গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা by এমাজউদ্দীন আহমদ
এক.
উপমহাদেশের এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আদর্শ বরাবর ছিল প্রেরণার উৎস। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বরাবরই জনগণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। এ জন্য জনগণ সংগ্রাম করেছে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছে লক্ষ্য।
উপমহাদেশের এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আদর্শ বরাবর ছিল প্রেরণার উৎস। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বরাবরই জনগণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। এ জন্য জনগণ সংগ্রাম করেছে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছে লক্ষ্য।
ব্রিটিশ-ভারতে বাঙালিরাই ছিল
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফ্রন্ট লাইনে। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে বিশ
শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত সর্বভারতীয় পর্যায়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এক
অর্থে ছিল বাঙালিদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন। দ্বিতীয় দশকের পরই এ আন্দোলনের
নেতৃত্ব যায় বাংলার বাইরে।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তার গণতান্ত্রিক সুরের জন্য। এ প্রস্তাবের মর্মবাণী একদিকে যেমন জাতীয় নিয়ন্ত্রণের অধিকার, অন্যদিকে তেমনি গণতন্ত্রের সার্বিক স্বীকৃতি। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের। পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রের বিকাশ এবং তার সার্থক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ রাজনৈতিক মহলের গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় যেসব আন্দোলন গণমনে উন্মাদনা সৃষ্টি করে, সেগুলোর প্রতিটির মূল প্রোথিত ছিল গণতান্ত্রিক চেতনায়।
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গঠিত বিরোধী দলগুলোর যে মোর্চা গঠিত হয় ১৯৫৪ সালে, সেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির সাতটি দফাই (৫, ৭, ১১, ১৪, ১৫, ২০, ২১) ছিল পূর্ব বাংলায় সংসদীয় গণতন্ত্রের সুষ্ঠু কার্যকারিতা সম্পর্কিত। যষ্ঠ দশকে আওয়ামী লীগের ছয় দফার আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে বাঙালিদের জাতীয় আন্দোলনে রূপ লাভ করে। ছয় দফা কর্মসূচির প্রথম দফা ছিল এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের রূপরেখাসম্পর্কিত। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের প্রাধান্য এবং জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ ছিল এর মূল বক্তব্য। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। স্বাধীনতাসংগ্রামের অগি্নঝরা দিনগুলোয় গণতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ জাতির প্রাণশক্তিকে সঞ্জীবিত রাখে। স্বাধীনতাযুদ্ধে এক রক্তের নদী সাঁতার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তুলে আনেন স্বাধীনতার লাল গোলাপ।
রক্তাক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে যা আশা করা হয়েছিল তাই হলো। নতুন রাষ্ট্রের সূচনালগ্নেই জনগণ লাভ করে গণতান্ত্রিক সংবিধান। ১৯৭২-এর সাময়িক সংবিধান আদেশে (Provisional Constitution Order 1972) বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭২-এর সংবিধানে সে ধারা অব্যাহত রইল। ১৯৭২-এর সংবিধানের মূল সুর সংসদীয় গণতন্ত্র। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ এবং জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ এ সংবিধানের মৌল বক্তব্য। মনে হয়েছে, এ জাতির এত দিনের প্রত্যাশা পূর্ণ হলো। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা এক পা দুই পা করে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হলো। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রবর্তিত হয় রাষ্ট্রপতিক সরকারের নামে 'রাষ্ট্রপতিক কর্তৃত্ববাদ' (Presidential Leviathan)। বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয় একদলীয় ব্যবস্থা। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম অধ্যায়টির সমাপ্তি এভাবে ঘটে।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাংলাদেশে আবার শুরু হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্রের জয়যাত্রা। ৯ বছর পর বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন ঘটে, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে, নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচিত জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন আইন, ৬ আগস্ট ১৯৯১, অভূতপূর্ব সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে আবারও প্রবর্তিত হলো সংসদীয় গণতন্ত্র। এ অঞ্চলে গণতন্ত্র কি শুধু রাজনৈতিক আদর্শ? গণতন্ত্র বিকাশের জন্য কেমন পরিবেশের প্রয়োজন? গণতান্ত্রিক সরকার হলো দায়িত্বশীল সরকার। সরকারের দায়িত্বশীলতা কিভাবে সুনিশ্চিত হবে? এ সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এসব প্রশ্নের পর্যালোচনা করা হয়েছে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে।
দুই.
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌল অঙ্গীকার
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এ দেশি নয়। এটি বিদেশি। মানব সভ্যতায় পাশ্চাত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান গণতন্ত্র। পাশ্চাত্যেই এর সূচনা হয়। পাশ্চাত্যেই এর সার্থক বিকাশ ঘটেছে। অবশ্য এ ব্যবস্থা এখন শুধু পাশ্চাত্যেই সীমিত নয়। এখন সর্বজনীন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে গণতন্ত্র। তাই এর লক্ষ্য, কাঠামো, অঙ্গীকার বিশ্লেষণ ক্ষেত্রে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে তার সূতিকাগারে, তার জন্মস্থানে।
পাশ্চাত্যে উদারনৈতিক গণতন্ত্র (Liberal Democracy) কার্যকর রয়েছে দুটি মৌল অঙ্গীকারের ভিত্তিতে :
১. সরকার যে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে তা ন্যাসী কর্তৃত্ব (Trust) এক আমানতস্বরূপ। সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত পন্থায় এবং সমাজের পক্ষে সরকার এ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যর্থ হয় অথবা সমাজ যদি মনে করে অনুমোদিত পন্থায় সরকার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেনি অথবা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে স্বেচ্ছায় সরকার পদত্যাগ করে। স্বেচ্ছায় অন্য রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনে বলপ্রয়োগ বা সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। বিধি-বিধানের কাঠামোয় শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
অন্য কথায়, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকৃতি, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রয়োগ পদ্ধতি, কর্তৃত্ব প্রয়োগকারীর বৈশিষ্ট্য, কর্তৃত্ব প্রয়োগে ব্যর্থতার রূপ এবং ব্যর্থ হলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে ঐকমত্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ঐকমত্যের পরিচয় মেলে প্রথায় বা কনভেনশনে। কোথাও বা তা বিধিবদ্ধ রয়েছে সংবিধানে। সব ক্ষেত্রে অবশ্য এ ঐকমত্য সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সর্বত্র থাকে ঐকমত্যের সুস্পষ্ট ছাপ।
২. গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের শাসন নয়। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রাধান্যই মূলকথা। আইন প্রণয়ন, আইনের পরিবর্তন বা সংশোধন সম্পন্ন হয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক, সংসদে। প্রণীত আইন মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। মন্দ হলেও তা মেনে চলতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তার পরিবর্তন বা সংশোধন সম্পন্ন না হয়। অন্য কথায়, সমাজে সব কিছুর নিয়ামক আইন। সমাজে সব শ্রেণী এবং গ্রুপের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আইন। পুরস্কার বা বঞ্চনা, পদোন্নতি বা পদচ্যুতি, লাভ বা লোকসান সব কিছু নির্ধারণ করে আইন, তা তিনি যত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন। মোটকথা, গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন হলো আইনের শাসন। কোনো ব্যক্তি বিক্ষুব্ধ হলে তিনি আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারেন। এর প্রতিবিধানে অগ্রসর হতে পারেন। কোনো কিছু পেতে হলে গণতান্ত্রিক সমাজে কেউ ব্যক্তির দিকে তাকায় না। তাকায় আইনের দিকে।
দুটি মৌল অঙ্গীকার ছাড়াও অন্য দুটি কারণে পাশ্চাত্যে উদারনৈতিক গণতন্ত্র সার্থক হয়ে উঠেছে। ১. গণতান্ত্রিক সমাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জারিত। সামাজিক পরিবেশে যুক্তির জোর স্বীকৃত। জোরের যুক্তি গণতন্ত্রে অচল। ব্যক্তিগত বুদ্ধির বলে অগ্রসর হয় ব্যক্তি, কিন্তু সামাজিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন হয় সমষ্টিগত প্রজ্ঞা। সমষ্টিগত প্রজ্ঞায় কোনো দলের নেই একচেটিয়া অধিকার। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সাফল্যের জন্যও নেই কোনো দলের একক কৃতিত্ব। সার্বিক প্রচেষ্টায় গণতন্ত্র সার্থক হয়। ২. গণতান্ত্রিক সমাজে সামাজিক উপত্যকা মোটামুটি সমতল। পীড়নমূলক স্তর বিন্যাসে সমাজজীবন অতিষ্ঠ নয়। সমাজে এক ধরনের সাম্য সবার চোখে পড়ে। তার ফলে একজন অন্যকে শ্রদ্ধা করে, অন্যের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে, যদিও তার মত ভিন্ন। একজন অন্যের কাজকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে বিন্যস্ত যে সমাজের সব শ্রেণী বা গ্রুপ জীবনের সর্বনিম্ন প্রয়োজন সম্পর্কে নিশ্চিত। ধনী-নির্ধন বা বড়-ছোটর মধ্যে ব্যবধান রয়েছে বটে, কিন্তু জীবনযাত্রার নূ্যনতম প্রয়োজন সম্পর্কে জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ নিশ্চিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে কাউকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয় না।
সরকারের দায়িত্বশীলতা
গণতন্ত্রের মৌল অঙ্গীকার থেকেই উদ্ভূত সরকারের দায়িত্বশীলতা। ন্যস্ত কর্তৃত্ব সরকার প্রয়োগ করবে বিধি-বিধানের কাঠামোয়, আলোচনা-পর্যালোচনার পর, মুক্ত আলোয় এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলত দলীয় ব্যবস্থা। সর্বাধিকসংখ্যক জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নীতি এবং কর্মসূচি বাছাইয়ের জন্য অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। নির্বাচনে বিভিন্ন দল তাদের নীতি এবং কর্মসূচির পসরা নিয়ে উপস্থিত হয় জনগণের সামনে। নির্বাচনে যেমন বাছাই করা হয় ব্যক্তি এবং ব্যক্তির সমন্বয়ে দল, তেমনি বাছাই করা হয় নীতি ও কর্মসূচি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং তার নীতি ও কর্মসূচি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্জন করে জাতীয় চরিত্র। লাভ করে ন্যস্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের অধিকার।
অধিকার একটি সামাজিক প্রত্যয়। সমাজজীবনে তা প্রযোজ্য এবং সমাজে দাবির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাই হয় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বিভিন্ন রূপে নানা প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত। রাজনৈতিক, আর্থিক, প্রশাসনিক ও নৈতিক কর্তব্যের আকারে সরকারের দায়িত্ব প্রাণ পায়।
রাজনৈতিক দায়িত্ব
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগে সংসদীয় সরকারের পন্থা সুনির্দিষ্ট, সংবিধান কর্তৃক সুনিয়ন্ত্রিত। নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সরকারের নীতি ও কর্মসূচির জন্য ব্যক্তিগত এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে সংসদের কাছে ও চূড়ান্ত পর্যায়ে জনগণের কাছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু সংসদ। নীতি নির্ধারিত হয় সংসদে। নির্বাহী কর্তৃত্বের ভিত্তিভূমি সংসদই। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা তাই দলের নীতি ও কর্মসূচির কাঠামোয় সংসদের কাছে দায়ী থেকে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন। সংসদের অব্যাহত আস্থাই মন্ত্রিপরিষদের প্রাণশক্তি।
সরকারের রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতার দুটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। ১. সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদই রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। সরকারের প্রধান দায়িত্ব তাই রাজনীতিকে সংসদীয় কার্যক্রমে পুরোপুরি ধারণ করা। জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ, সৃজনশীল বিশ্লেষণ, আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনার মূল প্রবাহকে সংসদে সীমিত রাখা। জাতীয় শক্তির দুর্বার ধারার মূলস্রোতকে সংসদে আবদ্ধ রাখা। সংসদে সব সমস্যার সমাধান হয় না বটে, সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা কিন্তু আসতে হবে সংসদ থেকেই। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনীতি এক অর্থে সংসদে বন্দি। রাজপথে তা আর নেমে আসে না। মিছিলে মিছিলে রাজপথ প্রকম্পিত হয় না। হরতাল-ধর্মঘটে অফিস-আদালত হয় না প্রাণহীন। সন্ত্রাসের কবলে পড়ে না জনজীবন। সরকারের দায়িত্বশীলতা ও কৃতিত্বের অন্যতম মানদণ্ড হলো জাতীয় রাজনীতিকে সংসদ কক্ষে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা।
শুধু ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে অবশ্য এটি সম্ভব নয়। তাই সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের সার্বিক রূপের প্রকাশ ঘটে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে। সরকারি দলের থাকে মন্ত্রিপরিষদ বা কেবিনেট। বিরোধী দলের থাকে ছায়া কেবিনেট। একটি কায়া বটে, অন্যটি ছায়া। দুটি মিলে সরকারের সামগ্রিক রূপ। সরকারি দলের নেতা সংসদের নেতা। তেমনি বিরোধী দলের নেতারও রয়েছে সাংবিধানিক মর্যাদা। তিনিও একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। সরকারি ব্যয়ে তাঁরও আবাসিক এবং অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়।
সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল বিকল্প সরকার। ক্ষমতাসীন দল ব্যর্থ হলে সে শূন্যস্থান পূরণ করে বিরোধী দল। তাই সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের যে দায়িত্ব তার একটা বড় অংশ বিরোধী দলের। রাজনীতি যেন রাজপথে না যায় তার সিংহভাগ দায়িত্ব বিরোধী দলের। রাজনীতি একবার রাজপথে নামলে সংসদীয় ব্যবস্থা অন্তঃসারশূন্য হয়ে ওঠে।
২. সংসদীয় ব্যবস্থা যেহেতু দলীয় ব্যবস্থা, তাই কর্তৃত্ব প্রয়োগের সময় ক্ষমতাসীন দলকে মনে রাখতে হবে- এ ক্ষমতা সীমিত এবং সাময়িক। সংসদীয় ব্যবস্থার সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত ব্রিটেনে হিসাব করে দেখা গেছে, কেবিনেটের গড় আয় সাড়ে তিন বছরের কিছু কম। মেয়াদ পূর্ণ করলেও নির্বাচনে কেবিনেটের সাফল্য-ব্যর্থতা, কৃতিত্ব-অদক্ষতা জনগণের বিচারের জন্য উন্মুক্ত হয়। নির্বাচনে যে নীতি ও কর্মসূচি আজকে জনগণকে আকর্ষণ করল না, আগামীকাল হয়তো তা-ই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল ক্ষমতালাভের পথকে সুগম করে তোলে। তাই বিরোধী দলের সমালোচনাকে 'জনস্বার্থবিরোধী' অথবা 'ধ্বংসাত্মক' বলার অধিকার সরকারের নেই। দেশপ্রেম ও জনসেবার একচেটিয়া অধিকার সমাজ কোনো দলকে দেয়নি। তবে সমালোচনার ধরন, ভাষা ও ভাব সম্পর্কে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহমত প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সমালোচনার উত্তাপে জনজীবন যেন জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ না হয়, বিরোধিতার প্রবল স্রোতে রাজনৈতিক শুচিতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেন ভেসে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংসদীয় সরকার প্রধানত আলোচনা-পর্যালোচনার সরকার। জাতীয় পর্যায়ে সব নীতি সম্পর্কে সংসদে অনুষ্ঠিত হতে হবে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আলোচনায় সবাইকে একমত হতে হবে, এমন কথা নয়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং জাতীয় স্বার্থ, আইনশৃঙ্খলা সংরক্ষণসম্পর্কিত বিষয় ছাড়া প্রায় প্রতিটি সামাজিক সমস্যায় থাকে ভিন্ন মত। এ জন্যই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ। ৬ আগস্টে গৃহীত দ্বাদশ সংশোধন আইন সংসদে যে পরিবেশে গৃহীত হয়, তা ব্যতিক্রমধর্মী। সব বিষয়ে থাকবে ভিন্ন মত, বিভিন্ন মতাদর্শ। তাই সিদ্ধান্তের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই মুখ্য। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল যতটুকু অবহিত থাকবে, সংখ্যালঘুর অনুধাবন করতে হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। বিরোধিতার চ্যালেঞ্জের মুখে সংখ্যাগুরুর এ অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া দায়িত্বহীনতার নামান্তর।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের এও লক্ষ্য থাকবে, সমস্যাটির সব দিকের আলোচনা যেন সম্পূর্ণ হয়। বিষয়টি যেন জনকল্যাণের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়। তা ছাড়া সংসদকে এড়িয়ে জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য না হলে কোনো অধ্যাদেশ প্রণয়নও দায়িত্বহীনতার নামান্তর।
দায়িত্বশীলতার অন্যতম প্রধান সূত্র জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন। এর যেমন বর্তমান আছে, তেমনি রয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও দৃষ্টিভঙ্গি। নির্বাচনব্যবস্থার উৎকর্ষের ফলে মন্ত্রিপরিষদ আজ জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। তাই সংসদের প্রতি যেমন সরকার দায়িত্বশীল, তেমনি দায়িত্বশীল জনগণের প্রতিও। ব্রিটিশ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে স্যার উইলিয়াম অ্যানসন (Sir William Anson) বলেন, 'গত ১০০ বছরে কেবিনেটের উৎপত্তি এবং রাজার ক্ষমতার বিলুপ্তির প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে তা রাজা-রানির কাছ থেকে আসে কমন্স সভায়। এখন কমন্স সভা থেকে নেমে এসেছে ভোটদাতা পর্যায়ে।' ফলে সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের দায়িত্বশীলতার অভিব্যক্তি দেখা যায় ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় : ক. সরকার জনগণের দ্বারা অনুমোদিত। খ. সরকারের কর্মসূচি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। গ. কেবিনেট সংসদের কাছে যতটুকু দায়ী, ঠিক ততটুকু দায়ী জনগণের কাছে।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জনগণের কাছে সরকারের দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু জনগণের জন্য নয়, সংসদীয় ব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্যও। এসব দেশে গণতন্ত্রের শুরু অনেক। গণতন্ত্রের পথ বড় বন্ধুর।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তার গণতান্ত্রিক সুরের জন্য। এ প্রস্তাবের মর্মবাণী একদিকে যেমন জাতীয় নিয়ন্ত্রণের অধিকার, অন্যদিকে তেমনি গণতন্ত্রের সার্বিক স্বীকৃতি। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের। পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রের বিকাশ এবং তার সার্থক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ রাজনৈতিক মহলের গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় যেসব আন্দোলন গণমনে উন্মাদনা সৃষ্টি করে, সেগুলোর প্রতিটির মূল প্রোথিত ছিল গণতান্ত্রিক চেতনায়।
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গঠিত বিরোধী দলগুলোর যে মোর্চা গঠিত হয় ১৯৫৪ সালে, সেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির সাতটি দফাই (৫, ৭, ১১, ১৪, ১৫, ২০, ২১) ছিল পূর্ব বাংলায় সংসদীয় গণতন্ত্রের সুষ্ঠু কার্যকারিতা সম্পর্কিত। যষ্ঠ দশকে আওয়ামী লীগের ছয় দফার আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে বাঙালিদের জাতীয় আন্দোলনে রূপ লাভ করে। ছয় দফা কর্মসূচির প্রথম দফা ছিল এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের রূপরেখাসম্পর্কিত। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের প্রাধান্য এবং জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ ছিল এর মূল বক্তব্য। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। স্বাধীনতাসংগ্রামের অগি্নঝরা দিনগুলোয় গণতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ জাতির প্রাণশক্তিকে সঞ্জীবিত রাখে। স্বাধীনতাযুদ্ধে এক রক্তের নদী সাঁতার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তুলে আনেন স্বাধীনতার লাল গোলাপ।
রক্তাক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে যা আশা করা হয়েছিল তাই হলো। নতুন রাষ্ট্রের সূচনালগ্নেই জনগণ লাভ করে গণতান্ত্রিক সংবিধান। ১৯৭২-এর সাময়িক সংবিধান আদেশে (Provisional Constitution Order 1972) বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭২-এর সংবিধানে সে ধারা অব্যাহত রইল। ১৯৭২-এর সংবিধানের মূল সুর সংসদীয় গণতন্ত্র। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ এবং জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ এ সংবিধানের মৌল বক্তব্য। মনে হয়েছে, এ জাতির এত দিনের প্রত্যাশা পূর্ণ হলো। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা এক পা দুই পা করে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হলো। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রবর্তিত হয় রাষ্ট্রপতিক সরকারের নামে 'রাষ্ট্রপতিক কর্তৃত্ববাদ' (Presidential Leviathan)। বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয় একদলীয় ব্যবস্থা। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম অধ্যায়টির সমাপ্তি এভাবে ঘটে।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাংলাদেশে আবার শুরু হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্রের জয়যাত্রা। ৯ বছর পর বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন ঘটে, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে, নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচিত জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন আইন, ৬ আগস্ট ১৯৯১, অভূতপূর্ব সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে আবারও প্রবর্তিত হলো সংসদীয় গণতন্ত্র। এ অঞ্চলে গণতন্ত্র কি শুধু রাজনৈতিক আদর্শ? গণতন্ত্র বিকাশের জন্য কেমন পরিবেশের প্রয়োজন? গণতান্ত্রিক সরকার হলো দায়িত্বশীল সরকার। সরকারের দায়িত্বশীলতা কিভাবে সুনিশ্চিত হবে? এ সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এসব প্রশ্নের পর্যালোচনা করা হয়েছে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে।
দুই.
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌল অঙ্গীকার
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এ দেশি নয়। এটি বিদেশি। মানব সভ্যতায় পাশ্চাত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান গণতন্ত্র। পাশ্চাত্যেই এর সূচনা হয়। পাশ্চাত্যেই এর সার্থক বিকাশ ঘটেছে। অবশ্য এ ব্যবস্থা এখন শুধু পাশ্চাত্যেই সীমিত নয়। এখন সর্বজনীন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে গণতন্ত্র। তাই এর লক্ষ্য, কাঠামো, অঙ্গীকার বিশ্লেষণ ক্ষেত্রে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে তার সূতিকাগারে, তার জন্মস্থানে।
পাশ্চাত্যে উদারনৈতিক গণতন্ত্র (Liberal Democracy) কার্যকর রয়েছে দুটি মৌল অঙ্গীকারের ভিত্তিতে :
১. সরকার যে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে তা ন্যাসী কর্তৃত্ব (Trust) এক আমানতস্বরূপ। সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত পন্থায় এবং সমাজের পক্ষে সরকার এ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যর্থ হয় অথবা সমাজ যদি মনে করে অনুমোদিত পন্থায় সরকার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেনি অথবা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে স্বেচ্ছায় সরকার পদত্যাগ করে। স্বেচ্ছায় অন্য রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনে বলপ্রয়োগ বা সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। বিধি-বিধানের কাঠামোয় শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
অন্য কথায়, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকৃতি, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রয়োগ পদ্ধতি, কর্তৃত্ব প্রয়োগকারীর বৈশিষ্ট্য, কর্তৃত্ব প্রয়োগে ব্যর্থতার রূপ এবং ব্যর্থ হলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে ঐকমত্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ঐকমত্যের পরিচয় মেলে প্রথায় বা কনভেনশনে। কোথাও বা তা বিধিবদ্ধ রয়েছে সংবিধানে। সব ক্ষেত্রে অবশ্য এ ঐকমত্য সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সর্বত্র থাকে ঐকমত্যের সুস্পষ্ট ছাপ।
২. গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের শাসন নয়। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রাধান্যই মূলকথা। আইন প্রণয়ন, আইনের পরিবর্তন বা সংশোধন সম্পন্ন হয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক, সংসদে। প্রণীত আইন মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। মন্দ হলেও তা মেনে চলতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তার পরিবর্তন বা সংশোধন সম্পন্ন না হয়। অন্য কথায়, সমাজে সব কিছুর নিয়ামক আইন। সমাজে সব শ্রেণী এবং গ্রুপের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আইন। পুরস্কার বা বঞ্চনা, পদোন্নতি বা পদচ্যুতি, লাভ বা লোকসান সব কিছু নির্ধারণ করে আইন, তা তিনি যত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন। মোটকথা, গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন হলো আইনের শাসন। কোনো ব্যক্তি বিক্ষুব্ধ হলে তিনি আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারেন। এর প্রতিবিধানে অগ্রসর হতে পারেন। কোনো কিছু পেতে হলে গণতান্ত্রিক সমাজে কেউ ব্যক্তির দিকে তাকায় না। তাকায় আইনের দিকে।
দুটি মৌল অঙ্গীকার ছাড়াও অন্য দুটি কারণে পাশ্চাত্যে উদারনৈতিক গণতন্ত্র সার্থক হয়ে উঠেছে। ১. গণতান্ত্রিক সমাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জারিত। সামাজিক পরিবেশে যুক্তির জোর স্বীকৃত। জোরের যুক্তি গণতন্ত্রে অচল। ব্যক্তিগত বুদ্ধির বলে অগ্রসর হয় ব্যক্তি, কিন্তু সামাজিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন হয় সমষ্টিগত প্রজ্ঞা। সমষ্টিগত প্রজ্ঞায় কোনো দলের নেই একচেটিয়া অধিকার। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সাফল্যের জন্যও নেই কোনো দলের একক কৃতিত্ব। সার্বিক প্রচেষ্টায় গণতন্ত্র সার্থক হয়। ২. গণতান্ত্রিক সমাজে সামাজিক উপত্যকা মোটামুটি সমতল। পীড়নমূলক স্তর বিন্যাসে সমাজজীবন অতিষ্ঠ নয়। সমাজে এক ধরনের সাম্য সবার চোখে পড়ে। তার ফলে একজন অন্যকে শ্রদ্ধা করে, অন্যের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে, যদিও তার মত ভিন্ন। একজন অন্যের কাজকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে বিন্যস্ত যে সমাজের সব শ্রেণী বা গ্রুপ জীবনের সর্বনিম্ন প্রয়োজন সম্পর্কে নিশ্চিত। ধনী-নির্ধন বা বড়-ছোটর মধ্যে ব্যবধান রয়েছে বটে, কিন্তু জীবনযাত্রার নূ্যনতম প্রয়োজন সম্পর্কে জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ নিশ্চিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে কাউকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয় না।
সরকারের দায়িত্বশীলতা
গণতন্ত্রের মৌল অঙ্গীকার থেকেই উদ্ভূত সরকারের দায়িত্বশীলতা। ন্যস্ত কর্তৃত্ব সরকার প্রয়োগ করবে বিধি-বিধানের কাঠামোয়, আলোচনা-পর্যালোচনার পর, মুক্ত আলোয় এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলত দলীয় ব্যবস্থা। সর্বাধিকসংখ্যক জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নীতি এবং কর্মসূচি বাছাইয়ের জন্য অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। নির্বাচনে বিভিন্ন দল তাদের নীতি এবং কর্মসূচির পসরা নিয়ে উপস্থিত হয় জনগণের সামনে। নির্বাচনে যেমন বাছাই করা হয় ব্যক্তি এবং ব্যক্তির সমন্বয়ে দল, তেমনি বাছাই করা হয় নীতি ও কর্মসূচি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং তার নীতি ও কর্মসূচি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্জন করে জাতীয় চরিত্র। লাভ করে ন্যস্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের অধিকার।
অধিকার একটি সামাজিক প্রত্যয়। সমাজজীবনে তা প্রযোজ্য এবং সমাজে দাবির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাই হয় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বিভিন্ন রূপে নানা প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত। রাজনৈতিক, আর্থিক, প্রশাসনিক ও নৈতিক কর্তব্যের আকারে সরকারের দায়িত্ব প্রাণ পায়।
রাজনৈতিক দায়িত্ব
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগে সংসদীয় সরকারের পন্থা সুনির্দিষ্ট, সংবিধান কর্তৃক সুনিয়ন্ত্রিত। নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সরকারের নীতি ও কর্মসূচির জন্য ব্যক্তিগত এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে সংসদের কাছে ও চূড়ান্ত পর্যায়ে জনগণের কাছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু সংসদ। নীতি নির্ধারিত হয় সংসদে। নির্বাহী কর্তৃত্বের ভিত্তিভূমি সংসদই। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা তাই দলের নীতি ও কর্মসূচির কাঠামোয় সংসদের কাছে দায়ী থেকে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন। সংসদের অব্যাহত আস্থাই মন্ত্রিপরিষদের প্রাণশক্তি।
সরকারের রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতার দুটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। ১. সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদই রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। সরকারের প্রধান দায়িত্ব তাই রাজনীতিকে সংসদীয় কার্যক্রমে পুরোপুরি ধারণ করা। জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ, সৃজনশীল বিশ্লেষণ, আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনার মূল প্রবাহকে সংসদে সীমিত রাখা। জাতীয় শক্তির দুর্বার ধারার মূলস্রোতকে সংসদে আবদ্ধ রাখা। সংসদে সব সমস্যার সমাধান হয় না বটে, সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা কিন্তু আসতে হবে সংসদ থেকেই। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনীতি এক অর্থে সংসদে বন্দি। রাজপথে তা আর নেমে আসে না। মিছিলে মিছিলে রাজপথ প্রকম্পিত হয় না। হরতাল-ধর্মঘটে অফিস-আদালত হয় না প্রাণহীন। সন্ত্রাসের কবলে পড়ে না জনজীবন। সরকারের দায়িত্বশীলতা ও কৃতিত্বের অন্যতম মানদণ্ড হলো জাতীয় রাজনীতিকে সংসদ কক্ষে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা।
শুধু ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে অবশ্য এটি সম্ভব নয়। তাই সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের সার্বিক রূপের প্রকাশ ঘটে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে। সরকারি দলের থাকে মন্ত্রিপরিষদ বা কেবিনেট। বিরোধী দলের থাকে ছায়া কেবিনেট। একটি কায়া বটে, অন্যটি ছায়া। দুটি মিলে সরকারের সামগ্রিক রূপ। সরকারি দলের নেতা সংসদের নেতা। তেমনি বিরোধী দলের নেতারও রয়েছে সাংবিধানিক মর্যাদা। তিনিও একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। সরকারি ব্যয়ে তাঁরও আবাসিক এবং অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়।
সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল বিকল্প সরকার। ক্ষমতাসীন দল ব্যর্থ হলে সে শূন্যস্থান পূরণ করে বিরোধী দল। তাই সংসদীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের যে দায়িত্ব তার একটা বড় অংশ বিরোধী দলের। রাজনীতি যেন রাজপথে না যায় তার সিংহভাগ দায়িত্ব বিরোধী দলের। রাজনীতি একবার রাজপথে নামলে সংসদীয় ব্যবস্থা অন্তঃসারশূন্য হয়ে ওঠে।
২. সংসদীয় ব্যবস্থা যেহেতু দলীয় ব্যবস্থা, তাই কর্তৃত্ব প্রয়োগের সময় ক্ষমতাসীন দলকে মনে রাখতে হবে- এ ক্ষমতা সীমিত এবং সাময়িক। সংসদীয় ব্যবস্থার সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত ব্রিটেনে হিসাব করে দেখা গেছে, কেবিনেটের গড় আয় সাড়ে তিন বছরের কিছু কম। মেয়াদ পূর্ণ করলেও নির্বাচনে কেবিনেটের সাফল্য-ব্যর্থতা, কৃতিত্ব-অদক্ষতা জনগণের বিচারের জন্য উন্মুক্ত হয়। নির্বাচনে যে নীতি ও কর্মসূচি আজকে জনগণকে আকর্ষণ করল না, আগামীকাল হয়তো তা-ই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল ক্ষমতালাভের পথকে সুগম করে তোলে। তাই বিরোধী দলের সমালোচনাকে 'জনস্বার্থবিরোধী' অথবা 'ধ্বংসাত্মক' বলার অধিকার সরকারের নেই। দেশপ্রেম ও জনসেবার একচেটিয়া অধিকার সমাজ কোনো দলকে দেয়নি। তবে সমালোচনার ধরন, ভাষা ও ভাব সম্পর্কে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহমত প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সমালোচনার উত্তাপে জনজীবন যেন জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ না হয়, বিরোধিতার প্রবল স্রোতে রাজনৈতিক শুচিতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেন ভেসে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংসদীয় সরকার প্রধানত আলোচনা-পর্যালোচনার সরকার। জাতীয় পর্যায়ে সব নীতি সম্পর্কে সংসদে অনুষ্ঠিত হতে হবে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আলোচনায় সবাইকে একমত হতে হবে, এমন কথা নয়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং জাতীয় স্বার্থ, আইনশৃঙ্খলা সংরক্ষণসম্পর্কিত বিষয় ছাড়া প্রায় প্রতিটি সামাজিক সমস্যায় থাকে ভিন্ন মত। এ জন্যই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ। ৬ আগস্টে গৃহীত দ্বাদশ সংশোধন আইন সংসদে যে পরিবেশে গৃহীত হয়, তা ব্যতিক্রমধর্মী। সব বিষয়ে থাকবে ভিন্ন মত, বিভিন্ন মতাদর্শ। তাই সিদ্ধান্তের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই মুখ্য। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল যতটুকু অবহিত থাকবে, সংখ্যালঘুর অনুধাবন করতে হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। বিরোধিতার চ্যালেঞ্জের মুখে সংখ্যাগুরুর এ অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া দায়িত্বহীনতার নামান্তর।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের এও লক্ষ্য থাকবে, সমস্যাটির সব দিকের আলোচনা যেন সম্পূর্ণ হয়। বিষয়টি যেন জনকল্যাণের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়। তা ছাড়া সংসদকে এড়িয়ে জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য না হলে কোনো অধ্যাদেশ প্রণয়নও দায়িত্বহীনতার নামান্তর।
দায়িত্বশীলতার অন্যতম প্রধান সূত্র জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন। এর যেমন বর্তমান আছে, তেমনি রয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও দৃষ্টিভঙ্গি। নির্বাচনব্যবস্থার উৎকর্ষের ফলে মন্ত্রিপরিষদ আজ জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। তাই সংসদের প্রতি যেমন সরকার দায়িত্বশীল, তেমনি দায়িত্বশীল জনগণের প্রতিও। ব্রিটিশ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে স্যার উইলিয়াম অ্যানসন (Sir William Anson) বলেন, 'গত ১০০ বছরে কেবিনেটের উৎপত্তি এবং রাজার ক্ষমতার বিলুপ্তির প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে তা রাজা-রানির কাছ থেকে আসে কমন্স সভায়। এখন কমন্স সভা থেকে নেমে এসেছে ভোটদাতা পর্যায়ে।' ফলে সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের দায়িত্বশীলতার অভিব্যক্তি দেখা যায় ত্রিবিধ প্রক্রিয়ায় : ক. সরকার জনগণের দ্বারা অনুমোদিত। খ. সরকারের কর্মসূচি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। গ. কেবিনেট সংসদের কাছে যতটুকু দায়ী, ঠিক ততটুকু দায়ী জনগণের কাছে।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জনগণের কাছে সরকারের দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু জনগণের জন্য নয়, সংসদীয় ব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্যও। এসব দেশে গণতন্ত্রের শুরু অনেক। গণতন্ত্রের পথ বড় বন্ধুর।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments