মিডিয়া ভাবনা সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন এক নয় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে
সম্পন্ন হওয়ায় ক্ষমতাসীনেরা দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে সংসদ নির্বাচন করার
দাবি আরও জোরদার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নানা
স্তরের নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এখন এই দাবিতে সোচ্চার।
তাঁদের
বক্তব্য হলো, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন
সম্পন্ন হয়েছে এবং চারটি সিটি করপোরেশনেই ১৮-দলীয় জোটের প্রার্থীরা বিপুল
ভোটে জয়ী হয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সরকারের ভিন্ন ধরনের সাফল্য।
তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি, যা অতীতে কয়েকটি ক্ষেত্রে
বিএনপি সরকার করেছিল।
কিন্তু আমার ধারণা, এই সাফল্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন দুটি সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা ও এসএসসি পরীক্ষা যেমন সম্পূর্ণ পৃথক পরীক্ষা। অথচ দুটিই পরীক্ষা। পরীক্ষার নিয়মকানুন, প্রশ্ন, খাতা দেখা, ফলাফল—সব এক। তবু খুবই পৃথক পরীক্ষা। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল একজন ছাত্রের জীবন পাল্টে দিতে পারে। সংসদ নির্বাচনের ফলও দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। কাজেই দেশের কোনো নির্বাচনই সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সংসদ নির্বাচনে দেশের সরকার বদল হতে পারে। ৩০০ জন আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হন, যাঁরা দেশের স্বার্থে বা তাঁদের স্বার্থে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারেন। পুরোনো আইন বাতিল করতে পারেন। বিভিন্ন দলের সংসদেরা মন্ত্রণালয়ের ওপর খবরদারি (সংসদীয় কমিটি) করতে পারেন। যে দল সরকার গঠন করবে, সেই দলের কিছু নেতা পরবর্তী
পাঁচ বছর দেশে প্রায় ‘যা খুশি তা’ করতে পারবেন।
সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের দল ক্ষমতায় যেতে পারলে নিজেদের নামে যত দুর্নীতির মামলা আছে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া যায়। অন্তত পাঁচ বছর কোনো রকম মামলা ছাড়াই থাকা যায় (বাংলাদেশে!)। আরও মজা হলো, নিজেদের পছন্দমতো বিচারক নিয়োগ দেওয়া যায়। আর কী চাই?
সরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, বিদেশভ্রমণ, সরকারি ক্রয় ও আরও নানা কিছুতে ভাগ পাওয়া যায়। এর ১০০ ভাগের ১০ ভাগও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পাবেন কি না সন্দেহ। তাঁরাও নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যালট পেপার, ভোটের বাক্স, প্রতীক, ভোট গণনা, বেসরকারি ও পরে সরকারি ফলাফল প্রকাশ—সবই রয়েছে। তবু দুই নির্বাচনে আকাশ-পাতাল তফাত। যেমন তফাত স্কুলের দুই পরীক্ষায়।
সম্প্রতি দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে স্থানীয় সরকারের চারটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি, অন্যান্য দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া যে বলে থাকে ‘দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠুভাবে সংসদ নির্বাচন হবে না, বিভিন্ন পক্ষের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না’, তার প্রধান কারণ হলো, এই নির্বাচন ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচন, একজন মেয়রের নির্বাচন নয়। একটি মেয়র পদে দুই বা তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই এলাকার সব সচেতন মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে এই একটি নির্বাচনে। ২১টি টিভি চ্যানেল ও ৩০টি জাতীয় দৈনিক অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে ওই এলাকায় সর্বক্ষণ সক্রিয় থাকে। পান থেকে চুন খসার উপায় থাকে না। অনেক টিভি চ্যানেল নানা প্রচার অনুষ্ঠানের লাইভ কভারেজ দিয়ে থাকে। নির্বাচনের দিন আরও সতর্ক থাকে সবাই। সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকে মিডিয়া। একটা ‘অনিয়ম’ কোথাও পেলে তা স্থানীয় প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর—সবখানে ছাঁকা পড়ে যাবে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাবে সেই খবর সারা বিশ্বে। প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভ মিছিল, মারদাঙ্গা হামলা, হরতাল ও নানা কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। এক মেয়রকে নির্বাচিত করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের গদিই নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে। কে এই এই ঝুঁকি নেবে? সরকারি দলের লোকেরা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বললেও ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ রহস্য কিন্তু এটাই।
৩০০ আসনে সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া কারও পক্ষে প্রতিটি কেন্দ্রে গভীর মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রধান কারণ লজিস্টিকসের অভাব। এত জনবল, যন্ত্রবল, যানবাহন কোনো কর্তৃপক্ষেরই নেই। বিশেষ করে প্রিন্ট ও বৈদ্যুতিন মিডিয়ার পক্ষে ৩০০ আসনে সমান মনোযোগ দেওয়া কখনো সম্ভব হবে না। ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ১০০ আসনে জাল ভোট, সংখ্যালঘু ভোটারকে বাধা দেওয়া, নারী ভোটারদের আসতে না দেওয়া, টাকার খেলা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি হবেই; যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার বা উপনির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সরকার যে প্রতিদিন জোর গলায় দাবি করছে, তার পেছনের কারণ, মিডিয়ার ভয়। বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মিডিয়া। আমাদের ধারণা, এখন কোনো সরকারের পক্ষেই ‘মাগুরা মডেলের’ নির্বাচন করা আর সম্ভব হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের সদিচ্ছা ছিল না, তা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে নানা বাস্তব কারণও এর সঙ্গে জড়িত ছিল।
স্থানীয় সরকার, উপনির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মধ্যে গুণগত পার্থক্য এবং নির্বাচনের সময় মিডিয়া, নাগরিক সমাজের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকায় যে পার্থক্য থাকে, তা নানা দৃষ্টান্তসহ দেখানোর চেষ্টা করেছি।
আমরা জানি, তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতেই থাকবেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।’ তবে এই ছোটখাটো ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে (তারাই সরকারে যায়) গত ২২ বছরে যে দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তার দৃশ্যগ্রাহ্য ও গুণগত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই সংসদ নির্বাচন করতে হবে; বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি (যা অন্যান্য দেশে দেখা যায়) তৈরি হলে মনে হয় না, কোনো পক্ষ ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি তুলবে।
ইদানীং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নিয়ে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন; ছোট বাচ্চাকে ভূতের ভয় দেখানোর মতো। তিনি বলছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক আসলে আর নির্বাচনই দেবে না। এবার তত্ত্বাবধায়ক আসলে কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করবে।’ সবই ভয়ের কথা। তত্ত্বাবধায়ককে এত ভয় কেন জানি না। কিন্তু এ দেশের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে আসেনি। সবাই দুই বছর রাজত্বও করেনি। সব সরকার দুই নেত্রীকে জেলে দেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভালো কাজগুলো প্রধানমন্ত্রীর মনে পড়ে না কেন? মানুষ তো ভালো দৃষ্টান্তই সামনে আনে। খারাপ দৃষ্টান্তকে ব্যতিক্রম মনে করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে এ দেশের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ মানেই খারাপ সরকার। তা তো মানা যায় না। আওয়ামী লীগ একসময় ‘বাকশাল’ করেছিল বলে সবাই কি আওয়ামী লীগের ওপর থেকে আস্থা উঠিয়ে নিয়েছে? নেয়নি। ‘বাকশাল’ একটা ব্যতিক্রমী ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। রাজনীতিতে ভুল হতেই পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার যদি এতই ভয় হয়, তাহলে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ আইন পাস করার সময় নানা শর্ত জুড়ে দিতে পারে। যেমন, এই সরকার ৯০ দিনের বেশি কার্যকর থাকবে না। ৯১ দিনের মাথায় তা সংবিধান অনুযায়ী বাতিল বলে বিবেচিত হবে। এই সরকার এমন কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, যার কার্যকারিতা ৯০ দিনের পরেও থাকবে। এই সরকার কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারবে না। কাউকে আটক করতে পারবে না। পূর্ববর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে না। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ছাড়া এই সরকার কোনো রকম অর্ডিন্যান্সও পাস করতে পারবে না। মোট কথা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু সংসদ নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, সামরিক বাহিনী ইত্যাদি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবে না। এর অন্যথা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে, সংবিধানের দৃষ্টিতে অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে, ইত্যাদি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনের সঙ্গে এ রকম শর্তাবলি যুক্ত করে দিলে কি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের আশঙ্কা দূর হতে পারে? সবাই মিলে আলোচনা করে দেখুন, আর কী কী শর্ত থাকলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেয়ামত পর্যন্ত থাকতে পারবে না। ৯০ দিনের মধ্যেই দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যেতে পারবে।
বর্তমান সরকারের ব্যবস্থাপনায় ও নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আমরা সবাই তাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলব, একটি, দুটি বা চারটি পদে একসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন আর ৩০০ পদে সংসদ নির্বাচন এক বিষয় নয়। তার চেয়েও যেটা জরুরি কথা, তা হলো উপনির্বাচন বা মেয়র নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারে প্রভাব পড়ে না। সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করা মানে, বর্তমান দূষিত রাজনীতির কারণে, পাঁচ বছর দেশের ওপর জমিদারি করা। ‘প্রধানমন্ত্রীর’ পদে আসীন ব্যক্তিটির একক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া; যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, ড. আকবর আলি খানের ভাষায় ‘মোগল সম্রাটদেরও চেয়েও বেশি’। কাজেই সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই
দলীয় সরকারের অধীনে করা উচিত হবে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
কিন্তু আমার ধারণা, এই সাফল্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন দুটি সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা ও এসএসসি পরীক্ষা যেমন সম্পূর্ণ পৃথক পরীক্ষা। অথচ দুটিই পরীক্ষা। পরীক্ষার নিয়মকানুন, প্রশ্ন, খাতা দেখা, ফলাফল—সব এক। তবু খুবই পৃথক পরীক্ষা। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল একজন ছাত্রের জীবন পাল্টে দিতে পারে। সংসদ নির্বাচনের ফলও দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। কাজেই দেশের কোনো নির্বাচনই সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সংসদ নির্বাচনে দেশের সরকার বদল হতে পারে। ৩০০ জন আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হন, যাঁরা দেশের স্বার্থে বা তাঁদের স্বার্থে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারেন। পুরোনো আইন বাতিল করতে পারেন। বিভিন্ন দলের সংসদেরা মন্ত্রণালয়ের ওপর খবরদারি (সংসদীয় কমিটি) করতে পারেন। যে দল সরকার গঠন করবে, সেই দলের কিছু নেতা পরবর্তী
পাঁচ বছর দেশে প্রায় ‘যা খুশি তা’ করতে পারবেন।
সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের দল ক্ষমতায় যেতে পারলে নিজেদের নামে যত দুর্নীতির মামলা আছে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া যায়। অন্তত পাঁচ বছর কোনো রকম মামলা ছাড়াই থাকা যায় (বাংলাদেশে!)। আরও মজা হলো, নিজেদের পছন্দমতো বিচারক নিয়োগ দেওয়া যায়। আর কী চাই?
সরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, বিদেশভ্রমণ, সরকারি ক্রয় ও আরও নানা কিছুতে ভাগ পাওয়া যায়। এর ১০০ ভাগের ১০ ভাগও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পাবেন কি না সন্দেহ। তাঁরাও নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যালট পেপার, ভোটের বাক্স, প্রতীক, ভোট গণনা, বেসরকারি ও পরে সরকারি ফলাফল প্রকাশ—সবই রয়েছে। তবু দুই নির্বাচনে আকাশ-পাতাল তফাত। যেমন তফাত স্কুলের দুই পরীক্ষায়।
সম্প্রতি দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে স্থানীয় সরকারের চারটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি, অন্যান্য দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া যে বলে থাকে ‘দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠুভাবে সংসদ নির্বাচন হবে না, বিভিন্ন পক্ষের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না’, তার প্রধান কারণ হলো, এই নির্বাচন ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচন, একজন মেয়রের নির্বাচন নয়। একটি মেয়র পদে দুই বা তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই এলাকার সব সচেতন মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে এই একটি নির্বাচনে। ২১টি টিভি চ্যানেল ও ৩০টি জাতীয় দৈনিক অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে ওই এলাকায় সর্বক্ষণ সক্রিয় থাকে। পান থেকে চুন খসার উপায় থাকে না। অনেক টিভি চ্যানেল নানা প্রচার অনুষ্ঠানের লাইভ কভারেজ দিয়ে থাকে। নির্বাচনের দিন আরও সতর্ক থাকে সবাই। সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকে মিডিয়া। একটা ‘অনিয়ম’ কোথাও পেলে তা স্থানীয় প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর—সবখানে ছাঁকা পড়ে যাবে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাবে সেই খবর সারা বিশ্বে। প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভ মিছিল, মারদাঙ্গা হামলা, হরতাল ও নানা কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। এক মেয়রকে নির্বাচিত করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের গদিই নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে। কে এই এই ঝুঁকি নেবে? সরকারি দলের লোকেরা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বললেও ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ রহস্য কিন্তু এটাই।
৩০০ আসনে সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া কারও পক্ষে প্রতিটি কেন্দ্রে গভীর মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রধান কারণ লজিস্টিকসের অভাব। এত জনবল, যন্ত্রবল, যানবাহন কোনো কর্তৃপক্ষেরই নেই। বিশেষ করে প্রিন্ট ও বৈদ্যুতিন মিডিয়ার পক্ষে ৩০০ আসনে সমান মনোযোগ দেওয়া কখনো সম্ভব হবে না। ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ১০০ আসনে জাল ভোট, সংখ্যালঘু ভোটারকে বাধা দেওয়া, নারী ভোটারদের আসতে না দেওয়া, টাকার খেলা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি হবেই; যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার বা উপনির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সরকার যে প্রতিদিন জোর গলায় দাবি করছে, তার পেছনের কারণ, মিডিয়ার ভয়। বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মিডিয়া। আমাদের ধারণা, এখন কোনো সরকারের পক্ষেই ‘মাগুরা মডেলের’ নির্বাচন করা আর সম্ভব হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের সদিচ্ছা ছিল না, তা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে নানা বাস্তব কারণও এর সঙ্গে জড়িত ছিল।
স্থানীয় সরকার, উপনির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মধ্যে গুণগত পার্থক্য এবং নির্বাচনের সময় মিডিয়া, নাগরিক সমাজের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকায় যে পার্থক্য থাকে, তা নানা দৃষ্টান্তসহ দেখানোর চেষ্টা করেছি।
আমরা জানি, তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতেই থাকবেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।’ তবে এই ছোটখাটো ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে (তারাই সরকারে যায়) গত ২২ বছরে যে দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তার দৃশ্যগ্রাহ্য ও গুণগত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই সংসদ নির্বাচন করতে হবে; বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি (যা অন্যান্য দেশে দেখা যায়) তৈরি হলে মনে হয় না, কোনো পক্ষ ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি তুলবে।
ইদানীং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নিয়ে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন; ছোট বাচ্চাকে ভূতের ভয় দেখানোর মতো। তিনি বলছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক আসলে আর নির্বাচনই দেবে না। এবার তত্ত্বাবধায়ক আসলে কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করবে।’ সবই ভয়ের কথা। তত্ত্বাবধায়ককে এত ভয় কেন জানি না। কিন্তু এ দেশের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে আসেনি। সবাই দুই বছর রাজত্বও করেনি। সব সরকার দুই নেত্রীকে জেলে দেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভালো কাজগুলো প্রধানমন্ত্রীর মনে পড়ে না কেন? মানুষ তো ভালো দৃষ্টান্তই সামনে আনে। খারাপ দৃষ্টান্তকে ব্যতিক্রম মনে করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে এ দেশের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ মানেই খারাপ সরকার। তা তো মানা যায় না। আওয়ামী লীগ একসময় ‘বাকশাল’ করেছিল বলে সবাই কি আওয়ামী লীগের ওপর থেকে আস্থা উঠিয়ে নিয়েছে? নেয়নি। ‘বাকশাল’ একটা ব্যতিক্রমী ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। রাজনীতিতে ভুল হতেই পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার যদি এতই ভয় হয়, তাহলে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ আইন পাস করার সময় নানা শর্ত জুড়ে দিতে পারে। যেমন, এই সরকার ৯০ দিনের বেশি কার্যকর থাকবে না। ৯১ দিনের মাথায় তা সংবিধান অনুযায়ী বাতিল বলে বিবেচিত হবে। এই সরকার এমন কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, যার কার্যকারিতা ৯০ দিনের পরেও থাকবে। এই সরকার কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারবে না। কাউকে আটক করতে পারবে না। পূর্ববর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে না। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ছাড়া এই সরকার কোনো রকম অর্ডিন্যান্সও পাস করতে পারবে না। মোট কথা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু সংসদ নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, সামরিক বাহিনী ইত্যাদি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবে না। এর অন্যথা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে, সংবিধানের দৃষ্টিতে অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে, ইত্যাদি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনের সঙ্গে এ রকম শর্তাবলি যুক্ত করে দিলে কি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের আশঙ্কা দূর হতে পারে? সবাই মিলে আলোচনা করে দেখুন, আর কী কী শর্ত থাকলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেয়ামত পর্যন্ত থাকতে পারবে না। ৯০ দিনের মধ্যেই দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যেতে পারবে।
বর্তমান সরকারের ব্যবস্থাপনায় ও নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আমরা সবাই তাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলব, একটি, দুটি বা চারটি পদে একসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন আর ৩০০ পদে সংসদ নির্বাচন এক বিষয় নয়। তার চেয়েও যেটা জরুরি কথা, তা হলো উপনির্বাচন বা মেয়র নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারে প্রভাব পড়ে না। সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করা মানে, বর্তমান দূষিত রাজনীতির কারণে, পাঁচ বছর দেশের ওপর জমিদারি করা। ‘প্রধানমন্ত্রীর’ পদে আসীন ব্যক্তিটির একক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া; যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, ড. আকবর আলি খানের ভাষায় ‘মোগল সম্রাটদেরও চেয়েও বেশি’। কাজেই সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই
দলীয় সরকারের অধীনে করা উচিত হবে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
No comments