খালি কলসি বাজে বেশি! ঈদ অডিও বাজার by মাহমুদ মানজুর
এই ঈদেও ঘুরে ফিরে গ্রামগঞ্জে টালিগঞ্জের জিৎ গাঙ্গুলী। লে পাগলু, পাগলু, ইটস ওনলি পেয়ার, দুই পৃথিবী, বলো না তুমি আমার, বাতাসে গুন গুন, ও ইয়ারা বে, কোকাকোলা, মনটা করে উড়ু উড়ু, খোকা বাবুর মতো এমন অনেক নতুন-পুরাতন গান দিয়ে ওপাড়ের (কলকাতা) দাদা বাবু এখন যত্রতত্র ছড়ি ঘোরাচ্ছেন এপাড় (বাংলাদেশে)। ঠিক এমন চিত্রের বিপরীতে এপাড়ের অন্যতম জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক-শিল্পী আরফিন রুমিও যেন কোন অংশে কম যান না।
একাই যেন ফাইট করছেন জিৎ জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে। না, গানের বিপরীতে গান দিয়ে নয়! জিৎ গাঙ্গুলির একগাদা সুপার হিট গানের বিপরীতে সুফিবাদী রুমি ফাইট করছেন বিয়ে কেন্দ্রিক নাটকের মঞ্চে দুই স্ত্রীকে বগলদাবা করে ছবি তুলে! সদ্যসমাপ্ত ঈদ কেন্দ্রিক গানের বাজারের মূল চিত্রনাট্য এটুকুই। এর বাইরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা কিংবা সফলতা নেই, যেটা হলফ করে বলা যায়। তবে জিৎ গাঙ্গুলি ভার্সেস আরফিন রুমির এই চিত্রনাট্যের বিভিন্ন বাঁকে আরও বেশ ক’জন শক্ত কুশীলব রয়েছেন। যাদের ফেসভ্যালু এবং আওয়াজ ছিল গ্রাম-বাংলার প্রচলিত প্রবাদের মতো। যেমন ‘খালি কলসি বাজে বেশি’ কিংবা ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। আর এ তালিকায় চলে আসে এলআরবি’র দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অ্যালবাম ‘যুদ্ধ’, অভাবের বাজারে ১০ লাখ টাকা আওয়াজে তৌসিফের ‘আমন্ত্রণ’, পুসান চলচ্চিত্র উৎসব মাত করা চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন’-এর অডিও, হৃদয় খানের ‘হৃদয় মিক্স থ্রি’, ওয়ারফেইজের ‘সত্য’, মেগা ব্যান্ড মিশ্র অ্যালবাম ‘হাতিয়ার’, সমূহ সম্ভাবনাময়ী খুদে তারকা নাওমীর প্রথম একক ‘নাওমী’ প্রভৃতি।
কোরবানির ঈদে অডিও বাজার বরাবরই থাকে সাদামাটা আয়োজনে। সে সঙ্গে রয়েছে অডিও বাজারের চলমান অব্যবস্থাপনা। তবুও এই ঈদে প্রকাশ পেয়েছিল উপরোল্লিখত বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অ্যালবাম। এর সঙ্গে ‘পদ্মপাতার জল’ (!) বিভাগে প্রকাশ পেয়েছে আরও প্রায় অর্ধশতাধিক অডিও সিডি। অথচ সব মিলিয়ে একটি অ্যালবামের একটি গানও গেল প্রায় ২০ দিনের অডিও বাজারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সেই অর্থে। যেমনটা নিকট অতীতে কোনমতে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিল ন্যান্সির ‘ঝরা পাতা’, হাবিবের ‘অন্তহীন’, ‘তুমি যে আমার ঠিকানা’, প্রিন্স মাহমুদের ‘ভুবন ডাঙ্গার হাসি’ গানগুলো। তবে এই ঈদে এর মধ্যেও ‘মন্দের ভালো’ বিভাগের হয়ে টুকটাক বাজতে শোনা যাচ্ছে ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রের