পাড়াপড়শীর ঘুম নেই by ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া
দুঃখজনক
হলেও সত্য, দেশে গত ২২ বছরেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
নির্বাচন এলেই শুরু হয় রাজনৈতিক ঝড় আর এতে প্রাণ যায় মানুষের। কেন এমনটি
হচ্ছে? কারণ একটাই- ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়া, তা যে কোনো উপায়েই হোক
না কেন। কী এর উদ্দেশ্য? জনকল্যাণ নাকি ব্যক্তি/গোষ্ঠীর কল্যাণ? যদিও বলা
হয়, সব কিছু করা হয় জাতির মঙ্গলের প্রয়োজনে। দু’দলই জাতির মঙ্গল করার সুযোগ
চায়। তবে এ কথাও সত্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ এগিয়েছে দু’দলের সময়েই।
তাই আমরা সামাজিক ও মানব উন্নয়নের সূচকে প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে অনেক
এগিয়েছি। এখন আমাদের প্রয়োজন টেকসই ও প্রকৃত গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস। আর
ক্ষমতার মোহমুক্তি। যদিও সব কিছুই হয় Of the people, by the people, for
the people-এর নামে, কিন্তু অন্তরে লালিত হয় এবং বাস্তবে প্রয়োগ হয় Off the
people, buy the people, far the people-এর গণতন্ত্র।
যুগান্তরে ৮ নভেম্বর ‘একমত হতে পারছেন না বিদেশীরা’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। দেশ আমাদের, নির্বাচন আমাদের, ভোট দেবে আমাদের জনগণ, কিন্তু একমত হতে পারছেন না পাড়াপড়শীরা। বর্তমান পৃথিবীকে বলা হয় গ্লোবাল-ভিলেজ। তাই যুক্তরাষ্ট্রকেও পড়শীদের অন্তর্ভুক্ত করছি। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পড়শী পর্যায়ে জাপান-কোরিয়া-চীন কিংবা গ্লোবাল-ভিলেজের একক ক্ষমতার মালিক যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের কিছু সুপরামর্শ দেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী ভারতও যেহেতু বাংলাদেশের জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং মূল প্রতিবেশী, তাই তাদের পরামর্শও নেয়া যেতে পারে। অবশ্য ভারতও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কিছুটা যুক্ত হয়েছে। তবে তারা ইদানীং অনেক বেশি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকার নিয়ে। সম্প্রতি ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার আয়োজিত ‘বাংলাদেশ : প্রোস্পেক্ট অব ডেমোক্রেটিক কনসলিডেশন’ বিষয়ক এক সেমিনারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সেখানে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সংবিধান নিয়েই চলছে যত তর্ক এবং বিরোধী দলের আপত্তি, যা সংঘাতের বড় কারণ। ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সাহায্যকারী বন্ধু। বাংলাদেশে যদি কোনো ধরনের জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করে, সেটা ভারতের কিছু অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। যদিও ভারতের সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে মাওবাদসহ কাশ্মীরে বহু বছর ধরে চলছে অস্থিতিশীলতা। এছাড়া কোনো কোনো সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ভারতের জন্য অস্বস্তিদায়ক। তাছাড়া ভারতের রয়েছে পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে বিদেশী মদদে আক্রান্ত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা। ফলে ভারত কোনোভাবেই চাইবে না বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠুক। কিন্তু এর অন্য পিঠে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিবেশ ও জনগণ। তাদের ভাবনাচিন্তা কিংবা ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার। এটা অবশ্যই সত্য যে, বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ জঙ্গিবাদ উত্থানের বিরোধী, কারণ এটা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা যেমন- তিস্তা ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে অস্পষ্টতা, সীমান্ত হত্যা, রামপালে যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রতিবেশ-পরিবেশের ওপর প্রভাব। আর ফারাক্কার প্রভাব তো এক সময়ের প্রবল প্রমত্ত পদ্মায় শুকনো মৌসুমে গাড়ি চলাচল করতে দেখে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়াই বোঝা যায়। দুঃখজনক যে, এ সরকারের সময়েও এগুলো মীমাংসিত হয়নি। পাশাপাশি ভারতেরও রয়েছে কিছু অভিযোগ। বন্ধুত্ব টিকে থাকে পারস্পরিক সহমর্মিতায়। এক্ষেত্রে ভারতকে বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে কেউ কারও কাছ থেকে আলাদা নয়। পারস্পরিক প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের যে কোনো ইতিবাচক ভূমিকাকে স্বাগত জানাব। ভারতের থিংক ট্যাঙ্কদের মধ্য থেকেই এ বক্তব্য এসেছে যে ‘একা বড় হওয়া যায় না’। অন্যদিকে আমেরিকা বহু বছর ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার। তারা জঙ্গিবাদের ভয়ে ভীত। এ ভয় যেমন রয়েছে আমেরিকা-ভারতের, তেমনি রয়েছে সৌদি আরব কিংবা বাংলাদেশের। ফলে অনেকগুলো ফ্রন্ট বিভিন্ন দেশে খুলতে হয়েছে আমেরিকার, তৈরি করেছে অনেক শত্র“। এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ঠাণ্ডা যুদ্ধোত্তর বিশ্ব ব্যবস্থায় একক আধিপত্য বজায় রাখার বিষয়টি। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অনেক দেশের কাছে। বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ- গ্যাস ব্লক ইজারা, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তিত করে তুলেছে। ভাবিয়ে তুলেছে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌশক্তির প্রভাব এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজে চীনের উপস্থিতিও। গোয়াদরের অবস্থান পারস্য উপসাগরের মুখে এবং সেখান থেকে সহজেই হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ ছাড়া ইরানের সঙ্গেও রয়েছে চীনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক। অন্যদিকে শ্রীলংকার কলম্বোতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন, যেটি আগস্টে উদ্বোধন করা হয়। ২০১২ সালে দক্ষিণ শ্রীলংকার হাম্বানটোটা শহরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করেছে চীন। তিব্বতের নিকটবর্তী শহর নেপালের লারছাতে চীন ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি স্থলবন্দর নির্মাণ করছে। অন্যদিকে মিয়ানমারে রয়েছে চীনের প্রবল প্রভাব। ফলে ঠাণ্ডা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী বন্ধন ভেঙে যুগের চাহিদায় নির্মিত হয়েছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী, যা সামরিক-বেসামরিক সব ক্ষেত্রেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এ ছাড়াও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অবস্থান তাদের এক সঙ্গে আসতে সাহায্য করেছে। কারণ দুটি দেশই সন্ত্রাসবাদের শিকার। ফলে একে অন্যের সহযোগী। মতদ্বৈততা যে হয় না তা নয়। কিন্তু পেশাদারিত্ব ও দেশের স্বার্থে ভারত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ আবেগনির্ভর কূটনীতির কারণে ও পেশাদারিত্বের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতার দায় ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে লাভ নেই, প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও পেশাদারিত্বের। যা হোক, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্ব অনেকটাই সুদৃঢ়। অনেক বিষয়েই দু’দেশ একমত। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র আর কর্তৃত্ব দিতে চাচ্ছে না ভারতকে। যুগান্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্তকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আস্তে আস্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়ায় ভারতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে চাইছে না দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান নেয়ার নেপথ্যে ভারতের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের বিরাট অংকের টাকার অস্ত্র ক্রয়, ফ্রান্স থেকে ভারতের অস্ত্র ক্রয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান থেকে ভারতের তেল ক্রয়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাম্প্রতিককালে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতানৈক্য হয়।’ অবশ্য আরেক সংবাদ অনুযায়ী, ড্যান মজিনা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন। মন্তব্যটিকে আমরা দু’ভাবে নিতে পারি- এক. নিছক কূটনৈতিক মন্তব্য; দুই. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর তার সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একত্রে কাজ করার নির্দেশনা। ভারতের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন টেকসই গণতন্ত্র, দেশপ্রেম ও পেশাদার আমলাতন্ত্র। এ ছাড়াও ভারত তার প্রভাব মার্কিন সরকার পর্যন্ত গড়িয়েছে। ভারতীয়-আমেরিকান নাগরিকরা আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ফলে তারা ভারতের স্বার্থ কিছুটা হলেও দেখবে বৈকি!
অন্য এক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশ বিষয়ে একমত। পাকিস্তানের কথা বলব না, কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে পাকিস্তানের প্রভাব নেই বললেই চলে। আর পাকিস্তান মার্কিন বলয়ভুক্ত দেশ, যদিও সে দক্ষতায় চীনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তদুপরি দেশটি জঙ্গিবাদের কারণে নিজেই পর্যুদস্ত। আর সৌদি আরব যদিও বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে, তথাপিও মার্কিন বলয়ের বাইরের কোনো দেশ নয়। যদিও সাম্প্রতিককালে নিরাপত্তা পরিষদে সদস্যপদ নেয়া-না নেয়া নিয়ে মার্কিনিদের সঙ্গে মনোমালিন্য চলছে, মূলত ইরান দমনে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কার্যকর ভূমিকা দেখতে না পাওয়ায় এই মান-অভিমান। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু করার নেই সৌদি রাজপরিবারের। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গেও সৌদি সম্পর্ক ভালো। কয়েক বছর আগে সৌদি বাদশাহ ভারত সফর করেছেন, করেছেন বিভিন্ন চুক্তি। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এবারের নির্বাচনী অচলাবস্থা নিয়ে প্রথমবারের মতো মন্তব্য করেছে চীন, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। চীন বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং সামরিক দিক থেকেও অন্যতম শক্তি। ফলে সে তার প্রভাববলয় আরও বৃদ্ধি করবে বিশেষভাবে এশিয়ায়, আর এটাই স্বাভাবিক। যা হোক, আমেরিকা, ভারত, চীন কিংবা সৌদি আরবের মধ্যে যতই বন্ধুত্ব কিংবা শত্র“তা থাকুক, বাংলাদেশের বিষয়টিকে তারা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইবে এবং ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে।
দেশ আমাদের, এর ভালো-মন্দ দুটোই নির্ভর করছে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের ওপর। একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেশকে এগিয়ে নেবে। পাড়াপড়শীদেরও এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। ভারতে যেমন কখনও ভাবা যায় না অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন, বাংলাদেশেও আমরা চাই একটি গণতান্ত্রিক ইনক্লুসিভ নির্বাচন। যাতে আমরাও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি। আর যে ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অনেক রাষ্ট্রই কনসার্ন আমাদের বিষয়ে, সেটাকে দক্ষতা-যোগ্যতা-প্রজ্ঞার মাধ্যমে ব্যবহার করে নেতারা আত্মনির্ভরশীল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবেন। আর আস্থা অর্জন করবেন জনগণের। প্রয়োজনে বিদেশী বন্ধুদের পরামর্শ নেবেন, কিন্তু ভরসা রাখবেন নিজ দেশ ও জাতির ওপর। সবার উপরে দেশ।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যুগান্তরে ৮ নভেম্বর ‘একমত হতে পারছেন না বিদেশীরা’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। দেশ আমাদের, নির্বাচন আমাদের, ভোট দেবে আমাদের জনগণ, কিন্তু একমত হতে পারছেন না পাড়াপড়শীরা। বর্তমান পৃথিবীকে বলা হয় গ্লোবাল-ভিলেজ। তাই যুক্তরাষ্ট্রকেও পড়শীদের অন্তর্ভুক্ত করছি। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পড়শী পর্যায়ে জাপান-কোরিয়া-চীন কিংবা গ্লোবাল-ভিলেজের একক ক্ষমতার মালিক যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের কিছু সুপরামর্শ দেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী ভারতও যেহেতু বাংলাদেশের জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং মূল প্রতিবেশী, তাই তাদের পরামর্শও নেয়া যেতে পারে। অবশ্য ভারতও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কিছুটা যুক্ত হয়েছে। তবে তারা ইদানীং অনেক বেশি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকার নিয়ে। সম্প্রতি ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার আয়োজিত ‘বাংলাদেশ : প্রোস্পেক্ট অব ডেমোক্রেটিক কনসলিডেশন’ বিষয়ক এক সেমিনারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সেখানে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সংবিধান নিয়েই চলছে যত তর্ক এবং বিরোধী দলের আপত্তি, যা সংঘাতের বড় কারণ। ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সাহায্যকারী বন্ধু। বাংলাদেশে যদি কোনো ধরনের জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করে, সেটা ভারতের কিছু অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। যদিও ভারতের সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে মাওবাদসহ কাশ্মীরে বহু বছর ধরে চলছে অস্থিতিশীলতা। এছাড়া কোনো কোনো সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ভারতের জন্য অস্বস্তিদায়ক। তাছাড়া ভারতের রয়েছে পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে বিদেশী মদদে আক্রান্ত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা। ফলে ভারত কোনোভাবেই চাইবে না বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠুক। কিন্তু এর অন্য পিঠে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিবেশ ও জনগণ। তাদের ভাবনাচিন্তা কিংবা ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার। এটা অবশ্যই সত্য যে, বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ জঙ্গিবাদ উত্থানের বিরোধী, কারণ এটা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা যেমন- তিস্তা ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে অস্পষ্টতা, সীমান্ত হত্যা, রামপালে যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রতিবেশ-পরিবেশের ওপর প্রভাব। আর ফারাক্কার প্রভাব তো এক সময়ের প্রবল প্রমত্ত পদ্মায় শুকনো মৌসুমে গাড়ি চলাচল করতে দেখে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়াই বোঝা যায়। দুঃখজনক যে, এ সরকারের সময়েও এগুলো মীমাংসিত হয়নি। পাশাপাশি ভারতেরও রয়েছে কিছু অভিযোগ। বন্ধুত্ব টিকে থাকে পারস্পরিক সহমর্মিতায়। এক্ষেত্রে ভারতকে বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে কেউ কারও কাছ থেকে আলাদা নয়। পারস্পরিক প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের যে কোনো ইতিবাচক ভূমিকাকে স্বাগত জানাব। ভারতের থিংক ট্যাঙ্কদের মধ্য থেকেই এ বক্তব্য এসেছে যে ‘একা বড় হওয়া যায় না’। অন্যদিকে আমেরিকা বহু বছর ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার। তারা জঙ্গিবাদের ভয়ে ভীত। এ ভয় যেমন রয়েছে আমেরিকা-ভারতের, তেমনি রয়েছে সৌদি আরব কিংবা বাংলাদেশের। ফলে অনেকগুলো ফ্রন্ট বিভিন্ন দেশে খুলতে হয়েছে আমেরিকার, তৈরি করেছে অনেক শত্র“। এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ঠাণ্ডা যুদ্ধোত্তর বিশ্ব ব্যবস্থায় একক আধিপত্য বজায় রাখার বিষয়টি। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অনেক দেশের কাছে। বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ- গ্যাস ব্লক ইজারা, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তিত করে তুলেছে। ভাবিয়ে তুলেছে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌশক্তির প্রভাব এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজে চীনের উপস্থিতিও। গোয়াদরের অবস্থান পারস্য উপসাগরের মুখে এবং সেখান থেকে সহজেই হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ ছাড়া ইরানের সঙ্গেও রয়েছে চীনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক। অন্যদিকে শ্রীলংকার কলম্বোতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন, যেটি আগস্টে উদ্বোধন করা হয়। ২০১২ সালে দক্ষিণ শ্রীলংকার হাম্বানটোটা শহরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করেছে চীন। তিব্বতের নিকটবর্তী শহর নেপালের লারছাতে চীন ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি স্থলবন্দর নির্মাণ করছে। অন্যদিকে মিয়ানমারে রয়েছে চীনের প্রবল প্রভাব। ফলে ঠাণ্ডা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী বন্ধন ভেঙে যুগের চাহিদায় নির্মিত হয়েছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী, যা সামরিক-বেসামরিক সব ক্ষেত্রেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এ ছাড়াও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অবস্থান তাদের এক সঙ্গে আসতে সাহায্য করেছে। কারণ দুটি দেশই সন্ত্রাসবাদের শিকার। ফলে একে অন্যের সহযোগী। মতদ্বৈততা যে হয় না তা নয়। কিন্তু পেশাদারিত্ব ও দেশের স্বার্থে ভারত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ আবেগনির্ভর কূটনীতির কারণে ও পেশাদারিত্বের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতার দায় ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে লাভ নেই, প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও পেশাদারিত্বের। যা হোক, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্ব অনেকটাই সুদৃঢ়। অনেক বিষয়েই দু’দেশ একমত। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র আর কর্তৃত্ব দিতে চাচ্ছে না ভারতকে। যুগান্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্তকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আস্তে আস্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়ায় ভারতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে চাইছে না দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান নেয়ার নেপথ্যে ভারতের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের বিরাট অংকের টাকার অস্ত্র ক্রয়, ফ্রান্স থেকে ভারতের অস্ত্র ক্রয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান থেকে ভারতের তেল ক্রয়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাম্প্রতিককালে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতানৈক্য হয়।’ অবশ্য আরেক সংবাদ অনুযায়ী, ড্যান মজিনা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন। মন্তব্যটিকে আমরা দু’ভাবে নিতে পারি- এক. নিছক কূটনৈতিক মন্তব্য; দুই. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর তার সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একত্রে কাজ করার নির্দেশনা। ভারতের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন টেকসই গণতন্ত্র, দেশপ্রেম ও পেশাদার আমলাতন্ত্র। এ ছাড়াও ভারত তার প্রভাব মার্কিন সরকার পর্যন্ত গড়িয়েছে। ভারতীয়-আমেরিকান নাগরিকরা আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ফলে তারা ভারতের স্বার্থ কিছুটা হলেও দেখবে বৈকি!
অন্য এক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশ বিষয়ে একমত। পাকিস্তানের কথা বলব না, কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে পাকিস্তানের প্রভাব নেই বললেই চলে। আর পাকিস্তান মার্কিন বলয়ভুক্ত দেশ, যদিও সে দক্ষতায় চীনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তদুপরি দেশটি জঙ্গিবাদের কারণে নিজেই পর্যুদস্ত। আর সৌদি আরব যদিও বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে, তথাপিও মার্কিন বলয়ের বাইরের কোনো দেশ নয়। যদিও সাম্প্রতিককালে নিরাপত্তা পরিষদে সদস্যপদ নেয়া-না নেয়া নিয়ে মার্কিনিদের সঙ্গে মনোমালিন্য চলছে, মূলত ইরান দমনে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কার্যকর ভূমিকা দেখতে না পাওয়ায় এই মান-অভিমান। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু করার নেই সৌদি রাজপরিবারের। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গেও সৌদি সম্পর্ক ভালো। কয়েক বছর আগে সৌদি বাদশাহ ভারত সফর করেছেন, করেছেন বিভিন্ন চুক্তি। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এবারের নির্বাচনী অচলাবস্থা নিয়ে প্রথমবারের মতো মন্তব্য করেছে চীন, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। চীন বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং সামরিক দিক থেকেও অন্যতম শক্তি। ফলে সে তার প্রভাববলয় আরও বৃদ্ধি করবে বিশেষভাবে এশিয়ায়, আর এটাই স্বাভাবিক। যা হোক, আমেরিকা, ভারত, চীন কিংবা সৌদি আরবের মধ্যে যতই বন্ধুত্ব কিংবা শত্র“তা থাকুক, বাংলাদেশের বিষয়টিকে তারা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইবে এবং ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে।
দেশ আমাদের, এর ভালো-মন্দ দুটোই নির্ভর করছে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের ওপর। একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেশকে এগিয়ে নেবে। পাড়াপড়শীদেরও এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। ভারতে যেমন কখনও ভাবা যায় না অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন, বাংলাদেশেও আমরা চাই একটি গণতান্ত্রিক ইনক্লুসিভ নির্বাচন। যাতে আমরাও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি। আর যে ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অনেক রাষ্ট্রই কনসার্ন আমাদের বিষয়ে, সেটাকে দক্ষতা-যোগ্যতা-প্রজ্ঞার মাধ্যমে ব্যবহার করে নেতারা আত্মনির্ভরশীল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবেন। আর আস্থা অর্জন করবেন জনগণের। প্রয়োজনে বিদেশী বন্ধুদের পরামর্শ নেবেন, কিন্তু ভরসা রাখবেন নিজ দেশ ও জাতির ওপর। সবার উপরে দেশ।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments