না খেয়ে কত দিন বাঁচা সম্ভব? by এ বি এম আব্দুল্লাহ
ধ্বংসস্তূপে ১৭ দিন! সাভারের ধসে যাওয়া
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে রেশমার বেঁচে থাকার কাহিনি ছুঁয়ে গেছে অগণিত
হূদয়। আর সেই সঙ্গে কৌতূহলী মনে জেগেছে প্রশ্ন, খাবার আর পানি ছাড়া মানুষ
কত দিন বাঁচতে পারে? বৈজ্ঞানিকভাবে এর উত্তর দেওয়া কঠিন।
তবে প্রাকৃতিক আর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, অনশন ধর্মঘট
ইত্যাদি অনেক ঘটনার মাধ্যমে খাবার ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার একটা ধারণা
পাওয়া সম্ভব।
১৯৮৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে ভূমিকম্পের সাত দিন পর দুটি মেটারনিটি হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশকিছু নবজাতককে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ১৯৯০ সালে ফিলিপাইনের লুজন অঞ্চলে ভূমিকম্পের পর একটি হোটেলের ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৪ দিন পর জীবিত উদ্ধার করা হয় পেড্রিটো ডাইকে। ১৯৯৫ সালে ১৯ বছর বয়স্ক পার্ক সান হুন নামের এক নারী দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের ভেঙে যাওয়া পাঁচতলা সুপার মার্কেটের ভেতর ১৭ দিন বেঁচে ছিলেন। ২০০৪ সালে টার্কিতে ১৬ বছর বয়সের কালেমকে জীবিত উদ্ধার করা হয় প্রায় এক সপ্তাহ পর। অন্যদিকে ২০০৪ সালে ইরানের বাম শহরে ভূমিকম্পের নয় দিন পর শহরবানু মাজানদারানি নামের ৯৭ বছরের এক নারী ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার পান। অবশ্য তিনি পুরোপুরি না খেয়ে ছিলেন না।
সবচেয়ে বেশি দিন না খেয়ে বেঁচে ছিলেন পাকিস্তানের কাশ্মীরে ৪০ বছর বয়সী নকশা বিবি। ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া ঘরে ৬৩ দিন বেঁচে ছিলেন পচে যাওয়া খাবার আর অল্প কিছু চুইয়ে পড়া পানির ওপর। একই বছরে পাকিস্তানে ভূমিকম্পে ধসে পড়া একটি স্কুলের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে পাঁচ দিন পর তিনজন ছাত্রকে উদ্ধার করা হয়। ২০১০ সালে হাইতির প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে ধসে পড়া একটি বিপণিবিতানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২৭ দিন পর জীবিত উদ্ধার হন ইভান্স মোন্সিজোনাক, যিনি টিকে ছিলেন পয়োনিষ্কাশন পাইপের পানি খেয়ে। একই ভূমিকম্পে ১১ দিনের এক শিশুকে এক সপ্তাহ পর জীবিত উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ বিস্ময় ঘটল বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে রেশমার বেঁচে থাকার ঘটনায়।
কোনো দুর্ঘটনার পর এক থেকে দুই দিনের মধ্যে কাউকে জীবিত উদ্ধার করতে না পারলে জাতিসংঘ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি দিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) সমন্বয়কের মতে, ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকাটা নির্ভর করে দুর্ঘটনার সময় কী ঘটেছে তার ওপর। যদি গুরুতর আঘাত না হয়, অক্সিজেন ও পানির সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে, তবে আটকা পড়া ব্যক্তি অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে।
একদম না খেয়ে ঠিক কত দিন বাঁচা যায় তা হিসাব করা দুরূহ। তবে এ কথা বলা যায় যে খাদ্য বা পানীয় ছাড়া বেঁচে থাকার সীমা নির্ভর করে কিছু নিয়ামকের ওপর। ভুক্তভোগীর বয়স, শারীরিক সুস্থতা, ওজন, কাজের মাত্রা, জিনগত বৈশিষ্ট্য, মনোবল, পরিবেশের তাপমাত্রা ইত্যাদির ওপর বেঁচে থাকা নির্ভর করে। অসুস্থ একজনের তুলনায় সুস্থদেহের একজন ব্যক্তি না খেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকবেন। আবার যাঁদের ওজন বেশি, বিশেষ করে চর্বি বেশি, তাঁদের সঞ্চিত শক্তি বেশি থাকায় তাঁরা বাঁচবেন বেশি দিন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানির উপস্থিতি। যদি পর্যাপ্ত পানি পান করা যায় তাহলে বেঁচে থাকা নির্ভর করে সঞ্চিত শক্তির ওপর। প্রাথমিকভাবে গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয়, যা শক্তির জোগান দেয়। কিন্তু গ্লাইকোজেনের ভান্ডার থাকে মাত্র ছয় ঘণ্টা। এরপর চর্বি ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হয়। তৃতীয় দিন থেকে ফ্যাটি অ্যাসিড দিয়ে কিটোন বডি তৈরি হয়, যা শক্তির জোগান দেয়। এভাবে যত দিন চর্বি থাকে তত দিন ফ্যাটি অ্যাসিড আর কিটোন বডির ওপর নির্ভর করা যায়। চর্বি শেষ হয়ে গেলে প্রোটিন ভাঙা শুরু হয়। এ পর্যায়ে দ্রুত দেহ ক্ষয় হতে থাকে, ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের চরম ঘাটতি দেখা দেয় এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমে যেতে থাকে। একপর্যায়ে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।
আমাদের শরীরের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ হলো পানি। সকল শারীরিক ক্রিয়া পানির ওপর নির্ভর করে। তাই শরীরে পানির তীব্র অভাব দেখা দিলে তা দ্রুতই পূরণ করতে হয়, তা না হলে দেহের বেশির ভাগ অঙ্গের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং দ্রুতই মৃত্যু হয়। পানির অভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর। খুব গরম পরিবেশে মাত্র এক ঘণ্টায় পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে আর তা পূরণ না করলে কয়েক ঘণ্টায় মৃত্যু হতে পারে। আবার ঠান্ডা পরিবেশে ঘাম কম দিলে পানি ছাড়াও বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকা যায়।
তাহলে না খেয়ে কত দিন বাঁচা সম্ভব? যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উত্তর নেই, তবুও আমরা বলতে পারি, পানি পান করলে এবং আবহাওয়া অনুকূল হলে একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি অন্তত দুই মাস বেঁচে থাকতে সক্ষম। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান না করলে ওই একই ব্যক্তির পক্ষে দুই সপ্তাহের বেশি বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক হবে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে হয়তো অনেক কিছুই বলা সম্ভব নয়, তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ ধরনের ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকা অলৌকিক ঘটনাই বলতে হবে।
লেখক: ডিন, মেডিসিন অনুষদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৮৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে ভূমিকম্পের সাত দিন পর দুটি মেটারনিটি হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশকিছু নবজাতককে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ১৯৯০ সালে ফিলিপাইনের লুজন অঞ্চলে ভূমিকম্পের পর একটি হোটেলের ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৪ দিন পর জীবিত উদ্ধার করা হয় পেড্রিটো ডাইকে। ১৯৯৫ সালে ১৯ বছর বয়স্ক পার্ক সান হুন নামের এক নারী দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের ভেঙে যাওয়া পাঁচতলা সুপার মার্কেটের ভেতর ১৭ দিন বেঁচে ছিলেন। ২০০৪ সালে টার্কিতে ১৬ বছর বয়সের কালেমকে জীবিত উদ্ধার করা হয় প্রায় এক সপ্তাহ পর। অন্যদিকে ২০০৪ সালে ইরানের বাম শহরে ভূমিকম্পের নয় দিন পর শহরবানু মাজানদারানি নামের ৯৭ বছরের এক নারী ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার পান। অবশ্য তিনি পুরোপুরি না খেয়ে ছিলেন না।
সবচেয়ে বেশি দিন না খেয়ে বেঁচে ছিলেন পাকিস্তানের কাশ্মীরে ৪০ বছর বয়সী নকশা বিবি। ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া ঘরে ৬৩ দিন বেঁচে ছিলেন পচে যাওয়া খাবার আর অল্প কিছু চুইয়ে পড়া পানির ওপর। একই বছরে পাকিস্তানে ভূমিকম্পে ধসে পড়া একটি স্কুলের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে পাঁচ দিন পর তিনজন ছাত্রকে উদ্ধার করা হয়। ২০১০ সালে হাইতির প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে ধসে পড়া একটি বিপণিবিতানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২৭ দিন পর জীবিত উদ্ধার হন ইভান্স মোন্সিজোনাক, যিনি টিকে ছিলেন পয়োনিষ্কাশন পাইপের পানি খেয়ে। একই ভূমিকম্পে ১১ দিনের এক শিশুকে এক সপ্তাহ পর জীবিত উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ বিস্ময় ঘটল বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে রেশমার বেঁচে থাকার ঘটনায়।
কোনো দুর্ঘটনার পর এক থেকে দুই দিনের মধ্যে কাউকে জীবিত উদ্ধার করতে না পারলে জাতিসংঘ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি দিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) সমন্বয়কের মতে, ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকাটা নির্ভর করে দুর্ঘটনার সময় কী ঘটেছে তার ওপর। যদি গুরুতর আঘাত না হয়, অক্সিজেন ও পানির সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে, তবে আটকা পড়া ব্যক্তি অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে।
একদম না খেয়ে ঠিক কত দিন বাঁচা যায় তা হিসাব করা দুরূহ। তবে এ কথা বলা যায় যে খাদ্য বা পানীয় ছাড়া বেঁচে থাকার সীমা নির্ভর করে কিছু নিয়ামকের ওপর। ভুক্তভোগীর বয়স, শারীরিক সুস্থতা, ওজন, কাজের মাত্রা, জিনগত বৈশিষ্ট্য, মনোবল, পরিবেশের তাপমাত্রা ইত্যাদির ওপর বেঁচে থাকা নির্ভর করে। অসুস্থ একজনের তুলনায় সুস্থদেহের একজন ব্যক্তি না খেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকবেন। আবার যাঁদের ওজন বেশি, বিশেষ করে চর্বি বেশি, তাঁদের সঞ্চিত শক্তি বেশি থাকায় তাঁরা বাঁচবেন বেশি দিন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানির উপস্থিতি। যদি পর্যাপ্ত পানি পান করা যায় তাহলে বেঁচে থাকা নির্ভর করে সঞ্চিত শক্তির ওপর। প্রাথমিকভাবে গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয়, যা শক্তির জোগান দেয়। কিন্তু গ্লাইকোজেনের ভান্ডার থাকে মাত্র ছয় ঘণ্টা। এরপর চর্বি ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হয়। তৃতীয় দিন থেকে ফ্যাটি অ্যাসিড দিয়ে কিটোন বডি তৈরি হয়, যা শক্তির জোগান দেয়। এভাবে যত দিন চর্বি থাকে তত দিন ফ্যাটি অ্যাসিড আর কিটোন বডির ওপর নির্ভর করা যায়। চর্বি শেষ হয়ে গেলে প্রোটিন ভাঙা শুরু হয়। এ পর্যায়ে দ্রুত দেহ ক্ষয় হতে থাকে, ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের চরম ঘাটতি দেখা দেয় এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমে যেতে থাকে। একপর্যায়ে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।
আমাদের শরীরের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ হলো পানি। সকল শারীরিক ক্রিয়া পানির ওপর নির্ভর করে। তাই শরীরে পানির তীব্র অভাব দেখা দিলে তা দ্রুতই পূরণ করতে হয়, তা না হলে দেহের বেশির ভাগ অঙ্গের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং দ্রুতই মৃত্যু হয়। পানির অভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর। খুব গরম পরিবেশে মাত্র এক ঘণ্টায় পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে আর তা পূরণ না করলে কয়েক ঘণ্টায় মৃত্যু হতে পারে। আবার ঠান্ডা পরিবেশে ঘাম কম দিলে পানি ছাড়াও বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকা যায়।
তাহলে না খেয়ে কত দিন বাঁচা সম্ভব? যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উত্তর নেই, তবুও আমরা বলতে পারি, পানি পান করলে এবং আবহাওয়া অনুকূল হলে একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি অন্তত দুই মাস বেঁচে থাকতে সক্ষম। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান না করলে ওই একই ব্যক্তির পক্ষে দুই সপ্তাহের বেশি বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক হবে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে হয়তো অনেক কিছুই বলা সম্ভব নয়, তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ ধরনের ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকা অলৌকিক ঘটনাই বলতে হবে।
লেখক: ডিন, মেডিসিন অনুষদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments