খালেদা জিয়ার ভারত সফর-নতুন বাস্তবতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা by দেলোয়ার হোসেন
বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী দেশ। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ভারতের সরকার ও জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
গত ৪১ বছরে বাংলাদেশের কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ভারত সফর করেছেন। ভারতের তরফেও শীর্ষ পর্যায়ে সফর হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতৃত্বে থাকা অবস্থাতেও ভারত সফর করেছেন। খালেদা জিয়া এখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী। তার ভারত সফরেও তাই বিস্ময়ের কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ দিকে লে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দলটির সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিশেষ করে ভারত সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিলে এবারের সফর বিরল ঘটনা তো বটেই, ঐতিহাসিক হিসেবেও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
খালেদা জিয়া দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দায়িত্ব পালনে জনগণের ম্যান্ডেট পেতেই পারেন। একাধিকবার ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার জন্য কখন কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য করণীয় কী_ এসব বিষয়ে নিশ্চয়ই তার সম্যক ধারণা রয়েছে। ভারত কেবল আমাদের প্রতিবেশী নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে তার ভূমিকা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তারা কেবল এশিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখেন। একইভাবে আমরা চীনের কথাও বলতে পারি। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় নেই। কিন্তু সম্প্রতি তিনি চীন সফর করে এসেছেন। তারপর গেলেন ভারতে। তিনি ক্ষমতায় থাকুন আর না-ই থাকুন, দেশের একজন জনপ্রিয় প্রধান নেতা হিসেবে স্বীকৃত এবং তার দলের বিপুল অনুসারী রয়েছে। ভারত ও চীনের নেতৃত্ব এটা উপলব্ধি করেন। তার সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসার এটাই কারণ।
খালেদা জিয়ার এবারের ভারত সফর বহুল আলোচিত। তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করেছেন। তার সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের আলোচনার খবর গুরুত্ব সহকারে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। কেবল একজন বিরোধীদলীয় নেতার সৌজন্য সফর হিসেবে বিষয়টি দেখা হলে ভুল করা হবে। এ সফরের সময় তিনি এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দ যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন যে, এ সফরের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আমার মনে হয়, এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। ভারতের সরকার ও বিরোধী পক্ষও এ সফরকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং বলা চলে যে, তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কিত নীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণেও তার ছাপ পড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের দিক থেকে বলা হচ্ছিল যে, তাদের বাংলাদেশ নীতিনির্ধারিত হয় এ দেশের জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের কথা বিবেচনায় রেখেই। তারা বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে নয়, বরং সব দল ও মতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ও উন্নত করে চলতে ইচ্ছুক। প্রণব মুখার্জি অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরকালে প্রকাশ্যেই এ বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরকালে কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদকে সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা যায় যে, এসব পদক্ষেপে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। এভাবেও বলতে পারি যে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে এবং সে অনুযায়ী কর্মকৌশল নির্ধারণ করছে।
খালেদা জিয়ার এবারের সফর আকস্মিক ছিল না। বরং তিনি এবং তার দল এ জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন কয়েক মাস ধরেই। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিএনপি যে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আনছে সেটা তুলে ধরেছেন। তিনি ভালো করেই জানেন যে, এ সফরে তার নিজের বা দলের হারাবার কিছু নেই, বরং তা থেকে লাভবান হওয়া সম্ভব। আর এটা প্রকৃতই যদি ঘটে তা হলে শুধু দল নয়, দেশেরও লাভ। আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদবোধ করছে বিএনপি_ এ বিষয়টিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাতে পারি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যে রাষ্ট্রটি সফর করেন তা ছিল চীন, ভারত নয়। অথচ আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসসহ আরও কয়েকটি ভারতীয় দলের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের সহযোগিতার কারণে শেখ হাসিনা প্রথমে দিলি্ল গেলে সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হতো। অন্যদিকে তিনি প্রথম গেলেন যে দেশটিতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময়ে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল এবং স্বীকৃতি প্রদানে যথেষ্ট বিলম্ব করেছিল। শেখ হাসিনা বিশ্বের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছিলেন, যেমন এখন নিচ্ছেন খালেদা জিয়া। আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরে নতুন ধরনের বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে যা কোনো বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষে অস্বীকার করা কঠিন। ভারত ও চীনের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে এবং তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক উন্নত হলে তাদের ক্ষতি নেই, এটা বুঝতে পারছে চীন। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করলেও চীনের আপত্তি নেই, সে বিষয়টি স্পষ্ট। অন্যদিকে, পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে সক্রিয়। তাছাড়া ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করা সম্ভব নয়, বাংলাদেশের একটি প্রধান দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্ব সেটাও নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। নিকট ভবিষ্যতের দৃষ্টান্ত টেনে বলতে পারি যে, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারত ফ্যাক্টর খুব একটা কাজ দেয়নি। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির মতো একটি দলের পক্ষে ভারত-বিরোধিতাকে মূলধন করে অগ্রসর হওয়া কঠিন_ সেটাই কিন্তু বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভারতের দিক থেকেও সক্রিয়তা ছিল এবং বলা যায় যে, তারাই প্রথমে হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো দল নয়, বরং জনগণকেই গুরুত্ব দেয়_ সে বার্তা তারা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছে। তারা আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছে এবং এবারের হাই প্রোফাইল সফরকে বলতে পারি তারই সফল পরিণতি। তারা খালেদা জিয়াকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং তিনি সেটা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। এ সুযোগে তারা ভারতের কাছে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন এবং অপর পক্ষ কী চায় সেটাও জানতে পারছেন সরাসরি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জন্যও এ সফর তাই ইতিবাচক ঘটনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, প্রধান ও অপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্ধ ভারত-বিরোধিতা এবং ভারত-তোষণ, উভয় ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে প্রায়শই সমস্যা হয়। দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু অনেক এবং কোনো কোনোটি তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা, তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন, ট্রানজিট, টিপাইমুখ বাঁধ, স্থল সীমান্ত নিয়ে বিরোধ, সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা_ এসব বিষয়ে প্রধান দলগুলোর অভিন্ন অবস্থান কাঙ্ক্ষিত থাকলেও বাস্তবে তা কমই পরিলক্ষিত হয়। ভারতের দিক থেকে বিশেষভাবে জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। খালেদা জিয়ার এবারের ভারত সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি এ সময়ে যে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন তার ফলে কিন্তু শেখ হাসিনার জন্যও এক নতুন সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। বলা যায়, ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক প্রশ্নে এখন বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলের অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। ভারতের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে সরকার সেটা কাজে লাগাতে পারে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, ২০১০ সালের প্রথম দিকে শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার যুগ সৃষ্টি হয়েছে বলে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল সে গতি কিন্তু ধরে রাখা যায়নি। তিস্তা ইস্যু ঝুলে গেছে। ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু ভারত বিষয়টিকে দেখছে একেবারেই ভিন্নভাবে। বাংলাদেশের জন্য ভারতের তরফে বড় ধরনের অর্থনৈতিক অঙ্গীকারও নেই। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার সফরের পর বাংলাদেশ সরকার বলতেই পারে যে, ভারত ইস্যুতে তাদের অবস্থান যথার্থ।
আমরা এটাও জানি যে, অনেক ইস্যুতেই বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর অবস্থান সাংঘর্ষিক। তাতে পাল্টাপাল্টি যতটা থাকে, বিচক্ষণতা ততটাই অনুপস্থিত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি যেসব অঙ্গীকার করেছে সেটা রাখা হবে কিনা, সে প্রশ্ন রয়েছে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসা। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, নতুন সরকার তারা গঠন করতে না পারলেও আরও অনেক বছর তারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিরাজ করবে। ভারত ইস্যুতে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার প্রভাব জনগণের ওপর পড়বেই। এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো কী অবস্থান গ্রহণ করে সেটা জনগণ বিবেচনায় নেবে। তারা সরকারের অনুরূপ অবস্থান নিলে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতেও সুবিধা। অন্যদিকে সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত তা কার্যকর করায় ঝুঁকি থেকে যায় যথেষ্ট। ভারতের নেতৃত্ব বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই এর অন্তর্নিহিত বার্তা উপলব্ধি করতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী নিজেদের নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বই দেশ পরিচালনা করে থাকে। ভারত ইস্যুতে তাদের দূরদর্শিতা প্রদর্শনের সুযোগ এসেছে এবং সেটা গ্রহণ করতে দ্বিধা করা উচিত নয়। অন্যথায় কেবল দেশের নয়, দলেরও ক্ষতি হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খালেদা জিয়া দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দায়িত্ব পালনে জনগণের ম্যান্ডেট পেতেই পারেন। একাধিকবার ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার জন্য কখন কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য করণীয় কী_ এসব বিষয়ে নিশ্চয়ই তার সম্যক ধারণা রয়েছে। ভারত কেবল আমাদের প্রতিবেশী নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে তার ভূমিকা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তারা কেবল এশিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখেন। একইভাবে আমরা চীনের কথাও বলতে পারি। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় নেই। কিন্তু সম্প্রতি তিনি চীন সফর করে এসেছেন। তারপর গেলেন ভারতে। তিনি ক্ষমতায় থাকুন আর না-ই থাকুন, দেশের একজন জনপ্রিয় প্রধান নেতা হিসেবে স্বীকৃত এবং তার দলের বিপুল অনুসারী রয়েছে। ভারত ও চীনের নেতৃত্ব এটা উপলব্ধি করেন। তার সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসার এটাই কারণ।
খালেদা জিয়ার এবারের ভারত সফর বহুল আলোচিত। তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করেছেন। তার সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের আলোচনার খবর গুরুত্ব সহকারে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। কেবল একজন বিরোধীদলীয় নেতার সৌজন্য সফর হিসেবে বিষয়টি দেখা হলে ভুল করা হবে। এ সফরের সময় তিনি এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দ যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন যে, এ সফরের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আমার মনে হয়, এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। ভারতের সরকার ও বিরোধী পক্ষও এ সফরকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং বলা চলে যে, তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কিত নীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণেও তার ছাপ পড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের দিক থেকে বলা হচ্ছিল যে, তাদের বাংলাদেশ নীতিনির্ধারিত হয় এ দেশের জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের কথা বিবেচনায় রেখেই। তারা বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে নয়, বরং সব দল ও মতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ও উন্নত করে চলতে ইচ্ছুক। প্রণব মুখার্জি অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরকালে প্রকাশ্যেই এ বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরকালে কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদকে সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা যায় যে, এসব পদক্ষেপে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। এভাবেও বলতে পারি যে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে এবং সে অনুযায়ী কর্মকৌশল নির্ধারণ করছে।
খালেদা জিয়ার এবারের সফর আকস্মিক ছিল না। বরং তিনি এবং তার দল এ জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন কয়েক মাস ধরেই। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিএনপি যে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আনছে সেটা তুলে ধরেছেন। তিনি ভালো করেই জানেন যে, এ সফরে তার নিজের বা দলের হারাবার কিছু নেই, বরং তা থেকে লাভবান হওয়া সম্ভব। আর এটা প্রকৃতই যদি ঘটে তা হলে শুধু দল নয়, দেশেরও লাভ। আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদবোধ করছে বিএনপি_ এ বিষয়টিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাতে পারি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যে রাষ্ট্রটি সফর করেন তা ছিল চীন, ভারত নয়। অথচ আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসসহ আরও কয়েকটি ভারতীয় দলের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের সহযোগিতার কারণে শেখ হাসিনা প্রথমে দিলি্ল গেলে সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হতো। অন্যদিকে তিনি প্রথম গেলেন যে দেশটিতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময়ে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল এবং স্বীকৃতি প্রদানে যথেষ্ট বিলম্ব করেছিল। শেখ হাসিনা বিশ্বের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছিলেন, যেমন এখন নিচ্ছেন খালেদা জিয়া। আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরে নতুন ধরনের বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে যা কোনো বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষে অস্বীকার করা কঠিন। ভারত ও চীনের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে এবং তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক উন্নত হলে তাদের ক্ষতি নেই, এটা বুঝতে পারছে চীন। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করলেও চীনের আপত্তি নেই, সে বিষয়টি স্পষ্ট। অন্যদিকে, পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে সক্রিয়। তাছাড়া ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করা সম্ভব নয়, বাংলাদেশের একটি প্রধান দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্ব সেটাও নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। নিকট ভবিষ্যতের দৃষ্টান্ত টেনে বলতে পারি যে, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারত ফ্যাক্টর খুব একটা কাজ দেয়নি। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির মতো একটি দলের পক্ষে ভারত-বিরোধিতাকে মূলধন করে অগ্রসর হওয়া কঠিন_ সেটাই কিন্তু বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভারতের দিক থেকেও সক্রিয়তা ছিল এবং বলা যায় যে, তারাই প্রথমে হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো দল নয়, বরং জনগণকেই গুরুত্ব দেয়_ সে বার্তা তারা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছে। তারা আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছে এবং এবারের হাই প্রোফাইল সফরকে বলতে পারি তারই সফল পরিণতি। তারা খালেদা জিয়াকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং তিনি সেটা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। এ সুযোগে তারা ভারতের কাছে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন এবং অপর পক্ষ কী চায় সেটাও জানতে পারছেন সরাসরি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জন্যও এ সফর তাই ইতিবাচক ঘটনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, প্রধান ও অপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্ধ ভারত-বিরোধিতা এবং ভারত-তোষণ, উভয় ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে প্রায়শই সমস্যা হয়। দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু অনেক এবং কোনো কোনোটি তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা, তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন, ট্রানজিট, টিপাইমুখ বাঁধ, স্থল সীমান্ত নিয়ে বিরোধ, সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা_ এসব বিষয়ে প্রধান দলগুলোর অভিন্ন অবস্থান কাঙ্ক্ষিত থাকলেও বাস্তবে তা কমই পরিলক্ষিত হয়। ভারতের দিক থেকে বিশেষভাবে জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। খালেদা জিয়ার এবারের ভারত সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি এ সময়ে যে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন তার ফলে কিন্তু শেখ হাসিনার জন্যও এক নতুন সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। বলা যায়, ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক প্রশ্নে এখন বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলের অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। ভারতের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে সরকার সেটা কাজে লাগাতে পারে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, ২০১০ সালের প্রথম দিকে শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার যুগ সৃষ্টি হয়েছে বলে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল সে গতি কিন্তু ধরে রাখা যায়নি। তিস্তা ইস্যু ঝুলে গেছে। ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু ভারত বিষয়টিকে দেখছে একেবারেই ভিন্নভাবে। বাংলাদেশের জন্য ভারতের তরফে বড় ধরনের অর্থনৈতিক অঙ্গীকারও নেই। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার সফরের পর বাংলাদেশ সরকার বলতেই পারে যে, ভারত ইস্যুতে তাদের অবস্থান যথার্থ।
আমরা এটাও জানি যে, অনেক ইস্যুতেই বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর অবস্থান সাংঘর্ষিক। তাতে পাল্টাপাল্টি যতটা থাকে, বিচক্ষণতা ততটাই অনুপস্থিত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি যেসব অঙ্গীকার করেছে সেটা রাখা হবে কিনা, সে প্রশ্ন রয়েছে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসা। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, নতুন সরকার তারা গঠন করতে না পারলেও আরও অনেক বছর তারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিরাজ করবে। ভারত ইস্যুতে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার প্রভাব জনগণের ওপর পড়বেই। এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো কী অবস্থান গ্রহণ করে সেটা জনগণ বিবেচনায় নেবে। তারা সরকারের অনুরূপ অবস্থান নিলে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতেও সুবিধা। অন্যদিকে সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত তা কার্যকর করায় ঝুঁকি থেকে যায় যথেষ্ট। ভারতের নেতৃত্ব বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই এর অন্তর্নিহিত বার্তা উপলব্ধি করতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী নিজেদের নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বই দেশ পরিচালনা করে থাকে। ভারত ইস্যুতে তাদের দূরদর্শিতা প্রদর্শনের সুযোগ এসেছে এবং সেটা গ্রহণ করতে দ্বিধা করা উচিত নয়। অন্যথায় কেবল দেশের নয়, দলেরও ক্ষতি হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments