গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে by আবু এন. এম. ওয়াহিদ
১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের যে কয়টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল তার অন্যতম হলো গণতন্ত্র। বস্তুতপক্ষে ১৯৪৭-এর পর থেকেই বাঙালির প্রাণের দাবি ছিল গণতন্ত্র, কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা দুই যুগেও আমাদের সে দাবি পূরণ করতে পারেনি।
কারণ অল্পদিনের মধ্যেই জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান মারা গেলেন। তারপর পাকিস্তান নামক নবজাত রাষ্ট্রের রাজনীতির প্রকৃত ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ চলে গেল প্রথমে বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনীর হাতে। সে দেশের মিলিটারি জান্তা আজও একটি ডিফেক্টো রাজনৈতিক দল হিসেবেই টিকে আছে। কখনো পেছন থেকে পরোক্ষভাবে, কখনো সামনে এসে সরাসরি তারা রাজনীতির কলকাঠি নাড়ে। এ ঘেরাটোপ থেকে পাকিস্তান আজও বেরোতে পারেনি।
যা হোক, ২৪ বছরে আমাদের যা বোঝার তা আমার বুঝে নিয়েছিলাম। সময়মতো আমাদের পথ আমরাই চিনে নিলাম। সে পথ ছিল কঠিন সংগ্রামের। সে দুর্গম পথ বেয়ে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম ১৯৭১ সালে, পেলাম সাধের বাংলাদেশ। শুরুতেই আশা ছিল গণতন্ত্রের পথে আমাদের নবযাত্রা শুভ হবে, মসৃণ হবে চলার পথ, সফল হবে স্বপ্নসাধ, কিন্তু হয়নি। আমরা বারবার হোঁচট খেতে লাগলাম। প্রথম ধাক্কা খেলাম ১৯৭৫-এ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল কায়েমের সময় যখন অন্য সব রাজনৈতিক দল এবং চারটি বাদে বাকি সব সংবাদপত্র বেআইনি ঘোষিত হলো। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলতে থাকল রীতিমতো কেওটিক অবস্থা। এ পর্যায়ে ঘটনা পরম্পরার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে আছে তুমুল বিতর্ক। সে বিতর্ক পাশ কাটিয়ে বলা যায়, আমরা ন্যূনতম একটি কোয়াজি গণতন্ত্রের পথে যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম তখন রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর আরেক ধাক্কায় এরশাদ দেশকে ফেলে দিলেন সামরিক শাসনের নতুন জাঁতাকলে। অবশেষে ১৯৯১ সালে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনল।
কিন্তু এ গণতন্ত্র দুই দশকেও আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করল না, করতে পারল না। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র নয়, আমরা পেয়েছিলাম শুধু একটি নির্বাচিত সরকার। নির্বাচিত সরকার গণতন্ত্রের একটি ন্যূনতম পূর্বশর্ত মাত্র। এটা কোনোক্রমেই গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ রূপ নয়। আমরা ভেবেছিলাম, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে প্রথমে রাষ্ট্রযন্ত্রে মজবুত গণতান্ত্রিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে পারব এবং তারপর আপনাআপনি আস্তে আস্তে দেশের তাবত মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, কিন্তু সে আশায় আমাদের গুড়ে বালি। দুঃখের বিষয়, দীর্ঘ ২২ বছরেও এ লক্ষ্য পূরণে আমরা একটুও এগোতে পারলাম না। সেই একই জায়গায় কুণ্ডলায়িত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি, ঘুরপাক খাচ্ছি ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে। একদল বলছে, ওই তারিখের পর পর দেশে শুরু হয়েছে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি; আবার আরেক দল বলছে, ১৫ আগস্টের পরই জাতি ফিরে পেয়েছে হারানো গণতন্ত্র। এ বিতর্কের অবসান না হলে সুশাসন ও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা কঠিন বৈ সহজ হওয়ার নয়।
প্রথমে দেখা যাক, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা কী বুঝি। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমি যা বুঝি তা হলো, দেশে কমপক্ষে দুটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল থাকবে। প্রতিটি দলের অভ্যন্তরের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা থাকবে, গণতন্ত্রের চর্চা থাকবে, যাবতীয় সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ হিসাব থাকবে, সর্বোপরি দলে কার্যকর ও শক্ত চেইন অব কমান্ড থাকবে।
রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ, অর্থাৎ সংসদ, বিচার ও জনপ্রশাসন বিভাগ স্বতন্ত্র থাকবে। আবার তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ও জবাবদিহিতা বিরাজ করবে। তারা দলীয়করণে দূষিত হবে না। তারা দুর্নীতির ঊধর্ে্ব উঠে দক্ষতা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের শাসক-বিচারক না ভেবে জনগণের সেবক-খাদেম মনে করবেন। অধিকার চর্চায় কেউ কারো গণ্ডি অতিক্রম করবেন না।
দেশে আরো থাকবে স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, অমবুডস্ম্যান, ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব বাজেটারি ও লোকবল নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে। থাকবে পৃথক সচিবালয়। টাকা-পয়সা বা ক্রিটিক্যাল সিদ্ধান্তের বেলায় তারা সব সময় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবে না। সব দায়িত্ব নিজস্ব সচিবালয়ের মাধ্যমে পালন করবে। এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠান একদিকে থাকবে সরকার থেকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র; আবার অন্যদিকে তারা সবাই নিজেদের মধ্যে এবং সরকারের সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে। কেউ কারো সীমা লঙ্ঘন করবে না। কারো কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না বা বাগড়া দেবে না।
এসব প্রতিষ্ঠান যদি আমরা সঠিকভাবে সময়মতো গড়ে তুলতে পারি এবং এদের যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে কাজ করতে দিই, তাহলে দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না, লাগার কথা নয়।
এখন দেখা যাক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আমি যা বুঝি তা কিন্তু 'উইনারস্ টেক অল, লুজারস্ গেট নাথিং' নয়। বাংলাদেশে এখন এ সংস্কৃতিই চলছে। অর্থাৎ যারা নির্বাচনে জেতে তারা পাঁচ বছরের জন্য দেশকে ইজারা নিয়ে নেয় এবং তাদের খেয়ালখুশিমতো দেশ চালায়। বিরোধী দলকে পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে শুধুই ঠ্যাঙায়। তাদের মতামতের কোনো মূল্যই দেয় না। জনগণের এজেন্ডা শিকেয় তুলে দলীয় এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, দেশজুড়ে শুরু করে নামবদলের মচ্ছব। এটা কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নয়। এ সবই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঠিক উল্টো কাজ।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের পর দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার আর দলীয় থাকে না, হয়ে যায় দেশের, সব মানুষের। সরকার নিজের কাজ দায়িত্ব, সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করে থাকে, অন্যের প্রতি সম্মান দেখায়। সব সিদ্ধান্ত ও কাজে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আমরা আরো বুঝি এমন একটি পরিবেশ, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে শত্রু না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববে। মতের মিল না থাকলেও পরমতকে সম্মান জানাবে, শ্রদ্ধা করবে, কারো প্রতি কেউ গালমন্দ করবে না। সংসদে সংসদীয় ভাষায় কথা বলবে, সংসদকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করবে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সংসদেই গৃহীত হবে। দলের ভেতরে প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুবিধা-অসুবিধার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। সিদ্ধান্তে সবাই একমত না হলে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত হবে, তবে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত অবজ্ঞা করে নয়। প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি কাজে টাকা-পয়সার ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকবে। সিনিয়র জুনিয়রকে স্নেহ করবেন। জুনিয়র সিনিয়রকে সমীহ করবেন। আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজস্ব নিয়মে আপন গতিতে চলবে। সরকার এর গতি রোধও করবে না, ত্বরান্বিতও করবে না। যে যে দলই করুক না কেন, সবাই সব সময় মনে রাখবে, সবার আগে দেশ, তারপর দল, তারপর পরিবার-ব্যক্তি। দল ও সরকারের যেকোনো কিছুতে পদ পাওয়ার ক্রাইটেরিয়া হবে দেশপ্রেম, সততা, দক্ষতা, বিনয়ী স্বভাব ইত্যাদি। কোনো সময়ই সরকার, দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যই সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হবে না। এ সব কিছুকেই যৌথভাবে বলা যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য দেশপ্রেম, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের একযোগে কাজ শুরু করার এটাই সময়।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
যা হোক, ২৪ বছরে আমাদের যা বোঝার তা আমার বুঝে নিয়েছিলাম। সময়মতো আমাদের পথ আমরাই চিনে নিলাম। সে পথ ছিল কঠিন সংগ্রামের। সে দুর্গম পথ বেয়ে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম ১৯৭১ সালে, পেলাম সাধের বাংলাদেশ। শুরুতেই আশা ছিল গণতন্ত্রের পথে আমাদের নবযাত্রা শুভ হবে, মসৃণ হবে চলার পথ, সফল হবে স্বপ্নসাধ, কিন্তু হয়নি। আমরা বারবার হোঁচট খেতে লাগলাম। প্রথম ধাক্কা খেলাম ১৯৭৫-এ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল কায়েমের সময় যখন অন্য সব রাজনৈতিক দল এবং চারটি বাদে বাকি সব সংবাদপত্র বেআইনি ঘোষিত হলো। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলতে থাকল রীতিমতো কেওটিক অবস্থা। এ পর্যায়ে ঘটনা পরম্পরার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে আছে তুমুল বিতর্ক। সে বিতর্ক পাশ কাটিয়ে বলা যায়, আমরা ন্যূনতম একটি কোয়াজি গণতন্ত্রের পথে যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম তখন রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর আরেক ধাক্কায় এরশাদ দেশকে ফেলে দিলেন সামরিক শাসনের নতুন জাঁতাকলে। অবশেষে ১৯৯১ সালে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনল।
কিন্তু এ গণতন্ত্র দুই দশকেও আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করল না, করতে পারল না। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র নয়, আমরা পেয়েছিলাম শুধু একটি নির্বাচিত সরকার। নির্বাচিত সরকার গণতন্ত্রের একটি ন্যূনতম পূর্বশর্ত মাত্র। এটা কোনোক্রমেই গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ রূপ নয়। আমরা ভেবেছিলাম, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে প্রথমে রাষ্ট্রযন্ত্রে মজবুত গণতান্ত্রিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে পারব এবং তারপর আপনাআপনি আস্তে আস্তে দেশের তাবত মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, কিন্তু সে আশায় আমাদের গুড়ে বালি। দুঃখের বিষয়, দীর্ঘ ২২ বছরেও এ লক্ষ্য পূরণে আমরা একটুও এগোতে পারলাম না। সেই একই জায়গায় কুণ্ডলায়িত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি, ঘুরপাক খাচ্ছি ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে। একদল বলছে, ওই তারিখের পর পর দেশে শুরু হয়েছে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি; আবার আরেক দল বলছে, ১৫ আগস্টের পরই জাতি ফিরে পেয়েছে হারানো গণতন্ত্র। এ বিতর্কের অবসান না হলে সুশাসন ও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা কঠিন বৈ সহজ হওয়ার নয়।
প্রথমে দেখা যাক, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা কী বুঝি। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমি যা বুঝি তা হলো, দেশে কমপক্ষে দুটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল থাকবে। প্রতিটি দলের অভ্যন্তরের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা থাকবে, গণতন্ত্রের চর্চা থাকবে, যাবতীয় সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ হিসাব থাকবে, সর্বোপরি দলে কার্যকর ও শক্ত চেইন অব কমান্ড থাকবে।
রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ, অর্থাৎ সংসদ, বিচার ও জনপ্রশাসন বিভাগ স্বতন্ত্র থাকবে। আবার তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ও জবাবদিহিতা বিরাজ করবে। তারা দলীয়করণে দূষিত হবে না। তারা দুর্নীতির ঊধর্ে্ব উঠে দক্ষতা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের শাসক-বিচারক না ভেবে জনগণের সেবক-খাদেম মনে করবেন। অধিকার চর্চায় কেউ কারো গণ্ডি অতিক্রম করবেন না।
দেশে আরো থাকবে স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, অমবুডস্ম্যান, ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব বাজেটারি ও লোকবল নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে। থাকবে পৃথক সচিবালয়। টাকা-পয়সা বা ক্রিটিক্যাল সিদ্ধান্তের বেলায় তারা সব সময় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবে না। সব দায়িত্ব নিজস্ব সচিবালয়ের মাধ্যমে পালন করবে। এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠান একদিকে থাকবে সরকার থেকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র; আবার অন্যদিকে তারা সবাই নিজেদের মধ্যে এবং সরকারের সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে। কেউ কারো সীমা লঙ্ঘন করবে না। কারো কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না বা বাগড়া দেবে না।
এসব প্রতিষ্ঠান যদি আমরা সঠিকভাবে সময়মতো গড়ে তুলতে পারি এবং এদের যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে কাজ করতে দিই, তাহলে দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না, লাগার কথা নয়।
এখন দেখা যাক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আমি যা বুঝি তা কিন্তু 'উইনারস্ টেক অল, লুজারস্ গেট নাথিং' নয়। বাংলাদেশে এখন এ সংস্কৃতিই চলছে। অর্থাৎ যারা নির্বাচনে জেতে তারা পাঁচ বছরের জন্য দেশকে ইজারা নিয়ে নেয় এবং তাদের খেয়ালখুশিমতো দেশ চালায়। বিরোধী দলকে পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে শুধুই ঠ্যাঙায়। তাদের মতামতের কোনো মূল্যই দেয় না। জনগণের এজেন্ডা শিকেয় তুলে দলীয় এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, দেশজুড়ে শুরু করে নামবদলের মচ্ছব। এটা কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নয়। এ সবই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঠিক উল্টো কাজ।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের পর দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার আর দলীয় থাকে না, হয়ে যায় দেশের, সব মানুষের। সরকার নিজের কাজ দায়িত্ব, সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করে থাকে, অন্যের প্রতি সম্মান দেখায়। সব সিদ্ধান্ত ও কাজে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আমরা আরো বুঝি এমন একটি পরিবেশ, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে শত্রু না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববে। মতের মিল না থাকলেও পরমতকে সম্মান জানাবে, শ্রদ্ধা করবে, কারো প্রতি কেউ গালমন্দ করবে না। সংসদে সংসদীয় ভাষায় কথা বলবে, সংসদকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করবে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সংসদেই গৃহীত হবে। দলের ভেতরে প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুবিধা-অসুবিধার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। সিদ্ধান্তে সবাই একমত না হলে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত হবে, তবে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত অবজ্ঞা করে নয়। প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি কাজে টাকা-পয়সার ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকবে। সিনিয়র জুনিয়রকে স্নেহ করবেন। জুনিয়র সিনিয়রকে সমীহ করবেন। আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজস্ব নিয়মে আপন গতিতে চলবে। সরকার এর গতি রোধও করবে না, ত্বরান্বিতও করবে না। যে যে দলই করুক না কেন, সবাই সব সময় মনে রাখবে, সবার আগে দেশ, তারপর দল, তারপর পরিবার-ব্যক্তি। দল ও সরকারের যেকোনো কিছুতে পদ পাওয়ার ক্রাইটেরিয়া হবে দেশপ্রেম, সততা, দক্ষতা, বিনয়ী স্বভাব ইত্যাদি। কোনো সময়ই সরকার, দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যই সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হবে না। এ সব কিছুকেই যৌথভাবে বলা যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য দেশপ্রেম, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের একযোগে কাজ শুরু করার এটাই সময়।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
No comments