আওয়ামী লীগ কি বিএনপির পথেই হাঁটছে? by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার
বাংলাদেশের
গণতান্ত্রিক ইতিহাস বেশ পুরনো। সংঘাতে না জড়িয়ে সমঝোতার মাধ্যমে
শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজার ইতিহাসও বেশ গৌরবের। বাংলার প্রথম
সার্বভৌম শাসক শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে যে মাৎস্যন্যায় বা
অরাজকতার যুগের সূচনা হয়েছিল, তার সমাপ্তির মধ্যেই ওই গৌরবের ইতিহাস
লুকায়িত আছে। ঐতিহাসিক লামা তারানাথ অরাজকতার যুগের অবসানের ইতিহাস আলোকপাত
করতে গিয়ে বলেছেন, ‘...দেশের রাজা নির্বাচিত হতেন। কিন্তু শেষের দিকের
একজন নির্বাচিত রাজার রানী প্রত্যেক নির্বাচিত রাজাকে রাতে হত্যা করতেন।
কয়েক বছর পর এইরূপ কিছুদিনের জন্য নির্বাচিত রাজা গোপাল এই রানীর হাত থেকে
মুক্তি লাভ করেন (অর্থাৎ রানীকে হত্যা করেন এবং স্থায়ী রাজা নির্বাচিত
হন)।’ তারানাথের ওই কাহিনীটি মোটামুটি সত্য বলে খ্যাতিমান আরেক ঐতিহাসিক
রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস : প্রাচীন যুগ’ গ্রন্থে মত
প্রকাশ করেছেন। ঐতিহাসিক লামা তারানাথের ‘নির্বাচন’ শব্দটির ব্যবহারই এই
ইঙ্গিত দেয় যে, ওই যুগে বাংলাতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত ছিল এবং শাসক
কে হবেন তা নির্বাচনের মাধ্যমেই ঠিক করা হতো। রাজা গোপালের নির্বাচনও সেই
কথারই প্রমাণ দেয়। আর যদি রানী কর্তৃক রাজাকে হত্যার ঘটনাকে সত্য হিসেবে
ধরে নেই; তবে ওই ঘটনাতে আমাদের বর্তমান রাজনীতিক ও কথিত তৃতীয় শক্তির জন্য
শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। একের পর এক রাজা নির্বাচিত করা হচ্ছে। আর রানী সবাইকে
হত্যা করছেন। কিন্তু এই অরাজকতার পরিপ্রেক্ষিতে সিংহাসনে শূন্যতার সুযোগে
অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করেনি অথবা বাঙালিরা নির্বাচিত রাজা
হত্যার শিকার হলেও নির্বাচন থেকে সরে এসে অন্য কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করেনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই উত্তর আধুনিক যুগে এসে আমরা রাজনৈতিক সংকটে আশংকা
প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি যে, যদি দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা না হয়;
তবে কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করবে। তা’হলে কি এই
প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াটা অযৌক্তিক যে, অরাজকতার যুগেও বাংলার গণতন্ত্র
যতটুকু শক্তিশালী ছিল; আজ তাও নেই?
বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্রের পথচলা মসৃণ নয়; তাই প্রধান দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থান আমাদের আতংকিত করে। এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, আমাদের মধ্যে ওই আতংক কে বা কারা তৈরি করেছে? কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তিই কি এর জন্য দায়ী? ইতিহাস বলে, বারবার গণতন্ত্রের বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য অগণতান্ত্রিক শক্তি দায়ী নয়; এর জন্য ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’... বলে সারা দিন জিকির করা রাজনৈতিক শক্তিই দায়ী। তাদের অগণতান্ত্রিক মানসিকতাই বারবার এ দেশের গণতন্ত্রের পথ চলাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তাদের মধ্যে অনৈক্যই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে বা সুযোগ করে দিয়েছে।
রাজা গোপালের কথাই ধরি না কেন! তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও রাজদণ্ড হাতে নিয়েই উত্তরাধিকারী মনোনয়ন পদ্ধতি চালু করেন। তিনি গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রেরও পথে হাঁটেন। ফলে পালদের প্রায় চারশ’ বছরের শাসনামলে বাংলার আর কোনো শাসককে আমরা নির্বাচিত হতে দেখিনি। সবাই অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ক্ষমতার মসনদে বসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, আমরা বিরোধী দলে থাকতে ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’... বলে চেঁচামেচি করলেও ক্ষমতায় যাওয়া মাত্রই আওয়াজ পাল্টে ফেলি। সংবিধান প্রেমে মগ্ন হই! নিজেদের প্রয়োজন মতো সংবিধান সংশোধন করে নেই। আইন প্রণয়ন করি। একবার ক্ষমতার স্বাদ পেলে আর ক্ষমতা ছাড়তে চাই না। গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক যে কোনো উপায়েই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকা চাই। ফলে সদ্য বিদায়ী সরকার আর সদ্য নির্বাচিত সরকারের কাজ-কর্মে কোনো পার্থক্য থাকে না। প্রাচীন বাংলার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক গোপালের মানসিকতার প্রতিছবিই যেন সেখানে উদ্ভাসিত হয়।
বাংলার যুগ যুগান্তরের ইতিহাস বলে, ক্ষমতা সর্বদা শাসককে গোপালে পরিণত করেছে। শাসকদের মধ্যে অগণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল হয়তো অনেক কারণে। কিন্তু প্রধান কারণ ছিল, পাকিস্তানিদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাব। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও মানসিকতার দিক থেকে ছিলেন অগণতান্ত্রিক। তাই তিনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করুন তা মনেপ্রাণে চাননি। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানও ওই পথেই হেঁটেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে শাসন ক্ষমতা না দিয়ে সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফল শুভ হয়নি। এই ইতিহাস প্রায় সবার জানা। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় কয়জনে! বাঙালিরাও নেয়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হলেও ওই যুক্তিযুদ্ধের বহু সেনানীই অগণতান্ত্রিক পথে হেঁটেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে।
সামরিক শাসনের কথা না হয় বাদই দিলাম। জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সব আচরণই সব সময়ই কি গণতান্ত্রিক ছিল? সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন, ১৯৭৫-এর কথাই যদি ধরি, ওই আইন কতটুকু গণতান্ত্রিক ছিল? ওই সংশোধীনতে শুধু একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বলা হয়েছিল তা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী নয়? আজ যারা সংবিধানের জন্য মায়াকান্না করছেন, গণতন্ত্রের জন্য অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য মাতম করছেন, তারা সেদিনও ছিলেন, কিন্তু তারা কি সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন? দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কথা বলেছিলেন? কেন জানি সেদিন তাদের চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তাই সেদিন সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুকে নির্মম ছুরি চালানো হলেও তারা আওয়াজ তোলা তো দূরের কথা, ‘উহ’ শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করেনি। খুব জানতে ইচ্ছে করে, গণতন্ত্রের কথিত ফেরিওয়ালাদের সংবিধান প্রেম সেদিন কোথায় ছিল?
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুই দলের অনড় অবস্থানে এ দেশের গণতন্ত্রিক ব্যবস্থা অনিশ্চিতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এখন সাধারণ মানুষের সরকারি দলের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা উচিত, যে ক্ষতি বর্তমান সরকারি দল বিরোধী দলে থাকতে করেছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল পালনের মাধ্যমে। ওই দাবি যে গণতান্ত্রিক ছিল না সেই বোধোদয় কেন এতদিন পরে হল সেই প্রশ্নেরও জবাব চাওয়া উচিত। ওই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করতে গিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের হরতালে যেসব নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছিল, তাদের পরিবারের কাছেও বর্তমান সরকারি দলের ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু জানি, এ দেশে রাজনীতিকদের কথাই শেষ কথা। তাই ওই সব ক্ষতিপূরণ সাধারণ জনগণ পাবে না। ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বরং জনগণকে সর্বদা শিল আর পাটার ঘষাঘষির মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারাতে হবে, এটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
জনগণের উচিত আজ সরকারি দলের নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নেয়া যে, আগামীতে যদি আপনি বিরোধী দলে যান, তবে তখনকার সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনে যাবেন কিনা সেই বিষয়টি। নাকি আপনি আগের মতো আপনার প্রতিশ্র“তি (‘আমরা বিরোধী দলে গেলেও হরতাল দেব না’) থেকে সরে আসবেন সেই বিষয়েও। অন্যদিকে বর্তমান বিরোধী দলের নেতার কাছ থেকেও জনগণকে এই প্রতিশ্র“তি আদায় করে নিতে হবে যে, আপনারা যদি ক্ষমতায় যেতে পারেন; তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন ইত্যাদি। আমরা আর দুই দলের মাঝখানে পড়ে কচুকাটা হতে চাই না। আমরা দুই দণ্ড শান্তি চাই। দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চাই। আমরা এ দেশের উন্নয়ন অবশ্যই চাই। কিন্তু গণতন্ত্রকে বিকিয়ে দিয়ে নয়। তবে ওই গণতন্ত্রও চাই না, যে গণতন্ত্রে শিশু মনিরকে পিতার সামনেই পুড়ে অঙ্গার হতে হয়। প্রতিদিন পুলিশের গুলিতে নিরীহ মানুষের প্রাণ যায় অথবা হরতালের নামে জ্বালাও-পোড়াও, ককটেল ফাটিয়ে সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করা হয়। পরিশেষে, এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই সত্য উদ্ভাসিত হবে যে, আজ সরকারি দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যা বলছে, সেই কথাই আমরা ১৯৯৬ সালে বিএনপিকে বলতে শুনেছি। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ যা বলেছে, আজ বিএনপি সেই কথাই বলছে। সেদিনও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ হরতাল, মানববন্ধন, মিছিল-সভা-সমাবেশ, জ্বালাও-পোড়াও করেছে। আজ বিএনপিও তাই করছে। তারা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে হরতাল, সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। সেদিন বিএনপি ১৫ ফেব্র“য়ারির একদলীয় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। আজ আওয়ামী লীগ অফিসে মনোনয়ন উৎসব, সর্বদলীয় সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশনের তোড়জোড় দেখে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকারও সেই পথেই হাঁটছে।
মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্রের পথচলা মসৃণ নয়; তাই প্রধান দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থান আমাদের আতংকিত করে। এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, আমাদের মধ্যে ওই আতংক কে বা কারা তৈরি করেছে? কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তিই কি এর জন্য দায়ী? ইতিহাস বলে, বারবার গণতন্ত্রের বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য অগণতান্ত্রিক শক্তি দায়ী নয়; এর জন্য ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’... বলে সারা দিন জিকির করা রাজনৈতিক শক্তিই দায়ী। তাদের অগণতান্ত্রিক মানসিকতাই বারবার এ দেশের গণতন্ত্রের পথ চলাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তাদের মধ্যে অনৈক্যই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে বা সুযোগ করে দিয়েছে।
রাজা গোপালের কথাই ধরি না কেন! তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও রাজদণ্ড হাতে নিয়েই উত্তরাধিকারী মনোনয়ন পদ্ধতি চালু করেন। তিনি গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রেরও পথে হাঁটেন। ফলে পালদের প্রায় চারশ’ বছরের শাসনামলে বাংলার আর কোনো শাসককে আমরা নির্বাচিত হতে দেখিনি। সবাই অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ক্ষমতার মসনদে বসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, আমরা বিরোধী দলে থাকতে ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’... বলে চেঁচামেচি করলেও ক্ষমতায় যাওয়া মাত্রই আওয়াজ পাল্টে ফেলি। সংবিধান প্রেমে মগ্ন হই! নিজেদের প্রয়োজন মতো সংবিধান সংশোধন করে নেই। আইন প্রণয়ন করি। একবার ক্ষমতার স্বাদ পেলে আর ক্ষমতা ছাড়তে চাই না। গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক যে কোনো উপায়েই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকা চাই। ফলে সদ্য বিদায়ী সরকার আর সদ্য নির্বাচিত সরকারের কাজ-কর্মে কোনো পার্থক্য থাকে না। প্রাচীন বাংলার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক গোপালের মানসিকতার প্রতিছবিই যেন সেখানে উদ্ভাসিত হয়।
বাংলার যুগ যুগান্তরের ইতিহাস বলে, ক্ষমতা সর্বদা শাসককে গোপালে পরিণত করেছে। শাসকদের মধ্যে অগণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল হয়তো অনেক কারণে। কিন্তু প্রধান কারণ ছিল, পাকিস্তানিদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাব। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও মানসিকতার দিক থেকে ছিলেন অগণতান্ত্রিক। তাই তিনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করুন তা মনেপ্রাণে চাননি। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানও ওই পথেই হেঁটেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে শাসন ক্ষমতা না দিয়ে সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফল শুভ হয়নি। এই ইতিহাস প্রায় সবার জানা। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় কয়জনে! বাঙালিরাও নেয়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হলেও ওই যুক্তিযুদ্ধের বহু সেনানীই অগণতান্ত্রিক পথে হেঁটেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে।
সামরিক শাসনের কথা না হয় বাদই দিলাম। জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সব আচরণই সব সময়ই কি গণতান্ত্রিক ছিল? সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন, ১৯৭৫-এর কথাই যদি ধরি, ওই আইন কতটুকু গণতান্ত্রিক ছিল? ওই সংশোধীনতে শুধু একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বলা হয়েছিল তা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী নয়? আজ যারা সংবিধানের জন্য মায়াকান্না করছেন, গণতন্ত্রের জন্য অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য মাতম করছেন, তারা সেদিনও ছিলেন, কিন্তু তারা কি সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন? দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কথা বলেছিলেন? কেন জানি সেদিন তাদের চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তাই সেদিন সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুকে নির্মম ছুরি চালানো হলেও তারা আওয়াজ তোলা তো দূরের কথা, ‘উহ’ শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করেনি। খুব জানতে ইচ্ছে করে, গণতন্ত্রের কথিত ফেরিওয়ালাদের সংবিধান প্রেম সেদিন কোথায় ছিল?
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুই দলের অনড় অবস্থানে এ দেশের গণতন্ত্রিক ব্যবস্থা অনিশ্চিতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এখন সাধারণ মানুষের সরকারি দলের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা উচিত, যে ক্ষতি বর্তমান সরকারি দল বিরোধী দলে থাকতে করেছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল পালনের মাধ্যমে। ওই দাবি যে গণতান্ত্রিক ছিল না সেই বোধোদয় কেন এতদিন পরে হল সেই প্রশ্নেরও জবাব চাওয়া উচিত। ওই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করতে গিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের হরতালে যেসব নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছিল, তাদের পরিবারের কাছেও বর্তমান সরকারি দলের ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু জানি, এ দেশে রাজনীতিকদের কথাই শেষ কথা। তাই ওই সব ক্ষতিপূরণ সাধারণ জনগণ পাবে না। ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বরং জনগণকে সর্বদা শিল আর পাটার ঘষাঘষির মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারাতে হবে, এটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
জনগণের উচিত আজ সরকারি দলের নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নেয়া যে, আগামীতে যদি আপনি বিরোধী দলে যান, তবে তখনকার সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনে যাবেন কিনা সেই বিষয়টি। নাকি আপনি আগের মতো আপনার প্রতিশ্র“তি (‘আমরা বিরোধী দলে গেলেও হরতাল দেব না’) থেকে সরে আসবেন সেই বিষয়েও। অন্যদিকে বর্তমান বিরোধী দলের নেতার কাছ থেকেও জনগণকে এই প্রতিশ্র“তি আদায় করে নিতে হবে যে, আপনারা যদি ক্ষমতায় যেতে পারেন; তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন ইত্যাদি। আমরা আর দুই দলের মাঝখানে পড়ে কচুকাটা হতে চাই না। আমরা দুই দণ্ড শান্তি চাই। দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চাই। আমরা এ দেশের উন্নয়ন অবশ্যই চাই। কিন্তু গণতন্ত্রকে বিকিয়ে দিয়ে নয়। তবে ওই গণতন্ত্রও চাই না, যে গণতন্ত্রে শিশু মনিরকে পিতার সামনেই পুড়ে অঙ্গার হতে হয়। প্রতিদিন পুলিশের গুলিতে নিরীহ মানুষের প্রাণ যায় অথবা হরতালের নামে জ্বালাও-পোড়াও, ককটেল ফাটিয়ে সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করা হয়। পরিশেষে, এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই সত্য উদ্ভাসিত হবে যে, আজ সরকারি দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যা বলছে, সেই কথাই আমরা ১৯৯৬ সালে বিএনপিকে বলতে শুনেছি। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ যা বলেছে, আজ বিএনপি সেই কথাই বলছে। সেদিনও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ হরতাল, মানববন্ধন, মিছিল-সভা-সমাবেশ, জ্বালাও-পোড়াও করেছে। আজ বিএনপিও তাই করছে। তারা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে হরতাল, সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। সেদিন বিএনপি ১৫ ফেব্র“য়ারির একদলীয় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। আজ আওয়ামী লীগ অফিসে মনোনয়ন উৎসব, সর্বদলীয় সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশনের তোড়জোড় দেখে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকারও সেই পথেই হাঁটছে।
মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments