বিশাল দুর্নীতির ঝুঁকি থেকে বিচার ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে by মইনুল হোসেন
আমরা
অনেকেই জাতির আকাক্সক্ষা পূরণ করতে নানাভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। কিন্তু বিচার
বিভাগ যদি ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে স্বাধীন দেশের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না এবং
বিচার তখন নির্যাতনে পরিণত হয়। গণতন্ত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রেও প্রথমে
বিচার বিভাগকে পোষ মানানো হয়। তারপর জাতি সভ্যতা ও শালীনতাবিবর্জিত রূপ
পেতে থাকে। তেমনটি ঘটুক, তা অবশ্য আমরা চাই না। শাসনতন্ত্র বিচার বিভাগকে
যে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়েছে তার যাতে অপব্যবহার না হয় সেটা দেখা ও রক্ষা
করার দায়িত্ব আর কারও নয়, বিচার বিভাগেরই নিজস্ব দায়িত্ব এটি। বিচার
বিভাগের নাজুক অবস্থা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। জামিন মঞ্জুর করার যেমন ক্ষমতা
আছে আদালতের, তেমনি একজন আসামিকে পুলিশ রিমান্ডেও পাঠাতে পারেন আদালত। তবে
এক্ষেত্রে বেশির ভাগ আদেশের সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
দুটি ক্ষেত্রেই একজন নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে
শাসনতান্ত্রিক সুরক্ষার সম্পর্ক রয়েছে, যা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এজন্য
কেবল বিচার বিভাগেরই বিশেষ এখতিয়ার রয়েছে জামিন ও পুলিশ রিমান্ড সংক্রান্ত
বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের ভূমিকা এতটাই
গুরুত্বপূর্ণ যে, বিচার বিভাগের সহায়তা ব্যতিরেকে আমরা দুর্নীতিবিরোধী
সংগ্রামে বিজয়ী হতে পারব না। আমাদের দেশে দুর্নীতির মধ্যেই দুর্নীতি বাসা
বাঁধে, তাই বড় ধরনের দুর্নীতির উদ্ঘাটন কোনো ক্ষেত্রের দুর্নীতি নিরোধে
কোনো প্রভাব ফেলে না। বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতির মামলা যত বেশি বড় হচ্ছে,
তত বেশি সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিতে
ভাগ বসানোর। লোকটি প্রধান অভিযুক্ত কি-না অথবা লোকটির বিরুদ্ধে বড় ধরনের
দুর্নীতির কোনো কেলেংকারি আছে কি-না সেটা কোনো বিষয় নয়, আসল কথা হচ্ছে
নির্দোষ ব্যক্তি হলেও তাকে জড়িত করে কতটা ফায়দা তোলা যাবে, সেটাই বিবেচ্য
বিষয়। জামিন এবং পুলিশ রিমান্ড বিষয় দুটি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং দুর্নীতির
মামলা দ্রুততার সঙ্গে ও স্বচ্ছভাবে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে অতীব গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়।
দুর্নীতির মামলার পেছনে থাকে বিপুল অংকের টাকার খেলা, আইনি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে সহজে অর্থ উপার্জন করার এ কাহিনী আজ আর গোপন নেই। কাউকে পুলিশ রিমান্ডে দেয়ার ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের সমর্থন না থাকার পরও পুলিশ রিমান্ডে নেয়া পুলিশের পক্ষে অত্যন্ত সহজ হচ্ছে। মানবাধিকার নেতা আদিলুর রহমান খানের ক্ষেত্রেও দেখা গেল হাইকোর্ট ডিভিশন পুলিশ রিমান্ডে পাঠানোর নিু কোর্টের আদেশ স্থগিত করেছেন। পুলিশের হেফাজতে একজন আসামিকে পাঠানোও যে শাসনতন্ত্রসম্মত নয়, তা গুরুত্ব পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। কাউকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে তা জেলে রেখেও করা যায়। আমাদের সর্বোচ্চ কোর্ট তো তাই বলছেন। মামলা বাড়ছে অথচ দুর্নীতি কমছে না। এর প্রধান কারণ মামলা তদন্তের নামে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার সুযোগ। কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে পুলিশের কাছে অসহায় করা আইনের শাসন হতে পারে না। মামলা প্রথম, তদন্ত পরে- এটা আইনের প্রোটেকশন নয়।
তাই সব দিক বিবেচনায় নিলে এ সিদ্ধান্তে না এসে উপায় নেই যে, আমাদের দেশে এক দুর্নীতি থেকে বহু দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বিচার ব্যবস্থার সহযোগিতায় হচ্ছে।
দুর্নীতির চাপ এতটা বাড়ছে যে বিচার বিভাগ তার পরিশুদ্ধ চরিত্র হারাচ্ছে এবং সেই অবক্ষয়ের স্বাক্ষর প্রকটিত হচ্ছে। আমাদের দেশে দুর্নীতির মামলা যে প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ায় মারাত্মক গলদ রয়েছে। আমরা দুর্নীতির উৎসমূলে আঘাত হানতে ব্যর্থ হচ্ছি। জনজীবনে যারা পদচারণা করছেন, তাদের বিবেকবোধকে সমুন্নত রাখার জন্য যেহেতু দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রাম, সেহেতু এই সংগ্রামে বিচারিক বিবেকবোধকে অম্লান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে সর্বতোভাবে। একজন সমালোচক যথার্থই বলেছেন, রুই-কাতলাদের দুর্নীতি রোধে বিচার ব্যবস্থা ব্যর্থ হচ্ছে বলেই দুর্নীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল, নির্দোষকে বাঁচাতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে বিচারের এই মূলনীতি খুব কমই বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এ কারণে দুর্নীতির মামলাগুলো পরিচালনার দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তারা মামলা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে নির্দোষকে নিষ্কৃতি দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কিছু লোকের জন্য দুর্নীতির মামলা হলেই লাভ। বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি অন্যায়-অবিচারকেই যে প্রশ্রয় দিচ্ছে তা তো সহজেই অনুমেয়। জনৈক ব্যক্তি বললেন, যেহেতু তার নাম এফআইআরে আছে সুতরাং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবে। আর এই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য কিভাবে জামিন পাওয়া যায় সেই চেষ্টা শুরু করলেন তিনি। ভাগ্য ভালো না হলে জামিন পাওয়া কঠিন। আইনের কথা হচ্ছে, দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন নির্দোষ। কিন্তু জামিনের ক্ষেত্রে সেটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এজন্য জজ-বিচারককে দোষ দেয়া নিরর্থক, কারণ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি কারও জামিন পাওয়ার অনুকূল নয়। এমনকি আমাদের আলোচিত গণমাধ্যমও ব্যাপারটিকে এভাবে মূল্যায়ন করে না যে, নির্দোষ ব্যক্তির সুরক্ষা ও বিচারের স্বচ্ছতার জন্য জামিনের সুযোগ অপরিহার্য। তবুও বিচারকদেরই বিচারিক নীতি-মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে।
অপরাধ সংক্রান্ত মামলা কারও বিরুদ্ধে সক্রিয় করার আগেই ভাবা উচিত কী কী কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির মানমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মামলা দিলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বন্দি রাখার অর্থ যে তার ব্যক্তিগত প্রায় সব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সেটাও কর্তৃপক্ষের চিন্তাভাবনায় থাকতে হবে। এটা জামিনে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার জন্যই প্রয়োজন। যদি কেউ চাকরিজীবী হন আর জামিন না পান, তাহলে জীবিকা অর্জনের সুযোগ থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হয়। আমরা যাতে একটি মানবতাবিবর্জিত নিষ্ঠুর সমাজ গঠন না করি, সেদিকে সবাইকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই তার এবং পরিবারের সদস্যদের শাস্তি ভোগের পালা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। তার শুধু এই তিক্ত সত্য জানার সুযোগ হচ্ছে যে আইন কত অন্ধ হতে পারে। দুর্নীতির মামলার জালে আটকা পড়া কোনো নির্দোষ ব্যক্তির উদ্ধার পাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কেউ চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজনও বোধ করেন না। এক্ষেত্রে আইন হয়তো নির্দোষ ব্যক্তির বিপক্ষে নয়, কিন্তু আইন দুর্বলেরও কোনো কাজে আসছে না। বড় মাপের দুর্নীতিবাজদের রয়েছে আর্থিক ক্ষমতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি। যারা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, তারা জানেন কিভাবে তা রক্ষা করতে হয়। তাদের সুনাম রক্ষার কোনো বালাই নেই, তারা ভালো করেই জানেন, অবৈধ অর্থ অবৈধ পথেই রক্ষা করতে হয়। রাজনীতিতে দুর্নীতি থাকায় দুর্নীতিপরায়ণদের রক্ষা পাওয়ার শেষ ভরসা হিসেবে রাজনীতি তো আছেই। তাই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংযোগ ব্যতিরেকে কোনো বড় ধরনের দুর্নীতি হতে পারছে না। বিচারের নীতি ও অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের জন্য জামিন মঞ্জুর করার কাজটি সহজ বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলার সুযোগ নেই। জামিন দেয়ার অর্থ কাউকে অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেয়া নয়। এমনকি জামিনে এমন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে, যাতে তাকে জেলে রাখা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সামাজিকভাবে নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক এমন কারও জামিন দেয়ার প্রশ্ন নিশ্চয়ই ভিন্নভাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। যদি জামিন পাওয়া সহজ হয়, তাহলে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতির প্রণোদনা কমে আসবে। জামিন লাভের পথে জটিলতা সৃষ্টি করায় বড় বড় দুর্নীতির মামলাগুলোকে ঘিরে দুর্নীতির ব্যাপক জাল বিস্তার লাভ করেছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা লাখ টাকা, কোটি টাকার শর্তে কথা বলে থাকেন। এটা বাড়িয়ে বলা হতে পারে, কিন্তু বিপুল অর্থের বিষয় চোখের সামনে থাকলে কোনো দাবিই অতিরিক্ত বিবেচিত হয় না। এটা আদালতেরও অজানা থাকার কথা নয় যে, জামিনের বিষয়টি বড় দুর্নীতির মতো বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এমনটি হওয়া উচিত নয়। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির মামলার জন্য মূল হোতাদের শাস্তি প্রদানের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাদের মামলাগুলো প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকতে পারলে দুর্নীতি দমন কাজে সফল হওয়া সহজ হতো। মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি করে দুর্নীতির সুযোগ ব্যাপক করা হচ্ছে মাত্র।
বড় কোনো দুর্নীতি সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করতে চাইলে দুর্নীতির মূল হোতাদের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। সবাইকে একত্র করে মামলা পরিচালনা করলে গোটা মামলার পরিণতি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ক্ষমতাধর কারও দুর্নীতির ব্যাপারে দুর্বলতা দেখিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করা যাবে না। জামিন মঞ্জুর করার ব্যাপারে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে পুলিশ ও প্রসিকিউশনকে বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে বলাই সঠিক ও যথার্থ কাজ হবে। প্রসিকিউশন বিলম্বিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকৃত অপরাধীকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম ব্যর্থ করে দিতে সাহায্য করা।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
দুর্নীতির মামলার পেছনে থাকে বিপুল অংকের টাকার খেলা, আইনি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে সহজে অর্থ উপার্জন করার এ কাহিনী আজ আর গোপন নেই। কাউকে পুলিশ রিমান্ডে দেয়ার ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের সমর্থন না থাকার পরও পুলিশ রিমান্ডে নেয়া পুলিশের পক্ষে অত্যন্ত সহজ হচ্ছে। মানবাধিকার নেতা আদিলুর রহমান খানের ক্ষেত্রেও দেখা গেল হাইকোর্ট ডিভিশন পুলিশ রিমান্ডে পাঠানোর নিু কোর্টের আদেশ স্থগিত করেছেন। পুলিশের হেফাজতে একজন আসামিকে পাঠানোও যে শাসনতন্ত্রসম্মত নয়, তা গুরুত্ব পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। কাউকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে তা জেলে রেখেও করা যায়। আমাদের সর্বোচ্চ কোর্ট তো তাই বলছেন। মামলা বাড়ছে অথচ দুর্নীতি কমছে না। এর প্রধান কারণ মামলা তদন্তের নামে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার সুযোগ। কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে পুলিশের কাছে অসহায় করা আইনের শাসন হতে পারে না। মামলা প্রথম, তদন্ত পরে- এটা আইনের প্রোটেকশন নয়।
তাই সব দিক বিবেচনায় নিলে এ সিদ্ধান্তে না এসে উপায় নেই যে, আমাদের দেশে এক দুর্নীতি থেকে বহু দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বিচার ব্যবস্থার সহযোগিতায় হচ্ছে।
দুর্নীতির চাপ এতটা বাড়ছে যে বিচার বিভাগ তার পরিশুদ্ধ চরিত্র হারাচ্ছে এবং সেই অবক্ষয়ের স্বাক্ষর প্রকটিত হচ্ছে। আমাদের দেশে দুর্নীতির মামলা যে প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ায় মারাত্মক গলদ রয়েছে। আমরা দুর্নীতির উৎসমূলে আঘাত হানতে ব্যর্থ হচ্ছি। জনজীবনে যারা পদচারণা করছেন, তাদের বিবেকবোধকে সমুন্নত রাখার জন্য যেহেতু দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রাম, সেহেতু এই সংগ্রামে বিচারিক বিবেকবোধকে অম্লান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে সর্বতোভাবে। একজন সমালোচক যথার্থই বলেছেন, রুই-কাতলাদের দুর্নীতি রোধে বিচার ব্যবস্থা ব্যর্থ হচ্ছে বলেই দুর্নীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল, নির্দোষকে বাঁচাতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে বিচারের এই মূলনীতি খুব কমই বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এ কারণে দুর্নীতির মামলাগুলো পরিচালনার দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তারা মামলা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে নির্দোষকে নিষ্কৃতি দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কিছু লোকের জন্য দুর্নীতির মামলা হলেই লাভ। বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি অন্যায়-অবিচারকেই যে প্রশ্রয় দিচ্ছে তা তো সহজেই অনুমেয়। জনৈক ব্যক্তি বললেন, যেহেতু তার নাম এফআইআরে আছে সুতরাং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবে। আর এই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য কিভাবে জামিন পাওয়া যায় সেই চেষ্টা শুরু করলেন তিনি। ভাগ্য ভালো না হলে জামিন পাওয়া কঠিন। আইনের কথা হচ্ছে, দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন নির্দোষ। কিন্তু জামিনের ক্ষেত্রে সেটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এজন্য জজ-বিচারককে দোষ দেয়া নিরর্থক, কারণ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি কারও জামিন পাওয়ার অনুকূল নয়। এমনকি আমাদের আলোচিত গণমাধ্যমও ব্যাপারটিকে এভাবে মূল্যায়ন করে না যে, নির্দোষ ব্যক্তির সুরক্ষা ও বিচারের স্বচ্ছতার জন্য জামিনের সুযোগ অপরিহার্য। তবুও বিচারকদেরই বিচারিক নীতি-মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে।
অপরাধ সংক্রান্ত মামলা কারও বিরুদ্ধে সক্রিয় করার আগেই ভাবা উচিত কী কী কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির মানমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মামলা দিলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বন্দি রাখার অর্থ যে তার ব্যক্তিগত প্রায় সব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সেটাও কর্তৃপক্ষের চিন্তাভাবনায় থাকতে হবে। এটা জামিনে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার জন্যই প্রয়োজন। যদি কেউ চাকরিজীবী হন আর জামিন না পান, তাহলে জীবিকা অর্জনের সুযোগ থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হয়। আমরা যাতে একটি মানবতাবিবর্জিত নিষ্ঠুর সমাজ গঠন না করি, সেদিকে সবাইকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই তার এবং পরিবারের সদস্যদের শাস্তি ভোগের পালা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। তার শুধু এই তিক্ত সত্য জানার সুযোগ হচ্ছে যে আইন কত অন্ধ হতে পারে। দুর্নীতির মামলার জালে আটকা পড়া কোনো নির্দোষ ব্যক্তির উদ্ধার পাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কেউ চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজনও বোধ করেন না। এক্ষেত্রে আইন হয়তো নির্দোষ ব্যক্তির বিপক্ষে নয়, কিন্তু আইন দুর্বলেরও কোনো কাজে আসছে না। বড় মাপের দুর্নীতিবাজদের রয়েছে আর্থিক ক্ষমতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি। যারা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, তারা জানেন কিভাবে তা রক্ষা করতে হয়। তাদের সুনাম রক্ষার কোনো বালাই নেই, তারা ভালো করেই জানেন, অবৈধ অর্থ অবৈধ পথেই রক্ষা করতে হয়। রাজনীতিতে দুর্নীতি থাকায় দুর্নীতিপরায়ণদের রক্ষা পাওয়ার শেষ ভরসা হিসেবে রাজনীতি তো আছেই। তাই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংযোগ ব্যতিরেকে কোনো বড় ধরনের দুর্নীতি হতে পারছে না। বিচারের নীতি ও অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের জন্য জামিন মঞ্জুর করার কাজটি সহজ বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলার সুযোগ নেই। জামিন দেয়ার অর্থ কাউকে অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেয়া নয়। এমনকি জামিনে এমন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে, যাতে তাকে জেলে রাখা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সামাজিকভাবে নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক এমন কারও জামিন দেয়ার প্রশ্ন নিশ্চয়ই ভিন্নভাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। যদি জামিন পাওয়া সহজ হয়, তাহলে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতির প্রণোদনা কমে আসবে। জামিন লাভের পথে জটিলতা সৃষ্টি করায় বড় বড় দুর্নীতির মামলাগুলোকে ঘিরে দুর্নীতির ব্যাপক জাল বিস্তার লাভ করেছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা লাখ টাকা, কোটি টাকার শর্তে কথা বলে থাকেন। এটা বাড়িয়ে বলা হতে পারে, কিন্তু বিপুল অর্থের বিষয় চোখের সামনে থাকলে কোনো দাবিই অতিরিক্ত বিবেচিত হয় না। এটা আদালতেরও অজানা থাকার কথা নয় যে, জামিনের বিষয়টি বড় দুর্নীতির মতো বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এমনটি হওয়া উচিত নয়। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির মামলার জন্য মূল হোতাদের শাস্তি প্রদানের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাদের মামলাগুলো প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকতে পারলে দুর্নীতি দমন কাজে সফল হওয়া সহজ হতো। মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি করে দুর্নীতির সুযোগ ব্যাপক করা হচ্ছে মাত্র।
বড় কোনো দুর্নীতি সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করতে চাইলে দুর্নীতির মূল হোতাদের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। সবাইকে একত্র করে মামলা পরিচালনা করলে গোটা মামলার পরিণতি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ক্ষমতাধর কারও দুর্নীতির ব্যাপারে দুর্বলতা দেখিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করা যাবে না। জামিন মঞ্জুর করার ব্যাপারে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে পুলিশ ও প্রসিকিউশনকে বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে বলাই সঠিক ও যথার্থ কাজ হবে। প্রসিকিউশন বিলম্বিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকৃত অপরাধীকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম ব্যর্থ করে দিতে সাহায্য করা।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments