ভিন্নমত-কিছু কম্পানি শেয়ার বেচার নামে জনগণের টাকা চুরি করছে by আবু আহমেদ
সৎ উদ্দেশ্যে শেয়ার বেচছে আমাদের দেশের খুব কম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা কম্পানি। অধিকাংশ কম্পানি জনগণকে দুইবার প্রতারিত করে। এক. প্রাথমিক শেয়ার বা আইপিও বেচার ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে আইপিও বেচে তারা অতিমূল্যায়ন করে। অতিমূল্যায়ন করার হাতিয়ার হলো দুটো।
এক. তারা আইপিও বেচার আগে সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করে কম্পানির সম্পদমূল্য অনেক বাড়িয়ে দেখায় এবং ওই অতিমূল্যায়িত সম্পদের বিপরীতে স্পন্সর বা উদ্যোক্তারা ইচ্ছামতো বোনাস শেয়ার গ্রহণ করে। ওই প্রক্রিয়ায় কম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল বা পরিশোধিত মূলধন দেড় থেকে দুই গুণ করার পর বাজারে আসে। বাজারে আসার পর আইপিও বিক্রির মাধ্যমে কম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল আরো এক দফা বৃদ্ধি করা হয়। এসব করা হয় আনুপাতিক ব্যবসা বৃদ্ধি ছাড়া। ফলে আইপিও ছাড়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অসততার সংস্কৃতি এসে যায় এবং এ ধরনের অতিমূল্যায়িত কম্পানির শেয়ার কিনে জনগণ শেষ পর্যন্ত লোকসানের সম্মুখীন হয়। প্রথম দিকে আইপিওগুলোর বাজারমূল্য ভালো থাকতে পারে। কারণ সেকেন্ডারি মার্কেটে আইপিওগুলোর ভালো মূল্য থাকার জন্য কম্পানিগুলো একদল জুয়াড়ি ভাড়া করে। ওরাই আইপিওগুলো কিনে কম্পানি ফান্ডামেন্টালস অনেক ওপরে নিয়ে যায় এবং তখন অনেকটা সবাই খুশি থাকে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা প্রতিফলিত হতে থাকে কম্পানির স্পন্সররা যখন তাদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে ফেলে। আর তখনই এসব কম্পানি Sick বা রুগ্ন হতে শুরু করে। কম্পানির ব্যবস্থাপনা শেয়ারহোল্ডারদের কাছে দায়ের ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে যায়। এসব ধুরন্ধর কম্পানি আবার সুযোগ বুঝে অতি প্রিমিয়ামে রাইট শেয়ার বিক্রিরও প্রস্তাব দেয়। অতিসাম্প্রতিক এক ঘটনা, তা হলো তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি কম্পানি স্পন্সরের জন্য ধরাবাঁধা ৩০ শতাংশ শেয়ার নিজ হাতে না রেখে আবার ওর প্রিমিয়ামে রাইট শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে অনেক দূরই এগিয়ে গিয়েছিল। দেরিতে হলেও রেগুলেটর এসইসি বিষয়টি ধরে ফেলে এবং সেই রাইট শেয়ার বেচার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। যাদের উদ্দেশ্যই হলো শেয়ার বেচা, তারা ৩০ শতাংশ শেয়ার নিজ হাতে রাখবে কেন? তারা তো পারলে ফ্যাক্টরিতে পণ্য উৎপাদন না করে শেয়ার উৎপাদন করত! প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ধুরন্ধর কম্পানিকে এসইসি শেয়ার বেচতে দেয় কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে এটাই শুধু বলব, ঋণ কুঋণে পরিণত হবে জেনেও ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট কেন ধুরন্ধর গ্রাহককে ঋণ দিচ্ছে? তা হলে অন্য প্রশ্ন, পাবলিক তথা জনগণ ওই সব ধুরন্ধর কম্পানির শেয়ার কেনে কেন? পাবলিক তো না বুঝেই অনেক কিছু করে। তারা তো ডেসটিনিকেও অনেক টাকা দিয়েছে। পাবলিকের কি সেই জ্ঞান আছে যে কম্পানি কোথায়-কিভাবে প্রতারণা করছে? তাই পাবলিক কেনে। আর পাবলিককে কেনানোর জন্য তো জুয়াড়িরা আছেই! তারাও লোভ দ্বারা তাড়িত! পাবলিকের লোভ হলো ঠকবাজ কম্পানিগুলোর অর্থ বানানোর মুখ্য উপাদান। পাবলিক থেকে গ্রিড বা লোভ নামের এই উপাদানও নিরুৎসাহী হবে না। ঠকবাজদের খেলাও বন্ধ হবে না। জনগণকে ঠকানোর জন্য প্রক্রিয়া হলো প্রিমিয়াম আইপিও এবং রাইট অফার বেচা। হঠাৎ দেখা গেল EPS এবং NAV বেড়ে গেল। পেশ করা হলো অতি সুন্দরভাবে রেগুলেটরের সামনে ১০ টাকার শেয়ারকে ৬০ টাকা বিক্রি করার জন্য। রেগুলেটর দেখে কাগজপত্র ঠিক আছে কি না। রেগুলেটর Due প্রয়োগ করে প্রিমিয়ামটা একটু কমিয়ে ৪০ টাকা করে দিল। কম্পানি তো মহাখুশি! তারা জানে তাদের শেয়ারের মূল্য মাত্র ১০ টাকা। তারা তো বাকি ৩০ টাকা ফাও পাচ্ছে! এরপর কয়েক দিন এই শেয়ার ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে হাতবদল করল। তারপর, তারপর দুই-আড়াই বছর পর ওদের EPS কোথায় যেন উবে গেল! জনগণ শুধুই প্রতারিত হলো। এসব কাজে ধুরন্ধর কম্পানিরা কাজে লাগায় অন্য ধুরন্ধর অডিট ফার্মকে, যারা অর্থের বিনিময়ে সব কিছুরই সনদ দিয়ে দেয়। অন্যদিকে অতি দক্ষ ও মিথ্যা বলতে সদা প্রস্তুত ইস্যু ম্যানেজার যে অতি সুন্দরভাবে ৩০০-৪০০ পৃষ্ঠার কাগজ লিখে প্রস্তাব পেশ করে। আর যাঁরা ভাবেন রেগুলেটর এসএসি তো আছে তাদের পক্ষ থেকে আইপিও এবং অন্যান্য শেয়ার বেচাগুলোকে যাচাই-বাছাই করার জন্য তাদের সেই আশা দুরাশা মাত্র। কারণ আমার জানামতে এসইসি শুধু কাগজপত্র পরীক্ষা করে। কিন্তু কাগজপত্রে যে একটা অশুদ্ধ বিষয়কেও শুদ্ধ করে পেশ করা যায়, তা দেখার ব্যাপারে এসইসির আগ্রহ অতি কম। অতীতে এসইসি তো অনেক আইপিওকে অনুমতি দিয়েছে, যেগুলো বাজার থেকে এখন হাওয়া হয়ে গেছে। এসইসি কি আপনার পক্ষে সঠিক কাজগুলো করেছে? অতিসম্প্রতি একটি রাইট অফারের স্পন্সররা নিজেদের টাকা কম্পানি হিসাবে জমা না দিয়ে শুধু জনগণের কাছ থেকে উচ্চ প্রিমিয়ামে টাকা নিয়েছে। এটা কেমন করে হলো?
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments