সত্যের আলোয় প্রকম্পিত অপশক্তি by মর্জিনা আফসার রোজী

আজ লেখার প্রারম্ভে একটি অতি পুরনো প্রবাদবাক্য মনে পড়ছে। ‘যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ’। আজ দেশের যে দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করছি কখনোই তা দেখিনি।
যে যন্ত্রণা সহ্য করছি কল্পনাতেও তা কখনো আনিনি। যে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মোকাবেলা প্রতিনিয়ত হচ্ছি, তা অভূতপূর্ব। চালের মধ্যে দু-একটা পাথর কণা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সে কণা যদি চালের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখনই সেটা হয়ে যায় অস্বাভাবিক। দুর্নীতি, দুঃশাসন আর অরাজকতায় দেশের বর্তমান অবস্থাটা ঠিক তদ্রƒপ অস্বাভাবিক ভয়াবহ। গণতন্ত্র থেকে গণ আর ন্যায়বিচার থেকে ন্যায় উধাও হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীনেরা সভা-সেমিনারে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করে শুধুই প্রহসন করে না উপহাসও করে। যে দেশে দিনের প্রকাশ্য আলোতে দুষ্কৃতের ছোড়া এসিড আর উপর্যুপরি তীè অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত শরীর লুটিয়ে পড়েন রাজপথে ২০ বছর বয়সী কোনো তরুণী, যে দেশে শুধু বিরোধীপক্ষের সদস্য মনে করে বিশ্বজিতের মতো অসহায় তরুণকে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বাঁচার শত চেষ্টা করেও লাশে পরিণত হতে হয়, প্রকাশ্য সূর্যালোকে শতচুর সামনে, প্রতিনিয়ত সীমান্তে নিরীহ মানুষের মৃত্যু নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তাচ্ছিল্যভরা সাফাই বক্তব্য থাকে যে দেশে; সেই দেশের সব জনসাধারণ কী করে গণতন্ত্রের অবস্থানের কথা বিশ্বাস করে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা যখন ক্ষমতায় মোহনীয় মায়ায় তলিয়ে যান, উচ্চাশা আর ভীতি যখন তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে; তখন অসহায় জনগণের কান্না আর দীর্ঘশ্বাস কেবল দিকদিগন্তে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। গণতান্ত্রিক মোড়কে আবিষ্ট হয়ে কোনো দল ক্ষমতার মসনদে বসে বিরোধী দলের মহাসচিবকে শুধু হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে অবিশ্বাস্য ছেলে ভুলানো মামলা দিয়ে মাসের পর মাস বন্দী করে রাখে।

সত্যিকার অর্থে সর্বকালেই বিরোধী পক্ষে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাপক হারে হয়। অথচ সে শত সহস্র প্রতিবাদী কণ্ঠনালীকেই আজ শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে গুম হয়ে খুন হতে হবে। এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত। মিটিং-মিছিল করে সরকারের অপশক্তি প্রয়োগ আর জুলুমবাজের কথা বলা যাবে না, তাহলে পরিণতি হবে ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক এবং ৩৯ দিন পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ, বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের মতো। আর সরকারের দমন-পীড়নের ষড়যন্ত্রের তথ্যচিত্র প্রকাশ করে দিলে পরিণতি হবে সাগর-রুনির মতো ভয়াবহ আর আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মতো দুর্বিষহ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে অবুঝ শিশুরাও হেসে ওঠে। প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম, খুন, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই আর ধর্ষণের পরিসংখ্যান নিয়ে দিনের সূচনা হয়। যখন প্রাণ বাঁচানোর পণ্যসামগ্রীর আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, যাতায়াত আর স্বাভাবিক জীবনযাপনের মূল্য পরিশোধ করতে কষ্টের কশাঘাতে জিভ বের হয়ে যায়, সেখানে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করেন ভুক্তভোগী জনতার সামনে। দানবের মতো ঘাড়ে চেপে বসা এ সরকারের মেয়াদকাল শেষের অপেক্ষায় দিন গুনছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। আসলে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে গ্যাঁড়াকলে পতিত তাই তো তারা ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে। জবরদখল আর গুম-খুনের রাজনীতি করে কত দিন আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে। যুগের বিবর্তনে ইতিহাসের চরম শাস্তি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন এখানে-সেখানে ডোবা, নালা, পুকুরে যত্রতত্র বেওয়ারিশ লাশ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে মানবতা কেঁদে ওঠে হু-হু করে, এক সময় দৃষ্টি ফেরাতে হয় অন্য দিকে। এই কি মানুষের জীবন! এতটাই তুচ্ছ, অবহেলিত। অথচ প্রধানমন্ত্রী সদাসর্বদা তার বক্তৃতায় যন্ত্রণাকাতর বাস্তব চিত্রকে আড়াল করে তার অহমিকাসম্পন্ন অমূলক উন্নয়নের কথা বলে তৃপ্তির হাসি হাসেন। প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন,্ এই যে আপনাদের দুঃশাসন আর ব্যর্থতার জন্য প্রতিদিন কত তাজা প্রাণ ঝরে যায় তাদের জন্য কি আপনাদের হৃদয়ে সামান্য মমতাও জন্মায় না? কোনো মৃত্যুর জন্য আপনাদের সামান্য সমবেদনা আর অনুশোচনাও প্রকাশ করতে কেউ কখনো দেখেনি। অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করতে যাকেই তারা পথের বাধা মনে করছে তাকেই তারা সরিয়ে দিচ্ছে দুনিয়া থেকে অথবা অমানুষিক বন্দী জীবনযাপনে বাধ্য করছে। ১৬ কোটি মানুষ এ বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছে অথচ এরা বহাল তবিয়তে থেকে জনগণের অর্থ ধ্বংস করছে। অন্য দিকে ‘‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ! ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!” বাংলাদেশের অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় জনগণ জীবনে একটু শান্তি চায়। নিরাপদ আশ্রয় চায়। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রাপ্য সুখটুকু উপলব্ধি করতে চায়। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বদা ঐক্যবদ্ধ। অত্যচারী শাসকগোষ্ঠী হয় তো ভুলে গেছে যে, সব অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুমের একদিন অবসান হবে। সে দিন এ সময়টি ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হবে। নিজের শিক্ষা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও মননশীল চিন্তাচেতনাকে ব্যবহার করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে যারা দুর্দান্ত ভূমিকা রেখে চলেছেন, তারা অবশ্যই নন্দিত হবেন। যারা সত্যের সন্ধান পেয়েছেন বা মানবতাহীন কুচক্রীমহল নিজেদের ভোগবিলাসের মসনদকে চিরস্থায়ী করতে বাধা হচ্ছেন সে সব স্বনামখ্যাত ব্যক্তিদেরও যে কৌশলে ফাঁসির কাষ্টে ঝোলাতে পারে, সে বোধ পরিষ্কার হয়ে গেছে। পরশ্রীকাতর এ সরকার জীবিত কি মৃত, কারো সম্মান ও জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারে না। সে কারণেই মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে বাদ দিয়েছে। শিশুদের নৈতিক শিক্ষার সব প্রদীপ একে একে নিভিয়ে দিচ্ছে। ভবিষ্যতের মানুষ যাতে ত্যাগ ও আদর্শের রাজনীতি না করে তাদের কাছ থেকে হিংসা, অহঙ্কার আর ধ্বংসের রাজনীতির শিক্ষা নেয় সেই ব্যবস্থাই নিশ্চিত করা হচ্ছে। মওলানা ভাসানীর মতো এমন একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ত্যাগী নেতার জীবনদর্শন পাঠ করলে মানবতা জাগ্রত হয়, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জাগে। তাদের এ হীনম্মন্যতায় ওই মহান নেতার জৌলুশময় জীবনীর কোথাও এতটুকু মলিনতার ছাপ পড়বে না, কিন্তু সর্বযুগেই ঘৃণাভরে স্মরণীয় হবে তাদের এই নীচতা। আজ মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তাজউদ্দীন আহমদসহ কালজয়ী, মৃত্যুঞ্জয়ী সে নেতারা জীবিত নেই। কিন্তু এ মহা প্রলয়ের ক্রান্তিলগ্নে যে সাহসী সৈনিক সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রাম করে মানুষের কল্যাণ করতে চান তাদের সম্মান জানাতে হবে; বিপদে পাশে থেকে শক্তির জোগান দিতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক
       

No comments

Powered by Blogger.