প্রমাণিত হল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ আসলে পাকিস্তানের by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমার
এক বন্ধুপুত্র মনসুর আহমদ ব্রাসেলসে একটি বড় ইউরোপিয়ান কোম্পানিতে চাকরি
নিয়ে বসবাস করেন। অর্থনীতি এবং রাজনীতি দুটি বিষয়েই তার পড়াশোনা প্রচুর।
মাঝে মাঝে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়েও তার সঙ্গে টেলিফোনে আমার আলাপ-আলোচনা
হয়। এই সেদিন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তানের
পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস হতেই মনসুর আমাকে
টেলিফোনে জানালেন- ‘আঙ্কেল, আমরা একাত্তরে ফিরে গেছি।’ কথাটির ব্যাখ্যা তার
কাছে জানতে চাইলাম। মনসুর বলল, এতদিন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান
জামায়াত ও বিএনপির মাধ্যমে ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালাচ্ছিল। তাতে সফল না হওয়ায়
এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি শুরু হতেই তারা স্বমূর্তি
ধারণ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যদি একাত্তরের অবস্থানে তারা থাকত, তাহলে
বাংলাদেশে আবার তারা সৈন্য পাঠাত। সেই সুযোগ না থাকায় পার্লামেন্টে
প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে তাদের এই জিঘাংসার প্রকাশ। মনসুর আমাকে বলল, আপনি
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন। পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে
প্রস্তাব পাস হওয়ার আগেই পাকিস্তানের জামায়াত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ঘোষণার জন্য তাদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে
আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার সুযোগ ও অবস্থান এখন পাকিস্তানের নেই। তাই
পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস দ্বারা এই পরোক্ষ যুদ্ধ ঘোষণা। প্রত্যক্ষ
যুদ্ধটি তো বাংলাদেশের মাটিতেই হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধের নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ,
হত্যাকাণ্ড চলছে, তা তো এক ধরনের যুদ্ধই। এই যুদ্ধের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ভার
পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র হাতে। হাসিনা সরকারের দৃঢ়তায়
এই প্রক্সি ওয়ার সফল হচ্ছে না বলেই পাকিস্তানকে এখন নিজের মুখোশ খুলে এই
যুদ্ধে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসতে হয়েছে। আমরা আবার একাত্তরে ফিরে গেছি। জাতীয়
পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভূমিকা
দেখে আমাদের বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
আমি মনসুর আহমদের এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। যদি কেউ নিরাসক্ত ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাস খতিয়ে দেখেন, তিনি দেখবেন, ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ করেনি। বাংলাদেশের ভেতরে ক্রমাগত তার স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে ইসলামাবাদের অর্থ ও অস্ত্রপুষ্ট অনুসারীদের দ্বারা। এই অনুসারীদের মধ্যে জামায়াতের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করা যায়। জামায়াত ধীরে ধীরে বিএনপিকে গ্রাস করে।
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে জঙ্গি অভ্যুত্থান, বাংলা ভাইদের আবির্ভাব, বারবার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা এবং সর্বশেষে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতেই দেশব্যাপী এই সন্ত্রাস সৃষ্টির প্যাটার্নের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এর পেছনে আইএসআই’র ষড়যন্ত্রের কালো হাতটির খেলা রয়েছে। আজ সারা দেশে যে সন্ত্রাসের তাণ্ডব, তা তো আজকের ব্যাপার নয়। বিএনপি যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই এই সরকারের প্রশ্রয়ে থেকে জামায়াত তার অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করেছে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের জন্য। দশ ট্রাক অস্ত্র চালান ঘটনার সব রহস্য তো এখনও উন্মোচিত হয়নি। বলা হচ্ছে, পূর্ব ভারতের উলফা বা এই জাতীয় গেরিলাদের হাতে পৌঁছানোর জন্য এ অস্ত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল। আসলে এ অস্ত্র আসছিল বাংলাদেশের মৌলবাদী জঙ্গিদের জন্য। এ ধরনের অস্ত্রের একটি চালানমাত্র ধরা পড়েছে। তার আগে ও পরে আরও কত অস্ত্রের চালান এসেছে এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত জঙ্গিদের হাতে পৌঁছেছে তার হিসাব কে দেবে? এখন এটা স্পষ্ট ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদান বানচাল করার জন্য জামায়াত এই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েছিল। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসাকে তাদের ঘাঁটি করেছিল।
এই সন্ত্রাস ও যুদ্ধকেই বিএনপি একটি রাজনৈতিক কভার দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধের খোলস পরিয়ে। একটি নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে এ ধরনের ধ্বংসাÍক অভিযানে নামা যে একটি অজুহাত এটা আজ দেশবাসীর সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আসল উদ্দেশ্য, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা বাতিল করা। ’৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব স্বদেশদ্রোহী গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল এবং পাকিস্তান, আমেরিকা প্রভৃতি যেসব দেশ তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিল, ২০১৩ সালে দেখা যাচ্ছে সেসব দেশই এই মানবতার শত্র“দের দণ্ডদানের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় হয়েছে।
এই যুদ্ধে আরেকটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপির গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রত্যাশা করে এবং বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে এলে তাকে ভোট দেয়। সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত বহুদলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন মেনে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে এলে অনেকেরই ধারণা, বিএনপি শুধু ভালো করত না, হয়তো জয়ী হতেও পারত।
কিন্তু বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে না থেকে জামায়াতের সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসের রাজনীতিতে যেতেই দেখা যাচ্ছে, এই সন্ত্রাসকে যতই আন্দোলনের খোলস পরানো হোক তাতে জনসমর্থন মিলছে না। সন্ত্রাস ও রক্তপাত দ্বারা জনগণকে ভীত করে কখনও কখনও ঘরে অবস্থানে বাধ্য করা যাচ্ছে, কিন্তু জনসমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মুখরক্ষার জন্য এখন হরতাল-অবরোধ তারা ডাকছেন। না ডাকলে তাদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়। এ অবরোধ ডাকা ক্রমশই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে ফেলা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি ভণ্ডুল করার জন্য শুধু অস্ত্র নয়, সন্ত্রাসী আমদানিও চলছে বহুদিন ধরে। আমার সহৃদয় পাঠকদের অনেকেরই হয়তো স্মরণ আছে, আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তানে তালেবান শাসন উৎখাতের পর দলে দলে সন্ত্রাসী তালেবান পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। আইএসআই তাদের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে। এ সময় খালেদা-নিজামী সরকার ছিল বাংলাদেশে ক্ষমতায়।
এ পলাতক জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়দান এবং প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশে কাজে লাগানোর জন্য করাচি থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে সাধারণ যাত্রীবেশে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হতে থাকে। এই খবর ইউরোপ-আমেরিকার প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়। ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ এবং ফ্রান্স ও জার্মানির দুটি প্রধান কাগজে তা ফলাও করে প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করা হয়। শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলের নেত্রী। তিনি দেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের উত্থান হতে চলেছে বলে এবং এখনই এ ব্যাপারে কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার বলে সরকারকে হুশিয়ার করেন। আর যায় কোথা? সরকারপ্রধান হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া তখনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বললেন, ‘দেশে মৌলবাদী জঙ্গিরা আস্তানা গাড়ছে এই প্রচার চালিয়ে হাসিনা দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করছেন।’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তোলে ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকা। একই দিনে পত্রিকা দুটি প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধে শেখ হাসিনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন এ মন্তব্যসহ ঘোষণা করে, ‘বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের আস্তানা নেই।’
বাংলাদেশে যখন জঙ্গি মৌলবাদীরা অর্থ, অস্ত্র ও সাংগঠনিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তদানীন্তন বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সেই সাবেক সরকার এবং তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে দুটি প্রধান জাতীয় পত্রিকা বলেছে, দেশে জঙ্গিবাদী নেই। তৎকালীন সরকারের অন্যতম মন্ত্রী, বর্তমানে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও গ্রেফতারকৃত মতিউর রহমান নিজামী আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বাংলা ভাই বলে কারও অস্তিত্ব নেই। এটা মিডিয়ার আবিষ্কার।’ পরে এই বাংলা ভাইদেরই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছিল। আর গত আফগান যুদ্ধের শেষে আফগানিস্তান থেকে বহু জঙ্গি যে পালিয়ে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তার সত্যতা প্রমাণ করছে বাংলাদেশের আজকের সন্ত্রাস। এরা সবাই আকাশ থেকে উড়ে এসে বাংলাদেশে জুড়ে বসেনি। পলাতক তালেবানদের হাতেই এদের অনেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধ যে কেবল অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, বরং একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হামলারই পুনরাবৃত্তি, এটা কাদের মোল্লার ফাঁসি একেবারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে। এত দিন বলা হয়েছে, এই কাদের মোল্লা বা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একাত্তরের মোল্লা ও সাঈদী নন। তাদের বদলে অন্য লোক এবং নির্দোষ লোক ধরে আনা হয়েছে। কাদের মোল্লা যে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা নন, সেটা প্রমাণ করার জন্য তার লেখা একটা চিঠিও বাজারে ছড়ানো হয়েছে এবং একশ্রেণীর মিডিয়া তা লুফে নিয়েছে।
এখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নিশ্চিতভাবে জানা গেল, এই কাদের মোল্লাই একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী ঘাতক কাদের মোল্লা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্র“ এই যুদ্ধাপরাধী দীর্ঘকাল ধরে এখন দণ্ডিত হওয়ায় এবং অন্যান্য অপরাধীরও দণ্ড নিশ্চিত হওয়ায় পাকিস্তান আর ঘোমটার আড়ালে থেকে বা তাদের পোষা অনুসারীদের সাহায্যে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা ও নাশকতামূলক কাজ চালিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি; একেবারে রণংদেহি মূর্তি ধারণ করে বাংলাদেশে যুদ্ধাভিযান চালানোরও হুমকি দিয়েছে। শক্তি, সুযোগ ও অনুকূল পরিবেশ থাকলে তারা যে ’৭১ সালের মতো হানাদার সৈন্য বাংলাদেশে পাঠাত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানও বহুদূরবর্তী এবং অন্তদ্বন্দ্বে জর্জরিত একটি পতনোন্মুখখ দেশ। হুমকি দেখানো এবং আস্ফালন করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই।
বাংলাদেশ নিয়ে ’৭১ সালে আমেরিকাসহ অনেক পশ্চিমাশক্তি যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, বর্তমানেও দেশটিকে ঘিরে তারা একই অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ অবস্থানটি হল একাত্তর সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানকে সমর্থন জুগিয়েছে এবং এক্ষণে ২০১৩ সালে সারা দেশে বিএনপি ও জামায়াত রাজনৈতিক আন্দোলনের কভারে যে মিনি গণহত্যা শুরু করেছে, তাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের অবৈধ দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের ওপর জোটবদ্ধ হয়ে চাপ সৃষ্টি করছে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধী এই বহিঃশক্তি। একজন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় জাতিসংঘ প্রধান পর্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় শত শত নিরীহ নির্দোষ সিভিলিয়ান হত্যা অব্যাহতভাবে চলতে থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, জাতিসংঘ প্রধান টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেননি। বাংলাদেশে এই যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগীরাই এখন রাজনৈতিক আন্দোলনের কভারে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, নিরীহ মানুষ, এমনকি বালক-বৃদ্ধ পুড়িয়ে মারছে। ওয়ার অন টেরোরিজমের স্বঘোষিত নেতা আমেরিকা বাংলাদেশের এই সন্ত্রাসীদের পরম বান্ধব। এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপস করার জন্য হাসিনা সরকারের ওপর ‘সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের’ নামে চাপের পর চাপ প্রয়োগ করছে।
১৯৭০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ব্যর্থ করার জন্য আমেরিকা ভারত মহাসাগরে তাদের সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছিল। এবার পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা করতে না পেরে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জোটবদ্ধভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভিত্তি রক্ষায় যুদ্ধরত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। ’৭১ সালে ভারত মহাসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর প্রেরণ এবং ২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের উৎসাহ ও সমর্থন জোগানো।
এবার বাংলাদেশের মিত্রদের অনেকে আশঙ্কা করেছিল, পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে ভারত-আমেরিকা নব্য মিতালির সুবাদে ভারত হয়তো দেশটির স্বাধীনতার পক্ষের শিবির ও সরকারের পক্ষে ’৭১-এর মতো শক্ত অবস্থান নিতে চাইবে না অথবা পারবে না। এই আশংকা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ এবং বর্তমান হাসিনা সরকারের পক্ষে দিল্লি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বলদর্পী আমেরিকা দিল্লিকে কিছুটা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দেশে নিযুক্ত ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়েকে একটি তুচ্ছ মামলায় কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে গ্রেফতার করে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাকে অশ্লীল নির্যাতনের (নগ্নদেহ তল্লাশিসহ) শিকার করেছে। ওয়াশিংটন ভেবেছিল, তাদের চেয়ে দুর্বল ভারত তার কোনো জবাব দিতে পারবে না। ভারত শক্ত জবাব দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। দিল্লি তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। ওয়াশিংটনকে কড়া ভাষায় বলেছে, ‘আমেরিকার জানা উচিত, বিশ্ব আর আগের অবস্থায় নেই।’ অর্থাৎ বিশ্বে আমেরিকার মোড়লিপনার দিন শেষ এবং তাদের সামরিক শক্তিও আর অপরাজেয় নয়।
’৭১ সালেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সমর্থন জানানোর দরুন দেশটির সঙ্গে অশিষ্ট আচরণ করেছিল আমেরিকা। স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ‘দ্যাট উইমেন’ (ঃযধঃ ড়িসবহ) বলে অভিহিত করে অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীও তার জবাব দিয়েছিলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে ভারত মহাসাগর থেকে মার্কিন নৌবহরকে লজ্জাকর পশ্চাদপসারণে বাধ্য করে। এবারও লন্ডনের কোনো কোনো কাগজের খবর, পুতিনের রাশিয়া অত্যন্ত সতর্কভাবে বাংলাদেশ তথা ভারত মহাসাগর পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছে। আমেরিকা বেশি বাড়াবাড়ি করতে চাইলে সিরিয়ায় নিশ্চিত মার্কিন ও পশ্চিমা হামলা রোখার মতো বাংলাদেশ সম্পর্কেও রাশিয়া এ অবস্থান গ্রহণ করবে। আর এবার চীনকে দিয়ে ভারতবিরোধী কার্ডটি খেলাতেও আমেরিকা ব্যর্থ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, একাত্তরের মতো বাংলাদেশবিরোধী এবারের যুদ্ধেও পাকিস্তান পরাজিত হবে। জামায়াতসহ যেসব জঙ্গি দল পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশে প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছে বারবার পরাজয়ের ফলে তারা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এদের সন্ত্রাসে জনগণ যদি ভীত না হয় এবং সরকার যদি আরও দৃঢ়তা ও কঠোরতার সঙ্গে এদের মোকাবিলা করে, তাহলে দেশী-বিদেশী অনেক চক্রান্ত এবং সন্ত্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। তবে সেজন্য একাত্তরের মতোই দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আমি মনসুর আহমদের এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। যদি কেউ নিরাসক্ত ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাস খতিয়ে দেখেন, তিনি দেখবেন, ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ করেনি। বাংলাদেশের ভেতরে ক্রমাগত তার স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে ইসলামাবাদের অর্থ ও অস্ত্রপুষ্ট অনুসারীদের দ্বারা। এই অনুসারীদের মধ্যে জামায়াতের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করা যায়। জামায়াত ধীরে ধীরে বিএনপিকে গ্রাস করে।
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে জঙ্গি অভ্যুত্থান, বাংলা ভাইদের আবির্ভাব, বারবার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা এবং সর্বশেষে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতেই দেশব্যাপী এই সন্ত্রাস সৃষ্টির প্যাটার্নের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এর পেছনে আইএসআই’র ষড়যন্ত্রের কালো হাতটির খেলা রয়েছে। আজ সারা দেশে যে সন্ত্রাসের তাণ্ডব, তা তো আজকের ব্যাপার নয়। বিএনপি যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই এই সরকারের প্রশ্রয়ে থেকে জামায়াত তার অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করেছে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের জন্য। দশ ট্রাক অস্ত্র চালান ঘটনার সব রহস্য তো এখনও উন্মোচিত হয়নি। বলা হচ্ছে, পূর্ব ভারতের উলফা বা এই জাতীয় গেরিলাদের হাতে পৌঁছানোর জন্য এ অস্ত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল। আসলে এ অস্ত্র আসছিল বাংলাদেশের মৌলবাদী জঙ্গিদের জন্য। এ ধরনের অস্ত্রের একটি চালানমাত্র ধরা পড়েছে। তার আগে ও পরে আরও কত অস্ত্রের চালান এসেছে এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত জঙ্গিদের হাতে পৌঁছেছে তার হিসাব কে দেবে? এখন এটা স্পষ্ট ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদান বানচাল করার জন্য জামায়াত এই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েছিল। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসাকে তাদের ঘাঁটি করেছিল।
এই সন্ত্রাস ও যুদ্ধকেই বিএনপি একটি রাজনৈতিক কভার দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধের খোলস পরিয়ে। একটি নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে এ ধরনের ধ্বংসাÍক অভিযানে নামা যে একটি অজুহাত এটা আজ দেশবাসীর সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আসল উদ্দেশ্য, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা বাতিল করা। ’৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব স্বদেশদ্রোহী গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল এবং পাকিস্তান, আমেরিকা প্রভৃতি যেসব দেশ তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিল, ২০১৩ সালে দেখা যাচ্ছে সেসব দেশই এই মানবতার শত্র“দের দণ্ডদানের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় হয়েছে।
এই যুদ্ধে আরেকটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপির গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রত্যাশা করে এবং বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে এলে তাকে ভোট দেয়। সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত বহুদলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন মেনে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে এলে অনেকেরই ধারণা, বিএনপি শুধু ভালো করত না, হয়তো জয়ী হতেও পারত।
কিন্তু বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে না থেকে জামায়াতের সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসের রাজনীতিতে যেতেই দেখা যাচ্ছে, এই সন্ত্রাসকে যতই আন্দোলনের খোলস পরানো হোক তাতে জনসমর্থন মিলছে না। সন্ত্রাস ও রক্তপাত দ্বারা জনগণকে ভীত করে কখনও কখনও ঘরে অবস্থানে বাধ্য করা যাচ্ছে, কিন্তু জনসমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মুখরক্ষার জন্য এখন হরতাল-অবরোধ তারা ডাকছেন। না ডাকলে তাদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়। এ অবরোধ ডাকা ক্রমশই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে ফেলা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি ভণ্ডুল করার জন্য শুধু অস্ত্র নয়, সন্ত্রাসী আমদানিও চলছে বহুদিন ধরে। আমার সহৃদয় পাঠকদের অনেকেরই হয়তো স্মরণ আছে, আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তানে তালেবান শাসন উৎখাতের পর দলে দলে সন্ত্রাসী তালেবান পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। আইএসআই তাদের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে। এ সময় খালেদা-নিজামী সরকার ছিল বাংলাদেশে ক্ষমতায়।
এ পলাতক জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়দান এবং প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশে কাজে লাগানোর জন্য করাচি থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে সাধারণ যাত্রীবেশে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হতে থাকে। এই খবর ইউরোপ-আমেরিকার প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়। ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ এবং ফ্রান্স ও জার্মানির দুটি প্রধান কাগজে তা ফলাও করে প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করা হয়। শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলের নেত্রী। তিনি দেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের উত্থান হতে চলেছে বলে এবং এখনই এ ব্যাপারে কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার বলে সরকারকে হুশিয়ার করেন। আর যায় কোথা? সরকারপ্রধান হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া তখনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বললেন, ‘দেশে মৌলবাদী জঙ্গিরা আস্তানা গাড়ছে এই প্রচার চালিয়ে হাসিনা দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করছেন।’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তোলে ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকা। একই দিনে পত্রিকা দুটি প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধে শেখ হাসিনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন এ মন্তব্যসহ ঘোষণা করে, ‘বাংলাদেশে জঙ্গি মৌলবাদীদের আস্তানা নেই।’
বাংলাদেশে যখন জঙ্গি মৌলবাদীরা অর্থ, অস্ত্র ও সাংগঠনিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তদানীন্তন বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সেই সাবেক সরকার এবং তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে দুটি প্রধান জাতীয় পত্রিকা বলেছে, দেশে জঙ্গিবাদী নেই। তৎকালীন সরকারের অন্যতম মন্ত্রী, বর্তমানে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও গ্রেফতারকৃত মতিউর রহমান নিজামী আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বাংলা ভাই বলে কারও অস্তিত্ব নেই। এটা মিডিয়ার আবিষ্কার।’ পরে এই বাংলা ভাইদেরই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছিল। আর গত আফগান যুদ্ধের শেষে আফগানিস্তান থেকে বহু জঙ্গি যে পালিয়ে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তার সত্যতা প্রমাণ করছে বাংলাদেশের আজকের সন্ত্রাস। এরা সবাই আকাশ থেকে উড়ে এসে বাংলাদেশে জুড়ে বসেনি। পলাতক তালেবানদের হাতেই এদের অনেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধ যে কেবল অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, বরং একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হামলারই পুনরাবৃত্তি, এটা কাদের মোল্লার ফাঁসি একেবারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে। এত দিন বলা হয়েছে, এই কাদের মোল্লা বা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একাত্তরের মোল্লা ও সাঈদী নন। তাদের বদলে অন্য লোক এবং নির্দোষ লোক ধরে আনা হয়েছে। কাদের মোল্লা যে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা নন, সেটা প্রমাণ করার জন্য তার লেখা একটা চিঠিও বাজারে ছড়ানো হয়েছে এবং একশ্রেণীর মিডিয়া তা লুফে নিয়েছে।
এখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নিশ্চিতভাবে জানা গেল, এই কাদের মোল্লাই একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী ঘাতক কাদের মোল্লা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্র“ এই যুদ্ধাপরাধী দীর্ঘকাল ধরে এখন দণ্ডিত হওয়ায় এবং অন্যান্য অপরাধীরও দণ্ড নিশ্চিত হওয়ায় পাকিস্তান আর ঘোমটার আড়ালে থেকে বা তাদের পোষা অনুসারীদের সাহায্যে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা ও নাশকতামূলক কাজ চালিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি; একেবারে রণংদেহি মূর্তি ধারণ করে বাংলাদেশে যুদ্ধাভিযান চালানোরও হুমকি দিয়েছে। শক্তি, সুযোগ ও অনুকূল পরিবেশ থাকলে তারা যে ’৭১ সালের মতো হানাদার সৈন্য বাংলাদেশে পাঠাত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানও বহুদূরবর্তী এবং অন্তদ্বন্দ্বে জর্জরিত একটি পতনোন্মুখখ দেশ। হুমকি দেখানো এবং আস্ফালন করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই।
বাংলাদেশ নিয়ে ’৭১ সালে আমেরিকাসহ অনেক পশ্চিমাশক্তি যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, বর্তমানেও দেশটিকে ঘিরে তারা একই অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ অবস্থানটি হল একাত্তর সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানকে সমর্থন জুগিয়েছে এবং এক্ষণে ২০১৩ সালে সারা দেশে বিএনপি ও জামায়াত রাজনৈতিক আন্দোলনের কভারে যে মিনি গণহত্যা শুরু করেছে, তাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের অবৈধ দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের ওপর জোটবদ্ধ হয়ে চাপ সৃষ্টি করছে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধী এই বহিঃশক্তি। একজন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় জাতিসংঘ প্রধান পর্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় শত শত নিরীহ নির্দোষ সিভিলিয়ান হত্যা অব্যাহতভাবে চলতে থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, জাতিসংঘ প্রধান টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেননি। বাংলাদেশে এই যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগীরাই এখন রাজনৈতিক আন্দোলনের কভারে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, নিরীহ মানুষ, এমনকি বালক-বৃদ্ধ পুড়িয়ে মারছে। ওয়ার অন টেরোরিজমের স্বঘোষিত নেতা আমেরিকা বাংলাদেশের এই সন্ত্রাসীদের পরম বান্ধব। এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপস করার জন্য হাসিনা সরকারের ওপর ‘সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের’ নামে চাপের পর চাপ প্রয়োগ করছে।
১৯৭০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ব্যর্থ করার জন্য আমেরিকা ভারত মহাসাগরে তাদের সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছিল। এবার পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা করতে না পেরে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জোটবদ্ধভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভিত্তি রক্ষায় যুদ্ধরত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। ’৭১ সালে ভারত মহাসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর প্রেরণ এবং ২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের উৎসাহ ও সমর্থন জোগানো।
এবার বাংলাদেশের মিত্রদের অনেকে আশঙ্কা করেছিল, পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে ভারত-আমেরিকা নব্য মিতালির সুবাদে ভারত হয়তো দেশটির স্বাধীনতার পক্ষের শিবির ও সরকারের পক্ষে ’৭১-এর মতো শক্ত অবস্থান নিতে চাইবে না অথবা পারবে না। এই আশংকা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ এবং বর্তমান হাসিনা সরকারের পক্ষে দিল্লি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বলদর্পী আমেরিকা দিল্লিকে কিছুটা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দেশে নিযুক্ত ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়েকে একটি তুচ্ছ মামলায় কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে গ্রেফতার করে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাকে অশ্লীল নির্যাতনের (নগ্নদেহ তল্লাশিসহ) শিকার করেছে। ওয়াশিংটন ভেবেছিল, তাদের চেয়ে দুর্বল ভারত তার কোনো জবাব দিতে পারবে না। ভারত শক্ত জবাব দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। দিল্লি তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। ওয়াশিংটনকে কড়া ভাষায় বলেছে, ‘আমেরিকার জানা উচিত, বিশ্ব আর আগের অবস্থায় নেই।’ অর্থাৎ বিশ্বে আমেরিকার মোড়লিপনার দিন শেষ এবং তাদের সামরিক শক্তিও আর অপরাজেয় নয়।
’৭১ সালেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সমর্থন জানানোর দরুন দেশটির সঙ্গে অশিষ্ট আচরণ করেছিল আমেরিকা। স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ‘দ্যাট উইমেন’ (ঃযধঃ ড়িসবহ) বলে অভিহিত করে অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীও তার জবাব দিয়েছিলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে ভারত মহাসাগর থেকে মার্কিন নৌবহরকে লজ্জাকর পশ্চাদপসারণে বাধ্য করে। এবারও লন্ডনের কোনো কোনো কাগজের খবর, পুতিনের রাশিয়া অত্যন্ত সতর্কভাবে বাংলাদেশ তথা ভারত মহাসাগর পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছে। আমেরিকা বেশি বাড়াবাড়ি করতে চাইলে সিরিয়ায় নিশ্চিত মার্কিন ও পশ্চিমা হামলা রোখার মতো বাংলাদেশ সম্পর্কেও রাশিয়া এ অবস্থান গ্রহণ করবে। আর এবার চীনকে দিয়ে ভারতবিরোধী কার্ডটি খেলাতেও আমেরিকা ব্যর্থ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, একাত্তরের মতো বাংলাদেশবিরোধী এবারের যুদ্ধেও পাকিস্তান পরাজিত হবে। জামায়াতসহ যেসব জঙ্গি দল পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশে প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছে বারবার পরাজয়ের ফলে তারা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এদের সন্ত্রাসে জনগণ যদি ভীত না হয় এবং সরকার যদি আরও দৃঢ়তা ও কঠোরতার সঙ্গে এদের মোকাবিলা করে, তাহলে দেশী-বিদেশী অনেক চক্রান্ত এবং সন্ত্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। তবে সেজন্য একাত্তরের মতোই দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
No comments