দুটি গান। এর একটি কবির বকুলের লেখা আইয়ুব বাচ্চুর সুর-সংগীতে, ন্যান্সি-লুৎফর হাসানের কণ্ঠে ‘ভাবনার রেলগাড়ি’ গানটি। অন্যটি রবিউল ইসলাম জীবনের কথায় একই সংগীত পরিচালকের ‘গোলমাল’। গান দুটি জনপ্রিয়তার দিকে কচ্ছপ গতিতে এগুচ্ছে। অনেকটা একই পূর্বাভাস মিলছে সম্ভাবনাময়ী নাওমীর ‘নাওমী’ অ্যালবামের ‘পথ ভোলা’ শীর্ষক রিদমিক গানটি। ফয়সাল রাব্বিকীনের কথায় এ গানটির সুর সংগীত করেছেন মাহমুদ সানী। ঈদের বাদবাকি অ্যালবামের গানগুলো তলিয়ে আছে জিৎ-রুমির কুচকাওয়াজের মধ্যে! এমনটাই বলছেন সংগীত সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য, কথাগুলো বলা হচ্ছে জনপ্রিয়তার নিরিখে, শ্রোতা চাহিদা মতে, বাজার জরিপের ভিত্তিতে। কোনভাবেই গানের মান বিচারে নয়। যেমন, ঈদের আগের দিন চাঁদপুরের মতলব বাজারে অডিও-ভিডিও দোকানি সঞ্জীবের সাদামাটা ভাষ্য এমন ছিল, আসিফের পর আর কোন শিল্পীর অ্যালবাম বিক্রি করে আমরা দোকান ভাড়া জোগাতে পারিনি। আমরা এখন টিকে আছি ভারতীয় বাংলা ছবি আর এসব ছবির টপটেন বিক্রি করে। যেমন এই ঈদে আমি নতুন কোন অ্যালবাম দোকানে তুলিনি। এদিকে বসুন্ধরা সিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অডিও-ভিডিও দোকানির ভাষ্য এমন, এই ঈদে আমরা সব অ্যালবামই দোকানে তুলেছি। এর মধ্যে কিছু বিক্রিও করেছি। যার বেশিরভাগই মনে হলো শিল্পীর আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুরা কিনেছেন! তবে আসল সত্য হলো আমরা মূলত বেঁচে আছি ভিডিও গেমস, কার্টুন আর হিন্দি-কলকাতার ছবি আর ছবির গান বিক্রি করে। এদিকে বেশ ক’বছর হলো দেশের রাজকীয় অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক বন্ধ করেছে প্রকাশনা। সেই ধারাবাহিকতায় এই ঈদে দেশের অন্যতম তিনটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে মনে করেন অডিও সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে রয়েছে সংগীতা, জি-সিরিজ এবং লেজারভিশন। সদ্য সমাপ্ত ঈদ আয়োজনে এই নামকরা ব্যানারগুলোতে ছিল না উল্লেখযোগ্য অ্যালবাম। বাকি থাকলো নতুন দুই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ডেডলাইন মিউজিক এবং সিডি চয়েজ। এই দুটি ব্যানার থেকে গেল ঈদে প্রায় সব বড়মাপের অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। তাতে কি? এরই মধ্যে ডেডলাইনের পরিচিতি ঘটেছে বাংলালিংক প্রযোজিত অ্যালবামগুলোর পরিবেশক হিসেবে। অন্যদিকে তরুণ শিল্পীদের পক্ষ থেকে পাহাড়সম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সিডি চয়েসের বিরুদ্ধে। আর এসব মিলিয়ে উৎসব কেন্দ্রিক গানের বাজার ক্রমশ চমকহীন হয়ে পড়ছে। জমছে না গান, মরে যাচ্ছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। শঙ্কার বিষয় এখানেই।
No comments