সরল গরল- দশম সংসদের বৈধতা ও একাদশের ভাবনা by মিজানুর রহমান খান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সমঝোতা হলে দশম
সংসদ ভেঙে নির্বাচনের’ যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির
নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
তখন
উভয় দল অনানুষ্ঠানিকভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর ব্যাপারে একমত হয়েছিল। কিন্তু
দশমে যে কারণে হচ্ছে না, সেটা একাদশে হবে কী? তবে গণতন্ত্রিক প্রক্রিয়া ধরে
রাখতে চাইলে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানে একটা উপযুক্ত সংশোধনী
লাগবে। বিএনপির উচিত হবে কেবল নির্বাচনকালীন নয়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
হ্রাস এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর ফর্মুলাসমন্বিত একটি
গুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে জনগণের সামনে হাজির করা।
এই সংসদে নির্বাচিত সাংসদদের ম্যান্ডেট কী? তাঁরা পাঁচ বছর কোন নৈতিকতা ও কর্তৃত্বে দেশ চালাবেন? সেনা মোতায়েনের ফলে এই ‘নির্বাচনের’ বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে মনে হয় না। বরং ইয়াজউদ্দিনের উদ্দেশে শেখ হাসিনার বিবৃতি পুনঃপ্রচারের সম্ভাবনা থাকবে। সেটি হচ্ছে, ‘জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে দাঁড় করাবেন না।’ শাসকগোষ্ঠী একদিকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষাকে জরুরি মনে করছে, অন্যদিকে আবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন আর সংসদ ভেঙে ৯০ দিন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সংবিধান তা সমর্থন করে না। তাই সমঝোতার জন্য কান্নাকাটি বৃথা। সমঝোতা নয়, সংবিধান বড়।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ গঠনের জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের শর্ত দিচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁরা দশম সংসদ নিয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছেন। কিন্তু জানুয়ারি মাসের পরে ‘দশম সংসদ নির্বাচন’ কথাটি জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে। বিএনপি এ বিষয়ে অপরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে। তার সামনে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেই। ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা ও লজ্জাকর কাণ্ডকীর্তিই তাদের পুঁজি।
বিএনপিকে ১৫তম সংশোধনীর সমালোচনা করতে বলুন। ফাটিয়ে দেবে। এরপর বলুন দুই-তৃতীয়াংশের চেরাগ পেলে কোন কোন অনুচ্ছেদ বদলাবেন? কোনটার পরিবর্তে কোনটা আনবেন? দেখবেন আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে। কারণ, এর উত্তর তাদের জানা নেই। নাগরিক সমাজের নামে যে অংশটি এখন বিএনপির নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছে, তাদেরও বিকার নেই। ‘আওয়ামী-বাকশালীদের’ হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোই তাদের গন্তব্য। অথচ গণতন্ত্র চাইলে এখনই বিএনপির কাছ থেকে কথা বের করতে হবে, তারা ক্ষমতা পেলে দেশশাসনের কার্যপ্রণালিটা কী করবে? আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও বিএনপি ব্যালটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে রেখেছে। আসলে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কী হবে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। মৌখিক নয়, একটি লিখিত অবস্থান আদায়ে বিএনপিকে চাপ দিতে হবে। শুধু অবরোধ বা তার নামে নাশকতা দিয়ে নির্বাচন ভন্ডুল করা যাবে না।
আগের লেখায় ইসির বশংবদ অবস্থা নিয়ে লিখেছি। সংবিধান ভেঙে গেলে বিবেকবানদের কেউ পদত্যাগ করে বাড়ি চলে যেতে পারেন। কিন্তু যে দেশে সংবিধান ভাঙাই ভবিতব্য, সে দেশে আমরা কেন আশা করি, ইসি ‘বিবেকহীন অনুপ্রবেশকারী?’ সংবিধানের মৃদু ভাঙচুর সমর্থন করে বিচারপতি আবদুর রশিদ ২০০৮ সালে লিখেছিলেন, ‘নির্বাহী বিভাগের যেকোনো ধরনের প্রভাবের বাইরে থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কমিশনারদের যদি প্রশাসনের বারান্দায় ফাইল হাতে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, তাহলে বিধাতাও তাঁদের স্বাধীন ও মুক্ত করতে পারবেন না। আইনের শাসন এবং সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব সংবিধানে স্বতঃসিদ্ধ থাকবে যদি না সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষগুলো সংবিধানের কথা ও তার ক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।’
এখন এটা কীভাবে চলছে? দ্বিদলীয় সমঝোতায় মূলত মেধার ভিত্তিতে এই কর্তৃপক্ষগুলোকে ঢেলে না সাজানোর কাজটাই চলছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার নাও। কিন্তু স্বচ্ছ ও অবাধ ভোটের ব্যাপারে তাদের না। কেবল আইন ও সংবিধান দিয়ে সংকট ঘুচবে না। সংকট গভীরতর হবে। নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে একাত্তরের রেডিকালাইজেশনের সামাজিক ক্ষতের নিরাময় ঘটেনি। একটা চরমতম পর্যায় থেকে হঠাৎ ফিরে আসার ঐতিহ্য কি এবারও টিকবে? বিএনপি ‘অবাধ’ নির্বাচনে সরকারে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে আরেকটি সংকটের ক্ষণ গণনাও শুরু করতে পারে। কথা হলো, সংবিধান এখন কোথায়? এক-এগারো না এলে আমরা কি বুঝবই না যে সংবিধানের আত্মা শূন্যে মেলাচ্ছে? সংবিধানের ছায়াকায়া আদালতের প্রাণও কেড়ে নেয়।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ৯০ দিনের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় হাইকোর্ট সংবিধান ব্যাখ্যা করেছিলেন। বিচিত্র ব্যাখ্যাও দেখেছি। যেমন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক জরুরি অবস্থার মামলায় কার্যত অভিমত দিলেন যে ইয়াজউদ্দিনের পরিকল্পনায় ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়াটাই সংবিধানসম্মত ছিল। এরপর বিচারপতি আবদুর রশিদ লিখলেন, ‘২০০৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নবম সংসদ নির্বাচনের তারিখকে অসংগত বলা যায় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারার প্রতিকার নবম সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের হাতেই রাখা যায়।’ কিন্তু তাঁরা প্রতিকার দেননি।
ভোটার তালিকার ত্রুটি ও বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর মতো একটি মামুলি সংশোধনীর জন্য সেদিন আমরা বিএনপি ও জামায়াতকে তুলাধোনা করেছি। আমরা লিখেছি, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন মানি না। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচনের ফল মানব না। বলেছি সমঝোতা বড়, সংবিধান নয়। এখন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। রানা প্লাজার মতো ছয়তলার সংবিধানের ফাউন্ডেশনে নয়তলা উঠছে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি পি. সত্যশিবম নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চ গত ২৭ সেপ্টেম্বর না ভোট মামলায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ‘না’ ভোট আমাদের দুই দলের সম্মতিতে বাতিল হয়েছে। কী পরিহাস, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম নিয়েছেন। এখন তাঁদের রায়টা তথ্যনিষ্ঠ হলো না। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশেও ‘না’ ভোট আছে।
‘না’ ভোট যাতে কলকি না পায় সে জন্য কংগ্রেস সরকারের পক্ষে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে ভোট মৌলিক অধিকার নয়। তাই আইনে যেভাবে বলে দেওয়া হবে, সেভাবেই জনগণ ভোট দেবে। তাই না ভোট দেওয়ার অধিকার নাগরিকের নেই। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সাফ বলেছেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো।
জাতিসংঘের দুটি সনদের আলোকেও বলা যায়, দশম সংসদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নের জোরটা আরও বেশি। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ২১ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি হচ্ছে জনগণের অভিপ্রায়। তাদের এই অভিপ্রায় নির্দিষ্ট সময়ের বিরতিতে অনুষ্ঠেয় এবং প্রকৃত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হবে।’ এর লঙ্ঘন ঘটছে। ‘প্রকৃত নির্বাচন’ বলতে কী বোঝায়, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। ‘নির্বাচন হবে সর্বজনীন এবং সাম্যতাপূর্ণ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। এবং এটা অনুষ্ঠিত হবে গোপন ভোটে কিংবা এর সমতুল্য কোনো অবাধ ভোট প্রদানের প্রক্রিয়ায়।’ গায়ের জোরে ৫ জানুয়ারি পার করলে ওই শর্ত পূরণ হবে না।
জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংবলিত আন্তর্জাতিক সনদের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের ভোট প্রদানের এবং নিজের নির্বাচিত হওয়ার সম-অধিকার আছে। নির্দিষ্ট সময়ান্তর প্রকৃত নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন হতে হবে গোপন ব্যালটে। ভোটারদের অবাধ ও মুক্ত চিন্তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।’
১৩তম সংশোধনী বাতিল ও বিএনপির সহিংস কর্মসূচির কারণে এই সনদ প্রয়োগে নাগরিকেরা সুযোগই পায়নি। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন ভাগাভাগির বিষয়ে স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে যে তিনি ওই সনদগুলোর কার্যকারিতাই স্বীকার করেন না। তিনি কী করে বলতে পারলেন, ‘সর্বদলীয় সরকারে’ বিএনপি এলে তিনি তাদের সঙ্গেও আসন ভাগাভাগি করতে পারতেন! ভারতের প্রধান বিচারপতি সত্যশিবম ২৭ সেপ্টেম্বরে যা লিখেছেন, তা বাংলাদেশ নির্বাচনে ভারতের এবারের অবস্থানকে হরবোলা পাখির মতোই ভেংচি কাটছে। তাঁর নির্জলা সত্য উচ্চারণ, ‘এই বিষয়ে কোনোক্রমেই দুই ধরনের অভিমত হতে পারে না যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই একটি দেশে সুস্থ গণতন্ত্রের বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে। সুষ্ঠু বা ফেয়ার কথাটি সব জনগণের সমসুবিধা নিশ্চিত করে। সর্বজনীন ভোটাধিকারকে সংবিধান যেভাবে ভারতের জনগণের ওপর ন্যস্ত করেছে এবং এর ফলে লাখ লাখ নাগরিক ভোট দিতে পারছে এবং এভাবে তারা ভারতীয় প্রজাতন্ত্র শাসনে অংশ নিচ্ছে।’ কিন্তু বাংলাদেশে ভোটের নামে যা সব হচ্ছে, তাতে জনগণের দেশ শাসনে অংশ নেওয়া হবে না।
ওই মামলাতেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যা বলেছেন তা মানলে আমাদেরও মানতে হবে, ৫ জানুয়ারি সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের যুক্তি, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো এবং এই কাঠামোর মধ্যে একজন ভোটারের কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটাধিকার প্রদানের অধিকার অন্তর্ভুক্ত।’ চার শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও নাশকতা প্রমাণ দিচ্ছে দশম সংসদ এই শর্ত পূরণ করতে যাচ্ছে না। এই সংসদ তাই কাগুজে সংসদ।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
mrkhanbd@gmail.com
No comments