ঢিল ও পাটকেলের কথা by ইমরুল কায়েস

আমাদের লোককথায় আছে, ঢিলটি মারলে পাটকেল খেতে হয়। ইংরেজিতে বলা হয়, টিট ফর ট্যাট। অনেক আগে ঢিলটি মেরেছিলেন ভিএস নাইপল। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপলের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সালমান রুশদি প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি জানি না আপনি কার কথা বলছেন,


তার সম্পর্কে আমি একদমই কিছু জানি না।' নাইপলের জন্ম ১৯৩২ সালে আর রুশদির ১৯৪৭-এ। লেখক হিসেবে দু'জনেই খ্যাতিমান। ফলে পরস্পরের সম্পর্কে না জানার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। আরও মজার ব্যাপার হলো, দু'জনেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে পরিচিত। নাইপলের পূর্বপুরুষ ভারত থেকে ত্রিনিদাদে অভিবাসী হয়েছিল। আর রুশদি তো ভারতীয় বংশোদ্ভূত বটেই। কাশ্মীরি মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। নাইপলের এই অবজ্ঞাসূচক উক্তির জন্য রুশদির মনে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ ছিল। জ্বলাপোড়াও যে ছিল না তা নয়। কিন্তু তিনি সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে নাইপলের ঢিলের বদলে একটি পাটকেল ছুড়েছেন। বইটির নাম জোসেফ অ্যান্টন : আ মেমোয়ার। বইটি আত্মজৈবনিক। বিতর্কিত বই 'স্যাটানিক ভার্সেস' লেখার পর রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়। আর তখন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে। এমনকি নিজের নামে লিখতেও পারতেন না, লুকিয়ে থাকার জায়গা প্রকাশিত হয়ে পড়ে সে ভয়ে। এ সময় তিনি জোসেফ অ্যান্টন ছদ্মনামে লিখতেন। নামটি তিনি নিয়েছিলেন দুই প্রিয় লেখক জোসেফ কনরাড ও আন্তন চেকভের নাম থেকে। আর সেই পালিয়ে বেড়ানো জীবনের কথাই বইটিতে তিনি লিখেছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বইয়ে রবার্ট গোটলিয়েবের সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন। গোটলিয়েব তখন আলফ্রেড এ নফ প্রকাশনীর প্রধান ছিলেন। আর এ প্রকাশনী থেকেই বেরিয়েছিল মিডনাইটস চিলড্রেনের যুক্তরাষ্ট্র সংস্করণ। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর গোটলিয়েব বলেছিলেন, রুশদির সঙ্গে দেখা করার জন্য তার তাড়া নেই। গোটলিয়েবের ভাষায়, 'আমি আপনাকে পছন্দ করি, আমি ভেবেছি আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব না।'
রুশদি বলেন, 'কেন? আপনি আমাকে পছন্দ করেন না? আপনি আমার বই প্রকাশ করেছেন।' 'আপনার বইয়ের জন্য নয়, আমি সম্প্রতি মহান এক লেখকের মহৎ একটি সৃষ্টি পড়েছি। আমার মনে হয় কি জানেন, আমি বোধহয় মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এমন লেখককে কোনোদিনই পছন্দ করতে পারব না।' রুশদি বলেন, 'কী সেই মহৎ সৃষ্টি আর কে সেই মহান লেখক? গোটলিয়েব বলেন, 'বইটার নাম অ্যামাং দ্য বিলিভার্স আর লেখকের নাম ভিএস নাইপল।' রুশদি বলেন, 'তাই? বইটি পড়তে হবে তো।' রুশদির অবস্থান থেকে অ্যামাং দ্য বিলিভার্সের কথা না জানার কিছু নেই। কিন্তু যে ভঙ্গিতে নাইপল সম্পর্কে বলেছেন তাতে মনে হয় ঢিলের জবাবে পাটকেলটিই তিনি ছুড়তে চেয়েছেন। এখানে বলে রাখা দরকার, ভাবনা-চিন্তার দিক থেকে রুশদি ও নাইপলের ভীষণ মিল আছে। দু'জনেই মুসলিমদের কঠোর সমালোচক। অনেকের মতে মুসলিমবিদ্বেষী। অ্যামাং দ্য বিলিভার্সের বিষয় মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার উত্থান। ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ঘুরে তিনি এ বই লিখেছেন। শুধু এটাই নয়, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত অ্যামাং দ্য বিলিভার্সের পর তিনি ১৯৯৮ সালে একই বিষয়ে তিনি লিখেছেন, বিয়ন্ড বিলিফ। বই দুটি মুসলিমবিদ্বেষের জন্য সমালোচিত হয়েছিল। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ বিয়ন্ড বিলিফকে আখ্যায়িত করেছিলেন একজন লেখকের মতাদর্শিক বিপর্যয় হিসেবে।
তবে নাইপলকে ফতোয়ার মুখে পড়তে হয়নি। ফতোয়ার মুখে পড়তে হয়েছে আহমেদ সালমান রুশদিকে। ধর্ম অবমাননার দায়ে তিনি যখন নাম-পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখনও তাকে ধর্মের খোটা খেতে হচ্ছে। তারই প্রকাশক তাকে মুসলিম বলেই চিহ্নিত করছেন। তিনি নাইপলকে জবাবটা না দিলে এই তথ্যটা অজানাই থেকে যেত।
 

No comments

Powered by Blogger.