গোলটেবিল বৈঠক সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও নাগরিক অধিকার
১৬ জুন ২০১৩, প্রথম আলোর আয়োজনে
‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও নাগরিক অধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা
হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক
শরীফ ভূঁইয়া: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মুনির হাসান: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
মিজানুর রহমান খান: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন বিষয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আইনটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ আইনের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আলোচনায় এসব বিষয় প্রাধান্য পাবে। শুরুতে আলোচনা করবেন মুহাম্মদ নুরুল হুদা।
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: সন্ত্রাসবিরোধী আইন গৃহীত হয় ২০০৯ সালে। অনেক আগে থেকেই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে এ আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। ২০০৪ সালের আগে থেকে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন এরই ধারাবাহিকতা। আইনটি একবার সংশোধন হয়েছে। এখন দ্বিতীয়বার সংশোধন হলো। এ আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আরও নিবর্তনমূলক অনেক আইন আছে। এগুলো দিয়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা যায়। বিশেষ ক্ষমতা আইন, দ্রুত বিচার আইন—এগুলোর অপব্যবহার তেমন হয়নি। এ অবস্থায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার হবেই, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। তবে অপব্যবহার যাতে না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে তদন্তের কথা বলা থাকে। কিন্তু কোন বিষয়ে কে তদন্ত করবেন, সেটা বলা থাকে না। তদন্তের ক্ষেত্রে একটি প্রশাসনিক নির্দেশ থাকা প্রয়োজন।
ভারত ও ব্রিটেনে টেলিফোনে আড়িপাতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের। এর মাধ্যমে তারা বড় বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে পেরেছে। এখন মূল বিষয় হচ্ছে, কীভাবে প্রয়োগ করা হবে। প্রয়োগের পদ্ধতি সঠিক না হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। আমার জানামতে, সন্ত্রাসের সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। তবে সন্ত্রাস রোধে খুব বেশি ফৌজদারি আইন হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই এর ব্যাপক প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ এখনো দেখা যায়নি। আমরা আশা করতে পারি, সরকার এবং রাজনীতিবিদ উভয়ই এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। রাজনীতিবিদদের হয়রানির উদ্দেশ্য থাকলে তা আরও অনেক আইনের মাধ্যমে করা যায়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এখনো ব্যবহার-অপব্যবহার কোনোটাই খুব বেশি হয়নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা (নিম্ন আদালতের বিচারক) সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সবার সন্দেহ থাকে, তাঁরা কতটুকু নিরপেক্ষ থাকবেন। এ জায়গায় কিছু কাজ করতে হবে। সব সন্ত্রাসী অপরাধী কিন্তু অপরাধী সন্ত্রাসী নয়। এ জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োজন হয়। আইনের অপব্যবহার রোধে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা দরকার। সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অপপ্রয়োগ রোধ করতে হবে। প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে। আইনটি যাতে প্রযুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা বাংলাদেশের মূলনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাদের অন্যায় কার্যকলাপ মোকাবিলার জন্য এ আইন দরকার।
আলী ইমাম মজুমদার: আইনটি একটি সংশোধনী আইন। সন্ত্রাস সারা পৃথিবীতে আছে। বাংলাদেশেও কোনো অংশে কম না। এর বিরুদ্ধে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। ২০০৯ সালের আইনের কিছু অপূর্ণতা ছিল এবং সে অপূর্ণতা দূর করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। এ আইনটি পাস না করলে আমাদের দেশ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ জন্য তড়িঘড়ি করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি পাস করা হলো। এখন কথা উঠছে, এ আইনের অপপ্রয়োগ হবে কি না। দেশে নিবর্তনমূলক আইন আছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এখনো খুব একটা মামলা হয়নি। কিন্তু মামলা করতে দুটি প্রতিবন্ধকতা ছিল। প্রথমত, মামলার এফআইআরে (প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন) জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (নিম্ন আদালতের বিচারক) অনুমতি লাগত। বর্তমান সংশোধনীতে বলা হয়েছে, তাঁকে অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়ার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এটা এখনো রয়েছে। এ দুই কারণে সহজে মামলা করা যেত না। রাষ্ট্র পরিচালনা, সন্ত্রাস দমন ইত্যাদির জন্য সরকারের আইন দরকার হয়। সরকারের চাহিদা নিরূপণ করে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক। আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি, সরকার থেকে খসড়া পাঠানোর সময় দুটি বিষয় ছিল না। কিন্তু সংসদীয় কমিটি দুটি বিধান যুক্ত করে দিল। তারা কীভাবে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারল? এটা আমাকে ভাবিয়েছে। আরও দু-একটি আইন থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতির বিধান উঠিয়ে দেওয়া ভুল হয়েছে। ১৮৭৮ সালের ব্রিটিশদের তৈরি করা আইন আমরা অনুসরণ করছি। এর ২৯ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিলের আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতির বিধান ছিল। ১৯৮০ সালে ৭ নম্বর আইনের মাধ্যমে সেটা উঠিয়ে নেওয়া হয়।
১৯৫৯ সালে নতুনভাবে ভারতে অস্ত্র আইন হয়। এ আইনের ৩৯ ধারায় বলা আছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া কোনো অভিযোগপত্র হবে না। এখনো ভারতে এ বিধান আছে। এটা কোনো একটা প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়ন করা নয়। এটা করা হয় অধিক নিরাপত্তার জন্য।
মিজানুর রহমান খান: অন্যান্য দেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ফেসবুক টুইটারের বিষয়টি নির্দিষ্ট করা নেই। কঠোর আইনের প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগের প্রশ্নের সঙ্গে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কালো তালিকাভুক্তির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটে দেখলাম, বাংলাদেশ কালো তালিকাভুক্ত বা উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে ইতিমধ্যেই আছে। ২০০৯ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কথা বলে আইন পাস হয়। এবারে কেবলই বিদেশি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বার্থের কথা বলা হয়েছে। এফএটিএফের এ-সংক্রান্ত চাহিদা পূরণে ৪১ সদস্যের ভারতীয় সংসদীয় কমিটি দীর্ঘদিন আলোচনা করে ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে প্রতিটি নতুন বাক্য যুক্ত করার ব্যাখ্যা আছে। আর আমাদের কমিটি এক দিন সভা করে দেড় পাতার দায়সারা প্রতিবেদন দিয়েছে। জাতিসংঘের নয়টি কনভেনশন আইনটির তফসিলে যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে তুলতে হবে। তা না করায় সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেছে। উপরন্তু চরম অদক্ষ, অস্বচ্ছ, ভুলভাল বাক্য গঠন ও অনুবাদ হয়েছে।
এমন হয়েছে, একই অপরাধে ১০টি আইনে ১০ ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বিচারের কয়েক ধরনের ফোরাম আছে। যেমন, ফেসবুক বা ইন্টারনেট অপব্যবহারের বিচারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ১০ বছরের কারাদণ্ড থাকার পরও আবারও তাকে এই আইনে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। মোবাইল কোর্টের ক্ষেত্রে কী হয়েছে? কোনো একটা অপরাধের জন্য বিচারিক হাকিম হয়তো তিন মাসের জেল দেবেন। সেই অপরাধে মোবাইল কোর্টের বিচারক হয়তো ৫০০ টাকা জরিমানা করবেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনেও এমনটা ঘটেছে। সব মিলিয়ে নাগরিক হিসেবে চরম অস্থিরতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে ক্রমাগত আইন পাস হতে থাকাটা খুবই উদ্বেগজনক।
শরীফ ভূঁইয়া: দেশে কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে নিজের সুবিধার দিকটি প্রাধান্য পায়। আইনটি হয়তো ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি করার পদ্ধতিটি মানা হয়নি। সাংসদেরা যেকোনো আইন সংসদে পাস করতে পারেন। কিন্তু এখানেও একটি পদ্ধতি আছে। প্রতিটি আইনের ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই করা হয়। এক দিন মাত্র সংসদীয় কমিটিতে ছিল। এক দিনে ওনারা কী করবেন? নয়টি আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি বাংলাদেশের আইনের অংশ করা হয়েছে। এগুলো এখন স্থানীয় আইনের অংশ হবে। আন্তর্জাতিক আইনে যখন চুক্তি করি, তখন আন্তর্জাতিকভাবে এটা মানার বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে থাকে না। আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তির ক্ষেত্রে মাত্র এক লাইনে বলা হয়েছে—এগুলো দেশীয় আইনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো। এসব সমঝোতা চুক্তির বিবরণ প্রায় ৫০০ পাতার। সংসদীয় কমিটিতে ও সাংসদদের হাতে এর অনুলিপি দেওয়া হয়নি। ফলে কেউ কিছু না জেনে অস্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে আইনটি পাস করেছেন। এটা এখন বাংলাদেশের আইনের অংশ। সাংসদদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হলো। আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এর আগে দু-একবার আন্তর্জাতিক চুক্তিকে দেশীয় আইনের অংশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংসদে বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রথম সবাইকে অন্ধকারে রেখে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক নীতিতে ব্যর্থতা আছে। কাউকে কাউকে খুশি করার জন্য এটা হতে পারে। আবার এই সময়ে আইনটির অপব্যবহারের উদ্দেশ্যটিও বাদ দেওয়া যাবে না। ৪০ বছরে একটি মানবাধিকার চুক্তিকে দেশীয় আইনের অংশ করা হয়নি। কেবল অনুসমর্থন (র্যাটিফাই) করা হয়েছে। অনুমসর্থন করলেও আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি মানার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। সেখানে এটা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ যে আইনের অংশ করতে হবে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল কি না, সেটিও ভাবার বিষয়।
মুনির হাসান: দীর্ঘদিন থেকে আমরা চাইছিলাম ফেসবুক, টুইটারের বিষয়গুলো মূল ধারায় আসুক। আইনটি ওয়েবসাইটে দিলে এ সম্পর্কে ভালো-মন্দ অনেক মতামত পাওয়া যেত। যিনি এ বিষয়গুলো তদন্ত করবেন, তাঁর এক ধরনের কারিগরি যোগ্যতা থাকতে হবে। আমেরিকায় ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে সাক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এক ব্যক্তি অন্যজনের নামে ১০০ জনকে খুদে বার্তা পাঠাতে পারেন। এর ৯০ শতাংশই মানুষই বুঝবেন না যে এটি অন্যজনের খুদে বার্তা। এভাবে গুরুতর অপরাধ হতে পারে। আমাদের দেশেও দেখেছি এটির অপব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। তাই ফেসবুক, টুইটারকে আইনের আওতায় আনাকে খুব একটা গলদ দেখি না। এই অপরাধগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দেশে কোনো আইটি ফরেনসিক ল্যাব নেই। এটা না থাকার কারণে কারও অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হবে। অপরাধ প্রমাণ করার ব্যাপারে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। কেউ যদি অপরাধমূলক কাজে ফেসবুক ব্যবহার করে, তাহলে তাকে কেন ধরা যাবে না। অন্য অপরাধীকে ধরা গেলে তাকেও ধরা যাবে। পত্রিকায় কোনো কিছু লিখে যদি দাঙ্গা বাধানো যায়, ফেসবুকে লিখেও ব্যাপক মানুষকে প্রভাবিত করে এমন অপরাধ করা যায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আমরা এটা দেখেছিও। এ আইনে মুক্তচিন্তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তা না। বরং মুক্তচিন্তাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।
আব্দুল কাইয়ুম: সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা থেকে কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা এসেছে। কর্তৃপক্ষ এগুলো বিবেচনায় নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক
শরীফ ভূঁইয়া: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মুনির হাসান: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
মিজানুর রহমান খান: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন বিষয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আইনটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ আইনের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আলোচনায় এসব বিষয় প্রাধান্য পাবে। শুরুতে আলোচনা করবেন মুহাম্মদ নুরুল হুদা।
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: সন্ত্রাসবিরোধী আইন গৃহীত হয় ২০০৯ সালে। অনেক আগে থেকেই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে এ আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। ২০০৪ সালের আগে থেকে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন এরই ধারাবাহিকতা। আইনটি একবার সংশোধন হয়েছে। এখন দ্বিতীয়বার সংশোধন হলো। এ আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আরও নিবর্তনমূলক অনেক আইন আছে। এগুলো দিয়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা যায়। বিশেষ ক্ষমতা আইন, দ্রুত বিচার আইন—এগুলোর অপব্যবহার তেমন হয়নি। এ অবস্থায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার হবেই, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। তবে অপব্যবহার যাতে না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে তদন্তের কথা বলা থাকে। কিন্তু কোন বিষয়ে কে তদন্ত করবেন, সেটা বলা থাকে না। তদন্তের ক্ষেত্রে একটি প্রশাসনিক নির্দেশ থাকা প্রয়োজন।
ভারত ও ব্রিটেনে টেলিফোনে আড়িপাতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের। এর মাধ্যমে তারা বড় বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে পেরেছে। এখন মূল বিষয় হচ্ছে, কীভাবে প্রয়োগ করা হবে। প্রয়োগের পদ্ধতি সঠিক না হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। আমার জানামতে, সন্ত্রাসের সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। তবে সন্ত্রাস রোধে খুব বেশি ফৌজদারি আইন হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই এর ব্যাপক প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ এখনো দেখা যায়নি। আমরা আশা করতে পারি, সরকার এবং রাজনীতিবিদ উভয়ই এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। রাজনীতিবিদদের হয়রানির উদ্দেশ্য থাকলে তা আরও অনেক আইনের মাধ্যমে করা যায়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এখনো ব্যবহার-অপব্যবহার কোনোটাই খুব বেশি হয়নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা (নিম্ন আদালতের বিচারক) সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সবার সন্দেহ থাকে, তাঁরা কতটুকু নিরপেক্ষ থাকবেন। এ জায়গায় কিছু কাজ করতে হবে। সব সন্ত্রাসী অপরাধী কিন্তু অপরাধী সন্ত্রাসী নয়। এ জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োজন হয়। আইনের অপব্যবহার রোধে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা দরকার। সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অপপ্রয়োগ রোধ করতে হবে। প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে। আইনটি যাতে প্রযুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা বাংলাদেশের মূলনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাদের অন্যায় কার্যকলাপ মোকাবিলার জন্য এ আইন দরকার।
আলী ইমাম মজুমদার: আইনটি একটি সংশোধনী আইন। সন্ত্রাস সারা পৃথিবীতে আছে। বাংলাদেশেও কোনো অংশে কম না। এর বিরুদ্ধে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। ২০০৯ সালের আইনের কিছু অপূর্ণতা ছিল এবং সে অপূর্ণতা দূর করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। এ আইনটি পাস না করলে আমাদের দেশ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ জন্য তড়িঘড়ি করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি পাস করা হলো। এখন কথা উঠছে, এ আইনের অপপ্রয়োগ হবে কি না। দেশে নিবর্তনমূলক আইন আছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এখনো খুব একটা মামলা হয়নি। কিন্তু মামলা করতে দুটি প্রতিবন্ধকতা ছিল। প্রথমত, মামলার এফআইআরে (প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন) জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (নিম্ন আদালতের বিচারক) অনুমতি লাগত। বর্তমান সংশোধনীতে বলা হয়েছে, তাঁকে অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়ার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এটা এখনো রয়েছে। এ দুই কারণে সহজে মামলা করা যেত না। রাষ্ট্র পরিচালনা, সন্ত্রাস দমন ইত্যাদির জন্য সরকারের আইন দরকার হয়। সরকারের চাহিদা নিরূপণ করে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক। আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি, সরকার থেকে খসড়া পাঠানোর সময় দুটি বিষয় ছিল না। কিন্তু সংসদীয় কমিটি দুটি বিধান যুক্ত করে দিল। তারা কীভাবে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারল? এটা আমাকে ভাবিয়েছে। আরও দু-একটি আইন থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতির বিধান উঠিয়ে দেওয়া ভুল হয়েছে। ১৮৭৮ সালের ব্রিটিশদের তৈরি করা আইন আমরা অনুসরণ করছি। এর ২৯ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিলের আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতির বিধান ছিল। ১৯৮০ সালে ৭ নম্বর আইনের মাধ্যমে সেটা উঠিয়ে নেওয়া হয়।
১৯৫৯ সালে নতুনভাবে ভারতে অস্ত্র আইন হয়। এ আইনের ৩৯ ধারায় বলা আছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া কোনো অভিযোগপত্র হবে না। এখনো ভারতে এ বিধান আছে। এটা কোনো একটা প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়ন করা নয়। এটা করা হয় অধিক নিরাপত্তার জন্য।
মিজানুর রহমান খান: অন্যান্য দেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ফেসবুক টুইটারের বিষয়টি নির্দিষ্ট করা নেই। কঠোর আইনের প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগের প্রশ্নের সঙ্গে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কালো তালিকাভুক্তির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটে দেখলাম, বাংলাদেশ কালো তালিকাভুক্ত বা উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে ইতিমধ্যেই আছে। ২০০৯ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কথা বলে আইন পাস হয়। এবারে কেবলই বিদেশি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বার্থের কথা বলা হয়েছে। এফএটিএফের এ-সংক্রান্ত চাহিদা পূরণে ৪১ সদস্যের ভারতীয় সংসদীয় কমিটি দীর্ঘদিন আলোচনা করে ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে প্রতিটি নতুন বাক্য যুক্ত করার ব্যাখ্যা আছে। আর আমাদের কমিটি এক দিন সভা করে দেড় পাতার দায়সারা প্রতিবেদন দিয়েছে। জাতিসংঘের নয়টি কনভেনশন আইনটির তফসিলে যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে তুলতে হবে। তা না করায় সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেছে। উপরন্তু চরম অদক্ষ, অস্বচ্ছ, ভুলভাল বাক্য গঠন ও অনুবাদ হয়েছে।
এমন হয়েছে, একই অপরাধে ১০টি আইনে ১০ ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বিচারের কয়েক ধরনের ফোরাম আছে। যেমন, ফেসবুক বা ইন্টারনেট অপব্যবহারের বিচারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ১০ বছরের কারাদণ্ড থাকার পরও আবারও তাকে এই আইনে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। মোবাইল কোর্টের ক্ষেত্রে কী হয়েছে? কোনো একটা অপরাধের জন্য বিচারিক হাকিম হয়তো তিন মাসের জেল দেবেন। সেই অপরাধে মোবাইল কোর্টের বিচারক হয়তো ৫০০ টাকা জরিমানা করবেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনেও এমনটা ঘটেছে। সব মিলিয়ে নাগরিক হিসেবে চরম অস্থিরতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে ক্রমাগত আইন পাস হতে থাকাটা খুবই উদ্বেগজনক।
শরীফ ভূঁইয়া: দেশে কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে নিজের সুবিধার দিকটি প্রাধান্য পায়। আইনটি হয়তো ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি করার পদ্ধতিটি মানা হয়নি। সাংসদেরা যেকোনো আইন সংসদে পাস করতে পারেন। কিন্তু এখানেও একটি পদ্ধতি আছে। প্রতিটি আইনের ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই করা হয়। এক দিন মাত্র সংসদীয় কমিটিতে ছিল। এক দিনে ওনারা কী করবেন? নয়টি আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি বাংলাদেশের আইনের অংশ করা হয়েছে। এগুলো এখন স্থানীয় আইনের অংশ হবে। আন্তর্জাতিক আইনে যখন চুক্তি করি, তখন আন্তর্জাতিকভাবে এটা মানার বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে থাকে না। আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তির ক্ষেত্রে মাত্র এক লাইনে বলা হয়েছে—এগুলো দেশীয় আইনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো। এসব সমঝোতা চুক্তির বিবরণ প্রায় ৫০০ পাতার। সংসদীয় কমিটিতে ও সাংসদদের হাতে এর অনুলিপি দেওয়া হয়নি। ফলে কেউ কিছু না জেনে অস্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে আইনটি পাস করেছেন। এটা এখন বাংলাদেশের আইনের অংশ। সাংসদদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হলো। আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এর আগে দু-একবার আন্তর্জাতিক চুক্তিকে দেশীয় আইনের অংশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংসদে বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রথম সবাইকে অন্ধকারে রেখে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক নীতিতে ব্যর্থতা আছে। কাউকে কাউকে খুশি করার জন্য এটা হতে পারে। আবার এই সময়ে আইনটির অপব্যবহারের উদ্দেশ্যটিও বাদ দেওয়া যাবে না। ৪০ বছরে একটি মানবাধিকার চুক্তিকে দেশীয় আইনের অংশ করা হয়নি। কেবল অনুসমর্থন (র্যাটিফাই) করা হয়েছে। অনুমসর্থন করলেও আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি মানার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। সেখানে এটা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ যে আইনের অংশ করতে হবে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল কি না, সেটিও ভাবার বিষয়।
মুনির হাসান: দীর্ঘদিন থেকে আমরা চাইছিলাম ফেসবুক, টুইটারের বিষয়গুলো মূল ধারায় আসুক। আইনটি ওয়েবসাইটে দিলে এ সম্পর্কে ভালো-মন্দ অনেক মতামত পাওয়া যেত। যিনি এ বিষয়গুলো তদন্ত করবেন, তাঁর এক ধরনের কারিগরি যোগ্যতা থাকতে হবে। আমেরিকায় ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে সাক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এক ব্যক্তি অন্যজনের নামে ১০০ জনকে খুদে বার্তা পাঠাতে পারেন। এর ৯০ শতাংশই মানুষই বুঝবেন না যে এটি অন্যজনের খুদে বার্তা। এভাবে গুরুতর অপরাধ হতে পারে। আমাদের দেশেও দেখেছি এটির অপব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। তাই ফেসবুক, টুইটারকে আইনের আওতায় আনাকে খুব একটা গলদ দেখি না। এই অপরাধগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দেশে কোনো আইটি ফরেনসিক ল্যাব নেই। এটা না থাকার কারণে কারও অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হবে। অপরাধ প্রমাণ করার ব্যাপারে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। কেউ যদি অপরাধমূলক কাজে ফেসবুক ব্যবহার করে, তাহলে তাকে কেন ধরা যাবে না। অন্য অপরাধীকে ধরা গেলে তাকেও ধরা যাবে। পত্রিকায় কোনো কিছু লিখে যদি দাঙ্গা বাধানো যায়, ফেসবুকে লিখেও ব্যাপক মানুষকে প্রভাবিত করে এমন অপরাধ করা যায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আমরা এটা দেখেছিও। এ আইনে মুক্তচিন্তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তা না। বরং মুক্তচিন্তাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।
আব্দুল কাইয়ুম: সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা থেকে কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা এসেছে। কর্তৃপক্ষ এগুলো বিবেচনায় নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
No comments