সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে
গতকাল নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সমঝোতার প্রয়াস কি শেষ হয়ে গেল? নির্বাচনটি কি সব দলের অংশগ্রহণে হবে? এ নিয়ে দুই শিক্ষাবিদের মতামত প্রকাশ করা হলো: সময় বেশি নেই। সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। সমঝোতার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি তৎপরতাও রয়েছে। নির্বাচনের পথেই যে সরকার এগোচ্ছে, তার প্রমাণ নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে এই সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা আসেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সরকার ও বিরোধী দলের সমঝোতার সুযোগ শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করি না। সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে। আমরা আশা করি, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থেই তাদের নির্বাচনে আসা উচিত। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মধ্যে দোদুল্যমানতা লক্ষণীয়। তারা কখনো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে, কখনো অন্তর্বর্তী সরকারে ৫+৫ সমতার কথা বলছে, আবার কখনো বলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে হবে। আসলে নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে দুটি ধারা রয়েছে।
একটি অংশ নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষপাতী, কেননা তারা মনে করে, মাঠ তাদের অনুকূলে আছে। কিন্তু জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল অংশটি নির্বাচন না করে রাজপথে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা কিংবা অন্য কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া নিজেকে আপসহীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও তিনি সরাসরি স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ দিয়ে চলেছেন। নির্বাচন ছাড়া বিএনপির সামনে কী পথ খোলা আছে? বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা পুরোপুরি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূলে। এখানে স্বাধীন গণমাধ্যম আছে, নাগরিক সমাজ আছে, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা আছেন। অতএব, কারও পক্ষেই আশির ও নব্বইয়ের দশকের মতো পাতানো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। বর্তমান সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সব কটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, সেসব নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। এমনকি একাধিক উপনির্বাচন ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীরাও জয়ী হয়েছেন। সর্বশেষ গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীরা অনেক ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। অতএব, বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই করা। বর্তমান সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনে কারচুপি হয়নি। কিন্তু কারচুপির আশঙ্কা আছে—এ অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি কিংবা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনাকে সরে যেতে বলা যুক্তিসংগত হতে পারে না।
আওয়ামী লীগ আমলে যেহেতু মাগুরা, মিরপুর কিংবা ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো নির্বাচন হয়নি, সেহেতু বিএনপি সরকারের ওপর পলিসি ডিকটেট করতে পারে না। তাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতি আর ১৯৯৬ সালের পরিস্থিতি এক নয়। সে সময় বিএনপি ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করেছে। কিন্তু আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলেও জাতীয় পার্টি, ১৪ দলসহ অনেক রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। ১৯৯৬ সালে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে বিরোধী দল যে ৬০ ঘণ্টা ও ৮৪ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে, তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। এমনকি দলের নেতা-কর্মীরাও মাঠে নামেননি। কেবল বোমা মেরে, ককটেল ফাটিয়ে বা গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়, আন্দোলন সফল করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ না করা ভুল সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। কেননা, প্রধানমন্ত্রী একটি প্রতিষ্ঠান। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকলেও আমি একই কথা বলতাম। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ রক্ষা করলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতেন।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। এরশাদ ও মহাজোটের অন্য শরিকেরা সেই উপলব্ধি থেকেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে—এই অযৌক্তিক দাবিতে বিএনপি অনড় থাকলে কিংবা নির্বাচন বর্জন করলে সেটি হবে তাদের জন্য আত্মঘাতী। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করে বা না করে নির্বাচনে আসুক, সেটাই সবার প্রত্যাশা। জাতীয় স্বার্থ, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যেই বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। সরকারেরও উচিত হবে বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের চেষ্টা করা। যেমন নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা, নির্বাচনের সময়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা। বিএনপি যদি নির্বাচনকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দাবি করে, সরকারের উচিত হবে সেগুলো তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া। বিএনপির নেতৃত্বকে এ কথাও মনে রাখতে হবে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচনটি আটকে থাকবে না। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তাদের অন্য কোনো এজেন্ডা নেই।
অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ: উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ: উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments