শিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্ব বাড়াতেই হবে by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
আমাদের
দেশটি সারা পৃথিবীর স্থলভাগের এক হাজার ভাগের মাত্র এক ভাগ দখল করে আছে আর
বিশ্বের এক হাজার ভাগের ২৪ ভাগ মানুষের অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষার দায়িত্ব
পালন করছে। কাজটি নিঃসন্দেহে জটিল, চ্যালেঞ্জিং ও দুরূহ। উপরন্তু
বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে আমাদের টিকতে হচ্ছে। তাই
সীমিত সম্পদ দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব পালনে আমাদের
অবশ্যই দূরদর্শী, উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল হতে হবে। আমাদের সম্পদের সর্বোত্তম
ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপচয় কমাতে হবে। এজন্য অবশ্য বর্তমান সরকারের
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানটি খুবই সময়োচিত। তবে এ স্লোগানের কার্যকর
বাস্তবায়ন প্রয়োজন। গত ২৫ বছরে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত
বাগাড়ম্বর আমরা কম শুনিনি। তবে তা দেশ ও সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে
কোনো ভূমিকা রাখেনি।
কোরিয়ার সামরিক সরকার অনুধাবন করেছিল, দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়টি আমাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এবং তার জন্য আন্তরিকভাবে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। এই মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে প্রায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি এবং যা নিয়ে এমনকি উন্নত দেশের পরিকল্পনাবিদরাও যে রীতিমতো হকচকিয়ে গেছেন তার মূলে রয়েছে- তাজরিন ফ্যাশন কিংবা রানা প্লাজার মৃত্যুকূপে বসে কাজ-করা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মহিলাদের নিরলস পরিশ্রমে তৈরি পোশাক রফতানি করা আয় এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আরবভূমিতে পরিবার থেকে দূরে থাকা নিগৃহীত-অবহেলিত খেটে খাওয়া মানুষের রেমিটেন্স। আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য খাত হল কৃষি। স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল বর্তমান সময়ের অর্ধেক। আবাদযোগ্য জমি ছিল বর্তমানের চেয়ে বেশি। তারপরও তখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না। এখন জনসংখ্যা দ্বিগুণ, আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ কম হওয়া সত্ত্বেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যান্য প্রযুক্তির জ্ঞানে, দক্ষতায়, কারিগরিতে আমরা ঢের পিছিয়ে আছি। ভারত গঙ্গার ওপর সেতু তৈরি করেছে ১৯৭১ সালে। আজ ৪০ বছর পরও এমন একটি সেতু নির্মাণ করার যোগ্যতা আমাদের হয়েছে কি-না তা যাচাই করার, নিজেদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার কোনো ঝুঁকিও আমরা নিতে পারছি না। আমাদের দেশের হাজার হাজার রোগী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চিকিৎসা সেবার জন্য গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়। এমনকি তিন চাকার সিএনজিচালিত বাহনগুলোও বিদেশ থেকে কিনতে হয়! একই সঙ্গে আদমজী জুট মিলের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-কারখানা, নিউজপ্রিন্ট মিল বন্ধ করে দিতে হয়, বিমানের ব্যবস্থাপনা বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়, এমনকি বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বও আউটসোর্স করা নিয়ে ভাবতে হয়। এর অর্থ হল জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিদ্যায় দক্ষতায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ সফলতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
সুখের বিষয়, বিগত ১৫-২০ বছর ধরে সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানা শাখায় গবেষণার জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করছে। আইসিটি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা গবেষণাকে জোরদার করার জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তবে এর ফলে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের অবদানে স্ফীত হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ নেই।
পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে, এমনকি এশিয়ার তালিকাতেও বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল আমাদের দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান পায় না- যদিও থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বিভিন্ন আরব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। এ পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কার যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে স্বাধীনতার পর বিশ্বসভায় আমরা আমাদের স্থান ধরে রাখতে পারিনি এবং ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। এমনকি পাকিস্তান থেকেও আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। ভারত আমাদের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে রয়েছে। আর অনেক কম জনসংখ্যার দেশ শ্রীলংকা ও নেপালের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্মানজনক র্যাংক পেত, যা এখন আর পাচ্ছে না। এর অর্থ হল, আমাদের শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে যত উদ্যোগ, তা কার্যকর হতে পারেনি। আমরা যদি এ বৃত্ত থেকে বের হতে চাই তাহলে আমাদের কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে, আমাদের ভুল বের করতে হবে।
এ পর্যন্ত গবেষণায় আমরা যে অনুদানগুলো দিয়েছি, তা ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়েছে কি-না- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কার্যকরভাবে তা মনিটর করা হয়নি। এর ফলে দেশের সীমিত সম্পদ যথাযথভাবে ব্যয় করা হচ্ছে কি-না তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে গবেষণায় অর্থায়নের জন্য নানা সংস্থা রয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল যখন বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়, তখন অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি যথাযথভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো আমি যখন নাড়াচাড়া করি, তাতে আমাদের অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম খুব একটা চোখে পড়ে না।
পাকিস্তানে অধ্যাপক আতাউর রহমান হায়ার এডুকেশন কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা যে সফল হয়েছে তার বড় প্রমাণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বরাদ্দ বেড়েছে ৩৪০ শতাংশ, ২০০৩ থেকে ২০০৮-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের তৈরি ডিজিটাল লাইব্রেরিতে ৪৫ হাজার পাঠ্যবই এবং ২৫ হাজার আন্তর্জাতিক জার্নাল সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত যেখানে কোনো পাকিস্তানি বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি, সেখানে এখন প্রথম দু’শতে আছে দুটি। এক হাজার ছাত্রকে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্য কিউবা পাঠানো হয়েছে। পাঁচ হাজার ছাত্রকে উন্নত বিশ্বে পিএইচডি শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোয় ২০০৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ছয়শ’; ২০০৮-এ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার তিনশ’তে। অধ্যাপক আতাউর রহমানকে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা তার সাফল্যের জন্য বড় বড় চারটি পুরস্কার দিয়েছে। সুবিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোর প্রশংসাও করা হয়েছে। পাকিস্তানের এ পরিসংখ্যানের কাছে আমাদের অর্জন উল্লেখ করার মতো নয়।
দেশে সমস্যার অন্ত নেই। রাজধানীতে যানজটের কারণে মানুষের যে উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে, জ্বালানি খরচ হচ্ছে, তা হিসাব করলে জাতীয় অগ্রগতিতে এর বিরূপ প্রভাব হবে চোখে পড়ার মতো। তারপরও এগুলো নিয়ে আমাদের দেশে সমন্বিত গবেষণা লক্ষণীয় নয়। সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ কেলেংকারির কথা জাতীয় দৈনিকগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হল। ব্যাংকে শত শত কম্পিউটার থাকা সত্ত্বেও তাতে বাধা দেয়ার কোনো ব্যবস্থাই যদি করা না গিয়ে থাকে, তাহলে সেখানে কী কম্পিউটারায়ন হল? আমরা কি তাহলে শুধু ম্যানুয়ালি যে কাজগুলো করা হতো, তা কম্পিউটার দিয়ে প্রতিস্থাপন করছি? কম্পিউটার দিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি কিংবা সিস্টেমের উন্নয়নে অপটিমাইজেশনের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না?
দেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। শিক্ষা শুধু আমাদের চারদিকে যে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা মানবকল্যাণে ব্যবহারের দক্ষতাই দেয় না, শিক্ষা আমাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরিতেও অবদান রাখে। শুধু প্রায়োগিক শিক্ষাই নয়, তাত্ত্বিক শিক্ষা ও গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। একসময় জাপান জানা জ্ঞান-বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি তৈরি করেছে। কিন্তু এখন তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, নানা দেশের ছাত্ররা সেখানে গবেষণা করছে।
আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য পাকিস্তানের অনুরূপ লক্ষ্যভেদী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য নিচের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
১. সারাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যেতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-গবেষক হিসেবে যোগদানের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যবহার করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠান হবে সারা পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারে বাংলাদেশের সঞ্চয়ের অগ্রপথিক, যা নিয়ে আমরা সবাই গর্ববোধ করব, যা আমাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করবে। এর বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে লোভনীয় হবে, যাতে সারাদেশের শিক্ষক-গবেষকরা সেখানে চাকরি পাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে নিজেদের প্রোফাইল উন্নত করে। এ প্রতিষ্ঠানের চাকরির স্থায়িত্ব ও পদোন্নতি শিক্ষকদের অর্জনের ওপর নির্ভর করবে। প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আদর্শ হিসেবে কাজ করবে।
২. উচ্চতর গবেষণার জন্য এখন যে অনুদানগুলো দেয়া হচ্ছে, তার অগ্রগতি নিয়মিতভাবে মনিটর করতে হবে। যেসব গবেষক অনুদানের অর্থ ব্যবহার করে গবেষণায় সফলতা পাচ্ছে না, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য নানা প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের অর্থের যথাযোগ্য ব্যবহারে সবাইকেই আন্তরিক হতে হবে।
৩. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে দায়দায়িত্ব নিয়ে বিদায় নিতে হবে। একটি স্বাধীন, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ও উচ্চ গুণাবলীসম্পন্ন শিক্ষাবিদ-নাগরিকদের দিয়ে তৈরি সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে নিয়োগ দিতে হবে। অধিকতর মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন স্নাতকদের শিক্ষকতার চাকরিতে উৎসাহিত করতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানের হায়ার এডুকেশন কমিশন শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি বৃদ্ধি করেছে। অধ্যাপকদের বেতন দুই লাখ চৌত্রিশ হাজার থেকে চার লাখের ওপর নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য বিদেশ থেকে স্বনামধন্য শিক্ষকদের নিয়ে আসছে, যেমনটি করছে কোরিয়াও।
৪. শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যোগ্য শিক্ষকের অভাবে উন্নতমানের পাঠ্যপুস্তক দিয়ে অবহেলিত অঞ্চলের ছাত্রদের সাহায্য করা যেতে পারে। শিক্ষার জন্য নিবেদিত চ্যানেল ব্যবহার করে সারাদেশের ছাত্রদের জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে সময়সূচি তৈরি করে ছাত্রদের জন্য পাঠদান করা যেতে পারে, যা স্কুল-কলেজের ছাত্ররা টেলিভিশন কক্ষে শিক্ষকের উপস্থিতিতে গ্রহণ করতে পারে। স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সুযোগ্য শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের যৌক্তিক মাত্রার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ব্যক্তির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হতে হলে তার আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্জন কিংবা ফলাফল বিবেচনায় আনতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের অত্যন্ত ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে প্রতিযোগিতা। শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে নানা ধরনের জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার সূচনা করতে হবে। ছাত্রদের প্রশংসনীয় দক্ষতার জন্য লোভনীয় পুরস্কার দিতে হবে। বর্তমান বোর্ড কর্তৃক প্রশ্ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ছাত্রদের সৃজনশীলতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়ছে না বলে জনসাধারণের মধ্যে যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতিকে ক্রসচেক করার জন্য সব শ্রেণীতে সব বিষয়ে অলিম্পিয়াডের অনুরূপ সৃজনশীল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সূচনা ঘটাতে হবে। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণদের প্রাণশক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৫. সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অর্জনের ভিত্তিতে স্বীকৃতি, র্যাংক ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তদনুযায়ী অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই অনুরূপ সাফল্য অর্জন করার উৎসাহ সৃষ্টি হয়। গোটা বিষয়টিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য গণমাধ্যমে এ বিষয়গুলোর ব্যাপক প্রচার করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উৎকর্ষ অর্জনের নানারকম প্রতিযোগিতা রয়েছে বলেই সারা পৃথিবীর মাত্র পাঁচ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ মানব সভ্যতার নানা প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডের ৯৫ শতাংশ স্বীকৃতির দাবিদার তারা। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষা কমিশনের তৈরি শিক্ষানীতির রিপোর্টগুলো যেভাবে আমাদের দেশে অবহেলিত হয়, তাতে মনে হয় না আমরা শিক্ষায় প্রকৃতই আগ্রহী। তবে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ যদি আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই শিক্ষাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। যে কোনো দেশের উন্নয়নে এখন প্রাকৃতিক সম্পদের থেকে মানবসম্পদ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যার ফলে প্রায় প্রাকৃতিক সম্পদহীন জাপান আজ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি, যদিও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়া কিংবা আরব দেশগুলো তা নয়। ১৬ কোটি মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ করতে পারলে আমরা নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব। কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও ভিয়েতনাম বিপুল বেগে অগ্রসর হচ্ছে। আমরাও পারব।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
কোরিয়ার সামরিক সরকার অনুধাবন করেছিল, দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়টি আমাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এবং তার জন্য আন্তরিকভাবে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। এই মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে প্রায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি এবং যা নিয়ে এমনকি উন্নত দেশের পরিকল্পনাবিদরাও যে রীতিমতো হকচকিয়ে গেছেন তার মূলে রয়েছে- তাজরিন ফ্যাশন কিংবা রানা প্লাজার মৃত্যুকূপে বসে কাজ-করা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মহিলাদের নিরলস পরিশ্রমে তৈরি পোশাক রফতানি করা আয় এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আরবভূমিতে পরিবার থেকে দূরে থাকা নিগৃহীত-অবহেলিত খেটে খাওয়া মানুষের রেমিটেন্স। আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য খাত হল কৃষি। স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল বর্তমান সময়ের অর্ধেক। আবাদযোগ্য জমি ছিল বর্তমানের চেয়ে বেশি। তারপরও তখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না। এখন জনসংখ্যা দ্বিগুণ, আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ কম হওয়া সত্ত্বেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যান্য প্রযুক্তির জ্ঞানে, দক্ষতায়, কারিগরিতে আমরা ঢের পিছিয়ে আছি। ভারত গঙ্গার ওপর সেতু তৈরি করেছে ১৯৭১ সালে। আজ ৪০ বছর পরও এমন একটি সেতু নির্মাণ করার যোগ্যতা আমাদের হয়েছে কি-না তা যাচাই করার, নিজেদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার কোনো ঝুঁকিও আমরা নিতে পারছি না। আমাদের দেশের হাজার হাজার রোগী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চিকিৎসা সেবার জন্য গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়। এমনকি তিন চাকার সিএনজিচালিত বাহনগুলোও বিদেশ থেকে কিনতে হয়! একই সঙ্গে আদমজী জুট মিলের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-কারখানা, নিউজপ্রিন্ট মিল বন্ধ করে দিতে হয়, বিমানের ব্যবস্থাপনা বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়, এমনকি বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বও আউটসোর্স করা নিয়ে ভাবতে হয়। এর অর্থ হল জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিদ্যায় দক্ষতায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ সফলতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
সুখের বিষয়, বিগত ১৫-২০ বছর ধরে সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানা শাখায় গবেষণার জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করছে। আইসিটি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা গবেষণাকে জোরদার করার জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তবে এর ফলে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের অবদানে স্ফীত হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ নেই।
পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে, এমনকি এশিয়ার তালিকাতেও বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল আমাদের দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান পায় না- যদিও থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বিভিন্ন আরব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। এ পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কার যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে স্বাধীনতার পর বিশ্বসভায় আমরা আমাদের স্থান ধরে রাখতে পারিনি এবং ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। এমনকি পাকিস্তান থেকেও আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। ভারত আমাদের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে রয়েছে। আর অনেক কম জনসংখ্যার দেশ শ্রীলংকা ও নেপালের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্মানজনক র্যাংক পেত, যা এখন আর পাচ্ছে না। এর অর্থ হল, আমাদের শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে যত উদ্যোগ, তা কার্যকর হতে পারেনি। আমরা যদি এ বৃত্ত থেকে বের হতে চাই তাহলে আমাদের কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে, আমাদের ভুল বের করতে হবে।
এ পর্যন্ত গবেষণায় আমরা যে অনুদানগুলো দিয়েছি, তা ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়েছে কি-না- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কার্যকরভাবে তা মনিটর করা হয়নি। এর ফলে দেশের সীমিত সম্পদ যথাযথভাবে ব্যয় করা হচ্ছে কি-না তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে গবেষণায় অর্থায়নের জন্য নানা সংস্থা রয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল যখন বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়, তখন অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি যথাযথভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো আমি যখন নাড়াচাড়া করি, তাতে আমাদের অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম খুব একটা চোখে পড়ে না।
পাকিস্তানে অধ্যাপক আতাউর রহমান হায়ার এডুকেশন কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা যে সফল হয়েছে তার বড় প্রমাণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বরাদ্দ বেড়েছে ৩৪০ শতাংশ, ২০০৩ থেকে ২০০৮-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের তৈরি ডিজিটাল লাইব্রেরিতে ৪৫ হাজার পাঠ্যবই এবং ২৫ হাজার আন্তর্জাতিক জার্নাল সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত যেখানে কোনো পাকিস্তানি বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি, সেখানে এখন প্রথম দু’শতে আছে দুটি। এক হাজার ছাত্রকে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্য কিউবা পাঠানো হয়েছে। পাঁচ হাজার ছাত্রকে উন্নত বিশ্বে পিএইচডি শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোয় ২০০৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ছয়শ’; ২০০৮-এ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার তিনশ’তে। অধ্যাপক আতাউর রহমানকে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা তার সাফল্যের জন্য বড় বড় চারটি পুরস্কার দিয়েছে। সুবিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোর প্রশংসাও করা হয়েছে। পাকিস্তানের এ পরিসংখ্যানের কাছে আমাদের অর্জন উল্লেখ করার মতো নয়।
দেশে সমস্যার অন্ত নেই। রাজধানীতে যানজটের কারণে মানুষের যে উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে, জ্বালানি খরচ হচ্ছে, তা হিসাব করলে জাতীয় অগ্রগতিতে এর বিরূপ প্রভাব হবে চোখে পড়ার মতো। তারপরও এগুলো নিয়ে আমাদের দেশে সমন্বিত গবেষণা লক্ষণীয় নয়। সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ কেলেংকারির কথা জাতীয় দৈনিকগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হল। ব্যাংকে শত শত কম্পিউটার থাকা সত্ত্বেও তাতে বাধা দেয়ার কোনো ব্যবস্থাই যদি করা না গিয়ে থাকে, তাহলে সেখানে কী কম্পিউটারায়ন হল? আমরা কি তাহলে শুধু ম্যানুয়ালি যে কাজগুলো করা হতো, তা কম্পিউটার দিয়ে প্রতিস্থাপন করছি? কম্পিউটার দিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি কিংবা সিস্টেমের উন্নয়নে অপটিমাইজেশনের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না?
দেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। শিক্ষা শুধু আমাদের চারদিকে যে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা মানবকল্যাণে ব্যবহারের দক্ষতাই দেয় না, শিক্ষা আমাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরিতেও অবদান রাখে। শুধু প্রায়োগিক শিক্ষাই নয়, তাত্ত্বিক শিক্ষা ও গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। একসময় জাপান জানা জ্ঞান-বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি তৈরি করেছে। কিন্তু এখন তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, নানা দেশের ছাত্ররা সেখানে গবেষণা করছে।
আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য পাকিস্তানের অনুরূপ লক্ষ্যভেদী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য নিচের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
১. সারাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যেতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-গবেষক হিসেবে যোগদানের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যবহার করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠান হবে সারা পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারে বাংলাদেশের সঞ্চয়ের অগ্রপথিক, যা নিয়ে আমরা সবাই গর্ববোধ করব, যা আমাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করবে। এর বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে লোভনীয় হবে, যাতে সারাদেশের শিক্ষক-গবেষকরা সেখানে চাকরি পাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে নিজেদের প্রোফাইল উন্নত করে। এ প্রতিষ্ঠানের চাকরির স্থায়িত্ব ও পদোন্নতি শিক্ষকদের অর্জনের ওপর নির্ভর করবে। প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আদর্শ হিসেবে কাজ করবে।
২. উচ্চতর গবেষণার জন্য এখন যে অনুদানগুলো দেয়া হচ্ছে, তার অগ্রগতি নিয়মিতভাবে মনিটর করতে হবে। যেসব গবেষক অনুদানের অর্থ ব্যবহার করে গবেষণায় সফলতা পাচ্ছে না, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য নানা প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের অর্থের যথাযোগ্য ব্যবহারে সবাইকেই আন্তরিক হতে হবে।
৩. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে দায়দায়িত্ব নিয়ে বিদায় নিতে হবে। একটি স্বাধীন, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ও উচ্চ গুণাবলীসম্পন্ন শিক্ষাবিদ-নাগরিকদের দিয়ে তৈরি সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে নিয়োগ দিতে হবে। অধিকতর মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন স্নাতকদের শিক্ষকতার চাকরিতে উৎসাহিত করতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানের হায়ার এডুকেশন কমিশন শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি বৃদ্ধি করেছে। অধ্যাপকদের বেতন দুই লাখ চৌত্রিশ হাজার থেকে চার লাখের ওপর নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য বিদেশ থেকে স্বনামধন্য শিক্ষকদের নিয়ে আসছে, যেমনটি করছে কোরিয়াও।
৪. শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যোগ্য শিক্ষকের অভাবে উন্নতমানের পাঠ্যপুস্তক দিয়ে অবহেলিত অঞ্চলের ছাত্রদের সাহায্য করা যেতে পারে। শিক্ষার জন্য নিবেদিত চ্যানেল ব্যবহার করে সারাদেশের ছাত্রদের জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে সময়সূচি তৈরি করে ছাত্রদের জন্য পাঠদান করা যেতে পারে, যা স্কুল-কলেজের ছাত্ররা টেলিভিশন কক্ষে শিক্ষকের উপস্থিতিতে গ্রহণ করতে পারে। স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সুযোগ্য শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের যৌক্তিক মাত্রার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ব্যক্তির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হতে হলে তার আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্জন কিংবা ফলাফল বিবেচনায় আনতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের অত্যন্ত ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে প্রতিযোগিতা। শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে নানা ধরনের জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার সূচনা করতে হবে। ছাত্রদের প্রশংসনীয় দক্ষতার জন্য লোভনীয় পুরস্কার দিতে হবে। বর্তমান বোর্ড কর্তৃক প্রশ্ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ছাত্রদের সৃজনশীলতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়ছে না বলে জনসাধারণের মধ্যে যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতিকে ক্রসচেক করার জন্য সব শ্রেণীতে সব বিষয়ে অলিম্পিয়াডের অনুরূপ সৃজনশীল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সূচনা ঘটাতে হবে। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণদের প্রাণশক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৫. সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অর্জনের ভিত্তিতে স্বীকৃতি, র্যাংক ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তদনুযায়ী অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই অনুরূপ সাফল্য অর্জন করার উৎসাহ সৃষ্টি হয়। গোটা বিষয়টিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য গণমাধ্যমে এ বিষয়গুলোর ব্যাপক প্রচার করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উৎকর্ষ অর্জনের নানারকম প্রতিযোগিতা রয়েছে বলেই সারা পৃথিবীর মাত্র পাঁচ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ মানব সভ্যতার নানা প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডের ৯৫ শতাংশ স্বীকৃতির দাবিদার তারা। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষা কমিশনের তৈরি শিক্ষানীতির রিপোর্টগুলো যেভাবে আমাদের দেশে অবহেলিত হয়, তাতে মনে হয় না আমরা শিক্ষায় প্রকৃতই আগ্রহী। তবে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ যদি আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই শিক্ষাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। যে কোনো দেশের উন্নয়নে এখন প্রাকৃতিক সম্পদের থেকে মানবসম্পদ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যার ফলে প্রায় প্রাকৃতিক সম্পদহীন জাপান আজ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি, যদিও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়া কিংবা আরব দেশগুলো তা নয়। ১৬ কোটি মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ করতে পারলে আমরা নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব। কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও ভিয়েতনাম বিপুল বেগে অগ্রসর হচ্ছে। আমরাও পারব।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments