মুক্তি দিতে হবে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। সংবিধানের দোহাই দিয়ে ভোটবিহীন নির্বাচন রাজনৈতিক দলের জন্য মানানসই নয়। কেননা সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া নেতৃত্বের জন্য অশোভনীয়। ভোটবিহীন নির্বাচনের কারণে দেশের প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। আর যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের দুঃখের শেষ নেই। তাদের মধ্যে রীতিমত ক্ষোভ বিরাজ করছে। বস্তুত এ ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক দলের রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। তারা কোনো দলকেই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে সমর্থ হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো প্রার্থীও তারা খুঁজে পায়নি। এটি বিরোধী দলের জন্য এক বিরাট সাফল্য। তাদের এখানে নৈতিক বিজয় হয়েছে, কিন্তু সার্বিক অর্থে রাজনীতির পরাজয় হয়েছে। পরাজিত হচ্ছেন রাজনীতিকরাও। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে বলেছেন, ‘দেশের জন্য যে কোনো ত্যাগ আমি স্বীকার করব।’ এর কিছুদিন পর ইমামদের এক সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমি দেশে শান্তি চাই, মানুষের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না, প্রধানমন্ত্রীর পদ আমার দরকার নেই’ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো চলমান সময়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তার সুন্দর সুন্দর এসব কথা বাস্তবে পরিণত হলে দেশে অশান্তি থাকার কথা নয়। ভোটবিহীন নির্বাচন বাতিল করে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, মুক্তি দিতে পারেন মানুষকে কষ্ট থেকে। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর কথা শুধু কথাই থাকবে না, তা বাস্তবে রূপ পাবে। রাজনীতির জয় হবে। ব্যর্থ নয়, সফল হবেন রাজনীতিকরা।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments