রামুর ঘটনার তদন্ত কমিটি ও আমাদের এগিয়ে যাওয়া by মো. জাকির হোসেন
রামুর বৌদ্ধপল্লীতে নজিরবিহীন, বর্বর এবং সব ধর্ম ও মানবতার জন্য চরম অবমাননাকর ঘটনা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদেশেও এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয়েছে নানাভাবে।
বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে এমন রাষ্ট্রের তরফ থেকে আরো কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। রামুর ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে যে পরিমাণ মেধা ও সময় ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ও মেধা খরচ হয়েছে পারস্পরিক দোষারোপ, চরিত্র হনন ও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অতীতের কর্মকাণ্ড অনুসন্ধানে। বিএনপি ইতিমধ্যে রামুর ঘটনায় তাদের দলীয় তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সরকার প্রশাসনের মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দুটি তদন্ত রিপোর্টই যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কিছু কট্টর সমর্থক ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করে না, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখে না। কেননা বিএনপির তদন্ত রিপোর্ট যে সরকারকে এবং তার দলীয় লোকজনকে দায়ী করবে এটা অবোধ শিশুও বোঝে। আর সরকারি তদন্ত রিপোর্টে কাদের দায়ী করা হবে তাও সবাই জেনে গেছে। তদুপরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন। আমাদের দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভুল হতে পারে; কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের বিষয়ে মন্ত্রীদের পূর্বাভাস ভুল হয়েছে- এমন নজির কেউ দেখাতে পারবে না, এটা হলফ করে বলতে পারি। নিজ দলের লোকজনকে বোঝানোর জন্য তদন্ত কমিটির আদৌ কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। কেননা এই শ্রেণীর অন্ধ দলভক্তদের এমন কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা আছে, যা দ্বারা তাঁরা অতিসহজেই তাঁদের মানসচক্ষে প্রতিপক্ষ দলের ষড়যন্ত্রের প্রতিটি ঘটনা দেখতে পান। কাজেই দুটি তদন্ত কমিটির পেছনে যে অর্থ, সময় ও মেধা ব্যয় হয়েছে এক অর্থে তার পুরোটাই অপচয় হয়েছে।
বিএনপি তার তদন্ত রিপোর্টে বলেছে, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এমন বর্বর ঘটনা সম্ভব হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ, সরকারের মদদে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ছিল। কেন সরকার এমন নারকীয় ঘটনায় মদদ দিতে গেল তার ব্যাখ্যাও তদন্ত রিপোর্টে ছিল। তদন্তদলের মতে, সরকারের মদদ দেওয়ার পেছনে দুটো উদ্দেশ্য ছিল- সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা এবং বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হওয়ার ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা। আরো বছরখানেক পর আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারিত। নির্বাচনের এক বছর আগে এমন ঘটনা ঘটিয়ে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে তা আমার মতো অনুর্বর রাজনীতিবিবর্জিত মস্তিষ্কে বোঝা অসম্ভবের চেয়েও বেশি কিছু। বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রের ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ঠিক কিভাবে লাভবান হবে, সে বিষয়ে তদন্ত রিপোর্টের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও এটি অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হয় না। 'আকেলমন্দ কে লিয়ে ইশারা ভি কাফি হ্যায়'। তদন্ত রিপোর্টের ইঙ্গিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি উপস্থিতির ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতে চায়।
বিএনপির তদন্ত রিপোর্ট বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. তদন্তপ্রক্রিয়ায় শত শত মানুষের সঙ্গে কথা বলা, ৬০ জনের বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভিডিও দৃশ্যসহ রেকর্ড করার পরও একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ কী কেবলই পদ্ধতিগত কারণে, না এর অন্য কোনো কারণ রয়েছে? দুই. বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রের ভয় দেখানো হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আওয়ামী লীগকে কেন সমর্থন করবে, বিএনপিকে কেন করবে না? তাহলে কী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আওয়ামী লীগ জঙ্গিবিরোধী আর বিএনপি জঙ্গিবান্ধব? তিন. বাংলাদেশের নিরীহ একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে যদি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা যায়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকারের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কী? চার. পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, রামুর ঘটনায় একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর পাশাপাশি কয়েকজন রোহিঙ্গারও সম্পৃক্ততা ছিল। তবে কী আওয়ামী লীগ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা করেছে, নাকি অন্যরা পরে এসে সম্পৃক্ত হয়েছে? আওয়ামী লীগের লোকজনই কী ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ও রোহিঙ্গাদের গভীর রাতে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে এই দুর্গম এলাকায় নিয়ে এসেছিল? রামুর পাশাপাশি রামু থেকে শতাধিক মাইল দূরে পটিয়ার মন্দিরে যে আক্রমণ-ভাঙচুর হয়েছে সেটাও কী আওয়ামী লীগের ওই একই পরিকল্পনার অংশ ছিল?
প্রিয় পাঠক, চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস একবার পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে যাওয়ার সময় জঙ্গলের মধ্যে এক মহিলাকে কাঁদতে দেখে কান্নার কারণ জানতে চাইলে মহিলা বলেন, 'কয়েক বছর আগে আমার শ্বশুরকে জঙ্গলের বাঘ হত্যা করেছে। আমার স্বামীও গেছে বাঘের পেটে। কিছুক্ষণ আগে আমি বাঘের আক্রমণে আমার সন্তানের ছিন্নভিন্ন দেহ সমাধিস্থ করেছি।' এত ঘটনার পরও এ রকম বিপজ্জনক জায়গায় থাকার কারণ জানতে চান কনফুসিয়াস। ক্রন্দনরত মহিলা জবাব দেন, এখানে বাঘ আছে সত্য; কিন্তু অত্যাচারী শাসকের নিপীড়ন নেই। উত্তর শোনার পর কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, জেনে রাখো, অত্যাচারী শাসক হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ংকর। বিএনপির তদন্ত প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সত্যি সত্যিই যদি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমন মানবতাবিরোধী কাজ করে থাকে, তাহলে তারাও কী হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ংকর অত্যাচারী শাসক নয়?
বিএনপির কাছে যদি এ রকম প্রমাণ থাকে, তাহলে দ্বিতীয় মেয়াদ দূরে থাক আওয়ামী লীগের এই মেয়াদ পূর্ণ করার বৈধতা থাকবে কী? আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এমন পরিকল্পিত নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে এই মর্মে বিএনপির তদন্তদলের কাছে যদি সত্যি সত্যিই প্রমাণ থাকে, তাহলে কালবিলম্ব না করে অতিদ্রুত জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা উচিত নয় কি? আর আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে মর্মে বিএনপির তদন্ত রিপোর্টের বর্ণনা যদি সত্যি না হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, বিএনপি কী নিছক রাজনৈতিক দোষারোপের জন্য এমন রিপোর্ট তৈরি করেছে, নাকি কোনো কিছু আড়াল করার জন্য এমন অসত্য প্রতিবেদন তৈরি করেছে?
সরকারি দলের ভাষ্য অনুযায়ী সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিএনপি-জামায়াত মিলে পরিকল্পিতভাবে এমন বর্বর ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এর পেছনে উদ্দেশ্য হলো- মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করা ও সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সরকারের কাছে যদি এ রকম কোনো তথ্যপ্রমাণ থাকে তাও কালবিলম্ব না করে প্রকাশ করা উচিত। কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাবি, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারাধীন অপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য যদি বিএনপি এমন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে, তাহলে তারাও কি আর জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে? দেশ ও দেশের মানুষ কি তাদের হাতে নিরাপদ থাকতে পারে?
সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি যদি সত্যি সত্যিই বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়ও তা কি আওয়ামী লীগের কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করবে? তাহলে কী পারস্পরিক দোষারোপ আর বিশ্বাস অযোগ্য দুই তদন্ত কমিটির ডামাডোলের মধ্যে আমাদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কান্না, দুঃখ, বেদনা, হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে যাবে? ভুলে গেলে চলবে না এ ঘটনার প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে যদি বিচারের সম্মুখীন করা না হয়, যদি প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়, যদি নিরপরাধ কাউকে অপরাধী সাজিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে প্রকৃত অপরাধীরা উৎসাহী হবে ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য। ফলে আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। অস্তিত্ব বিপন্ন একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হতে আমাদের দুই নেত্রীর ভালো লাগবে কি? বিচার না হলে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী যে বিনিয়োগকারীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা শুরু করেছেন, এমন নিরাপত্তাহীন পরিবেশে তাঁরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন কি?
আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি সামান্য হলেও দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে থাকেন, তাহলে রামুর ঘটনা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি এ মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তদন্ত কমিটিতে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার গঠিত অন্যান্য সংসদীয় কমিটিতে বিএনপি না এলেও ভোটের রাজনীতির জন্য হলেও বিএনপি এ তদন্ত কমিটিতে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। এভাবে কমিটি গঠিত হলে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তকরণে সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণিত হবে। জনমনে আস্থার সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সরকারের দৃঢ়সংকল্পের বার্তা পৌঁছে যাবে। আমাদের বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের কষ্ট, বেদনা ও দীর্ঘশ্বাস লাঘবের জন্য কিছুটা হলেও অবলম্বন খুঁজে পাবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গায়ে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগানোর প্রচেষ্টা আরো একবার ভণ্ডুল হয়ে যাবে। পারস্পরিক দোষারোপ বন্ধ হবে। প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। আর এভাবেই আমরা রামুর ঘটনা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারব। আমাদের এগিয়ে যাওয়া চলতেই থাকবে। এর অন্যথা হলে রামুর ঘটনা আমাদের বারবার তাড়া করে বেড়াবে। আমাদের এগিয়ে যাওয়া পুরোপুরি থমকে না গেলেও বাধাগ্রস্ত হবে সন্দেহ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
zhossain@justice.com
« পূর্ববর্তী সংবাদ
বিএনপি তার তদন্ত রিপোর্টে বলেছে, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এমন বর্বর ঘটনা সম্ভব হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ, সরকারের মদদে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ছিল। কেন সরকার এমন নারকীয় ঘটনায় মদদ দিতে গেল তার ব্যাখ্যাও তদন্ত রিপোর্টে ছিল। তদন্তদলের মতে, সরকারের মদদ দেওয়ার পেছনে দুটো উদ্দেশ্য ছিল- সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা এবং বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হওয়ার ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা। আরো বছরখানেক পর আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারিত। নির্বাচনের এক বছর আগে এমন ঘটনা ঘটিয়ে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে তা আমার মতো অনুর্বর রাজনীতিবিবর্জিত মস্তিষ্কে বোঝা অসম্ভবের চেয়েও বেশি কিছু। বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রের ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ঠিক কিভাবে লাভবান হবে, সে বিষয়ে তদন্ত রিপোর্টের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও এটি অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হয় না। 'আকেলমন্দ কে লিয়ে ইশারা ভি কাফি হ্যায়'। তদন্ত রিপোর্টের ইঙ্গিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি উপস্থিতির ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতে চায়।
বিএনপির তদন্ত রিপোর্ট বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. তদন্তপ্রক্রিয়ায় শত শত মানুষের সঙ্গে কথা বলা, ৬০ জনের বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভিডিও দৃশ্যসহ রেকর্ড করার পরও একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ কী কেবলই পদ্ধতিগত কারণে, না এর অন্য কোনো কারণ রয়েছে? দুই. বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রের ভয় দেখানো হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আওয়ামী লীগকে কেন সমর্থন করবে, বিএনপিকে কেন করবে না? তাহলে কী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আওয়ামী লীগ জঙ্গিবিরোধী আর বিএনপি জঙ্গিবান্ধব? তিন. বাংলাদেশের নিরীহ একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে যদি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা যায়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকারের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কী? চার. পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, রামুর ঘটনায় একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর পাশাপাশি কয়েকজন রোহিঙ্গারও সম্পৃক্ততা ছিল। তবে কী আওয়ামী লীগ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা করেছে, নাকি অন্যরা পরে এসে সম্পৃক্ত হয়েছে? আওয়ামী লীগের লোকজনই কী ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ও রোহিঙ্গাদের গভীর রাতে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে এই দুর্গম এলাকায় নিয়ে এসেছিল? রামুর পাশাপাশি রামু থেকে শতাধিক মাইল দূরে পটিয়ার মন্দিরে যে আক্রমণ-ভাঙচুর হয়েছে সেটাও কী আওয়ামী লীগের ওই একই পরিকল্পনার অংশ ছিল?
প্রিয় পাঠক, চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস একবার পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে যাওয়ার সময় জঙ্গলের মধ্যে এক মহিলাকে কাঁদতে দেখে কান্নার কারণ জানতে চাইলে মহিলা বলেন, 'কয়েক বছর আগে আমার শ্বশুরকে জঙ্গলের বাঘ হত্যা করেছে। আমার স্বামীও গেছে বাঘের পেটে। কিছুক্ষণ আগে আমি বাঘের আক্রমণে আমার সন্তানের ছিন্নভিন্ন দেহ সমাধিস্থ করেছি।' এত ঘটনার পরও এ রকম বিপজ্জনক জায়গায় থাকার কারণ জানতে চান কনফুসিয়াস। ক্রন্দনরত মহিলা জবাব দেন, এখানে বাঘ আছে সত্য; কিন্তু অত্যাচারী শাসকের নিপীড়ন নেই। উত্তর শোনার পর কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, জেনে রাখো, অত্যাচারী শাসক হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ংকর। বিএনপির তদন্ত প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সত্যি সত্যিই যদি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমন মানবতাবিরোধী কাজ করে থাকে, তাহলে তারাও কী হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ংকর অত্যাচারী শাসক নয়?
বিএনপির কাছে যদি এ রকম প্রমাণ থাকে, তাহলে দ্বিতীয় মেয়াদ দূরে থাক আওয়ামী লীগের এই মেয়াদ পূর্ণ করার বৈধতা থাকবে কী? আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এমন পরিকল্পিত নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে এই মর্মে বিএনপির তদন্তদলের কাছে যদি সত্যি সত্যিই প্রমাণ থাকে, তাহলে কালবিলম্ব না করে অতিদ্রুত জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা উচিত নয় কি? আর আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে মর্মে বিএনপির তদন্ত রিপোর্টের বর্ণনা যদি সত্যি না হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, বিএনপি কী নিছক রাজনৈতিক দোষারোপের জন্য এমন রিপোর্ট তৈরি করেছে, নাকি কোনো কিছু আড়াল করার জন্য এমন অসত্য প্রতিবেদন তৈরি করেছে?
সরকারি দলের ভাষ্য অনুযায়ী সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিএনপি-জামায়াত মিলে পরিকল্পিতভাবে এমন বর্বর ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এর পেছনে উদ্দেশ্য হলো- মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করা ও সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সরকারের কাছে যদি এ রকম কোনো তথ্যপ্রমাণ থাকে তাও কালবিলম্ব না করে প্রকাশ করা উচিত। কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাবি, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারাধীন অপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য যদি বিএনপি এমন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে, তাহলে তারাও কি আর জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে? দেশ ও দেশের মানুষ কি তাদের হাতে নিরাপদ থাকতে পারে?
সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি যদি সত্যি সত্যিই বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়ও তা কি আওয়ামী লীগের কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করবে? তাহলে কী পারস্পরিক দোষারোপ আর বিশ্বাস অযোগ্য দুই তদন্ত কমিটির ডামাডোলের মধ্যে আমাদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কান্না, দুঃখ, বেদনা, হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে যাবে? ভুলে গেলে চলবে না এ ঘটনার প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে যদি বিচারের সম্মুখীন করা না হয়, যদি প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়, যদি নিরপরাধ কাউকে অপরাধী সাজিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে প্রকৃত অপরাধীরা উৎসাহী হবে ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য। ফলে আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। অস্তিত্ব বিপন্ন একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হতে আমাদের দুই নেত্রীর ভালো লাগবে কি? বিচার না হলে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী যে বিনিয়োগকারীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা শুরু করেছেন, এমন নিরাপত্তাহীন পরিবেশে তাঁরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন কি?
আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি সামান্য হলেও দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে থাকেন, তাহলে রামুর ঘটনা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি এ মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তদন্ত কমিটিতে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার গঠিত অন্যান্য সংসদীয় কমিটিতে বিএনপি না এলেও ভোটের রাজনীতির জন্য হলেও বিএনপি এ তদন্ত কমিটিতে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। এভাবে কমিটি গঠিত হলে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তকরণে সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণিত হবে। জনমনে আস্থার সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সরকারের দৃঢ়সংকল্পের বার্তা পৌঁছে যাবে। আমাদের বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের কষ্ট, বেদনা ও দীর্ঘশ্বাস লাঘবের জন্য কিছুটা হলেও অবলম্বন খুঁজে পাবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গায়ে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগানোর প্রচেষ্টা আরো একবার ভণ্ডুল হয়ে যাবে। পারস্পরিক দোষারোপ বন্ধ হবে। প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। আর এভাবেই আমরা রামুর ঘটনা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারব। আমাদের এগিয়ে যাওয়া চলতেই থাকবে। এর অন্যথা হলে রামুর ঘটনা আমাদের বারবার তাড়া করে বেড়াবে। আমাদের এগিয়ে যাওয়া পুরোপুরি থমকে না গেলেও বাধাগ্রস্ত হবে সন্দেহ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
zhossain@justice.com
« পূর্ববর্তী সংবাদ
No comments