স্বাধীন দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধার জীবন নিরাপদ নয়- পিতাকে পুত্র by কাদের সিদ্দিকী
গত সপ্তাহে তোমাকে লেখা হয়নি। নানা টানপড়েনে সময় করে উঠতে পারিনি। আর
শরীর ভালো ছিল না। আগামী ৯ ফেব্র“য়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আমাদের
জন্ম দেয়া রাজনৈতিক দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন।
আজ
থেকে ১৩ বছর আগে এই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনেই কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের
জন্ম হয়েছিল। গরিব-দুঃখী নির্যাতিত মানুষের পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব
পালন করতে। তাই সম্মেলনের কারণে দু-এক পর্ব লিখতে না পারলে মাফ করো।
বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট যে যা-ই বলুন যথাযথ
বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে সফল হতে পারেনি। এটা মনে রাখতে হবে সরকার যত
খারাপ ভাষায় কথা বলবে, বুঝতে হবে বিরোধী দল সঠিক পথে রয়েছে। কিন্তু
প্রধান বিরোধী দল নারী নির্যাতনের কথা বলে না, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া
সে কথা বলে না। শিকদের চোখে মরিচের গুঁড়ো ছিটালে কথা বলে না। বিবৃতি দেয়,
কিন্তু অন্তরে তাগিদ বোধ করে না। আর সরকারÑ সে তো কহতব্য নয়! এত সময়
তুমি বেঁচে থাকলে এ অরাজক অবস্থা দেখে তোমার মতো সাহসী পুরুষও হয়তো
আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। বড় খারাপ অবস্থায় আছি আমরা। এই সে দিন
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী অতি সাধারণ ছাপোষা বাচ্চু রাজাকার নামে একজনকে
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। বাচ্চু রাজাকার উপস্থিত ছিল
না, তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ফাঁসির আদেশ দিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজাকারের
ফাঁসি হলে কেউ কান্নাকাটি করবে এমন ভাবার কারণ নেই। কিন্তু রাজাকারের ফাঁসি
হলো রাজাকার কমান্ডারদের নাম এলো না, কমান্ডারের কমান্ডার আসামি হলো না,
যারা রাজাকার বানাল তাদের ফাঁসি হলো নাÑ এ প্রশ্ন তো থেকেই যাবে। বাচ্চু
রাজাকার একসময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেছে। লম্বা
দাড়িতে মেহেদি মাখা মারাত্মক এক নূরানী চেহারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সোয়া
শ’-দেড় শ’ টাকার বেতনভুক্ত রাজাকার হলেও এখন তার মারাত্মক দাপট। ধনসম্পদের
কোনো অভাব ছিল না। মাদরাসা, মক্তব, এতিমখানা বহু কিছুর মালিক। এ কারণে
বিদেশ থেকে দেদার পয়সার আমদানি। আমার ওসব নিয়ে কোনো কথা নেই। আমার মনে
প্রশ্ন, গত বছর বাচ্চু রাজাকার সম্পর্কে যখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের
তদন্তকারীরা কাজ শুরু করে, তখন থেকে তাকে কঠিন পুলিশি নজরে রাখা হয়েছিল।
ঠিক যে দিন তার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়, সে দিনও সে বাড়িতেই ছিল। কিন্তু
গ্রেফতার করতে গিয়ে দেখা গেল পাখি উড়ে গেছে। তাহলে কাকে পাহারা দেয়া
হলো? যে দিন থেকে বাচ্চু রাজাকারকে নজরে রাখতে পুলিশের দায়িত্ব দেয়া
হয়েছিল সেই পুলিশদের এবং তদারককারী অফিসার তাদের কাউকে কি এই ব্যর্থতার
জন্য জিজ্ঞেস করা হয়েছে অথবা শাস্তি দেয়া হয়েছে? যে দিন ভদ্রলোক
পালিয়েছেন বলে বলা হলো, সে দিন এক মহিলা এএসপির স্বকণ্ঠ বয়ান শুনেছিলাম।
তিনি বলেছিলেন, ‘গতকালও আমরা কনফার্ম ছিলাম বাচ্চু রাজাকার বাড়িতেই আছে।’
তাহলে পালালেন কী করে? ঘুষের জমানায় তাদেরও কি দু-চার-দশ কোটি ঘুষ দিয়ে
পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে? নাকি যা পত্রপত্রিকায় দেখছি, বাচ্চু রাজাকার
কোথায় আছে সরকার জানে। তা যদি হয় তাহলে কি এটা সরকারি কৌশল, বাচ্চু
রাজাকার পালিয়ে যাবেÑ সাীসাবুদ কোনো কিছু হবে না, তড়িঘড়ি একটি রায়
দিয়ে টেস্ট করে দেখা হবে প্রতিক্রিয়া কী হয়। কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি
পরপারে আছো। ওপার থেকে যদি এসব কর্মকাণ্ডের কিছু বুঝতে পারো, তাহলে তোমার
রুহানি শক্তিতে দু-এক কথা আমাকে জানাও না। তাতে তোমার লাভ ছাড়া তি হওয়ার
কোনো কারণ নেই।
যাক এবার আসি মুক্তিযোদ্ধাদের দুরবস্থা নিয়ে। গত ১৮ জানুয়ারি ফারুক আহমেদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। সত্যিই স্বাধীন দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধার জীবন নিরাপদ নয়। সিলেটের ফারুক আহমেদ স্কুলজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিল। তোমার খুবই ঘনিষ্ঠ শিষ্য বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ’৬৭ থেকে ’৬৯ একটানা দুই বছর যখন জেলে তখন এই ফারুক আহমেদের সাথে আমার পরিচয়। ছেলেটি আমার চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট ছিল। তুমি ৫৫ বছরে ওপারে গেছো। তোমার মতো ফারুকও আততায়ীর গুলিতে ৬০ বছর বয়সে পরপারে গেল। মুক্তিযুদ্ধে ওর নিষ্ঠার কোনো তুলনা হয় না। তোমার হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামেও সে আমার সাথী হয়েছিল। জীবনে দু’বার আমার হাত ফস্কে গুলি বেরিয়েছে। একবার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধে, আরেকবার ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিসফায়ারে কেউ হতাহত হয়নি। হঠাৎ করে স্টেনগানের একটি গুলি আন্ধির কাছাকাছি একটি বাড়িতে ঘরের চাল ফুটো করে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর ১৯৭৫ সালে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়ায় রাত ১০-১১টার দিকে রাশিয়ান স্টেনগানের এক মিসফায়ার ফারুকের পায়ে এবং বাবুল হকের হাতে লেগেছিল। দু’জনই সারাজীবনের জন্য তিগ্রস্ত হয়, ফারুক একটু আগাগোড়াই বদরাগি স্বভাবের। প্রথম অবস্থায় ভালোভাবে চিকিৎসা করা যায়নি। মেঘালয়ের তুরা হাসপাতালে থাকতে চায়নি। তাই শুরু থেকেই তার পায়ের বুড়ো আঙুলে পচন ধরেছিল। যা জীবনে কোনো দিন পুরোপুরি ভালো হয়নি। কমবেশি সব সময় সেই কাঁচা ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে। যে দিন গুলি লেগেছিল সে দিন থেকে যত দিন আমার প্রতি ওর আস্থা ছিল তত দিন কখনো ওর গায়ে গুলি লাগার জন্য উহ্ আহ্ টু-টা করেনি। বাবুল হকও তেমনি। ও এখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্যামেরা চালায়। গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে ক্যামেরা ধরে রাখতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এ জন্য এক দিনও কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেনি। আমি করি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ফারুক করত আওয়ামী লীগ। ভিন্ন স্রোতে পড়ে সে আমার অনেক নাহক সমালোচনা করেছে। জঘন্য গালাগালও করেছে। কিন্তু আমি ওকে কোনো দিন কিছু বলতে পারিনি। ওর গালির চেয়ে আমার হাত ফসকে গুলি সব সময় অনেক বড় মনে হয়েছে। গালির আঘাতের চেয়ে গুলির আঘাত অনেক অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক হওয়ায় ওর প্রতি কোনো দিন ুব্ধ হতে পারিনি, অকল্যাণ কামনা করিনি। তার পরও ওর মৃত্যুর পরপর ওর স্ত্রী যখন বলেছে তার স্বামী দলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছে, দলীয় অপছন্দের লোকেরা এ হত্যার জন্য দায়ী, তখন বুকটা চৌচির হয়ে গেছে। যে দলের জন্য এত শ্রম দিয়েছে তাকে কায়েমি স্বার্থের কারণে দলের লোকেরা হত্যা করলে অন্যেরা কোন সাহসে দল করবে? আরো মনটা বড় বেশি খারাপ হয়েছে, টাঙ্গাইলের সাধারণ মানুষের ওপর এ রকম একটি নিবেদিত সার্বণিক রাজনৈতিক মানুষের মৃত্যু কোনো শোকের ছাপ ফেলেনি। কেন ফেলেনি বলতে পারব না। তবে এটাই সত্য যে, তেমন কোনো শোকের ছাপ ল করা যায়নি।
আমার এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ বীর প্রতীককে তুমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতে। আমি বেশ কয়েকবার ওকে তোমার কাছে নিয়ে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে আমার ছায়া হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের এক সময় আমার দেহরী বাহিনীতে যারা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ফজলুল হক বীর প্রতীক, আবদুল্লাহ বীর প্রতীক, ছানোয়ার, আব্দুল লতিফ ভম্বল, বজলু, দুরমুজ খাঁ, মোমেন, মাসুদ, ত্রিশালের আবুল কালাম আজাদ, কস্তুরিপাড়ার শামসু, মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা, আরিফ আহমেদ দুলাল, আব্দুল হালিম, তমশের আলী। এদের মধ্যে তামাইটের আবদুল্লাহ একেবারে অরজ্ঞানহীন। প্রথম যেবার মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে গিয়েছিল, কঙ্কালের মতো স্বাস্থ্যগতর দেখে ওকে আনফিট করে বের করে দিয়েছিলাম। মাস দেড়েক পর আবার সে ভর্তি হতে যায়। সেবার ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান ওকে ভীষণ পরীা-নিরীা করে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করেছিল। স্বাধীনতার পর বিদেশী এক প্রচারমাধ্যমে সাাৎকারে যা বলেছিল, ‘আমি গরিব মানুষের ছেলে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাই। শুনলাম দেশে যুদ্ধ লাগছে। প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ পাই। লেখাপড়া জানি না, তেমন কিছু বুঝি না। দেখলাম একদল পাকিস্তান রাখতে চায়, আরেক দল বাংলাদেশ বানাতে চায়। পাকিস্তানে তো আছিই। আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ বানাতে পারলে তো ভালোই হয়। তাই মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমবার ভর্তি হতে পারিনি। পরে আবার ভাবলাম, প্রথম মুক্তিবাহিনীতে যাবো, এবার যদি না নেয় তাহলে রাজাকারে ভর্তি হবো। যুদ্ধ আমাকে করতেই হবে। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ ছাড়া ঘরে বসে থাকতে পারব না।’
সে ১৫-১৬ বছরের কিশোর। ওই সময় ঘরে থাকা তার পৌরুষে বাধে। তাই ঘর থেকে বেরোনো দরকার। তাই চেষ্টা করেছে স্বাধীনতার পে থাকতে, স্থান না পেলে বিপে যেত। কারণ মূল ল্য তার যুদ্ধ। এটা আমার কথা নয়, এটা আবদুল্লাহর কথা। মুক্তিযুদ্ধে তার মতো অসীম সাহসী যোদ্ধা খুব কম দেখেছি। বুদ্ধিশুদ্ধি তখনো কম ছিল, এখনো সোজা সরল একজন মানুষ। যদি সে সেনাবাহিনীর জেনারেল অথবা রাজনৈতিক বড় কোনো নেতা হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসের জন্য তার বীর প্রতীক খেতাবের মূল্য হতো হাজার হাজার কোটির সমান। কিন্তু যেহেতু দরিদ্র ঘরের সন্তান, আমার সাথে থাকার কারণে চুরিচামারি শিখতে পারেনি, একেবারে নিঃস্ব দরিদ্রের মতো চলে, সেহেতু কোট প্যান্ট-টাই পরা খেতাবপ্রাপ্তদের মতো জাতীয় কোনো মূল্যায়ন নেই। কথাগুলো তোমাকে বড় দুঃখে জানাচ্ছি। ঈমান ঠিক থাকলে তাকে অনেক বেঈমানরাই ভালো বলে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন অনুগত ছিল, ’৭৫-এ তোমার হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামেও তেমনই ছিল, এখনো আছে। তাই বেঈমান দালালদের কাছে সে খুবই মূল্যহীন। ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামে আমার ছায়া হয়ে ছিল। বিয়ে করেছে সে সময়ই। এখন দুই মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েগুলো খুবই ভালো ছাত্রী। আমার ছেলেমেয়ে এ প্লাস পায়নি। কিন্তু ওর ছেলেমেয়ে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। আল্লাহ রহম না করলে কি অমন হয়? মিরপুর চিড়িয়াখানার সামনে পরিত্যক্ত কয়েক একর জমির ওপর সারা দেশের কয়েক শ’ মুক্তিযোদ্ধা থাকে। সেখানে ছোট্ট একটু জায়গা নিয়ে আবদুল্লাহ বীর প্রতীকও থাকে। নিজেদের মধ্যে খুব বেশি মিল নেই। যে জন্য বাইরের লোকেরাও তাদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করতে পারে। যেটা সব সময়ই করে। খুব সম্ভবত এখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক নেতা মিরপুরের আমির হোসেন মোল্লা। জানি না, সে আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কি না। কিন্তু যখন যে সরকার আসে সেই সরকারের লেজুড় সাজে। তার আবার মূল নেতারা ক’দিন আগে বিএনপিতে গেছে। সুবিধার জন্য এক সময় আমার কাছেও আসত। বিএনপির আমলে একবার জায়গাটি কোনো ধনবানকে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি তার সোচ্চার প্রতিবাদ করেছিলাম। সে জন্য আর লিজ দিতে পারেনি। কয়েক শ’ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সেখানে আছে। কিন্তু তাদের ওপর বহিরাগতদের জোরজুলুমের শেষ নেই। বিশেষ করে সরকারি দলের জোরজুলুম সীমাহীন। অতি সম্প্রতি বীর প্রতীক আবদুল্লাহর রুটি-রুজির একমাত্র পথ কয়েকটি গরু। সেই গরু-বাছুর তাড়িয়ে দিয়ে তার ঘর ভেঙে ওখানকার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুল মান্নান নামে এক তস্কর দখল করে বাঁশের দোতলা বানিয়েছে। ইংরেজের বিরুদ্ধে ইতিহাসে তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিল। আর তস্কর মান্নান খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে বাঁশের দোতলা বানিয়েছে। শোনা যায় তাকে নাকি সব রকমের সহায়তা করছেন ওখানকার সংসদ সদস্য আসলামুল হক। অন্য দিকে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা আমির হোসেন মোল্লা। তোমাকে কী বলব, স্বাধীন দেশে তস্করদের কত সাহস, মসজিদের মধ্যে ঢুকে বাসাইল থানার বালিয়ার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার নিজামকে মারধর করেছে। আবদুল্লাহ বীর প্রতীকের ঘর ভাঙার সময় তার প্রতিবাদে নিজাম থানায় পুলিশি সাহায্য চাইতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে একজন দুষ্কৃতকারী আঘাতের পর আঘাতে রক্তাক্ত করেছে। অথচ আইনের রক চেয়ারে বসে তামাশা দেখেছে। মনে হয় যতণ ওই সব বকধর্মী রাষ্ট্রের রকদের রক্তাক্ত করা না হবে, ঘুম ভাঙবে না। শাসক দলের গোলামি ছাড়বে না। তুমি জানো না মিরপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে, আমিও জানি না। কিন্তু সময়টা তো সবাই জানে। এক দিন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ বীর প্রতীকের জমি দখল করায় অবশ্য অবশ্যই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আওয়ামী তস্কর যে মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে আঘাত করতে সাহস পায়, মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার সরকারের এতে আত্মহত্যা করা উচিত। আমি প্রিয় দেশবাসীর কাছে আহ্বান করতে চাই, বর্তমান প্রজন্মের কাছে উদাত্ত আহ্বান, যে ক’জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো আছে তাদেরকে লাঞ্ছনার হাত থেকে রা করে নিজেদের মান-সম্মান-ইজ্জত সমুন্নত রাখুন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যখন যৌবন ছিল, তখন তারা জাতিকে পাহারা দিয়েছে, হানাদারকবলিত দেশ মুক্ত করেছে। আজ সন্ত্রাসীযুক্ত দেশকে আপনারা মুক্ত করে নিরাপদ বসবাস উপযোগী করুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাতাম, কিন্তু তিনি মহা ঘোরে আছেন। রঙিন চশমায় তিনি সব মায়াময় দেখছেন। তিনি এখন মর্ত্যে নেই, স্বর্গ-মর্ত্যরে মাঝামাঝি কোথাও বিচরণ করছেন। তাই তাকে বলে কোনো লাভ নেই। তুমি পিতা, তোমাকে বললাম।
যাক এবার আসি মুক্তিযোদ্ধাদের দুরবস্থা নিয়ে। গত ১৮ জানুয়ারি ফারুক আহমেদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। সত্যিই স্বাধীন দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধার জীবন নিরাপদ নয়। সিলেটের ফারুক আহমেদ স্কুলজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিল। তোমার খুবই ঘনিষ্ঠ শিষ্য বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ’৬৭ থেকে ’৬৯ একটানা দুই বছর যখন জেলে তখন এই ফারুক আহমেদের সাথে আমার পরিচয়। ছেলেটি আমার চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট ছিল। তুমি ৫৫ বছরে ওপারে গেছো। তোমার মতো ফারুকও আততায়ীর গুলিতে ৬০ বছর বয়সে পরপারে গেল। মুক্তিযুদ্ধে ওর নিষ্ঠার কোনো তুলনা হয় না। তোমার হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামেও সে আমার সাথী হয়েছিল। জীবনে দু’বার আমার হাত ফস্কে গুলি বেরিয়েছে। একবার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধে, আরেকবার ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিসফায়ারে কেউ হতাহত হয়নি। হঠাৎ করে স্টেনগানের একটি গুলি আন্ধির কাছাকাছি একটি বাড়িতে ঘরের চাল ফুটো করে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর ১৯৭৫ সালে হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়ায় রাত ১০-১১টার দিকে রাশিয়ান স্টেনগানের এক মিসফায়ার ফারুকের পায়ে এবং বাবুল হকের হাতে লেগেছিল। দু’জনই সারাজীবনের জন্য তিগ্রস্ত হয়, ফারুক একটু আগাগোড়াই বদরাগি স্বভাবের। প্রথম অবস্থায় ভালোভাবে চিকিৎসা করা যায়নি। মেঘালয়ের তুরা হাসপাতালে থাকতে চায়নি। তাই শুরু থেকেই তার পায়ের বুড়ো আঙুলে পচন ধরেছিল। যা জীবনে কোনো দিন পুরোপুরি ভালো হয়নি। কমবেশি সব সময় সেই কাঁচা ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে। যে দিন গুলি লেগেছিল সে দিন থেকে যত দিন আমার প্রতি ওর আস্থা ছিল তত দিন কখনো ওর গায়ে গুলি লাগার জন্য উহ্ আহ্ টু-টা করেনি। বাবুল হকও তেমনি। ও এখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্যামেরা চালায়। গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে ক্যামেরা ধরে রাখতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এ জন্য এক দিনও কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেনি। আমি করি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ফারুক করত আওয়ামী লীগ। ভিন্ন স্রোতে পড়ে সে আমার অনেক নাহক সমালোচনা করেছে। জঘন্য গালাগালও করেছে। কিন্তু আমি ওকে কোনো দিন কিছু বলতে পারিনি। ওর গালির চেয়ে আমার হাত ফসকে গুলি সব সময় অনেক বড় মনে হয়েছে। গালির আঘাতের চেয়ে গুলির আঘাত অনেক অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক হওয়ায় ওর প্রতি কোনো দিন ুব্ধ হতে পারিনি, অকল্যাণ কামনা করিনি। তার পরও ওর মৃত্যুর পরপর ওর স্ত্রী যখন বলেছে তার স্বামী দলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছে, দলীয় অপছন্দের লোকেরা এ হত্যার জন্য দায়ী, তখন বুকটা চৌচির হয়ে গেছে। যে দলের জন্য এত শ্রম দিয়েছে তাকে কায়েমি স্বার্থের কারণে দলের লোকেরা হত্যা করলে অন্যেরা কোন সাহসে দল করবে? আরো মনটা বড় বেশি খারাপ হয়েছে, টাঙ্গাইলের সাধারণ মানুষের ওপর এ রকম একটি নিবেদিত সার্বণিক রাজনৈতিক মানুষের মৃত্যু কোনো শোকের ছাপ ফেলেনি। কেন ফেলেনি বলতে পারব না। তবে এটাই সত্য যে, তেমন কোনো শোকের ছাপ ল করা যায়নি।
আমার এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ বীর প্রতীককে তুমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতে। আমি বেশ কয়েকবার ওকে তোমার কাছে নিয়ে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে আমার ছায়া হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের এক সময় আমার দেহরী বাহিনীতে যারা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ফজলুল হক বীর প্রতীক, আবদুল্লাহ বীর প্রতীক, ছানোয়ার, আব্দুল লতিফ ভম্বল, বজলু, দুরমুজ খাঁ, মোমেন, মাসুদ, ত্রিশালের আবুল কালাম আজাদ, কস্তুরিপাড়ার শামসু, মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা, আরিফ আহমেদ দুলাল, আব্দুল হালিম, তমশের আলী। এদের মধ্যে তামাইটের আবদুল্লাহ একেবারে অরজ্ঞানহীন। প্রথম যেবার মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে গিয়েছিল, কঙ্কালের মতো স্বাস্থ্যগতর দেখে ওকে আনফিট করে বের করে দিয়েছিলাম। মাস দেড়েক পর আবার সে ভর্তি হতে যায়। সেবার ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান ওকে ভীষণ পরীা-নিরীা করে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করেছিল। স্বাধীনতার পর বিদেশী এক প্রচারমাধ্যমে সাাৎকারে যা বলেছিল, ‘আমি গরিব মানুষের ছেলে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাই। শুনলাম দেশে যুদ্ধ লাগছে। প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ পাই। লেখাপড়া জানি না, তেমন কিছু বুঝি না। দেখলাম একদল পাকিস্তান রাখতে চায়, আরেক দল বাংলাদেশ বানাতে চায়। পাকিস্তানে তো আছিই। আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ বানাতে পারলে তো ভালোই হয়। তাই মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমবার ভর্তি হতে পারিনি। পরে আবার ভাবলাম, প্রথম মুক্তিবাহিনীতে যাবো, এবার যদি না নেয় তাহলে রাজাকারে ভর্তি হবো। যুদ্ধ আমাকে করতেই হবে। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ ছাড়া ঘরে বসে থাকতে পারব না।’
সে ১৫-১৬ বছরের কিশোর। ওই সময় ঘরে থাকা তার পৌরুষে বাধে। তাই ঘর থেকে বেরোনো দরকার। তাই চেষ্টা করেছে স্বাধীনতার পে থাকতে, স্থান না পেলে বিপে যেত। কারণ মূল ল্য তার যুদ্ধ। এটা আমার কথা নয়, এটা আবদুল্লাহর কথা। মুক্তিযুদ্ধে তার মতো অসীম সাহসী যোদ্ধা খুব কম দেখেছি। বুদ্ধিশুদ্ধি তখনো কম ছিল, এখনো সোজা সরল একজন মানুষ। যদি সে সেনাবাহিনীর জেনারেল অথবা রাজনৈতিক বড় কোনো নেতা হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসের জন্য তার বীর প্রতীক খেতাবের মূল্য হতো হাজার হাজার কোটির সমান। কিন্তু যেহেতু দরিদ্র ঘরের সন্তান, আমার সাথে থাকার কারণে চুরিচামারি শিখতে পারেনি, একেবারে নিঃস্ব দরিদ্রের মতো চলে, সেহেতু কোট প্যান্ট-টাই পরা খেতাবপ্রাপ্তদের মতো জাতীয় কোনো মূল্যায়ন নেই। কথাগুলো তোমাকে বড় দুঃখে জানাচ্ছি। ঈমান ঠিক থাকলে তাকে অনেক বেঈমানরাই ভালো বলে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন অনুগত ছিল, ’৭৫-এ তোমার হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামেও তেমনই ছিল, এখনো আছে। তাই বেঈমান দালালদের কাছে সে খুবই মূল্যহীন। ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামে আমার ছায়া হয়ে ছিল। বিয়ে করেছে সে সময়ই। এখন দুই মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েগুলো খুবই ভালো ছাত্রী। আমার ছেলেমেয়ে এ প্লাস পায়নি। কিন্তু ওর ছেলেমেয়ে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। আল্লাহ রহম না করলে কি অমন হয়? মিরপুর চিড়িয়াখানার সামনে পরিত্যক্ত কয়েক একর জমির ওপর সারা দেশের কয়েক শ’ মুক্তিযোদ্ধা থাকে। সেখানে ছোট্ট একটু জায়গা নিয়ে আবদুল্লাহ বীর প্রতীকও থাকে। নিজেদের মধ্যে খুব বেশি মিল নেই। যে জন্য বাইরের লোকেরাও তাদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করতে পারে। যেটা সব সময়ই করে। খুব সম্ভবত এখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক নেতা মিরপুরের আমির হোসেন মোল্লা। জানি না, সে আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কি না। কিন্তু যখন যে সরকার আসে সেই সরকারের লেজুড় সাজে। তার আবার মূল নেতারা ক’দিন আগে বিএনপিতে গেছে। সুবিধার জন্য এক সময় আমার কাছেও আসত। বিএনপির আমলে একবার জায়গাটি কোনো ধনবানকে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি তার সোচ্চার প্রতিবাদ করেছিলাম। সে জন্য আর লিজ দিতে পারেনি। কয়েক শ’ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সেখানে আছে। কিন্তু তাদের ওপর বহিরাগতদের জোরজুলুমের শেষ নেই। বিশেষ করে সরকারি দলের জোরজুলুম সীমাহীন। অতি সম্প্রতি বীর প্রতীক আবদুল্লাহর রুটি-রুজির একমাত্র পথ কয়েকটি গরু। সেই গরু-বাছুর তাড়িয়ে দিয়ে তার ঘর ভেঙে ওখানকার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুল মান্নান নামে এক তস্কর দখল করে বাঁশের দোতলা বানিয়েছে। ইংরেজের বিরুদ্ধে ইতিহাসে তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিল। আর তস্কর মান্নান খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে বাঁশের দোতলা বানিয়েছে। শোনা যায় তাকে নাকি সব রকমের সহায়তা করছেন ওখানকার সংসদ সদস্য আসলামুল হক। অন্য দিকে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা আমির হোসেন মোল্লা। তোমাকে কী বলব, স্বাধীন দেশে তস্করদের কত সাহস, মসজিদের মধ্যে ঢুকে বাসাইল থানার বালিয়ার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার নিজামকে মারধর করেছে। আবদুল্লাহ বীর প্রতীকের ঘর ভাঙার সময় তার প্রতিবাদে নিজাম থানায় পুলিশি সাহায্য চাইতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে একজন দুষ্কৃতকারী আঘাতের পর আঘাতে রক্তাক্ত করেছে। অথচ আইনের রক চেয়ারে বসে তামাশা দেখেছে। মনে হয় যতণ ওই সব বকধর্মী রাষ্ট্রের রকদের রক্তাক্ত করা না হবে, ঘুম ভাঙবে না। শাসক দলের গোলামি ছাড়বে না। তুমি জানো না মিরপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে, আমিও জানি না। কিন্তু সময়টা তো সবাই জানে। এক দিন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ বীর প্রতীকের জমি দখল করায় অবশ্য অবশ্যই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আওয়ামী তস্কর যে মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে আঘাত করতে সাহস পায়, মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার সরকারের এতে আত্মহত্যা করা উচিত। আমি প্রিয় দেশবাসীর কাছে আহ্বান করতে চাই, বর্তমান প্রজন্মের কাছে উদাত্ত আহ্বান, যে ক’জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো আছে তাদেরকে লাঞ্ছনার হাত থেকে রা করে নিজেদের মান-সম্মান-ইজ্জত সমুন্নত রাখুন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যখন যৌবন ছিল, তখন তারা জাতিকে পাহারা দিয়েছে, হানাদারকবলিত দেশ মুক্ত করেছে। আজ সন্ত্রাসীযুক্ত দেশকে আপনারা মুক্ত করে নিরাপদ বসবাস উপযোগী করুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাতাম, কিন্তু তিনি মহা ঘোরে আছেন। রঙিন চশমায় তিনি সব মায়াময় দেখছেন। তিনি এখন মর্ত্যে নেই, স্বর্গ-মর্ত্যরে মাঝামাঝি কোথাও বিচরণ করছেন। তাই তাকে বলে কোনো লাভ নেই। তুমি পিতা, তোমাকে বললাম।
No comments